জ্বলদর্চি

আমি ইন্দু/পলাশ বন্দ্যোপাধ্যায়

আমি ইন্দু

পলাশ বন্দ্যোপাধ্যায়

আমারো গুটিকয় বন্ধু আছে এ পৃথিবীতে।
তারা বলেছিল, এ কাহিনী যেন আমি স্থান কাল পাত্র পাল্টে লিখি। কারণ, তারা চায়নি আমি কারো অনুগ্রহ বা করুনার পাত্রী হই। আমি রাজি হইনি। ভেবেছি যা লিখব, সবটাই অবিকৃত অবস্থায়। নিজের কথা অকপটে লেখার সাহস আমার আছে।

  আমি ইন্দ্রাক্ষী বন্দ্যোপাধ্যায়। সংক্ষেপে ইন্দু। বয়স বিয়াল্লিশ বছর। গায়ের রঙ, শরীরের গঠন স্বাভাবিক। বুদ্ধি গড়পড়তার থেকে বেশি। সঙ্গে, কপাল ফাটা। কলকাতার এক বেসরকারি স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা। রাস্তার পাশে অবহেলায় ফুটে থাকা ফুলও  সুযোগে বনেদি বৈঠকখানার ফুলদানিতে জায়গা পাওয়ার যোগ্য হয়। সে ভরসাতে আমার জীবনের কথা লিখতে বসেছি আমি।

  জন্ম মেডিক্যাল কলেজে। বেড়ে ওঠা বেলেঘাটার দু কামরার আবাসনে। আমার বড়দি মীনাক্ষী। বয়স চুয়াল্লিশ। ওজন চল্লিশ। রক্তাল্পতা আছে। বিবাহিতা। ছেলে ক্লাস এইটে পড়ে। ক্রিকেটভক্ত। বড়দির বর বেসরকারি চাকুরে। টানাটানির সংসার। ছোট ভাই ইন্দ্রনীল মনরোগী। আটত্রিশ বছর। ফিয়ার সাইকোসিস। ওষুধ খায়। আগে চাকরি করত। এখন ফ্রীলান্স সাংবাদিক। ওর বউ মহালয়া ব্যাংক চাকুরে। তাদের মেয়ে ময়ূরাক্ষী। বয়স ছয়। আমার বাবা জীবনকৃষ্ণ বাবু ছাত্র দরদী শিক্ষক ছিলেন। মা বিন্দুবালার এখন বয়স আটষট্টি। ডায়াবেটিক কিন্তু কর্মঠ। দিদা অন্নদাসুন্দরী এখনো বেঁচে আছেন। নব্বই বছর। বুকে ব্যথা। শ্বাসকষ্ট। পাত্তা দেন না ওসব।  বিদুষী। সর্বদা বইয়ের মধ্যে ডুবে আছেন। বাঁচতে ঘোরতর অনিচ্ছা এখন। কখনো বুকের ব্যাথা তীব্র হলে আমাকে বলেন বেশি করে ঘুমের ওষুধ দিয়ে তাঁকে চিরমুক্তি দিতে।

  আপাতত আমি থাকি আমার স্কুলের কাছাকাছি এক ফ্ল্যাটবাড়ির পাঁচ তলার এক দু কামরায়। লোন নিয়ে কেনা।

  ছোটবেলা থেকেই আমি খুব গোঁয়ার। বাবা তাই ডাকতেন জিদ্দি বলে। একবার বিশ্বকর্মা পুজোর দিন ছাদে ঘুড়ি ওড়াতে গিয়ে সুতো কম পড়ে যাওয়ায় মেঘের ওপারে ঘুড়ি পাঠাতে পারিনি। রাগে সেবার তিনদিন কথা বলিনি বাবার সাথে। আরো একবার কোনো এক ছুটকো কারণে প্রিয় এক বন্ধুর সাথে মারপিটের সময় গালে গভীর ক্ষত হয়েছিল। বাবার বকা খেয়ে ঘর পালিয়ে সেবার হাওড়া স্টেশনে গিয়ে বসেছিলাম। এক বছরের বড় গৃহ শিক্ষক সুব্রতদা আমাকে খুব বুঝিয়ে সুঝিয়ে বাড়ি এনেছিল তখন। 

  যখন ক্লাস এইটে পড়ি আমি, বাবা তাঁর স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে নৈনিতাল গেছিলেন শিক্ষামূলক ভ্রমণে। সেখানে ডায়ারিয়া হয়ে একরকম বিনা চিকিৎসায় মারা যান তিনি। প্রচারবিমুখ লাজুক মানুষ ছিলেন । মানুষকে অকারণে বিব্রত না করার খেসারত এভাবে দিতে হয়েছিল তাঁকে। তাঁর শেষযাত্রায় মানুষের ঢল নেমেছিল রাজপথে। ভিড় ঠেলে সামনে পৌঁছে বাবাকে শেষ প্রণাম করতে না পেরে কেঁদে ফেলেছিলাম সেদিন। মা তখন আমাকে বুঝিয়েছিলেন, মানুষের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা পাওয়া খুব গর্বের ব্যাপার। পার্থিব কোনো ব্যাপারে কোনো মোহ ছিলনা তাঁর। তুচ্ছ সুখ স্বাচ্ছন্দ্যে কখনো গা ভাসাননি কখনো। আমাদেরও ভাসাতে দেননি। তাতে ক্ষোভ ছিল আমাদের। চিরকাল লাইফবয় সাবান মেখে বড় হওয়া আমরা তখন ভাবতাম, এ বড় অন্যায়! এখন  বুঝতে পারি, আমরাই অন্যায় করেছি তাঁর প্ৰতি। জীবদ্দশায় তাঁকে আমরা চিনতে পারিনি। প্রাপ্য সম্মান দিইনি তাঁর যোগ্যতাকে।

  বাবা চলে যাওয়ার পর সংসারে তীব্র অনটন শুরু হয়। ভিতরে বাইরে  একটানা লড়াইয়ে মায়ের তখন জেরবার অবস্থা।দিদি সে সময় একবার ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ল। হু হু করে রক্তে হিমোগ্লোবিন কমে যাচ্ছে। যখন ব্লাড ক্যান্সার ডায়াগনোসিস প্রায় নিশ্চিত, বরাত জোরে মেডিক্যাল কলেজের এক ডাক্তারের চিকিৎসায় দিদি সেরে ওঠে। সে দুর্বলতা তার আজও কাটেনি। এটা ওটা লেগেই আছে। বরের অফিসের ভাত, ছেলের দৌরাত্ম্য সামলে প্রায়শই হাঁফিয়ে ওঠে সে।

  ভাই ইন্দ্রনীল ছোটবেলা থেকেই অসম্ভব চুপচাপ। পড়াশোনায় ভালো কিন্তু ফাঁকিবাজ। বলা ভালো, পুঁথিগত বিদ্যের প্ৰতি কোনো আকর্ষণ নেই। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া বাড়ির পুরোনো বিদেশি ক্যামেরা নিয়ে এদিক ওদিক কি সব ছবি তুলে বেড়াত। বাবার কড়া আদেশ ছিল ,বেলা সাতটার মধ্যে বাড়ি ঢুকতে হবে সবাইকে। একদিন দেরি করে ফেরার ভয়ে  সারারাত ছাদে শুয়ে বসে কাটিয়েছিল ভাই। সকালবেলা ঘুমন্ত অবস্থায় তাকে নীচে নামিয়ে আনা হয়। এ হেন ভাই হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করার পর এক বেসরকারি সংস্থা থেকে সাংবাদিকতার ডিপ্লোমা নিয়ে বিশ বছর বয়সে হায়দ্রাবাদ রওনা দেয় এক টিভি কোম্পানির জুনিয়র ফটো জার্নালিস্ট পদে যোগ দিতে। ক্রিমিনাল জার্নালিজমের দলে ফটোগ্রাফি করত সে। সেরকম এক কাজে একবার চোখের সামনে এক সঙ্গী সাংবাদিককে খুন হতে দেখে মানসিক ভাবে বিদ্ধস্ত হয়ে কলকাতা ফিরে আসে । আর ওমুখো হয়নি। সেখানে কর্মসূত্রে আলাপ হয়েছিল  এম.ফিলের ছাত্রী কলকাতার মেয়ে মহালয়ার সঙ্গে। আলাপ শেষপর্যন্ত বিয়ে বিয়েতে গিয়ে দাঁড়ায়।

  বাবা মারা যাওয়ার পর আমি বড় হতে থাকলাম এদিক ওদিক   ঠোক্কর খেতে খেতে। পড়াশোনায় মতি নেই। পাড়ার বখাটে ছোঁড়াদের সঙ্গে ওঠা বসা। রকে আড্ডা মারি তাদের সঙ্গে। পথ চলতি মানুষদের উত্যক্ত করি। কোনো মেয়েলিপনাই ছিলনা আমার মধ্যে। ক্লাস টেনে অংকে পাঁচ পাওয়ার পর ক্লাস টিচার বাসবীদি'র ধাতানিতে সেই যে টনক নড়ে, তাতেই মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও বাংলা অনার্স নিয়ে বি.এ. পাশ করি ভালো ফল সমেত। বি.এ. পড়ার সময় অতি বাম রাজনীতি করতাম। পোস্টার লিখতাম। গ্রুপ থিয়েটার করতাম। একদিন তেমন এক থিয়েটারের রিহার্সালের শেষে বন্ধু উদ্ভব আমাকে হঠাৎ আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলেছিল,'আমার চোখের দিকে তাকা তো ইন্দু! কিছু কি বুঝতে পারিস?'
উত্তেজনা ও ভয়ে আমার প্রায় মূর্ছা যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল সেদিন। সেই প্রথম আমার মেয়ে হয়ে ওঠার শুরু। উদ্ভবের সঙ্গে পরে আর কখনো যোগাযোগ হয়নি।
বেলেঘাটাতে আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে এক দেমাকী কাকিমা থাকতেন। স্বামী আরবে চাকরি করতেন। কাঁচা পয়সা। একদিন আমাকে ডেকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলেছিলেন, 'কি লাভ এই অর্থহীন পড়াশোনায় যাতে সংসারের সুরাহা হয়না? পেটে ভাত নেই। আবার সংস্কৃতিও করা চাই !' খুব আঁতে লেগেছিল সেদিন। তারপর নিজের উদ্যোগে বোলপুরে এক এন.জি.ও'র চাকরি জোগাড় করে প্রথমে তা শুনিয়ে এসেছিলাম সেই কাকিমাকে। আদিবাসী ছেলেমেয়েদের  পড়ানোর কাজ। সামান্য মাইনে। তবু তো নিজে উপায় করা! তার তৃপ্তিই আলাদা।  তাদের সরল জীবনযাত্রার  সঙ্গে মিশে, মহুয়ার নেশা ধরানো নাচের তালে মুগ্ধ হয়ে সেখানে ছিলাম কিছুকাল। গোটা দিন কাজের শেষে লালমাটির সরু পথ ধরে দুদিকের পলাশ গাছ গুনতে গুনতে বাসায় ফিরতাম যখন, তখন চাঁদ ভেজা আকাশের দিকে তাকিয়ে কান্নায় বুক ভেঙে আসত। বুঝতাম এ যন্ত্রণা প্রিয়জনের সঙ্গে আনন্দ ভাগ করে না নিতে পারার যন্ত্রণা।

  চিরকালই স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি আমি। শেষমেশ কলকাতায় ফিরলাম সে স্বপ্নের টানে। বাবার মতো হওয়ার স্বপ্ন। ভাবলাম দরদী শিক্ষিকা হয়ে জাতির ভবিষ্যৎ গড়ব। আমার হাত ধরে তৈরি হবে দেশের শয়ে শয়ে মেরুদন্ডী নাগরিক। সুযোগ এসে গেল হঠাৎই। স্কুল জীবনের  বন্ধু হামিদা তখন মধ্য কলকাতার এক নামি বেসরকারী স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষিকা। ছাত্রজীবন খুব উজ্জ্বল ও বর্ণময় ছিল তার। একদিন ফোন করে আমাকে বলল, তার স্কুলে বাংলা শিক্ষিকা নেওয়া হবে। সে সেখানে আমার নাম ভেবে রেখেছে। প্রথমে মনে হয়েছিল এ অন্যায়। এ স্বজনপোষণ।  শুনে   হামিদা বুঝিয়েছিল ,স্বজনপোষণ যদি যোগ্যতার নিরিখে হয় তাহলে তা সমাজের পক্ষে লাভদায়ী। এরপর আমার আর কোনো যুক্তি ধোপে টেকেনি তার কাছে। সুতরাং আমি সে স্কুলে জয়েন করি। প্রাথমিক মাইনে পাতে দেওয়ার মতো নয়, তবে যোগ্যতা দেখিয়ে উন্নতির অবকাশ আছে। আমি তো লেগে পড়লাম, এবং অচিরেই পড়ে গেলাম ম্যানেজমেন্টের নজরে। মাইনে বাড়ল। গুরুত্ব বাড়ল। প্রাইভেটে বাংলায় এম.এ করলাম। বি.এড, এম.এড করলাম। পরীক্ষার ফল আশাতিরিক্ত ভালো হলো। তারপর এখনকার স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষিকা পদে জয়েন করলাম ইন্টারভিউ দিয়ে। মাইনে বাড়ল। সংসারের সুরাহা হলো খানিক।

  এম.এ পড়াকালীন গৌতমের সঙ্গে আলাপ। আমার থেকে বয়সে বড়। আকর্ষণীয় সুপুরুষ। সেলস এ কাজ করে। প্রথম দিকের ভালো লাগাটা আস্তে আস্তে ভালোবাসায় পরিণত হলো। উড়লাম বেশ কিছুদিন। তারপর বিয়ে করলাম। বিয়ের পর শুরু হলো আর এক টানাপোড়েন। ওর দুশ্চরিত্র, বদমেজাজি, কামচোর পরিচয় অচিরেই চোখের সামনে প্রকট হতে শুরু করল। কোনো চাকরিতেই সে বেশিদিন টিকতে পারেনা।  গোঁয়ার-গোবিন্দ। বোঝালে বোঝে না। বিভিন্ন অছিলায় টাকা চায় আমার কাছে। না দিলে অশান্তি করে, এমন কি গায়েও হাত তোলে। সব মিলে অতিষ্ঠ হয়ে উঠলাম আমি। ভালোবাসা ভীতি, ও শেষে ঘৃণায় পরিণত হলো। বুঝলাম মোহের ফাঁদে পা বাড়িয়ে বিরাট ভুল করে ফেলেছি। পরে জেনেছিলাম নিজের মাসতুতো বোনের সঙ্গে বহুদিনের শারীরিক সম্পর্ক তার। ফলে আমার সঙ্গে সম্পর্ক কোনদিনই দানা বাঁধেনি। এমন কি স্বল্পকালীন দাম্পত্যে  পেটে আসা দুটো বাচ্চাকেই নষ্ট করে দিতে হয়েছিল তাদের পিতৃত্ব নিয়ে গৌতমের সন্দেহ থাকায়। একদিন সময়ের আগে স্কুল থেকে বাসায় ফিরে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় তাদের দেখে লজ্জায়, অপমানে সেই মুহূর্তেই আমার মরে যেতে ইচ্ছে করেছিল।  বাড়ি থেকে বেরিয়ে কলকাতা ময়দানে পৌঁছে চুপচাপ তিন ঘন্টা সেখানে বসে থেকে অতি কষ্টে নিজেকে সামলেছিলাম সেদিন। এরপর আইন আদালত করে সে বিয়ে ভেঙে দিই। মিউচ্যুয়াল ডিভোর্স। শ্বশুরবাড়ির মানুষগুলো ভালো ছিল। শ্বশুর সদাশিব। বাড়িতে কোনো মেয়ে না থাকায় শাশুড়ির খুব প্রিয়পাত্রী ছিলাম আমি। ভাসুর দুজন ছিলেন স্নেহশীল দাদার মতো। সোনারপুরের গাছগাছালি ঘেরা আমার সে শ্বশুরবাড়ি আজো টানে আমাকে। খুব মিস করি অন্য মানুষগুলোকে।

  এরপর দুটো ঘটনা ঘটল। ভাইয়ের একটা মেয়ে হলো। তার ঠিক পরে পরেই মহালয়া একটা চাকরি পেয়ে বর বাচ্চাকে রেখে সোজা চলে গেল দিল্লি। সদ্যোজাত ভাইঝি এলো আমার হেফাজতে। স্কুলে আসি তাকে নিয়ে। ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে খাওয়াই। ন্যাপি পাল্টাই। তার বড় হওয়া দেখতে দেখতে খানিকটা সময় কাটে। একাকীত্ব কাটে।  এরপর স্কুলের তখনকার ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে সামান্য এক ব্যাপারে মতের অমিল হওয়ায় স্কুল ছাড়তে হয় আমাকে। পাশে সদ্য এক মিশনারি স্কুল তৈরি হয়েছিল। সেখানকার প্রধান শিক্ষিকা পদে জয়েন করি তখন। সে স্কুলে থাকাকালীন এম.ফিল করি প্রাইভেটে। করেস্পন্ডেন্স কোর্সে।
নতুন স্কুল। ছাত্র নেই। পড়ানোর পরিবেশ নেই। শুধু স্টাফরুমে বসে পরনিন্দা পরচর্চা আর রাজনীতি। এখানে থাকব কি করে? যথারীতি হাঁফিয়ে উঠলাম। কিছুদিনের মধ্যেই অবশ্য আমার পুরনো স্কুলের মালিকানা বদল হলো। ওখানকার প্রধান শিক্ষিকা শিশিরনকনা'দি হঠাৎ ব্রেন স্ট্রোকে মারা যাওয়ার পর পদ খালি থাকাতে নতুন করে জয়েন করলাম সে পদে।
এদিকে ভাইয়ের বউ সরকারি ব্যাংকের চাকরি পেয়ে কলকাতা ফিরল তিন বছর পর। ময়ূরাক্ষী স্বাভাবিক ভাবে আমার কাছ ছাড়া হলো। আবার মনে মনে একা হয়ে গেলাম আমি। নিষ্ঠুর পৃথিবী। কখনো  সে মানুষকে তার প্রাপ্য দেয়না। মর্যাদা দেয়না। একটা অভাববোধ, একটা শূন্যতা রেখে দেয় সবার জন্য।

  ছোট কিছুরও ব্যাপ্তি সীমাহীন হয় অনেক সময়। বড় মনে হওয়া ঘটনাও গুরুত্বহীন হয়ে হারিয়ে যায় অন্ধকারে। পরবর্তী  ঘটনাগুলোর কথা সংক্ষেপেই বলি, যদিও সেগুলোর গুরুত্ব আমার জীবনে অসামান্য।
সংসারী হওয়ার উচ্চাশা কখনো ছাড়তে পারিনি। ভাবনা সর্বদা, নিজের ঘর, নিজের পরিবার, তাদের সঙ্গে খুনসুটি এসব পথে আবর্তিত হয়। আবার আত্মমর্যাদা, ব্যক্তিস্বাধীনতা এসবের দিকেও সমান আকর্ষণ। এ দুইয়ের দোটানার মধ্যেই  একদিন প্রাত ভ্রমণে বেরিয়ে আলাপ পল্লব ও মাধবীদি'র সঙ্গে। পল্লব আমার প্রায় সমবয়সী। ডাক্তার।সরকারি চাকুরে। চুপচাপ, আমুদে, রসিক। জীবন ও সংসার সম্বন্ধে অনেক ঝড়ঝাপ্টা পেরিয়ে এখন আর কোনো টেনশন নেই। মাধবীদি এজি বেঙ্গলের চাকুরে। তাঁর মাতৃসুলভ আচরণ আমাকে মুগ্ধ করে। এঁরা পরস্পরের ভালো বন্ধু ছোটবেলা থেকে। নিজ নিজ ক্ষেত্রে অনেক সমস্যা থাকা সত্ত্বেও এঁদের নির্মল বন্ধুত্বে কোনো ছেদ পড়েনি। এ দুজন মানুষের সঙ্গে পরিচয় জীবন চলার পথে আমার আত্মবিশ্বাস আরো বাড়িয়ে দিলো। বিশ্বাস করতে শিখলাম, অনেক যন্ত্রণা সয়ে, যুদ্ধ করার পরেও হাসি মুখে পৃথিবীর পথ চলা যায়। শান্তির আকর থাকে মানুষের মনে, মানসিকতায়। তা কেনা যায়না। মাধবীদি'র বরের চাকরি চলে যায় যখন, তখন তাঁদের দুটো ছোট্ট মেয়ে। বর আর কোমর তুলে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারেননি। তখন থেকে সংসারের জোয়াল নিজের কাঁধে নিয়ে চাকরি জুটিয়ে, টিউশনি করে, গান শিখিয়ে মাধবীদি মেয়েদের যোগ্য করে গড়ে তুলেছেন। তারা দুজনেই বিদেশে চাকরি করে এখন। পল্লবের লড়াই  আরো কঠিন। বলা যাবেনা। বলতে কড়া বারণ আছে তাঁর।

  বৈশ্যবাবু মুদ্রার উল্টো পিঠ। মধ্যবয়সী। ছোঁকছোঁকানি ভাব। চোরের মতো চোখের চাহনি। মেডিক্যাল সাইকোলজিস্ট। ভাইয়ের চিকিৎসাসূত্রে তার সাথে আলাপ হয়েছিল। আমি ডিভোর্সি খবর পেয়ে বহুদিন  লালসা চরিতার্থ করার স্বপ্নে ছিলেন। (অথচ উনি বিবাহিত। হয়তো বা অসুখী। হয়তো বা স্বভাবদোষী।) পারেন নি  স্রেফ তার প্ৰতি আমার নিরুত্তাপ আচরণের কারণে। কোনোরকম সাড়া না পেয়ে। নরনারীর সম্পর্কে নিছক দেহবাদ নিয়ে আপত্তি এবং ঘৃণা বস্তু দুটো আমার চিরকালই ছিল। স্বাভাবিক ভাবেই আমাকে তার শিকার হতে দিইনি।
  কিছুদিনের জন্য পাশের মিশনারি স্কুলে গেছিলাম যখন, তখন ভুল করে আমার মোবাইলে আসা একটা এস.এম. এসের উপর ভর করে অর্ণবের সঙ্গে আমার আলাপ। পেশায় সে শেয়ার ব্রোকার। আমার বিয়াল্লিশ বছরের জীবনে এখনো পর্যন্ত সে আমার কাছে যোগ্যতম  বলে স্বীকৃত 'হতে পারতো' সঙ্গী। তার সঙ্গে মিশে আমার ভালো লেগেছিল। আমাকে বুঝত। অল্পদিনের পরিচয়ে আমার একাকিত্বের অনেকখানি ঘুচিয়ে দিয়েছিল সে।  আমার ফ্ল্যাটে খাবার জল না থাকায়, রোজ আমার জন্য মিনারেল ওয়াটার বয়ে নিয়ে আসত সে। একদিন ক্যাফে কফি ডে'তে কফি খাওয়ার অবসরে আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল, যদিও বয়সে সাত বছরের ছোট ছিল আমার থেকে। তার প্ৰতি আমার শ্রদ্ধা ছিল অবশ্য অন্য  কারণে। কোনোদিন আমার একাকিত্বের সুযোগ নিয়ে আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করেনি সে। সম্পর্ক অবশ্য পরিণতি পায়নি শেষ পর্যন্ত। বাধ সেধেছিলেন তার অসুস্থ মা। একদিন নিজের মাথার দিব্যি দিয়ে তাকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছিলেন তিনি যে, বয়সে বড় ডিভোর্সি মেয়েকে সে বিয়ে করতে পারবে না। অর্ণবের মেরুদন্ড এত শক্ত ছিলনা যে সে  নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকে। আপাতত  মায়ের পছন্দের ও নিজের অপছন্দের এক ব্যবসায়ীর মেয়েকে বিয়ে করে সে এক সন্তানের অসুখী বাবা।
আগে যা ভাবতে পারতাম না, এখন তা পারি। নতুন করে সব শুরু করার তীব্র ইচ্ছেতে হালে আবার যোগ্য সঙ্গী খোঁজা শুরু করেছি। এ ব্যাপারে  আমার বৃহত্তর পরিবার আমার পাশে। আমার নতুন পছন্দ তনুময়। সরকারি চাকুরে। লেখক। ডিভোর্সি। আমার বেশ লেগেছে তার কথাবার্তা। নিন্দুকেরা বলে বুদ্ধিজীবী, সাংস্কৃতিক জগতের মানুষেরা ভালো হয়না চারিত্রিক ভাবে।  চরিত্র নিয়ে এ হাস্যকর অতি সরলীকরণ আমি আমল দিই না। তাতে লাভ হয়না। নিজের বিচারের উপরেই ভরসা রেখে চলেছি চিরকাল। জীবনের বাকি দিনগুলোও সে ভাবে চলতে চাই। অর্ণব  তনুময়ের সঙ্গে সম্পর্কের কথা শুনে মরিয়া হয়ে হুমকি দিয়েছে তাকে ওর সঙ্গে পুরোনো সম্পর্কের কথা জানিয়ে দিয়ে সে আত্মহত্যা করবে। অথচ বউকে,  ছাড়বে যে, সে বুকের পাটা নেই। পল্লব ও মাধবীদি বলেছে, 'এও একধরণের সাইকোপ্যাথি, সুতরাং এতে একদম পাত্তা না দিলেও চলবে। যে পুরুষ বিবাহিত তার নৈতিক অধিকার নেই প্রাক্তন প্রেমিকার নতুন সম্পর্কের ব্যাপারে নাক গলানোর। জীবন একটাই। সামনে তাকাতে হবে'।

  তাঁদের এ কথা আমি মেনে নিয়েছি। পিছনে অতল খাদ। সামনে পাহাড়। এ দুইয়ের মাঝে দাঁড়ানো আমি আজ আর একদম ভীত নই। জানি পাহাড় ডিঙাতে হবে। সঙ্গে এও জানি  ওপারে আছে  জীবনের প্রাচুর্য্যে ভরা সবুজ পৃথিবী।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

2 Comments

  1. একদম নতুন আঙ্গিকে লেখা বৃহতের ক্যানভাসে ছোটোগল্প। বেশ ভালো লাগলো। শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন রইলো।

    ReplyDelete
  2. একদম নতুন আঙ্গিকে লেখা। বৃহতের ক্যানভাসে ছোটগল্পের অঙ্কণ। খুব সুন্দর । শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন রইলো।

    ReplyDelete