জ্বলদর্চি

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম/পর্ব-২৯/সন্দীপ কাঞ্জিলাল

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম
পর্ব-২৯
সন্দীপ কাঞ্জিলাল

ধর্ম ও দর্শন 


শ্রমজীবী মানুষগণ জমির মালিক বাণিজ্যিক সুবিধাভোগী ও অভিজাত শ্রেণীর মানুষদের বিরুদ্ধে একত্রিত হয়েছিলেন। ফ্যাসিস্ট সরকারগুলি ইতালি (খ্রিঃ ১৯২২-৪৩),জার্মানি (খ্রিঃ ১৯৩৩-১৯৪৫),স্পেন (খ্রিঃ ১৯৩৯-৭৫)- যথাক্রমে Benito Mussolini,Adolf Hitler এবং Francisco Franco- র নেতৃত্ব জনগণের কাছে জাতির ত্রাণকর্তা হিসেবে মনে করেছিলেন।

   রাশিয়া এবং জাপানে ফ্যাসিবাদ (খ্রিঃ ১৯৩৫-১৯৪৫) ওই একইভাবে জাপানিদের রক্ষাকর্তা হিসেবে ভিত গড়তে চেয়েছিল। সামন্ততন্ত্রের জন্ম যা ইউরোপে খ্রিঃ সতেরো শতকে হয়েছিল যার ফলে সমাজে প্রভু ও দাস শ্রেণীর উদ্ভব ঘটেছিল তার ঐতিহাসিক শিকড়ের খোঁজ পাওয়া যায় এগারো শতাব্দে। শক্তপোক্ত রাজশক্তির উত্থানও এই পরম্পরা অঙ্গ, যা ইউরোপ ছাড়াও পৃথিবীর বহু দেশে দেখা গিয়েছিল প্রাচীনকাল থেকেই। কিন্তু মানুষের স্বাধীনতার স্পৃহাকে কখনোই প্রতিহত করা যায়নি। এর জন্যে সাধারণ মানুষকে যুগে যুগে আত্মবলিদান দিতে হয়েছে এবং অসম লড়াইয়ে রাজশক্তি গণঅভ্যুত্থানকে দমন করতে পারেনি। কী রাষ্ট্রজীবনে, কি সমাজ জীবনে এমনকি মানুষের ধর্মজীবনেও তার পরিচয় যুগে যুগে রয়ে গেছে। 

  উনবিংশ শতাব্দে কট্টর প্রোটেস্ট্যান্ট আন্দোলন যা আমেরিকায় শুরু হয়েছিল, তা আক্ষরিক অর্থে বাইবেলের নির্দেশাবলীকে মেনে চলার আন্দোলন ছিল।

   সহস্র বৎসর পর যিশুর পুনরুত্থান, কুমারী মায়ের গর্ভে তার জন্মলাভ এবং যিশুর নির্দেশ পালন না করার অর্থ পাপে নিমজ্জিত হওয়া প্রভৃতি বিষয়ে এই কট্টরপন্থীরা নানাভাবে প্রচারপত্র বিলি করা থেকে, সেই সময়ের বুদ্ধিজীবীদের কাজে লাগিয়ে, তাদের উদ্দেশ্য সাধন করেছিলেন যার প্রভাব খ্রিঃ ১৯২০ থেকে খ্রিঃ ১৯৪০ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এই কট্টরপন্থীগণ  মিডিয়াকেও কাজে লাগাতে কসুর করেননি। ইসলাম ধর্মের কট্টরপন্থীগণও কোনোভাবেই পিছিয়ে ছিলেন না। তারাও ও পাশ্চাত্যের প্রগতি ও আধুনিক জীবনযাত্রা অস্বীকার করে জনসাধারণকে এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ডাক দিয়েছিলেন এবং এই কট্টরপন্থীগণই তালিবান নামে পরিচিত। এই কট্টর ধর্মীয় আন্দোলন উত্তর আমেরিকা, আফগানিস্থান, পাকিস্তান, বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে; বিপুল সংখ্যায় না হলেও যথেষ্ট সংখ্যক তারা জনজীবনকে অস্থির করে তুলেছে।

   আফ্রিকায় Nation of Islam বা Black Muslim আন্দোলন সংগঠিত হলে তার নেতৃত্বে ছিলেন Eligah Muhammad। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই আন্দোলন বিপুলভাবে ব্যাপ্তি লাভ করল। 
 
  ধর্মীয় আন্দোলনের পরম্পরায় অতীতের দিকে ফিরে তাকালে এগারো শতাব্দে চীন দেশে Neo Confucianism আন্দোলন শুরু হয়েছিল বৌদ্ধ ধর্ম ও ডাওইজিম- এর বিরুদ্ধে। কনফুসিয়াসের ধর্মীয় প্রভাব জাপানেও বিস্তার লাভ করেছিল, যা বৌদ্ধধর্মের জেন (Zen) মতবাদের দ্বারা পুষ্ট ছিল এবং যার মূল প্রতিপাদ্য বিষয়- স্বর্গীয় করুণালাভ করার মধ্য দিয়েই মানুষ তার দৈনন্দিন জীবনকে সুস্থিত রাখতে পারে, আধুনিকতা বা প্রচলিত ধর্মবিশ্বাস এই সুস্থিতি মানুষকে কখনোই দিতে পারবে না। 


   জাপানিগণ বৌদ্ধধর্ম ও সিন্টো (Shinto) ধর্মকে সংযুক্ত করে খ্রিঃ ষষ্ঠ শতাব্দে এক নতুন ধর্মের উত্থান ঘটালেন। সিন্টো ধর্মাবলম্বী ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের জন্যে কাছাকাছি অথচ আলাদা মন্দির তৈরি হল।

   আপন আপন ধর্ম বিশ্বাসকে অক্ষুন্ন রাখতে ও ভক্তগণকে সন্তুষ্ট রাখতে সরকার খ্রিঃ ১৮৬৮ শতাব্দে নির্দেশনামা জারি করল, সিন্টো মন্দিরে নিযুক্ত বৌদ্ধ পুরোহিতদের সিন্টো ধর্মাবলম্বী হতেই হবে। কারণ রাষ্ট্রীয় ধর্ম হল সিন্টো। এর ফলে রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে বৌদ্ধ ধর্মাচরণ বন্ধই হয়ে গেল। তবুও জাপানিগণ সিন্টো ধর্মানুযায়ী জন্ম, বিবাহ, নববর্ষ পালন করলেও পারলৌকিক ক্রিয়া স্মরণ- সম্পর্কিত অনুষ্ঠানগুলি বৌদ্ধ ধর্মনুযায়ী পালন করতেন। সিন্টোধর্ম স্থানীয় জাপানি ধর্ম কামী (Kami)  নামে আত্মার পূজাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল । Izanagi এবং Izanami নামে কামীর জুড়ি জাপানের সমস্ত দ্বীপের সৃষ্টির পেছনে রয়েছেন এবং তারাই জাপানের যাবতীয় জাতি উপজাতির জনক জননী। রাজ পরিবারের উদ্ভবও এই বিশ্বাস প্রচলিত ছিল। সিন্টো ধর্মানুযায়ী ভক্তি সহকারে ধর্মবিধি পালন করে চললে ভক্তগণ স্বর্গীয় করুণা লাভ করে নিশ্চিন্ত জীবন যাপন করতে পারবেন- এই বিশ্বাস ছিল। 


   বিংশ শতাব্দের গোড়ার দিকে ভাববাদের(Idealism) বিরুদ্ধে বাস্তববাদের (Realism) আন্দোলনে William James; Bertrand Russell,G.E.Moore প্রমূখ দার্শনিক ও শিক্ষাবিদগণ অগ্রণী ভূমিকা নিলেন। বিভিন্ন ধর্ম ও মতবাদের সূত্র অবলম্বন করে ও তাদের উপাদানগুলিকে বিচার-বিশ্লেষণ করে New Religious Movement (NRM), শুরু হলো পশ্চিমের দেশগুলি সহ ভারত, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, চীন ও জাপানে। 
 
    Consequentialism তত্ত্ব অনুযায়ী বিশ্বজগতে দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণা প্রভৃতি সমস্যাগুলিকে ভোগ করতেই হবে। কিন্তু সেই সবকে ছাপিয়ে যদি আনন্দ সুখ বন্ধুত্ব সৌন্দর্যানুভূতি মানুষকে বেশি করে প্রাণিত করে সেদিকেই নজর দিতে হবে। এই তত্ত্বকে খারিজ করা হলো যুক্তি দিয়ে। নৈতিক তত্ত্ব অনুযায়ী যে কোনো কাজ তার অন্তর্নিহিত গুণের উপর প্রতিষ্ঠা পায় তা শুভ ও অশুভ যাই হোক না কেন, কখনই কাজের ফলাফলের ওপর নির্ভর করে না। সত্তার প্রকৃতি ও বাস্তবতা পরিপন্থী যে নৈতিকতা (Deontological Ethics) তা হল এমন কিছু কাজ বর্তমান যা স্বতঃঅনৈতিক (মিথ্যা কথা বলা, কথা দিয়ে কথা না রাখা, খুন করা,  নিরপরাধীকে শাস্তি দেওয়া) এ যেন শ্লোগানের মতই করতে হবে বলে করা, বলতে হবে বলে বলার মত- "Duty for duty's sake" এইসব কাজের জন্য কোন যুক্তি খাড়া করা দরকার করে না। Immanuel Kant (খ্রিঃ ১৭২৪-১৮০৮) এই দর্শনের প্রবক্তা। কান্টের মতে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়গুলিকে বোধগম্য ও বোধগম্য ধারণায় পরিণত করার জন্য মন যে ধারণাগুলি গঠন করে থাকে তাদের মধ্যে যে কোনটি অপেক্ষাকৃত মৌলিক এবং তার চর্চাই মানব জীবনকে সুস্থিতি দান করতে পারে। "Thou shalt not kill" এর বিপরীতে অনিবার্যভাবে এমন কাজ রয়েছে, যা এই কাজের ইচ্ছার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। "Pay your debts on time, if you want to be able to obtain a mortgage"- তুমি সময় মত ঋণ পরিশোধ করো, যদি তুমি তোমার অধিকার ফিরে পেতে চাও। ( ক্রমশ)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments