জ্বলদর্চি

ভূতের গল্প-(কাটাঁগঞ্জে এক রাত)/ ধৃতি বিশ্বাস

ভূতের  গল্প
কাটাঁগঞ্জে এক রাত  

ধৃতি বিশ্বাস 

                 
ইনজেকশন দিয়েছি ওষুধটা রাতের খাবার 10 মিনিট আগে খাওয়া বেন  আড়চোখে একবার হাত ঘড়িটার দিকে চেয়ে ব্যস্ত হাতে সিরিজ, টেথোস্কোপ কালো ব্যাগ  ভরতে ভরতে ডাক্তার মহিম গুপ্ত  গৃহকর্তা অবনী দাসকে কথাগুলো বললেন।

 - "ডাক্তারবাবু আপনার ফিসটা" বিনীত কন্ঠে অবনীবাবু বলে উঠলেন।  -"কাল দুপুরের দিকে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আসুন রোগী কেমন থাকে জেনে  এ ব্যাপারে কথা হবে "। ডাক্তার বাবু বললেন।

      রাস্তায় নেমে ডাক্তার গুপ্ত দেখলেন সন্ধ্যে আসন্ন।দ্রুতপায়ে তিনি স্বাস্থ্য কেন্দ্রের পথ ধরলেন।আসলে ডাক্তারবাবু নদীয়া জেলার কাটাগঞ্জ এর একটি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নতুন চাকরিতে জয়েন করেছেন।এখানকার গাছগাছালি পরিবৃত মেঠো পথ ঘাট তিনি ঠিকমতো চেনেন না। এজন্যই আলো থাকতে থাকতে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পৌছাবার জন্য তিনি এত তোড়জোড় করছেন।উল্লেখ্য স্বাস্থ্য কেন্দ্রের কোয়ার্টারেই বর্তমানে ডাক্তার বাবু বসবাস করছেন।স্বাস্থ্য কেন্দ্র সরকারি এজন্য ওষুধ-পত্র  বিনামূল্যে দেওয়া হয় তবে ডাক্তারবাবু রোগীর কাছে গিয়ে চিকিৎসা করলে সামান্য কিছু ফিস নেন।

 ২
      উঁচু-নিচু আলপথ ধরে ডাক্তারবাবু এগিয়ে চলেছেন এখনো অনেকটা পথ যেতে হবে। তবে হাঁটতে ডাক্তারের খুব একটা খারাপ লাগছে না। বৈশাখের গরমে সারাদিন  পুড়লেও শেষ বিকালে পশ্চিম দিক থেকে আসা প্রাণজুড়ানো শীতল বাতাস ডাক্তারবাবুর পথশ্রম শুষে নিচ্ছে।

      -"  ডাক্তারবাবু দয়া করে একটিবার দাঁড়ান একটা কাতর  কণ্ঠস্বর সহসা ডাক্তারবাবুর পথ রোধ করল" অবাক হয়ে ডাক্তারবাবু পিছন ফিরে দেখলেন 4\5 হাত  দূরে একটা মাঝবয়েসী লোক জোড়হাতে দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকারে ওর মুখটা ঠিকমতো দেখতে না পেলেও হাটু অবধি খাটো ধুতি,খালি গা, কাঁধে গামছা দেখে তাকে গ্রামের লোক বলেই ডাক্তার বাবুর মনে হল।
--"কে তুমি "-- "আমি হিরু"--" কি ব্যাপার বলতো " -- আমাকে বাঁচান ডাক্তার বাবু বড় বিপদ-- কি হয়েছে খুলে বল আগে --আমার ছেলেটার বড় অসুখ ডাক্তারবাবু বললেন  কি রোগ হয়েছে  সারাদিন কাঁশতে কাঁশতে মুখ দিয়ে রক্ত উঠে আসছে গো ডাক্তার। এখনই চলুন নয় তো আরো বাঁচবে না গো।  করোনা হয়নি তো? না না ওসব হয়নি ডাক্তারবাবু।তা তুমি মুখে মাস্ক পড়োনি  কেন? আজ্ঞে এই  যে গামছা আছে বলে মুখটা ঢাকার চেষ্টা করলো লোকটা। সামান্য বিরক্ত হলেন ডাক্তারবাবু।  মুখে বললেন  -"হ্যাঁ চলো।"

  ৩
     খানিকটা গিয়ে হিরুকে রাস্তা ছেড়ে মাঠে নামতে দেখে ডাক্তার বাবু বললেন ওদিকে কোথায় চললে?  আমার বাড়ি এই পথে যেতে হবে। দেতোঁ হেসে হিরু জবাব দিল।কিন্তু ওদিকে তো ধু ধু মাঠ অবাক কন্ঠে ডাক্তারবাবু বললেন। উত্তরের হিরু শুধু বলল তাড়াতাড়ি চলেন ডাক্তারবাবু নয়তো ছেলেটা আর বাঁচবে না 
আর কথা না বাড়িয়ে ডাক্তারবাবু হিরুর  পিছু পিছু চলতে লাগলেন। আজ আবার ঘোর অমাবস্যা। ডাক্তারবাবু প্যান্টের পকেট থেকে পেন্সিল টর্চ বের করে নামমাত্র আলোয় হিরুকে লক্ষ করে ঘন অন্ধকার ঠেলে চলতে লাগলেন। দূরে কোথাও শিয়াল ডাকছে। পশ্চিম দিক থেকে আসা বাতাসেরা অবসর নিয়েছে।অসহ্য গরমে পথ হাঁটা জনিত কারণে ডাক্তারবাবু দরদর করে ঘামছেন।তবে তিনি বিরক্ত হন নি। কারণ ডাক্তারদের কাজ ই এরকম। সময় অসময়ে রোগীদের বিপদে ঝাপিয়ে পড়া। ডাক্তারদের কর্তব্য।

       আর কতদূর হিরু এই  আরেকটু।এই হিরু লোকটাকে ডাক্তারবাবুর একটু কেমন কেমন লাগছে। টর্চের আলো যখন ওর পেছনে ফেলেছেন তখন  দেহটাকে কেমন যেন অস্পষ্ট অনেকটা ভাসমান আবছায়ার মতো মনে হচ্ছে। তাছাড়া ওর গা থেকে কেমন যেন একটা চামড়া পোড়া কটু গন্ধ আসছে।

       ক্রমে তারা মাঠ পেরিয়ে একটা ছোট বনের মুখে এসে দাঁড়ালো। ডাক্তারবাবু টর্চ জ্বালিয়ে হাতঘড়িটা দেখলেন আটটা দশ বাজে অর্থাৎ প্রায় এক ঘন্টা তিনি হিরুর সঙ্গে হাঁটছেন। তাও আবার এমন নির্জন আধার ঘন পরিবেশে। তার মনের গভীরে ভয়ের সামান্য একটা ঢেউ খেলে গেল।

      তবে সেটাকে আমল না দিয়ে তিনি হিরুকে বললেন কোথায় তোমার বাড়ি। তো আবার দেখছি জঙ্গল শুরু হলো আর একটু বাকি। বন টার মাঝে গিয়ে একটু গেলে একটা ছোট পুকুরের  ধারে আমার ঘর। ডাক্তার --এত দূরে বনের 
মধ্যে বাড়ি করেছো কেন? আমরা তো নিচু জাতের মানুষ তাই গাঁয়ের মধ্যে থাকার জো নেই।  হিরু বলল।

 ৪
আবার শুরু হল পথ চলা।অন্ধকারে এতক্ষণে ডাক্তারবাবুর চোখ সয়ে এসেছে।বন থেকে একটানা ঝিঁঝিঁর ডাক ভেসে আসছে।বট, ইউক্যালিপটাস গাছ গুলো নিঃশব্দ প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে আছে। দূরে কোনো বট গাছের মগডাল থেকে শকুনের বাচ্চার কান্না ভেসে আসছে। ডাক্তারবাবু হিরু কে প্রশ্ন করলেন এই বনের মধ্যে আবার হাতির উৎপাত আছে নাকি?-- তা আছে তবে আপনার কোন ভয় নেই আমি আছি না।

    অবশেষে একটা ছোট পুকুরের পাশে জীর্ণ কুটিরের সামনে তারা পৌঁছালেন। ডাক্তার বাবু  পুকুরটার দিকে চেয়ে অবাক হলেন।সবুজ কচুরিপানা সর্বাত্মকভাবে গ্রাস করেছে পুকুরটাকে। এক  ঝলক দেখলেই বোঝা যায় এই পুকুর বহুদিন কার ও পা ধোওয়ায়  নি। কুঁড়েঘর টার অবস্থাও খুবই  জীর্ন। সঙ্গে দীর্ঘদিন গোবর  ন্যাতা না দেওয়ায় দেয়ালগুলো কালচে হয়ে গেছে।

  হিরু কুঁড়েটির   তোবরানো পাতলা টিনের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে গেলো।ওর পিছু পিছু ডাক্তারবাবু ঘরে ঢুকে পড়লেন। ভেতরে কোনো আলো নেই।যেন জগতের যাবতীয় কালিমা আজ হিরুর কুঠিরে আশ্রয় নিয়েছে। বিরক্ত হয়ে ডাক্তারবাবু বললেন একটা আলোর ব্যবস্থা করতে পারোনি।আজ্ঞে কেরোসিন শেষ হয়ে গেছে।বিরক্তি চেপে রেখে ব্যাগ হাতড়ে ডাক্তারবাবু একটা আধ জ্বলা মোমবাতি বের করলেন। তারপর বুক পকেট থেকে লাইটার বের করে তাতে অগ্নিসংযোগ করলেন। আস্তে আস্তে চাপ চাপ অন্ধকার গুলো অবয়ব নিতে লাগল।
  
 মুহূর্তে মহিম ডাক্তার দেখলেন একটা হতশ্রী মাকড়সা জাল পরিবৃত্ত পুঁতিগন্ধ পূর্ণ ঘরে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন।ঘরের এক কোণে ছেঁড়া চাটাই এর ওপর একটা বছর দশেকের ছেলে মৃতের মত পড়ে আছে।

   ডাক্তারবাবু মোমবাতি হাতে  রোগীর দিকে এগিয়ে গেলেন। রোগীর মুখের কাছে মোমবাতিটা নিয়ে এসে তিনি দেখলেন ছেলেটির সমস্ত মুখে মৃত্যু বিরাজ করছে। ফ্যাকাশে  ঠোঁটের কষ দিয়ে ঝরে পড়া রক্তরেখা ও শুকনো হয়ে গেছে। মহিম ডাক্তার বুঝতে পারলেন ছেলেটির অনেক আগেই মৃত্যু হয়েছে। তবু একবার পালস  দেখলেন।না স্তব্ধ।

   হিরু কাতর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল কেমন দেখছেন ডাক্তারবাবু। বুকের কাছে জমে থাকা কাথাটা টেনে মৃতদেহের মুখ ঢেকে দিতে দিতে ডাক্তারবাবু বললেন হিরু সবশেষ। তোমার ছেলে আর জেগে উঠবে না।
     না-- না-- চিৎকার করে ছেলের মৃতদেহের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়লো।  হিরু অস্ফুট  নাঁকি সুরে ও বলতে লাগল  যদি ঠিক সময়ে ডাক্তার আনতে পারতাম---
    সহসা মহিম ডাক্তার একটি হাড় হিম করা দৃশ্য দেখলেন হিরু আর ওর ছেলের দেহের মাংসগুলো হাড়ের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে।মাথার চুলগুলো ঢুকে যাচ্ছে খুলির মধ্যে।দেখতে দেখতে হিরু আর ওর ছেলে কঙ্কালে পরিণত হল।হিরুর কঙ্কালটা ওর ছেলের কঙ্কালের উপর  নাকি সুরে কেঁদে চলেছে-- যদি ঠিক সময়ে   ডা---
      আচমকা দুটো কঙ্কাল চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে ঘরের বাতাসে মিলিয়ে গেলো। বিছানায় পড়ে রইল শুধু মুঠো মুঠো ছাই।

   মহিম ডাক্তার জীবনে প্রথমবার ভয় পেলেন। ভয়টা  ছিল তীব্র আতঙ্কে মোড়া। কোনোক্রমে কুঠির এর বাইরে এসে মহিম ডাক্তার অচৈতন্য হয়ে লুটিয়ে পড়লেন পুকুরের ধারে।

   ৬
 জ্ঞান ফিরে মহিম ডাক্তার নিজেকে কাঁটাখালি স্বাস্থ্য কেন্দ্রের একটি বেডে আবিষ্কার করেন। আস্তে আস্তে বিছানায় উঠে বসে তিনি দেখেন কাঁটাখালি গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধান বিশ্বেশ্বর মান্না আর অবনীবাবু হাত খানেক দূরে অপর একটি বেডে বসে আছেন।

    মহিম ডাক্তার কি একটা বলতে গেলে তাকে থামিয়ে অবনীবাবু বললেন ব্যস্ত হবেন না ডাক্তারবাবু সব বলছি।আজ সকালে কাঠুরিয়াদের একটা দল জঙ্গলে গেছিল কাঠ কাটতে। ওরা আপনাকে অচেতন অবস্থায়  পোড়া  বাড়ির সামনে পড়ে থাকতে দেখে  ধরাধরি করে এখানে এনেছে।

   
মহিম ডাক্তার ব্যাগ্র কন্ঠে বলে উঠলেন আচ্ছা হিরু হিরু কি --- পঞ্চায়েত প্রধান তাকে থামিয়ে দিয়ে একটু নীচু স্বরে বলতে লাগলেন হিরু পাঁচ বছর আগে মারা গেছে।বেচারী র জীবনটা ছিল দুঃখে ভরা।ওর ছেলে সঞ্জুকে জন্ম দিয়েই স্ত্রী মারা গেছিল।সঞ্জুকে কোলে পিঠে মানুষ করেছে।বড় ভালোবাসতো ছেলেটাকে।কিন্তু এই সুখ বেশিদিন সহ্য হলো না। সঞ্জু যক্ষা রোগে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ল। প্রাণ ঢেলে ছেলের সেবা করেছিল হিরু। নিজে না খেয়ে দামী ওষুধপথ্য র ব্যবস্থা করেছিল।কিন্তু বিধিবাম এক অমাবস্যার সন্ধ্যায় ওর ছেলেটা অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়ে।বেচারি এই কাটাখালি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে দৌড়ে এসেছিল তখন এখানে ডাক্তার ছিলেন  প্রদীপ কর। তিনি  সঙ্গে সঙ্গে গিয়েছিলেন।

    কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি ওরা পৌছাবার পূর্বেই সঞ্জু শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিল। তারপর থেকে হিরু পাগলের মত হয়ে যায় চান, খাওয়া ত্যাগ করে ও ছেলের মৃত্যুর জন্য নিজেকে দায়ী করতে থাকে। খালি বিড়বিড় করে বলতো যদি ঠিক সময়ে ডাক্তার আনতে পারতাম।

  দিন পাঁচেক পর হিরু আত্মহত্যা করেছিল।নিজের ঘরেই গায়ে আগুন দিয়ে পুড়ে মরে ছিল।

    তারপর থেকে আমাবস্যার রাতে হিরুর  অতৃপ্ত আত্মা ডাক্তার খুঁজতে বের হয়। বেশ কয়েকজন ডাক্তার ওর খপ্পরে পড়েছিলেন।তবে শেষ দুবছর আর এরকম ঘটনা ঘটেনি। আমরা ভেবেছিলাম বোধহয় ওর আত্মা মুক্তি পেয়েছে।এজন্য  আপনাকে ওর ব্যাপারে কিছু বলা হয়নি। কিন্তু এখন দেখছি  !

    মহিম ডাক্তার পুনরায় জ্ঞান হারালেন। ভয় পাওয়া মানুষের সমস্ত লক্ষণ তার মুখে বর্তমান।দূরের বট গাছটি থেকে একটা শালিকের করুন কিচিরমিচির শোনা যাচ্ছে বোধহয় ওর কোন সন্তানের মৃত্যু হয়েছে।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments