দূরদেশের লোকগল্প-- আফ্রিকা (তাঞ্জানিয়া)
চিন্ময় দাশ
বাঘ সিংহের লড়াই
একদিন একটা বাঘের মনে হল, আমি সিংহের চেয়ে বড়। কীসের জোরে অত গুমোর সিংহের? বনের ভিতর বাঘই বড়। বাঘই রাজা! যদি মানতে না চায়, লড়াই করে বুঝিয়ে দেব ব্যাটাকে।
যেমন ভাবনা তেমন কাজ। সাথেসাথে সিংহের ডেরায় এসে হাজির হয়ে গেল বাঘ। এসেই ভয়ানক এক গর্জন। আসলে, বাঘ চমকে দিতে চাইল সিংহকে।
তখন সময়টা দুপুর। ভর পেট খেয়ে, আয়েস করে ঘুম দিচ্ছিল সিংহ। চিৎকারে ঘুমটা গেল ভেঙে। তাতে মেজাজ তিরিক্ষি সিংহের। সেও চেঁচিয়ে উঠল—কে চেঁচায়রে ওখানে?
কোনও জবাব নাই। উল্টে আরও জোরে একটা হুঙ্কার দিয়ে উঠল বাঘ। অগত্যা বাইরে আসতে হল। বাইরে বেরিয়ে একেবারে বাঘের সামনে হাজির হল সিংহ। বিরক্ত গলায় বলল-- অমন করে চেঁচাচ্ছ কেন এখানে? এত বড় বন পড়ে আছে। যেখানে খুশি যাও। যত খুশি চেঁচাও। আমার এখানে এসব চলবে না।
আগুন জ্বলে উঠল বাঘের চোখজোড়ায়। বলল—এই বন সকলের। তার মানে, এই জায়গাটাও সকলের। আমাকে চলে যেতে বলবার তুমি কে? আমার ইচ্ছা হলে, আমি থাকব এখানে। ইচ্ছা হলে চেঁচাবও।
মুখের ওপর কথা সহ্য করবার লোক সিংহ নয়। বাঘের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছিল সে। ভাগ্যিস তখনই একটা হাতি এসে হাজির হল সেখানে। নইলে ভারী একটার ক্তারক্তি কান্ড হতে বসেছিল।
হাতি এসে দুজনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে পড়ল—এত বাদবিতন্ডা কেন দুজনের? হয়েছেটা কী? বলো তো শুনি।
লড়াইতে বাধা পড়ায় বাঘ ভারী বিরক্ত। সে গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কোন জবাব দিল না হাতির কথার। সিংহ গম্ভীর জীব। হুট করে মাথা গরম করে না। সে মাথা ঠান্ডা রেখে হাতিকে বলল সব খুলে। বাঘ কিন্তু একই রকম গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
হাতি পড়ে গেল মহা ফ্যাসাদে। সে বুঝে গেল, এই দুই মহারথীর বিবাদ মেটানো সহজ কাজ নয়। কুতকুতে চোখ দুটো বুজে, ভারী মাথাটা নাড়তে নাড়তে ভাবতে লাগল, কী করা যায় এখন?
ঠিক সেসময়েই একটা ঘুঘুপাখি উড়ে যাচ্ছিল সেখান দিয়ে। সে সব দেখে শুনে, ঝুপ করে নেমে পড়ল হাতির পিঠে। ঘুঘু হল বনের সব জীবের কবিরাজ। সবাই তাকে মান্য করে। সে পিঠের ওপরে বসেই, হাতিকে বলল-- বাঘ সিংহকে তো এমন মুখোমুখি দেখিনি কখনও। তা, ব্যাপারটা কীগো, গজরাজ?
হাতি তাকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলল, যেমনটা সিংহ তাকে শুনিয়েছে। ঘুঘু অবাক হয়ে বলল-- ওহ্, এইটুকু ব্যাপার!
ঘুঘুর হালকা চালের কথা শুনে, হাতি অবাক-- মানে? এটাকে সমস্যা বলে মনে হচ্ছে না তোমার?
-- কখন বললাম গো? ঘুঘু হেসে বলল-- অবশ্যই এটা সমস্যা। তবে মিটবে না, এতোটা বড় নয় মোটেই।
হাতি আবারও অবাক হয়ে গেল তার কথা শুনে। ঘুঘু এবার নেমে এল হাতির পিঠ থেকে। বাঘ আর সিংহ মুখোমুখি দঁড়িয়ে আছে। তাদের মাঝখানটিতে উড়তে লাগল ডানা ঝাপটে। বিরক্ত হল বটে, কোন কথা বলল না তারা দুটিতে। তখন ঘুঘুই বলল-- তোমরা নিজেরাই তো মিটিয়ে নিতে পারো ব্যাপারটা। খামোখা চেঁচামেচি করছো কেন?
এবার বাঘ আর সিংহ একসাথে চেঁচিয়ে উঠল-- কীভাবে? কীভাবে মিটিয়ে নেব?
ঘুঘু বলল-- খুব সোজা কথা। বাঘ চেঁচাতে থাকুক। তার যতক্ষণ ইচ্ছে। সিংহমশাই ভেতরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ুক।
সিংহের আর সহ্য হল না। সে ধমক দিয়ে বলল-- হতভাগা, বেকুব। পায়ের কাঁটা তোলা, চোখের ধুলো সাফ করা, কিংবা ধর, ঘা সারিয়ে তোলা-- এসব কাজই তোমাকে দিয়ে হবে। বড়দের বিবাদ মেটানো তোমার কম্মো নয়। ভাগো এখান থেকে।
বাঘও গরগর করে উঠল-- তোমাকে নাক গলাতে হবে না। আমাদের বিবাদ, আমরা নিজেরাই ফয়সালা করে নেব সময় মতো।
ঘুঘু দমবার লোক নয়। তার মাথা ভারী ঠান্ডা। সে গলা নরম করে বলল—তা হয়না, বন্ধুরা। বিবাদ কখনো জিইয়ে রাখতে নাই। মিটিয়ে নিতে হয়। সিংহকে বলল—আমার সাথে একবার ভেতরে এস তো।
বলেই, গুহার ভেতরে ঢুকে পড়ল ঘুঘু। অগত্যা মুখ খানিক ব্যাজার করে, সিংহ চলল তার পিছু পিছু। হাজার রকম জিনিস থাকে ঘুঘুর ঝোলায়। সিংহ ভেতরে আসতেই, তুলোর দুটো ডেলা বানিয়ে, সিংহের দিকে এগিয়ে দিল সে—এই নাও, বন্ধু। দুই কানে গুঁজে নাও। বেকুবটার গর্জন থেকে এগুলোই বাঁচাবে তোমাকে। কথাটা ঠিক, কি বেঠিক, নিজেই পরখ করে দেখো।
সিংহের কানে তুলো গুঁজে, সিংহকে সাথে নিয়ে, বাইরে চলে এলো ঘুঘু।
বাঘকে বলল—সিংহের সাথে কথা হয়েছে আমার। মনের সাধ মিটিয়ে যত খুশি চেঁচাও তুমি। এর কোনও আপত্তি নাই।
বাঘ কিছু বুঝতেই পারল না। ব্যাপারটা মাথায় ঢুকছে না তার। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। তার পর বিকট এক গর্জন। এমন গর্জন, বনের সব গাছপালা ঝাঁকিয়ে, কিলিমাঞ্জারো পাহাড়টাকেও টলিয়ে দিল যেন।
কিন্তু সিংহ দাঁড়িয়ে আছে নির্বিকার। ঠিক যেন একটা পাথরের মূর্তি। বাঘ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। এবার আরও জোরে গর্জন করে উঠল সে। সিংহের তো কানে তুলো। কোন হেলদোল নাই তার। ঘুঘুকে ধন্যবাদ দিয়ে, হেলতে দুলতে গুহায় ঢুকে পড়ল সে। এবার নিশ্চিন্তে ঘুমানো যাবে সাধ মিটিয়ে।
এমন বাজের মত গর্জনকে তোয়াক্কাই করল না সিংহ! এতে ভারী মাথা গরম হয়ে গেল বাঘের। তেমনি ভেতরে ভেতরে খানিকটা ভড়কেও গেছে বাঘ। ব্যাপারটা কী? সিংহ এত শান্ত হয়ে গেল কেন? সে ঘুঘুকে বলল—ব্যাপারখানা কী তোমাদের? কী ফন্দি এঁটেছো?
ঘুঘু শান্ত গলায় বলল-- কোন ফন্দি নয় গো। সিংহকে কেবল একটু সমঝে দিয়েছি আমি, এই মাত্র।
--সমঝে দিয়েছি মানে?
-- আসলে সিংহ তো একটু মাথামোটা। ভালো করে বুঝিয়ে দিয়েছি, কত শক্তি ধরো তুমি। তোমার সাথে লড়তে এলে, আখেরে যে নিজেই মারা পড়বে, সেটাই বুঝতো না হতভাগা।
ঘুঘুর কথা থামিয়ে, বাঘ অবাক গলায় বলল-- তুমি বললে, আর ও মেনে নিলো?
ঘুঘু বলল-- সে তো তুমি নিজের চোখেই দেখলে। কথাটা মেনে নিয়ে, কেমন চুপচাপ ভেতরে চলে গেল। ক্ষমতাকে কে না ভয় পায়, বলো?
সিংহ তার শক্তির কথা মেনে নিয়েছে। বাঘ ভারী খুশি। ঘুঘুকে বলল—ধন্যবাদ বন্ধু। অনেক দিনের একটা বিবাদ মিটিয়ে দিলে তুমি।
বাঘের নরম মেজাজ দেখে, ঘুঘু সুযোগ পেয়ে গেল। বলল—তোমাকেও একটা কথা বলি, বন্ধু। তুমি যতই গর্জন করো, এখন থেকে সিংহ আর কানই দেবে না তাতে। কিন্তু বনের অন্যরা তো আর বুঝবে না। তারা ভাববে, তোমাকে গ্রাহ্যই করছে না সিংহ। তাতে কিন্তু মান থাকবে না তোমার।
বাঘের গলায় তখন রাজ্যের দুঃশ্চিন্তা—তাই তো! কিন্তু সেটা তো চলবে না। কী করা যায়?
-- তাহলে, একটা কথা শোন আমার। ঘুঘু বলল-- তুমি আর এ অঞ্চলেই এসো না। আগবাড়িয়ে নিজের মান খোয়াতে আসার দরকারটাই বা কী? নিজের এলাকায় একেবারে রাজার হালে থাকো। মিটে গেল ঝামেলা। ঝগড়া বিবাদের চেয়ে, শান্তিতে থাকাই তো ভালো। তাই না?
বাঘ খুশি মুখে বলল—ঠিক বলেছ, কবরেজ! কথাটা মনে রাখব তোমার। অনেক ধন্যবাদ, বন্ধু। বলে, হেলতে দুলতে চলে গেল বাঘ।
বাঘ রওনা দিল দেখে, টুক করে আবার সিংহের ডেরায় ঢুকে পড়ল ঘুঘু। তুলো বের করে দিতে হবে সিংহের কান থেকে। নইলে, বিপদে পড়ে যাবে বেচারা।
এদিকে, হাতির মাথায় তো কিছুই ঢুকছে না। পাহাড়ের মত চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে দেখেই যাচ্ছে শুধু।কী যে করল পুঁচকে পাখিটা! সব একেবারে ভোজবাজির মতোই ঘটে গেল!
ততক্ষণে ঘুঘুও বেরিয়ে এসেছে ভেতর থেকে। হাসি মুখে বলল—চলি গো, গজরাজ। তুমিও নিজের কাজে চলে যাও। এখানে থেকে আর করবেটাই বা কী?
দক্ষিণ মুখ করে, ডানা মেলে দিল ঘুঘু।
জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন
0 Comments