জ্বলদর্চি

ভুল এবং ভুল বোঝাবুঝি /তড়িৎ ভট্টাচার্য

ভুল এবং ভুল বোঝাবুঝি 

তড়িৎ ভট্টাচার্য 

আমাদের জীবনটাই ভুলে ভরা। এই যে বিরাট বিশ্বলোক এখানে কত কিছু আছে, সবই যে আমাদের জানা তা নয় কিন্তু যে জিনিসটার প্রভাব আমাদের ওপর সবচেয়ে বেশি তা হচ্ছে ভুল। একটা গান আছে না – -“এই জীবনের খাতায় পাতায় যা লেখা তা সবই ভুল।” তাহলে এই ভুলের পথ বেয়েই আমরা আমাদের সুখ-দুঃখ, ব্যথা বেদনার যে দিনগুলো কাটাই বা প্রেম-প্রীতি-ভালবাসার সম্পর্ক গড়ে তুলি তা সবই ভুল। তা হলোটা কি? আমরা কি পেলাম? এই তাসের প্রাসাদে ভুলের খেলাঘরে আমরা তো বেশ সময় কাটাচ্ছি। আসলে তা নয়। ভুল একটা এমন বিষয় যা অনবরত গড়ছে অনবরত ভাঙছে। জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পথে বিশ্বাস এর ওপর ভিত্তি করে গড়ে তুলছে সম্পর্ক আবার পরে সেটাই ভুল প্রমাণিত হচ্ছে নিজের কার্যকারণের অবশেষ হিসেবে। তাই এ এমন এক জিনিস যা আমাদের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন “আমি জেনে শুনে বিষ করেছি। পান।” অর্থাৎ ভুল করেছি। আমরা জেনেও ভুল করছি আবার না জেনেও ভুল করছি। যদিও দুটো পরবর্তী ভাব এক রকম নয়। আমরা মানুষ চিনতে ভুল করি। সংসার চিনতে ভুল করি, যে কাজ করবো বলে শুরু করছি সেটাও ভুল করি। তাই মায়ায় ভরা, ভুলে ভরা সংসার আমাদের কাছে এক কুহেলিকার মতন। যাই হোক বৃহত্তর চিত্রপটে ভুলের ছবি আঁকতে গিয়ে অনেক গম্ভীর কথা বলা হয়ে গেল। এখন আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে কেমন সব অদ্ভুত ভুল আমরা করি তাই একটু বলা যাক।

  জ্যাঠামশাই হৈ হৈ করে শুরু করে দিয়েছেন তার চশমাটা কোথায় বলে। সবাই তটস্থ। এদিক ওদিক খোঁজা হচ্ছে কিন্তু কোথায় চশমাটা পাওয়া যাচ্ছে না। তারপর নাতি এসে দাদুর মাথার ওপর থেকে চশমাটা নামিয়ে দিতে দাদুর মুখে হাসি। নিজেই বলছেন, কি রকম ভুল করে সবাইকে ব্যস্ত করলাম। এরকম ভুল করে অনেকেই চলেছেন। কিন্তু সুকুমার রায়ের গোঁফ চুরির কাহিনী কিন্তু অন্য কথা বলে ভুলের চূড়ান্ত নিদর্শন। অধ্যাপক খাতা দেখছেন মাঝে মাঝে দোয়াতে কলম ডুবিয়ে নিচ্ছেন। খেয়ালই নেই পাশেই রাখা চায়ের কাপে দুবার কলম ডুবিয়েছেন। লিখতে গিয়ে দেখছেন লেখা পড়ছে না। তারপর খেয়াল হলো কি করেছেন। নিজের মনে মনে বলছেন, ভুল করে ভাগ্যিস চা-টা খাইনি। তাহলেই জোড়া ভুল হয়ে যেত। দাঁত তোলার ঘটনা তো আমরা জানি ভুল দাত তোলা হয়েছিল। কিন্তু চোখ? এখন তো যে চোখটা অপারেশন হবে সেদিকের কপালে স্টীকার লাগিয়ে দেওয়া হয়। এছাড়া বাঁ-ডান লেখা হয়। কিন্তু ভুল করে অন্য চোখের ছানি কাটা হয়েছে ডাক্তার বুঝতেই পারেন নি। এখন তো মাইক্রো সার্জারী হয়েছে। আগেকার দিনে পুরো পেট কেটে নানান ধরণের অপারেশন হতো। এমন হয়েছে অপারেশনের পর সেলাই হয়ে গিয়েছে। পেটের ভেতর তোয়ালে রয়ে গিয়েছে। আমার বোনের ক্ষেত্রে এ ঘটনা ঘটেছিলো এবং সে মারা যায়। ডাক্তার কিন্তু খুব বড় ডাক্তার ছিলেন। এ রকম কতো ঘটনা আছে। স্টেশনারী দোকানে জিনিষ কিনে পঞ্চাশ টাকা দিয়েছি, কিছু ফেরত পাব। দোকানদার আমায় একশো টাকা হিসেবে টাকা ফেরৎ দিচ্ছেন। অনেকদিন আগের কথা। অফিসে মাইনের দিন ওপরের ব্যাঙ্ক থেকে টাকা আনতে গিয়েছি ক্যাশিয়ারের সঙ্গে। মোট দেড় লক্ষ টাকার মতো। ব্যাঙ্কের ক্যাশিয়ার তাড়া দিচ্ছে তাড়াতাড়ি নিয়ে যান আজ অসম্ভব চাপ। টাকার বান্ডিল যখন দিচ্ছে তখনই আমি দেখেছি যে দশ টাকার বান্ডিল মানে দশটা অর্থাৎ এক একটা ১০০০ টাকার মোট দশ হাজার টাকা বেশি দিয়েছে। আমার ক্যাশিয়ার দেখেছে কিন্তু কিছু বলেনি। আমি যখন ব্যাঙ্কের ক্যাশিয়ারকে আবার গুনতে বললাম তখন সে খুব বিরক্ত ধমক দেওয়াতে গুনলো আর ভুলটা ধরা পড়লো। তখন সে নির্বাক। এই ভুলের জন্য তাকে তখনকার দিনের এই টাকাটা ভুলের মাশুল হিসেবে গুনতে হতো। বাস, ট্রাম এর কন্ডাকটারদের ভুল হয় না। আর ভুল হয় না বাজারে সবজী, মাছ-মাংস যারা বিক্রি করে। কিন্তু ভুল শেয়ারে টাকা খাটিয়ে অনেকে সর্বস্বান্ত হয়েছেন এটা আমরা জানি। সাহিত্যিক, বৈজ্ঞানিক, অধ্যাপক এদের ভুলো মানুষ বলা হয়। ভুল এরা আকছার করেন। অথচ কত বৃহত্তর বিষয়ের সঙ্গে এরা যুক্ত। বেশ অদ্ভুত লাগে। সিনেমা দেখতে গিয়েছেন বাবা-মা। সিনেমা শেষ হবার পর বাবা বাড়ি চলে এলেন সঙ্গে মা নেই। মেয়ে জিজ্ঞাসা করলো ‘মা কোথায়?’ তখন তার খেয়াল হলো আরে সিনেমা ভাঙ্গার পরেই তিনি নিজের মনেই হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছেন। তার স্ত্রীর কথা খেয়ালই নেই। আবার গেলেন আর গিয়ে দেখলেন হলের সামনে দাঁড়িয়ে একা তার স্ত্রী তাকে খুঁজছেন। ভুল ওষুধ খাওয়ার গল্প তো অনেক আছে। আমি নিজেই একবার আয়োডিন খেয়ে ফেলেছিলাম ভিটামিন-বি কমপ্লেকস্ এর বদলে। যার ফলে সারা রাত আমায় জল খেতে হয়েছিল ডাক্তারদাদার নির্দেশে। এছাড়া প্রেম ভালবাসায় ভেসে আমরা অনেক সময় আমাদের জীবন সঙ্গী বা সঙ্গিনী বাছতে ভুল করি। যার জন্য সারাজীবন ভুগতে হয়। এটা এক কথায় লিখলাম কিন্তু এটার বিস্তৃতি বিরাট। কতোজনের ভুলের কথা লিখবো সব ব্যক্তিগত জীবনের কাহিনী। আর ছোট থেকে বড় ভুল আর বড় ভুল থেকে বড় সমস্যা আমরা ভোগ করি। তবু ভুল করা থেকে আমরা বিরত হইনা। দীর্ঘদিনের অভ্যেস ছাড়া যায় কখনো? এই প্রসঙ্গ শেষ করবো আর একটা ভুলের ঘটনা নিয়ে। আমার যমজ দাদা সেজদা এবং ছোড়দা আমাদের চোখে তাদের কিছু অমিল আছে। কিন্তু বাইরের লোক ধরতে পারে না। আমার বাবা মারা যাওয়ার পর মুন্ডিত মস্তক দুজনকে দেখে ভুল করেছিল তাদের ছেলে মেয়েরা। আর স্ত্রীদের একটু সময় লেগেছিল। আর ভুল করেছিলেন ছোড়দার এক শ্বশুরমশাই। ছোড়দার বদলে সেজদাকে নাম ধরে ডেকে সাড়া না পেয়ে প্রচন্ড বিরক্ত তিনি আমার জামাইবাবুকে জানাচ্ছেন। তাকে বোঝানো যাচ্ছে না তিনি ভুল করছেন। ভুল ভাঙলো দুজনকে একসঙ্গে দেখে। এইভাবে ভুলের বা ভুল করার ইতিহাস দীর্ঘ। কতো আর লেখা যায়। এবার একটু ভুল বোঝাবুঝির কথা লেখা যাক্।

  একে ভুল তারপর আবার ভুল বোঝাবুঝি। ব্যক্তিগত ভুল করার মাসুল নিজেকে গুনতে হয় কিন্তু অপরের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝির ফলে কতো যে অশান্তি আর সংসারে কতো জীবন নষ্ট হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। এই ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে স্বামী-স্ত্রীর সঙ্গে। শুধু সন্দেহের বশে ভুল করে স্বামী স্ত্রীকে কষ্ট দিয়েছেন বা হারিয়েছেন আবার স্ত্রী স্বামীকে। এই ভুল বোঝাবুঝিতে অনেক সংসার তছনচ হয়ে গিয়েছে। এ ছাড়া ভাই এ ভাই, বন্ধুতে বন্ধুতে, সহকর্মীদের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝির ঘটনা প্রচুর। এই ভুল বোঝাবুঝির ফলে যে দূরত্ব ঘটে, সম্পর্কের তা ঠিক হতে অনেক সময় লাগে। আর এই সময়ের মধ্যে অনেকে আবার হারিয়ে যান পৃথিবী থেকে আর আফশোষ থেকে যায়। দুর্গাপূজোর দিন একটি ভুল বোঝাবুঝির ফলে মামার বাড়ির সঙ্গে একটি পরিবারের দূরত্ব তৈরী হয় এবং প্রায় দশ বছর বাদে আবার সেটা ঠিক হয় একটা মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। আর এই দশ বছরে মামার বাড়ির অনেকে চলে গিয়েছেন। কি হলো এই ভুল বোঝাবুঝির ফল? হারিয়ে গেল দশটা বছর। হারিয়ে গেলেন আরও অনেকে।

  এই ভুল বোঝাবুঝিটা একটু বেশি যারা সিনেমা জগতের সঙ্গে যুক্ত। অর্থাৎ অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মধ্যে। প্রায়ই কাগজে এদের নানান ঘটনা আমরা জানতে পারি। যদিও এসব রঙিন জগতের ব্যাপার তবুও আমরা তো এদের বাইরে নই।

 শেষ করবো আমার বাসস্থানের একজনের সঙ্গে আমার ভুল বোঝাবুঝি নিয়ে। অবশ্য আমি নয় তিনিই আমাকে ভুল বুঝে আমার সঙ্গে তার সহজ সরল সম্পর্কটা নষ্ট করে ফেলেছেন। কেন করলেন জানিনা। অথচ এই জায়গায় আসার পর তার সঙ্গেই আমার প্রথম আলাপ হয় এবং তিনি আমায় বন্ধু বলেই ডাকতেন। আমার স্ত্রী তাকে দাদা বলে ডাকতেন এবং খুবই শ্রদ্ধা করতেন বড় ভাইয়ের মতো। অথচ সেই তিনি কোন ভুল বোঝাবুঝির জায়গা থেকে আমার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছেন। আমি দু'চারবার কথা বলার চেষ্টা করে কোন সাড়া পাইনি। কি দুর্ভাগ্য আমাদের, আমরা যারা এই ভুল বোঝাবুঝির শিকার হই। এ এক মানসিক অসুস্থতা। যার থেকে আমাদের মুক্তি নেই। যতই আমরা যুগোপযুগী হই আর শিক্ষিত হই, এ হচ্ছে ডাক্তারদের এলার্জী রোগের মতো যার কোন ওষুধ নেই। নিজের চেষ্টায় এবং মনের বলে যদি এর থেকে বেরুনো যায় তাহলে এক কথা, নচেৎ নয়।

আরও পড়ুন 


বিশ্ববোধ -একটা ভাবনা/তড়িৎ ভট্টাচার্য 

তড়িৎ ভট্টাচার্য

১৯৪১ সালে ৮ই জুলাই জন্ম। ন’জন ভাইবোনের মধ্যে সপ্তমজন হিসাবে জন্মগ্রহণ। বাবা বিষ্ণুপদ ভট্টাচাৰ্য্য উচ্চ শিক্ষিত এবং অত্যন্ত সজ্জন ব্যক্তি ছিলেন। ভাই বোনেরা সবাই সরস্বতীর বরপুত্র ছিলেন। তড়িৎ ভট্টাচার্য্যের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একটু ভিন্ন ছিল। স্নাতক হওয়ার পর পরই পিতৃবিয়োগ হওয়াতে তাকে কর্মস্থলে প্রবেশ করতে হয়। ইচ্ছা ছিল বিভূতিভূষণের ওপর গবেষণা করে বাংলায় অধ্যাপনা করার কিন্তু তা হয়নি। তবু লেখার অভ্যেসটা তারই হাত ধরে সেই পঞ্চাশের দশক থেকে। দীর্ঘ বিবাহিত জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে ২০১১ সালের এপ্রিল মাসে স্ত্রী বিয়োগের পর। পুত্র, পুত্রবধু এবং নাতনী নিয়ে এখন বাকি পথ চলা। সর্বক্ষণের সাথী লেখা। দিনের অনেকটা সময় কাটে লেখা নিয়ে এবং মনের মতো মানুষ পেলে তার সঙ্গে কথা বলে আনন্দ আহরণ করতে।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇




Post a Comment

0 Comments