জ্বলদর্চি

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম -- পর্ব-(২৬)/সন্দীপ কাঞ্জিলাল

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম -- পর্ব-(২৬)
সন্দীপ কাঞ্জিলাল

ধর্ম ও দর্শন

মার্কসীয় দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা কার্ল মার্কস, (খ্রিঃ১৮০৮-১৮৮৩) হেগেল ও ফয়েরবাক দর্শন দ্বারা ঋদ্ধ হলেও তার দর্শন হল- সমাজকে পরিবর্তন করে  মানুষ এবং সেই সঙ্গে নিজেও পরিবর্তিত হয়- By acting on the external world and changing it, man changes his own nature." এই একই প্রত্যয় থেকে উঠে আসে যে সত্য, তা হল-  "All history is the progressive modification of human nature." শ্রেণীসংগ্রামের ভিতর দিয়েই এই পরিবর্তন আসবে এবং এই সংগ্রাম হবে ভয়ঙ্কর ও রক্তাক্ত। এই সংগ্রামে হয় জয় আসবে, নয় মৃত্যু, মাঝখানে কোন বিকল্প নেই- "Victory or death, Bloody war or nothing!This is the pitiless formulation of the question." এই উদ্ধৃতি মার্কস, জর্জ স্যান্ড থেকে ধার করে সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদনের বিচার করতে উৎপাদন প্রণালীকেই বিরোধের ওপর প্রতিষ্ঠিত করার কথা বললেন। মানুষই সব। বিভিন্ন দার্শনিক মতবাদ যে তত্ত্বের ওপরই প্রতিষ্ঠিত হোক না কেন, তা মানুষকে বাদ দিয়ে নয়।

  কার্ল মার্কস এর তত্ত্বের ওপর কমিউনিজম প্রতিষ্টিত। যার মূল হল- প্রতিটি মানুষ তার শ্রমের ফল ভোগ করবে, কিন্তু পুঁজিবাদী অর্থনীতি ব্যবস্থায় সেই ফল শ্রমিক ভোগ করতে পায় না, যে কারণে সমাজে দুটি শ্রেণীর মানুষের উদ্ভব হয়। এক দল সর্বহারা, অপর দল কোন শ্রম না করেই সম্পদের অধিকারী। এর ফলে মানুষে মানুষে দূরত্ব ও ব্যবধানের (Alienation) সৃষ্টি হয়। শ্রমজীবী মানুষ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নিজের শ্রমের বিনিময়ে অর্জিত সম্পদ যখন ছিনিয়ে নেয়, তখন এই দূরত্ব বা ব্যবধান ঘুচে যায়। 

  মার্কসবাদীগণ ঈশ্বরবিশ্বাসী নন। বিশেষজ্ঞদের মতে বর্তমানে এই তত্ত্ব অচল- "Actually Dilectical Materialism is now a dead horse as a philosophy, be it Marxian or Engelsian. I think John Passmore voices the opinion of the philosophical community of today when he says " Vagueness of Dilectical materialism in contrast to those form of 19th century materialism which depend upon the definition of matter and force then current, has made of it a flexible polemical weapon" (A Hundred years of Philosophy, 1957.) 
ডেনিস দার্শনিক Soren Kierkegaard (খ্রিঃ ১৮১৩-১৮৫৫) অস্তিত্ববাদের (Existentialism) জনক। তিনি বললেন, বাস্তবজীবন অত্যন্ত রূঢ় তা কখনোই বস্তুনিরপেক্ষ বা অমূর্ত ধারণার উপর দাঁড়াতে পারে না। এই উপলব্ধির মধ্য দিয়েই ধর্মকে বিচার করতে হবে এবং খ্রিস্টধর্মের 'বিশ্বাস' বিষয়টি বিচারের আলোয় দেখতে হবে। বিংশ শতাব্দীর পাশ্চাত্য দার্শনিকগণ বিশেষত Karl Barth, Karl Jaspers, Martin Heidegger ও Martin Buber এই অস্তিত্ববাদী দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। 

  অস্তিত্ববাদ দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর আলোকপাত করেছে- প্রথমটি মানুষের অস্তিত্ব সম্পর্কিত, দ্বিতীয়টি হল মানুষের কোন কিছু নিরূপণ করার অধিকার ও ক্ষমতা। এই দুটি বিষয়কে কেন্দ্র করেই পরমসত্তার অস্তিত্ব ও অধিবিদ্যা সংক্রান্ত বিবেচিত হবে। মানুষই তার স্বাধীন সত্তার বিস্তারের মধ্য দিয়ে নিজেকে খুঁজবে, বুঝবে এবং যে কোন বিষয় স্বাধীনভাবে বিচার করেই নিজের আয়ত্বে আনতে চাইবে। মানুষ যদি সত্যভ্রষ্ট হয়ে মিথ্যা বিশ্বাসের বশে তার স্বাধীন সত্তাকে খর্ব করে, তবে তাকে অবশ্যই ভাবতে হবে কেন এবং কি কারণে সে এই মানসিক স্তরে আসতে চাইছে; কেন স্বাধীনভাবে সে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারছে না। 

  জার্মান সুইস দার্শনিক Nietzsche Friedrich (খ্রিঃ ১৮৪৪-১৯০০) মানুষের নৈতিক মূল্যের উপর জোর দিয়েছেন এবং মানুষকে জীবনকে মহিমান্বিত করেছেন। খ্রিষ্টানিটির বিরুদ্ধে তার প্রতিবাদী কন্ঠস্বর গর্জে উঠল। তিনি ভগবানের মৃত্যু ঘোষণা করলেন। তার দর্শনে অভিভূত হয়ে জার্মান ইহুদী দার্শনিক Martin Buber (খ্রিঃ১৮৭৮-১৯৬৫) ইহুদি ধর্মের পরিপন্থী জীবনে আগ্রহী হলেন এবং ইহুদি আরব সম্পর্ককে সহযোগিতার মধ্যে এনে প্যালেস্টাইনের ভবিষ্যৎ শুভের দিকে আনতে আগ্রহী হলেন। আঠারো শতকে পোল্যান্ডে জুডেইজমের যে অতীন্দ্রিয়বাদ আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তার মধ্য দিয়েই আধুনিক জুডেইজমের সমস্যাগুলিকে নিরাময় করার কথা বলেছিলেন।

  সাধারণ মানুষ অতিরিক্ত ধর্মীয় আচার আচরণ পছন্দ করে না এবং এই কারণেই তারা যে কোনো ধর্মীয় আচার আচরণে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারে। যাতে শান্তি সুখ অনুভব করে তাই-ই তাদের কাছে শ্রেষ্ঠ পথ। তারা স্বাভাবিকভাবেই মনে করেন- ঈশ্বর সর্বত্র বিরাজমান এবং সবসময়ই মানুষের সঙ্গে আছেন। ধর্মকে পাণ্ডিত্য দিয়ে বোঝালে তা গ্রহণযোগ্য হয় না। আচার-আচরণের নিষ্ঠুরতা দিয়েও ধর্মবোধ জাগে না বরং তা স্বাভাবিকভাবেই মানুষের হৃদয়ে জয়লাভ করে। নাচগান আনন্দ উল্লাস প্রভৃতির মধ্য দিয়ে আধ্যাত্মিকতার বিকাশ সম্ভব। কট্টর জুডেইজম-পন্থীরা এই মতবাদ গ্রহণ করেননি। ফলে Hasidism নামে ধর্মীয় আন্দোলনের অনুগামীগণ সর্বধ্বংসী নাৎসিদের শিকার হন। Martin Buber এর কাছে বাইবেলের ধর্মীয় নির্দেশ এবং মানুষের জীবন এই দুয়ের মধ্যে বরাবরের সংঘাত রয়েছে বলেই মনে হয়েছিল। 

  Sartre Jean-paul (1905-1980) বিখ্যাত ফরাসি দার্শনিক ঔপন্যাসিক নাট্যকার অস্তিত্ববাদী দর্শনকে বহুধাপ এগিয়ে দিয়ে লিখেছেন- মানুষের বৌদ্ধিক উন্নতি ঘটে তিনটি স্তরে- প্রথমটি হল তার স্বাধীনতা বোধ; দ্বিতীয়টি  সাম্যতা বোধ ও তৃতীয়টি বিশ্বভ্রাতৃত্ববোধ। এই তিনটি ভাবনাই ফরাসি বিপ্লবের (খ্রিঃ ১৭৮৯) স্তম্ভ ছিল। এই তিনটি ভাবনাকে গ্রহণ করে তিনি অস্তিত্ববাদ, মার্কসবাদ নৈরাজ্যবাদকে ব্যাখ্যা করেছিলেন। G. W. F.Hegel এর (খ্রিঃ ১৭৭০-১৮৩১) মতে মানুষ একদিক দিয়ে যেমন স্বাধীন, অপর দিক দিয়ে সাধারণ ভাবেই আপন উদ্দেশ্য সাধনে বদ্ধপরিকর বলেই সব দিক দিয়েই অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত। সে কখনোই একা নয়। তার বিচার  Marxism মানবতন্ত্রের মধ্যেই নিহিত। মার্কসবাদের সামাজিক ক্ষেত্রে শ্রেণীভূক্ত মানুষ হচ্ছে কর্তা এবং পরিবর্তন হচ্ছে তার বিষয়।

  অস্তিত্ববাদের (Existentialism) বড় কথা হল, ব্যাক্তি কর্ম সম্পাদন করে এবং সব কাজই মানুষের জন্য সম্পাদিত হয় । মার্কসীয় তত্ত্বে সাম্যতাবোধ শুধুমাত্র মানুষের গুণগত দিকের প্রমাণ নয়, তা তার রাজনৈতিক মুক্তিরও পথ। তাই ধনের অসম বিতরণের ফলে যে নিপীড়নের সৃষ্টি হয় বা মানুষের মধ্যেও যে ক্ষোভ ও দৈন্য সৃষ্টি হয়, তা প্রতিবাদ প্রতিরোধের রূপ নিয়ে বৃহত্তর আন্দোলনের জন্ম দেয়। রাষ্ট্র যদি এই বৈষম্যের জন্ম দেয় বা বৈষম্যকে এগিয়ে দেয় তবে রাজনৈতিক অস্থিরতার পরিনাম হয়ে দাঁড়ায় নৈরাজ্য। মানুষ তখন রাষ্ট্রকেই উৎখাত করতে বদ্ধপরিকর হয়ে ওঠে।

আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments