জ্বলদর্চি

ক্যালকুলাস-এর জনক গণিতজ্ঞ গটফ্রিড উইলহেল্ম ভন লিবনিৎজ : ইতিহাসের এক ট্র্যাজিক হিরো /পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

বিজ্ঞানের অন্তরালে বিজ্ঞানী ।। পর্ব ― ৪২

ক্যালকুলাস-এর জনক গণিতজ্ঞ গটফ্রিড উইলহেল্ম ভন লিবনিৎজ : ইতিহাসের এক ট্র্যাজিক হিরো 

পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা


১৭১৬ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসের চোদ্দো তারিখ। বড়সড় এক নক্ষত্র পতন ঘটল সেদিন। মহাকাশে নয়, বিজ্ঞানের ইতিহাসে। হ্যানোভার শহরে এক কবর-স্থান। বিজ্ঞানের এক ট্র্যাজিক নায়কের মৃতদেহ পড়ে থাকল সমাধিস্থ হবার অপেক্ষায়। খোলা আকাশের নিচে। তীব্র অনাদরে। চরম অবহেলায়। অথচ, সমাধিস্থ করার লোকের প্রচণ্ড অভাব। মন্ত্র আউড়ে কফিনে মাটি দেবার কেউ নেই। মরদেহ সমাধিস্থ করার সময় হাজির থাকলেন মাত্র একজন। তিনি অকৃতদার মৃত মানুষটির সেক্রেটারি। আর চরম লাঞ্ছনা ও অপমান সঙ্গে নিয়ে চিরঘুমের দেশে পাড়ি দিলেন যিনি, তিনি গটফ্রিড উইলহেল্ম ভন লিবনিৎজ। গণিতজ্ঞ। দার্শনিক। সফল কূটনীতিবিদ।

  সময়টা ১৭১২ খ্রিস্টাব্দ। তখন তিনি রয়্যাল সোসাইটির সম্মানিত ফেলো। কিন্তু সমানে চোর অপবাদ শুনতে শুনতে দারুণ ক্লান্ত তিনি। দীর্ঘদিন গণিত চর্চা ছেড়েছেন। তার বদলে ইতিমধ্যে দর্শনশাস্ত্রের বেশ কিছু বিষয়ে লিখলেন বই। তবুও কোনও মতে পিছু ছাড়ল না অপমান। বিবেকের দংশন কুরে কুরে খায়। শেষমেশ, মৃত্যুর বছর চারেক আগে রয়্যাল সমিতিকে অনুরোধ করলেন― 'মিথ্যা আইডিয়া চুরির অপবাদ থেকে তাঁকে অব্যাহতি দেওয়া হোক।' সোসাইটির প্রেসিডেন্ট তখন বিখ্যাত গণিতজ্ঞ, দার্শনিক আর পদার্থবিজ্ঞানী আইজাক নিউটন। আত্মশ্লাঘায় পঞ্চমুখ এই নিউটন-এর বিরুদ্ধেই তাঁর সমূহ রাগ-অভিমান-অভিযোগ-অপমান। লাঞ্ছনা। শেষমেশ অসহায় আত্মসমর্পণের ইচ্ছা। নিজের সকল অহংকার, প্রতিপত্তি আর সম্মান জলাঞ্জলি দিয়ে।

  নাহ, মৃত্যুর আগে অব্দি তাঁর সে-বাসনা পূরণ হয়নি। পিছু ছাড়েনি অপবাদ। মৃত্যুর পরে আরও দু'দশক সে-অপমানের বোঝা বয়ে বেড়াতে হল তাঁকে। আসলে নিউটন-এর সঙ্গে ঝগড়া, বিতর্ক, যুক্তি-পাল্টা যুক্তি তাঁর যাবতীয় সম্মান ভূলুণ্ঠিত করে। দুজনের দ্বন্দ্বের কেন্দ্রবিন্দু গণিতের এক দূরহ বিষয়ে। 'ক্যালকুলাস'। এ হেন ক্যালকুলাস আবিষ্কারের কৃতিত্ব দাবি করে ধুন্ধুমার কাণ্ড ঘটে যায় ইউরোপে।

  বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে যে দুটি মহাযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল, তার কেন্দ্রবিন্দু ছিল দুটি দেশ― ইংল্যান্ড আর জার্মানি। যুদ্ধ শুরুর সঙ্গে সঙ্গে শুধুমাত্র ইউরোপ ভূখণ্ডের দেশগুলি সে-দ্বৈরথে জড়িয়ে পড়েনি, বাকি মহাদেশগুলিও দুভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু ইংরেজ আর জার্মানদের বৈরিতা আজকের নূতন নয়, বেশ পুরোনো। প্রথম মহাযুদ্ধের দু'শ বছর আগে গণিতের ওই বিষয় নিয়ে তুমূল বচসা ইউরোপজুড়ে। গণিতের নবতম শাখা 'ক্যালকুলাস'। বিষয়টির নতুনত্বে ছিল চমক। ক্যালকুলাস একটি  প্রাচীন ল্যাটিন শব্দ। যার অর্থ― পাথরের টুকরো। প্রাচীন যুগে ও-রকম পাথরের টুকরো দিয়ে গণনার কাজ চালানো হত। সেখান থেকে গণিতের অপরিহার্য  অংশ হিসাবে ঢুকে পড়েছে ক্যালকুলাস শব্দটি। যদিও আধুনিক গণিতে এর আমদানি সায়েন্টিস্ট লিবনিৎজ-এর হাত ধরে। তা, সেই ক্যালকুলাস উদ্ভাবনের কৃতিত্ব দাবি করে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে যুযুধান দেশ দুটো। জাতে ইংরেজ আইজাক নিউটনের সঙ্গে জার্মান বংশোদ্ভূত গটফ্রিড লিবনিৎজ-এর বিবাদে গ্রেট ব্রিটেন বাদে বাকি ইউরোপের দেশগুলি শেষের জনের পক্ষ অবলম্বন করে। কিন্তু যুদ্ধ জিততে ছলচাতুরির অভাব ছিল না আইজাক নিউটনের। নিজের প্রভাব খাটিয়ে চরম অপদস্থ করেছিলেন লিবনিৎজ'কে। 

  ঘটনাটি কী? আর, কে এই লিবনিৎজ? কী তাঁর পরিচয়? পুরো নাম গটফ্রিড উইলহেল্ম ফন লিবনিৎজ। জন্ম ১৬৪৬ খ্রিস্টাব্দের পয়লা জুলাই, জার্মানির লাইপৎজিগ শহরে। বাবা ফ্রিডরিখ লিবনিৎজ পেশায় ছিলেন দর্শনের অধ্যাপক। যখন ছোট্ট গটফ্রিড-এর বয়েস মাত্র ছ'বছর, বাবা মারা গেলেন। চার সন্তান নিয়ে মা ক্যাথরিন স্মুক পড়লেন মহাফাঁপরে। অসহায় মা অল্প বয়স থেকে লক্ষ্য করলেন শিশু গটফ্রিড সাহিত্য, আইন, দর্শন আর গণিতে অত্যন্ত মেধাবী। বাড়িতে বাবার তৈরি লাইব্রেরিতে কম বয়সে সে নিজের জ্ঞানের খোরাক জোগাড় করত অনায়াসে। ফলে অল্প দিনে খুব বিদ্যান হয়ে ওঠে সে। ১৬৬১ সালের এপ্রিল মাসে দর্শন অধ্যয়ন শুরু করে লাইপৎজিগ বিশ্ববিদ্যালয়ে। মাত্র দু'বছরের মাথায়, ১৬৬২ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে, যখন তাঁর বয়স মাত্র পনেরো বছর, দর্শন-এ স্নাতক সম্পূর্ণ করে। ১৬৬৪ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসের সাত তারিখে দর্শনে মাস্টার ডিগ্রি লাভ। তারপর শুরু হল আইন নিয়ে পড়াশুনা। ১৬৬৫ খ্রিস্টাব্দের ২৪ সেপ্টেম্বর আইনে স্নাতক হন তিনি। ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দের প্রথমে, মাত্র উনিশ বছর বয়সে, লিখলেন নিজের প্রথম বই 'De Arte Combinatoria' (On The Combinational Art)। আইনে ডক্টরেট করার বাসনায় বড়সড় ধাক্কা― লাইপৎজিগ ইউনিভার্সিটি তাঁর আবেদন বাতিল করে। কারণ সম্ভবত অল্প বয়স। এসময় লাইপৎজিগ ছেড়ে তিনি পাড়ি জমান ইউনিভার্সিটি অফ অল্টডর্ফ (University of Altdorf)। ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দের জুনে সত্বর একটি থিসিস জমা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। অল্টডর্ফ ইউনিভার্সিটি আইনে ডক্টরেট উপাধি প্রদান করে তাঁকে এবং ওকালতি প্র্যাকটিসের অনুমতি দেয়।

  যৌবনে একটি ক্যালকুলেটিং মেশিন বানিয়ে সবাইকে চমকে দিয়েছিলেন গটফ্রিড লিবনিৎজ। যোগ আর গুণের কাজ করা যেত সে-যন্ত্রে। দর্শন আর গণিত প্রিয় বিষয় হওয়া সত্ত্বেও প্রথম জীবনে পেশা হিসেবে বাছলেন কূটনীতি।

  আইন নিয়ে পড়াশুনা করার পর লিবনিৎজ প্রথমে ঠিক করেছিলেন ওকালতি পেশায় পসার বাড়াবেন। তার বদলে বনে যান ডিপ্লোম্যাট। একজন কূটনীতিবিদ। কারণ জার্মান সাম্রাজ্যে তখন হাজার একটা সমস্যা। টুকরো টুকরো প্রদেশে বিভক্ত জার্মান ভূখণ্ড। সেসব খণ্ড খণ্ড আঞ্চলিক প্রদেশগুলোর মধ্যে সৎভাব নেই। প্রায়শই খেয়োখেয়ি লেগে থাকত। ছোট ছোট প্রদেশগুলোর রাজার দরবারে লিবনিৎজ কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞ এবং পরামর্শদাতা হিসাবে কাজ করেন। এমন সময় আরও এক কঠিন বিপদ জার্মানির ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলে। সমস্যা মূলত বহিরাগত। সময়টা ১৬৭২ খ্রিস্টাব্দ। ফ্রান্সের সিংহাসনে তখন সম্রাট চতুর্দশ লুই। ওদিকে ফ্রান্সের সঙ্গে জার্মানির সম্পর্ক একেবারে তলানিতে। জার্মানরা এই ভেবে রীতিমতো ভীত যে সম্রাট লুই জার্মানি আক্রমণ করবে। সেই সময়, যখন ফ্রান্স-জার্মানির সম্পর্ক বেশ খারাপ, নিজ উদ্যোগে দেশ ত্যাগ করে প্যারিসে চলে যান লিবনিৎজ। লক্ষ্য ফরাসি সম্রাটকে বোঝানো― জার্মানির বদলে মিশর দখল করলে তাঁর ষোলআনা লাভ। তাহলে ওখান থেকে তাঁর পক্ষে ওলন্দাজ উপনিবেশগুলো আক্রমণ করা সহজতর হবে। এই দেশত্যাগ গটফ্রিড-এর জীবন আমূল বদলে দেয়।

  ফরাসি দেশের রাজধানী প্যারিসে এসে বহু জ্ঞানীগুণী মানুষজনের সংস্পর্শে আসেন তিনি। তাঁর যোগাযোগ হয় গণিত আর ফিজিক্সের মস্তবড় পণ্ডিত ক্রিশ্চিয়ান হুইগেনস-এর সঙ্গে। হুইগেনস তাঁকে জ্যামিতির নানা সমস্যা নিয়ে গবেষণায় উদ্বুদ্ধ করেন, পরামর্শ দেন। পরামর্শ শুনে চার বছর প্যারিসেই থেকে যান লিবনিৎজ। মাঝে কিছুদিন বিক্ষিপ্তভাবে লন্ডন ঘুরে আসেন দু'বার। সেখানকার পণ্ডিতবর্গের সংস্পর্শে আসেন। যোগাযোগ বাড়ে। জ্যামিতি নিয়ে গবেষণা তাঁকে নিয়ে যায় ক্যালকুলাসের দিকে। ক্যালকুলাস কী? খায়, না মাথায় মাখে? কী কাজে লাগে এই ক্যালকুলাস?
         
  আজকের বিজ্ঞানের ভীত পুরোপুরি ক্যালকুলাসের উপর দাঁড়িয়ে। আধুনিক ক্যালকুলাস ব্যতিরেকে ফিজিক্স-কেমিস্ট্রি-গণিত অচল। তা, সেসময় ক্যালকুলাস মূ্ল্যবান হয়ে উঠেছিল প্রধান চারটি কারণে। প্রথমত, গতি সংক্রান্ত হিসাব-নিকাশে গোলমাল বাঁধছিল নানা কারণে। সূর্য কেন্দ্রীক বিশ্বের ধারণার প্রবর্তক নিকোলাস কোপারনিকাস (১৪৭৩―১৫৪৩) এবং কেপলার-এর মতো পণ্ডিতগণ বললেন― গ্রহেরা সূর্যের চারিদিকে আর উপগ্রহেরা গ্রহের চারপাশে ঘোরে। ওরকম ঘোরাফেরার নেপথ্যে রয়েছে মহাকর্ষ বল। আর, ঘোরার পথ বৃত্তাকার নয়, উপবৃত্তাকার। যত সহজে একটি বৃত্তের ক্ষেত্রফল নির্ণয় করা যায়, ততটাই কঠিন উপবৃত্তের ক্ষেত্রফল গণনা। আবার, উপবৃত্তাকার পথে ভ্রাম্যমাণ বস্তুর গতির হেরফের হয় সবসময়। গতির এরকম পরিবর্তনের হিসাব কষা গণিতের সাধারণ নিয়মে সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত, বক্ররেখার স্পর্শকের ব্যাপারটা। স্পর্শক এমন একটি সরলরেখা যা ওই বক্ররেখাকে একটি বিন্দুতে স্পর্শ করে। বক্ররেখা বরাবর বস্তুর গতির অভিমুখ জানা যায় স্পর্শকের মাধ্যমে। তৃতীয়ত, গণিতের 'ম্যাক্সিমা মিনিমা প্রবলেম'। সূর্যের চারিদিকে যে উপবৃত্তাকার পথে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে; সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্ব কখনও বাড়ে, কখনও কমে। সে ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ আর সর্বনিম্ন দূরত্বের হিসাবটা কী হবে? বীজগণিত কিংবা জ্যামিতি সে-মাপ দিতে অসমর্থ। তা মেলে ক্যালকুলাসের সাহায্যে। চতুর্থত, এবং সবশেষ সমস্যা হল― বক্ররেখার দৈর্ঘ্য মাপা, বক্ররেখা দিয়ে ঘেরা যেকোনও জায়গার ক্ষেত্রফল নির্ধারণ কিংবা তল বেষ্টিত এলাকার আয়তন নির্ণয়।

  ওরকম চার প্রকার জটিল গাণিতিক সমস্যা সমাধানে ক্যালকুলাসের আবির্ভাব বিজ্ঞানে। তাঁর প্যারিস-বাস কালে ― ১৬৭৫ খ্রিস্টাব্দে ― লিবনিৎজ আবিষ্কার করলেন ক্যালকুলাস। ১৬৮৪ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাস। লাইপৎজিগ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত 'অ্যাকটা এরুডিটোরাম' জার্নালে ক্যালকুলাস বিষয়ে একটি প্রবন্ধ লিখলেন তিনি। জার্নালখানি পড়ে ওদিকে ইংল্যান্ডে ধুন্ধুমার কাণ্ড! এতদিনে টনক নড়ল আরেকজনের। প্রমাদ গুনলেন তিনি, আইজাক নিউটন। রীতিমতো গোলাবারুদ ছুঁড়তে শুরু করে দিলেন। কারণ, তাঁর দাবি― অনেক কাল আগে ১৬৬৫ খ্রিস্টাব্দে ক্যালকুলাসের প্রাথমিক ব্যাপার-স্যাপার গুলো আবিষ্কার করে গোপনে গচ্ছিত রেখেছিলেন তিনি। লিবনিৎজ ক্যালকুলাস সংক্রান্ত তথ্যমালা প্রকাশ করার পর ধ্যান ভাঙল নিউটনের। ১৬৮৭ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত জগদ্বিখ্যাত গ্রন্থ 'ফিলোজফায়ে ন্যাচুরালিস প্রিনখিপিয়া ম্যাথমেটিকা'য় তিনি বললেন― লিবনিৎজ-এর আবিষ্কারের আগে তিনি ক্যালকুলাস আবিষ্কার করেছেন। সুতরাং ক্যালকুলাস আবিষ্কারের পুরো কৃতিত্ব তাঁর একার। শুধু এ কথা বলেই চুপ থাকেননি নিউটন। তিনি আরও বললেন― চুপিসারে লিবনিৎজ তাঁর আইডিয়া চুরি করেছেন। এ যে মারাত্মক অভিযোগ! কেন এ কথা বললেন নিউটন? কী প্রমাণ আছে তাঁর কাছে?
      
  ১৬৭৬ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাস। যে একখানা চিঠি নিউটন বন্ধুবর―প্রকাশক ওল্ডেনবার্গের হাতে তুলে দিয়েছিলেন লিবনিৎজ'কে পৌঁছে দিতে, সে চিঠি প্রাপকের কাছে পৌঁছয় অনেক পরে― ১৬৭৭ খ্রিস্টাব্দের গ্রীষ্মে। চিঠিতে ভাসাভাসা সাংকেতিক চিহ্নে ক্যালকুলাসের উল্লেখ করেছিলেন নিউটন। সে-চিঠির প্রাপ্তি সংবাদ জানিয়ে লিবনিৎজ পাল্টা আর একখান চিঠি লিখেছিলেন নিউটনকে। আর সেটাই নিউটনের তুরুপের তাস। ইসকাফনের বিবি! কিন্তু ও চিঠি লেখার এক বছর আগে ১৬৭৫ খ্রিস্টাব্দে লিবনিৎজ সম্পূর্ণ স্বাধীন ভাবে ক্যালকুলাস আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন।

  হে পাঠক, বিচার করুন ক্যালকুলাস আবিষ্কারের কৃতিত্ব কার বেশি? একটা জিনিস আবিষ্কার করে গোপন রাখা রিসার্চ না-করারই সামিল, যা নিউটন করেছিলেন। আবিষ্কৃত তথ্য যে আগে প্রকাশ করবে, কৃতিত্ব তার-ই প্রাপ্য। তাই, ক্যালকুলাস আবিষ্কারের কীর্তি কোনও মতে নিউটনের প্রাপ্য নয়, প্রিয় পাঠক। স্মরণে থাকবে― একই কারণে রেডিও তরঙ্গ আবিষ্কারের কৃতিত্ব চলে যায় এক ইতালিয়ান উদ্ভাবক গুগলিয়েলমো মার্কনি'র কাছে, জগদীশচন্দ্র বসুর নয়। অথচ, সেসময় বাস্তবে তার উল্টো ঘটনা ঘটল। নিজের নাম-যশ-খ্যাতি ও প্রভাব খাটিয়ে অপদস্থ করলেন লিবনিৎজ'কে। সেটা ১৭০৪ খ্রিস্টাব্দ। তিনি বিবাদ উস্কে দিলেন। পরোক্ষে চোর অপবাদে লিবনিৎজ'কে বিদ্ধ করলেন। স্বাভাবিক ভাবেই ক্যালকুলাসের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ল গোটা ইউরোপ ভূখণ্ড। ইংলিশ চ্যানেল দু'ভাগে ভাগ হয়ে গেল। নিউটনের পক্ষে ইংল্যান্ডের সমস্ত পণ্ডিত। আর লিবনিৎজ-এর সমর্থনে বাকি ইউরোপের পণ্ডিতকুল। শুরু হয়ে গেল কাদা ছোঁড়া-ছুঁড়ি। ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি সংক্রান্ত ঝগড়া-ঝাটি, মামলা-মোকদ্দমার সেই শুরু। বিবাদ গড়াল ইংল্যান্ডের রয়্যাল সোসাইটি পর্যন্ত। মামলা হল রয়্যাল সমিতির কাছে। নিউটনের হাতের পুতুল-মার্কা কমিটি নিউটনের পক্ষে রায় ঘোষণা করে। গোটা ইউরোপের আক্রমণ থেকে দেশের সম্মান পুনরুদ্ধার করে নিউটন তখন জাতীয় হিরো। অন্যদিকে, মামলায় হেরে গিয়ে লিবনিৎজ অপমানের অন্ধকার স্রোতে। শেষ জীবনটা দারুণ অবজ্ঞায় কাটে তাঁর। গণিত ছেড়ে দর্শনশাস্ত্রে নিজেকে ব্যস্ত রাখলেন তিনি। বই লিখলেন। কিন্তু বিতর্ক পিছু ছাড়েনি। সমাজে তাঁর বিরুদ্ধে এতটা ঘৃণা, নেগেটিভ ভাবনা ছেয়ে গেছিল যে মৃত্যুর পরে তাঁর মৃতদেহ সমাধিস্থ করার লোক পাওয়া যায়নি। কেউ এগিয়ে আসেনি। তাঁর ব্যক্তিগত সেক্রেটারি একলা হাজির রইলেন কবর দেওয়ার সময়। তাঁর মৃত্যুর পরেও তরজা থামেনি। চার দশক গড়িয়েছিল। তবে, মৃত্যুর অর্ধশতাব্দী অতিক্রান্ত হলে'পর লিবনিৎজ'কে ক্যালকুলাস আবিষ্কারে যৌথ সম্মান প্রদান করা হয়। ক্যালকুলাসের দুটি পার্ট― ইন্টিগ্রেল বা সমাকল আর ডিফারেন্সিয়াল বা অবকল ক্যালকুলাস। ইন্টিগ্রেল ক্যালকুলাস আবিষ্কার করেন লিবনিৎজ। ডিফারেন্সিয়াল ক্যালকুলাসের আবিষ্কর্তা নিউটন। 

  ক্যালকুলাস ছাড়া গণিতের আরও অনেক সূত্র, নিয়ম আবিষ্কার করেছেন লিবনিৎজ। তাঁর একটি বড় কীর্তি বাইনারি সিস্টেম আবিষ্কার। বাইনারি সিস্টেম কী?

  আমরা যখন কোনও সংখ্যা লিখি; ১ থেকে ৯ এবং ০ (শূন্য)― এই দশটি অঙ্ক ব্যবহার করি। একে ডেসিমেল সিস্টেম বলে। এমন দশটি অঙ্ক দিয়ে লক্ষ-নিযুত-কোটি পরিমাণ যেকোনও সংখ্যা প্রকাশ করা যায়। কিন্তু কম্পিউটারে ডেসিমেল সিস্টেম কাজ করে না। তাহলে, কম্পিউটারের ভাষা কী হবে? কোন সিস্টেমে কাজ করে ল্যাপটপ-মোবাইল? ডিজিটাল যন্ত্রপাতি যে নিয়মে কাজ করে, তা-ই হল বাইনারি সিস্টেম। এই সিস্টেমে দুটি মাত্র অঙ্কসংখ্যা ― ০ (শূন্য) আর ১ (এক)। হেড আর টেইল। ট্রু ও ফলস। ইয়েস অথবা নো। অন কিংবা অফ। মাঝামাঝি কোন সংখ্যা নেই। বাইনারি সিস্টেমে যেকোন সংখ্যা প্রকাশ করা যায় শূন্য ও এক দিয়ে। কিন্তু মৃত্যুর পূর্বে তিনি দেখে যেতে পারলেন না― তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা সমস্ত নেভেটিভ ভাবনার 'টেইল' কখন যে স্বীকৃতির 'হেড' হয়ে ফিরেছে, তা কেউ খেয়াল করেনি। এখন, শ্রদ্ধেয় গটফ্রিড উইলহেল্ম ভন লিবনিৎজ-ও বাইনারি সিস্টেমের 'এক' এবং অদ্বিতীয়।

তথ্যসূত্র :
● ঈশ্বরকণা মানুষ ইত্যাদি ― পথিক গুহ
● লিবনিৎজ-নিউটন ক্যালকুলাস বিতর্ক ― উইকিপিডিয়া
● দ্য করেসপন্ডেন্স থিওরি অফ ট্রুথ ― স্ট্যানফোর্ড এনসাইক্লোপিডিয়া অফ ফিলোজফি
● দ্য ফিলোজফি অফ লিবনিৎজ : মেটাফিজিক্স অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ
● গটফ্রিড উইলহেল্ম লিবনিৎজ : বায়োগ্রাফি & ফ্যাক্টস ― ব্রিটানিকা

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন

Post a Comment

0 Comments