জ্বলদর্চি

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ উপমামৃত/ পর্ব-২/সুদর্শন নন্দী

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ উপমামৃত     
পর্ব-২
সুদর্শন নন্দী

 
১৮৮১, ১০ই ডিসেম্বর, রাজেন্দ্রের বাড়ি।
অনেকগুলি ব্রাহ্মভক্ত এসেছেন দেখে ঠাকুর বলছেন —
“ব্রাহ্মসভা না শোভা? ব্রাহ্মসমাজে নিয়মিত উপাসনা হয়, সে খুব ভাল; কিন্তু ডুব দিতে হয়। শুধু উপাসনা, লেকচারে হয় না। তাঁকে প্রার্থনা করতে হয়, যাতে ভোগাসক্তি চলে গিয়ে তাঁর পাদপদ্মে শুদ্ধাভক্তি হয়।"
“হাতির বাহিরের দাঁত আছে আবার ভিতরের দাঁতও আছে। বাহিরের দাঁতে শোভা, কিন্তু ভিতরের দাঁতে খায়। তেমনি ভিতরে কামিনী-কাঞ্চন ভোগ করলে ভক্তির হানি হয়।"

এভাবে উপমার অর উপমা দিয়ে তিনি বলছেন-বাহিরে লেকচার ইত্যাদি দিলে কি হবে? শকুনি উপরে উঠে কিন্তু ভাগাড়ের দিকে নজর। হাওয়াই হুস করে প্রথমে আকাশে উঠে যায় কিন্তু পরক্ষণেই মাটিতে পড়ে যায়।
ভোগাসক্তি ত্যাগ হলে শরীর যাবার সময় ঈশ্বরকেই মনে পড়বে। তা না হলে এই সংসারের জিনিসই মনে পড়বে — স্ত্রী, পুত্র, গৃহ, ধন, মানসম্ভ্রম ইত্যাদি। পাখি অভ্যাস করে রাধাকৃষ্ণ বোল বলে। কিন্তু বেড়ালে ধরলে ক্যাঁ ক্যাঁ করে।
তাই সর্বদা অভ্যাস করা দরকার। তাঁর নামগুণকীর্তন, তাঁর ধ্যান, চিন্তা, আর প্রার্থনা — যেন ভোগাসক্তি যায় আর তোমার পাদপদ্মে মন হয়।
ঠাকুর উপমা সহকারে ভক্তদের বললেন, এরূপ সংসারী লোক, সংসারে দাসীর মতো থাকে, সব কর্ম কাজ করে, কিন্তু দেশে মন পড়ে থাকে। অর্থাৎ ঈশ্বরের উপর মন রেখে কর্মগুলি করে। সংসার করতে গেলেই গায়ে পাঁক লাগে। ঠিক ভক্ত সংসারী পাঁকাল মাছের মতো, পাঁকে থেকেও গা পাঁকশূন্য।

এই যে উপমার সাহায্যে ঈশ্বরীয় কথাগুলি ভক্তদের কানে, হৃদয়ে পৌঁছে দেওয়া তা সাধারণ কথনে সাদামাটা হয়ে থেকে যেত। কিন্তু ঠাকুরের কথামৃত উপমা দিয়ে ম্যারিনেট করা, শুধু শুনতে ভালো লাগে বা, শোনার আকর্ষণ  তীব্র হয় তা নয়, উপমা সহকারে উপদেশ    
একেবারে হৃদয়ে গেঁথে যায়। কখনো ভোলা যায় না।
১৮৮২, ১লা জানুয়ারি।
আজ শ্রীরামকৃষ্ণ সিমুলিয়া ব্রাহ্মসমাজের সাংবাৎসরিক মহোৎসবে ভক্তসঙ্গে এসেছেন। জ্ঞান চৌধুরীর বাড়িতে মহোৎসব হচ্ছে।  

প্রথমে কিছু পাঠ হল। নরেন্দ্র গাইতে পারেন, তাঁকে গান গাইতে অনুরোধ করাতে তিনিও গান গাইলেন।
সন্ধ্যায় ইঁদেশের গৌরী পণ্ডিত গেরুয়াপরা ব্রহ্মচারীবেশে উপস্থিত হয়েছেন।
গৌরী — কোথা গো পরমহংস বাবু?
খানিক পরে কেশব ব্রাহ্মভক্তগণ সঙ্গে নিয়ে পৌঁছলেন ও ভূমিষ্ঠ হয়ে শ্রীরামকৃষ্ণকে প্রণাম করলেন। সকলেই দালানের উপর আনন্দ করছেন। সংসারী ভক্তদের উপবিষ্ট দেখে ঠাকুর হাসতে হাসতে বলছেন-
তা সংসারে হবে না কেন? তবে কি জান, মন নিজের কাছে নাই। নিজের কাছে মন থাকলে তবে তো ভগবানকে দেবে। মন বন্ধক দিয়েছ; কামিনী-কাঞ্চনে বন্ধক! তাই সর্বদা সাধুসঙ্গ দরকার।

এবার উপমা দিয়ে বোঝালেন ঠাকুর। বললেন-এক ভাঁড় জল যদি আলাদা রেখে দাও, ক্রমে শুকিয়ে যাবে! কিন্তু গঙ্গাজলের ভিতর যদি ওই ভাঁড় ডুবিয়ে রাখো, তাহলে শুকবে না! কামারশালার লোহা আগুনে বেশ লাল হয়ে গেল। আবার আলাদা করে রাখো, যেমন কালো লোহা, তেমনি কালো। তাই লোহাকে মধ্যে মধ্যে হাপরে দিতে হয়।

এবার ঠাকুর আসল  কথাটি বললেন। বললেন-আমি কর্তা, আমি করছি তবে সংসার চলছে; আমার গৃহ পরিজন — এ সকল অজ্ঞান! আমি তাঁর দাস, তাঁর ভক্ত, তাঁর সন্তান — এ খুব ভাল।
একেবারে আমি যায় না। এই বিচার করে উড়িয়ে দিচ্ছ, আবার কাটা ছাগল যেমন একটু ভ্যা ভ্যা করে হাত পা নাড়ে, সেই রকম কোথা থেকে আমি এসে পড়ে।
তাঁকে দর্শন করবার পর, তিনি যে আমি রেখে দেন, তাকে বলে পাকা আমি।

যেমন তরবার পরশমণি ছুঁয়েছে, সোনা হয়ে গিয়েছে। তার দ্বারা আর হিংসার কাজ হয় না!
ভক্তরা অবাক হয়ে ঠাকুরের উপমা আর সেই উপমার মূল কথাটি বিস্ময় মিশ্রিত আগ্রহে শুনছেন।
একটু বিশ্রাম করে ঠাকুর কেশবকে বলছেন — তোমার ছেলের বিবাহের বিদায় পাঠিয়েছিলে কেন? ফেরত এনো — আমি ও-সব নিয়ে কি করব?
কেশব হাসছেন তা শুনে। ঠাকুর আবার বলছেন — আমার নাম কাগজে প্রকাশ কর কেন? বই লিখে, খবরের কাগজে লিখে, কারুকে বড়ো করা যায় না। ভগবান যাকে বড় করেন, বনে থাকলেও তাকে সকলে জানতে পারে।

ঠাকুর এবার তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে উপমা সহকারে বললেন-গভীরবনে ফুল ফুটেছে, মৌমাছি কিন্তু সন্ধান করে যায়। অন্য মাছি সন্ধান পায় না। মানুষ কি করবে? মানুষের মুখ চেয়ো না — লোক! পোক! যে মুখে ভাল বলছে, সেই মুখে আবার মন্দ বলবে। আমি মান্যগণ্য হতে চাই না। যেন দীনের দীন, হীনের হীন হয়ে থাকি।
আমরা জানি ঠাকুরের সাথে কথামৃতকার শ্রীমের প্রথম দিকের সাক্ষাৎকারে শ্রীম সাকার নিরাকার মাটির প্রতিমা নিয়ে অনেক কথা হয়। শ্রীম বলেছিলেন মাটির  প্রতিমা পূজার কোন মানে হয় না। ঠাকুর সেদিন বলেছিলেন— তুমি মাটির প্রতিমাপূজা বলছিলে। যদি মাটিরই হয়, সে-পূজাতে প্রয়োজন আছে। নানারকম পূজা ঈশ্বরই আয়োজন করেছেন। যার জগৎ তিনিই এ-সব করেছেন — অধিকারী ভেদে। যার যা পেটে সয়, বা সেইরূপ খাবার বন্দোবস্ত করেন।

এবার ঠাকুর উপমা দিয়ে বললেন-
“এক মার পাঁচ ছেলে। বাড়িতে মাছ এসেছে। মা মাছের নানারকম ব্যঞ্জন করেছেন — যার যা পেটে সয়! কারও জন্য মাছের পোলোয়া, কারও জন্যে মাছের অম্বল, মাছের চড়চড়ি, মাছ ভাজা — এই সব করেছেন। যেটি যার ভাল লাগে। যেটি যার পেটে সয় — বুঝলে?”
মাস্টার — আজ্ঞে হাঁ।

১৮৮২এর  মার্চ।
মাস্টার বিনীতভাবে জিজ্ঞাসা করলেন — ঈশ্বরে কি করে মন হয়?
শ্রীরামকৃষ্ণ বললেন— ঈশ্বরের নামগুণগান সর্বদা করতে হয়। আর সৎসঙ্গ — ঈশ্বরের ভক্ত বা সাধু, এঁদের কাছে মাঝে মাঝে যেতে হয়। সংসারের ভিতর ও বিষয়কাজের ভিতর রাতদিন থাকলে ঈশ্বরে মন হয় না। মাঝেমাঝে নির্জনে গিয়ে তাঁর চিন্তা করা বড় দরকার। প্রথম অবস্থায় মাঝে মাঝে নির্জন না হলে ঈশ্বরে মন রাখা বড়ই কঠিন।

এবার উপমা দিয়ে বোঝালেন-
যখন চারাগাছ থাকে, তখন তার চারিদিকে বেড়া দিতে হয়। বেড়া না দিলে ছাগল-গরুতে খেয়ে ফেলে।
ধ্যান করবে মনে, কোণে ও বনে। আর সর্বদা সদসৎ বিচার করবে। ঈশ্বরই সৎ — কিনা নিত্যবস্তু, আর সব অসৎ — কিনা অনিত্য। এই বিচার করতে করতে অনিত্য বস্তু  মন থেকে ত্যাগ করবে।
মাস্টারের এবার জানতে ইচ্ছা — সংসারে কিরকম করে থাকতে হবে?

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বললেন — সব কাজ করবে কিন্তু মন ঈশ্বরেতে রাখবে। স্ত্রী, পুত্র, বাপ, মা — সকলকে নিয়ে থাকবে ও সেবা করবে। যেন কত আপনার লোক। কিন্তু মনে জানবে যে, তারা তোমার কেউ নয়।
এবার আবার উপমা দিয়ে বিষয়টি বোঝালেন। বললেন-
বড় মানুষের বাড়ির দাসী সব কাজ কচ্ছে, কিন্তু দেশে নিজের বাড়ির দিকে মন পড়ে আছে। আবার সে মনিবের ছেলেদের আপনার ছেলের মতো মানুষ করে। বলে ‘আমার রাম’ ‘আমার হরি’, কিন্তু মনে বেশ জানে — এরা আমার কেউ নয়।

আরেকটি উপমা দিলেন। কচ্ছপ জলে চরে বেড়ায়, কিন্তু তার মন কোথায় পড়ে আছে জানো? — আড়ায় পড়ে আছে। যেখানে তার ডিমগুলি আছে। সংসারের সব কর্ম করবে, কিন্তু ঈশ্বরে মন ফেলে রাখবে।
ঈশ্বরে ভক্তিলাভ না করে যদি সংসার করতে যাও তাহলে আরও জড়িয়ে পড়বে। বিপদ, শোক, তাপ — এ-সবে অধৈর্য হয়ে যাবে। আর যত বিষয়-চিন্তা করবে ততই আসক্তি বাড়বে।

তেল হাতে মেখে তবে কাঁঠাল ভাঙতে হয়! তা না হলে হাতে আঠা জড়িয়ে যায়। ঈশ্বরে ভক্তিরূপ তেল লাভ করে তবে সংসারের কাজে হাত দিতে হয়।
কিন্তু এই ভক্তিলাভ করতে হলে নির্জন হওয়া চাই। মাখন তুলতে গেলে নির্জনে দই পাততে হয়। দইকে নাড়ানাড়ি করলে দই বসে না। তারপর নির্জনে বসে, সব কাজ ফেলে দই মন্থন করতে হয়। তবে মাখন তোলা যায়। কথায় কথায় তাঁর উপমা আর উপমা। যাতে ঈশ্বরীয় বর্ণনায় না কোন ফাঁক থেকে যায়।
   (চলবে)

Post a Comment

0 Comments