জ্বলদর্চি

কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজুমদারের সাক্ষাৎকার নিলেন গবেষক অভিষেক রায়

কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজুমদারের সাক্ষাৎকার নিলেন গবেষক অভিষেক রায়


উপন্যাসের কিছু প্রশ্নের উত্তর সন্ধানে সমরেশ মজুমদারের মুখোমুখি 


 সাক্ষাৎকার নিয়েছেন- ড. অভিষেক রায় 


আধুনিক কথাসাহিত্য তথা উপন্যাসের ধারায় অন্যতম জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক সমরেশ মজুমদার। প্রধানতঃ উত্তরবঙ্গকে সাহিত্যের পৃষ্ঠায় তুলে ধরে সাহিত্যধারায় তাঁর জয় যাত্রা শুরু। তবে কাহিনির সংগতি বিধানে দক্ষিণবঙ্গ একেবারে বাদ যায়নি। সমরেশের পাঠক মাত্রই জানেন যে, তাঁর বেশ কিছু জনপ্রিয় উপন্যাসের কহিনি উত্তরবঙ্গে শুরু হয়ে দক্ষিণবঙ্গে শেষ হয়েছে। এসব কিছুকে ছাপিয়ে বিষয় বৈচিত্র্যই সমরেশ-এর উপন্যাসের জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ। তাঁর লেখা বিভিন্ন উপন্যাস পড়তে পড়তে অসংখ্য প্রশ্ন মনে জেগেছে। তারই উত্তর সন্ধানে এই সাক্ষাৎকার। প্রশ্নগুলো কথোপকথনে বিক্ষিপ্ত বিচ্ছিন্ন ভাবে উঠে এলেও উত্তরগুলো অনুসন্ধিৎসু পাঠকের কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হবে বলে আশা রাখি।
      
অভিষেক: আজ প্রথমে আপনার অর্জুন চরিত্রটি সম্পর্কে কিছু জানতে চাই। আপনি অর্জুনকে একটা বয়সের সীমার মধ্যে আটকে রেখেছেন কেন?

সমরেশ: অর্জুনকে নিয়ে আমি কোন অ্যাডাল্ট গল্প লিখিনি। এখনো অর্জুনের প্রেম দেখাইনি। কিন্তু পরিণত বয়সের একটা গন্ধ আছে। অর্জুনের এই বয়সে সিগারেট খাওয়া আসলে সে গোয়েন্দাগিরিতে সক্ষম এটা বোঝাতে। তাছাড়া ষোল-সতেরো বছরের ছেলে সিগারেট খেতে পারে না কি ? একটা যোল সতেরো বছরের ছেলেকে গোয়েন্দা হতে হলে মিনিমাম একুশ-বাইশ বছরের বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিতে হবে। তো সেটা মফসসলের ছেলে অর্জুন পেরেছে। কলকাতার ছেলে হলে হয়তো পারত না।

প্রঃ- 'এখনও সময় আছে' উপন্যাসটি রূপকধর্মী। একথা কি আপনি সমর্থন করেন?
 
উঃ- হ্যাঁ। এই উপন্যাসটিকে রূপকধর্মী উপন্যাসই বলা উচিত। অসংখ্য প্রতীক ব্যবহারে জীবনের ভেতরে আর এক জীবনকে আমি ছুঁতে চেয়েছি। যেমন, রাধার আসা বা ফাল্গুনীকে প্রথমে নিয়ে এসে পরে রাধাকে নিয়ে আসা। ঐ মাছটা আসলে একটা রহস্য। অগভীর জলে মাছের খেলা করা আসলে অবচেতন স্তরের খেলা। আর মালিনী, সে তো পুরুষের আকাঙ্ক্ষার একটা আবছা রূপ। তাই সে নামটা বলতে হয় বলে বলেছে। রাধার সাথে ঝড়ের রাতে হঠাৎ মিলন তো ভেতরে বাসা বেঁধে থাকা গোপন ইচ্ছের রূপদর্শন। ঝড়টা কোন প্রাকৃতিক ঝড় নয়, মানসিক ঝড়। 


প্রঃ-'উত্তরাধিকার’, ‘কালবেলা' প্রভৃতি উপন্যাস থেকে ‘এখনও সময় আছে' উপন্যাসটির পার্থক্য কোথায়?

উঃ-‘উত্তরাধিকার’, ‘কালবেলা'র মতো উপন্যাসগুলিকে আবেগ দিয়ে ধরতে হয়। কিন্তু ‘এখনও সময় আছে’ উপন্যাসটি সম্পূর্ণভাবে বোধ ও বুদ্ধিকেন্দ্রিক। বুঝতে হবে, ভাবতে হবে। আবেগে আক্রান্ত হতে পারবে না। যেমন 'পথের পাঁচালী'কে আমি কখনও বোধের উপন্যাস বলব না। কেননা এই উপন্যাসটি থেকে রস পেতে হলে সম্পূর্ণভাবে আবেগের ওপর ভর করতে হয়। কিন্তু 'আরণ্যক' আমার কাছে অনেক বেশি বোধের উপন্যাস।

প্রঃ-‘কালপুরুষ’-এর শেষাংশে মাধবীলতা যেভাবে অর্কের পক্ষ নিল, তাতে মনে হল সে সক্রিয় সহযোগিতা করবে। এবং অর্ক সত্যিকারের পরিবর্তনের মুখ হয়ে দেখা দেবে। কিন্তু দীর্ঘ আটাশ বছর পর ‘মৌষলকাল'-এ সেই সম্ভাবনার ছিটে ফোঁটাও পাওয়া গেল না। মাধবীলতা সম্পূর্ণভাবে পালটে গেল। মাধবীলতার এই পালটে যাওয়ার পেছনে মনস্তত্ত্বটা কি?

উঃ-আটাশ বছর অনেক বড়ো। অনেক সময়। মাধবীলতা একসময় অনিমেষকে বাঁচাতে অনেক পুলিশি অত্যাচার সহ্য করেছিল। “মৌষলকাল’-এ সেই মাধবীলতা অনিমেষকে ছাড়াতে থানাতে যেতে চাইছেনা। অনিমেষকে নিজের মতো থাকতে দিতে চাইছে। মাধবীলতার এই যে একটা বিশাল পরিবর্তন তা অ্যাটাচমেন্ট থেকে সরে যাওয়া বা ডিটাচ হওয়া থেকে আসছে। তুমি একবার চিন্তা করে দেখ, মাধবীলতা অ্যাটাচ ছিল বলেই একটা বাচ্চাকে পৃথিবীতে এনেছে। তাকে বড়ো করেছে। অ্যাটাচ ছিল বলে জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর পঙ্গু অনিমেষকে নিজের কাছে নিয়ে এসেছে। অ্যাটাচ ছিল বলে পুরো সংসারটাকে দাঁড় করাবার আপ্রাণ চেষ্টা করেছে। অ্যাটাচ ছিল বলে সবাইকে নিয়ে জলপাইগুড়িতে গেছে। এমনকি অ্যাটাচ ছিল বলেই থানার হাজতে বন্দি অর্ককে বলতে পেরেছিল—“তোর পাশে থাকব'। অর্থাৎ এতদিন তার অ্যাটাচমেন্ট প্রচণ্ডভাবে ছিল। তারপর আটাশ বছর চলে গেল। 'মৌষলকাল'-এ অনিমেষের বয়স সত্তর প্লাস। মাধবীলতা বৃদ্ধা হওয়া সত্ত্বেও যেটুকু পারে সংসার করেছে। কিন্তু মনের দিক থেকে শিকড়গুলো সমস্ত আলগা হয়ে গেছে। আলগা হয়ে গেছে বলে ছেলেকে ফেলে রেখে চলে যেতে পারছে। জলপাইগুড়ি গিয়ে ছোটমার সাথে আশ্রমে চলে যেতে চাইছে। আর অনিমেষের মধ্যে আগুনের উদ্দীপনা থাকলেও তা নিভু নিভু। পুলিশ তাকে ধরার সময় কোন প্রতিবাদ করল না। অথচ করাটা স্বাভাবিক ছিল। অন্যদিকে এতকাল ধরে দেখা যুক্তিবাদী মাধবীলতাকে দেখা গেল নিষ্ক্রিয় ভূমিকায়। দীর্ঘকাল একসাথে থাকতে থাকতে যখন চাওয়াটা না মেটে তখন মনের মধ্যে ধুলো পড়তে আরম্ভ করে। সেই ধুলো থেকে আসে নিষ্ক্রিয়তা। সে আর ঝগড়া করে না প্রতিবাদ করে না। এখন অনিমেষের হাতে কাঠ পিঁপড়ে উঠতে দেখেও কিছু বলে না। অথচ পাশে বসে আছে। আগে হলে ঝাঁপিয়ে পড়ে পিঁপড়েটাকে ফেলে দিত। মাধবীলতার এইরকম আচরণের মানে এই নয় যে সে অনিমেষকে এখন পছন্দ করে না। আসলে ভেতর থেকে সায় আর নেই। এটা জীবনের একটা অদ্ভুত ধর্ম। আটাশ বছরের লড়াই থেকে মাধবীলতা এই জায়গাতে এসে দাঁড়িয়েছে।


            সমরেশ মজুমদার ও অভিষেক রায় 



প্রঃ-‘আট কুঠুরি নয় দরজা’ উপন্যাসে নায়ক আকাশলালের এই যে মরে যাওয়া এবং বেঁচে ওঠার মধ্যে কি কোন ম্যাসেজ আছে?

উঃ- না, কোন ম্যাসেজ নেই। আমেরিকান একটি কাগজে পড়েছিলাম কোন মানুষকে বাইপাস সার্জারি করে তার মধ্যে মৃত্যুর লক্ষণ ফুটিয়ে তোলা সম্ভব। অর্থাৎ একটা মানুষকে যদি বিশেষ কৌশলে বাইপাস করা যায় তাহলে প্রায় চব্বিশ ঘন্টা তার মধ্যে মৃত্যুর লক্ষণ দেখা যাবে। যে পরিমাণ রক্ত হার্টে গেলে আমরা স্বাভাবিক থাকি এই রকম বাইপাসের ফলে তার কুড়ি শতাংশ হার্টে যায়। হার্ট নির্জীব হয়ে পড়ে। শরীরে মৃত্যুর লক্ষণ দেখা যায় কিন্তু মারা যায় না। তেইশ চব্বিশ ঘন্টা পর ভেতরে ঢোকানো মেশিনটা কাজ বন্ধ করে দিলে সঙ্গে সঙ্গে মারা যায়।

    কিন্তু ঐ সময়ের মধ্যে যদি আবার বাইপাস করে ভালভ বসিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসা সম্ভব। এই ব্যাপারটা আমাকে উৎসাহিত করেছিল। বৈচিত্র্য আনার জন্য ডাক্তারি শাস্ত্রের এই কৌশলটিকে কাহিনির প্রয়োজনে ব্যবহার করেছি।
প্রঃ-‘আট কুঠুরি নয় দরজা’কে কি রাজনৈতিক উপন্যাসের মধ্যে ফেলা যায়?

উঃ - হ্যাঁ, একটা রাজনৈতিক গন্ধ আছে। তবে পুরোপুরি রাজনৈতিক নয়। একটা অঞ্চলকে কেন্দ্র করে একটা রাজনৈতিক বিক্ষুব্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু আন্দোলনটা দেখাইনি। দেশ বা অঞ্চলের নামও উল্লেখ করিনি। একটা রাজনৈতিক গন্ধ রেখেছি। রাজনীতি ডাইরেক্ট আসছে না। রাজনীতিকে ব্যবহার করা হচ্ছে। 

প্রঃ-'কালবেলা' উপন্যাসে আপনি যে নকশাল আন্দোলনের কথা বলেছেন সেই আন্দোলন সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন নকশাল নেতা ভিন্ন ভিন্ন কথা বলেছেন। এ বিষয়ে আপনার অভিমত কি?

উঃ-আমি আগেও বলেছি, এটা অন্ধের হস্তি দর্শন। যে যার মতো করে ভেবেছে। সে যেটা করেছে সেটাই ঠিক। আমি তো নকশাল ছিলাম না, তাই অনেকের কাছে আমি যা লিখেছি তা ভুল লিখেছি। আবার অনেকে সমরেশ মজুমদারের সাথে তাঁর বন্ধু নকশাল নেতা শৈবাল মিত্রের যোগ আবিষ্কার করেছেন। শৈবাল যা বলেছে সমরেশ তাই লিখেছে, এই ধরনের কথাবার্তা সেই সময় চালু ছিল। আমার কথা হচ্ছে নকশাল আন্দোলন সম্পর্কে যে লেখাটা আমি লিখেছি, সেটি সঠিক কি বেঠিক এ নিয়ে আমার কাছে কোন দ্বন্দ্ব নেই। আমার পাঠক আজ প্রায় বত্রিশ-তেত্রিশ বছর ধরে এই বইটা পড়ছেন।

    এখনো প্রতিবছর দু'তিনটি এডিশন হয়। অর্থাৎ এক জেনারেশন থেকে আর এক জেনারেশনে বইটা চলে যাচ্ছে। এই বইটা পড়ে সেই সময়ের আন্দোলন সম্পর্কে। তাদের একটা ধারণা তৈরি হল, একথা তারা বলছেন। নকশাল আন্দোলনের সময়। ঐ আন্দোলন নিয়ে অনেক প্রবন্ধ অনেক কবিতা লেখা হয়েছে। আমি বাইরে থেকে যেভাবে দেখেছি তাই লিখেছি। তো সেটা যদি পাঠকের কাছে গৃহীত হয়, আমার কাছে সেটাই আনন্দের। এ যেন, ‘কবি, তব মনোভূমি রামের জনম্ স্থান অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো'। যেহেতু ‘কালবেলা’ উপন্যাস, তাই এর মধ্যে একশো ভাগ সত্য না থাকলেও সত্যের বাইরে নয়।


প্রঃ-সমরেশ বসু তাঁর ‘মহাকালের রথের ঘোড়া' উপন্যাসে নকশাল আন্দোলনকে যেভাবে দেখিয়েছেন সেটা কি এই আন্দোলনের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব নয়?

উঃ-এ বিষয়ে আমার কোন কথা বলা ঠিক নয়। তবে সমরেশদাকে এই ব্যাপারটা নিয়ে আমি বলেছিলাম। আসলে উনিও আমার মতো বাইরে থেকে দেখেছেন এবং আমার মতো নকশাল আন্দোলনের গন্ধটাকে গ্রহণ করেছেন।


প্রঃ-ইতিহাসে বর্ণিত অশোক ও তিষ্যারক্ষার কাহিনি নিয়ে আপনি 'শরণাগত' উপন্যাসটি লিখলেন। কিন্তু কেন এই কাহিনির প্রতি আপনি আকৃষ্ট হলেন সে বিষয়ে যদি কিছু বলেন।

 উঃ-সমরেশদা (সমরেশ বসু)একদিন আমাকে চিনা পরিব্রাজকের লেখা একটি বই পড়তে দিয়েছিলেন। ওখানেই আমি অশোক ও তিষ্যারক্ষার কাহিনিটি পড়ি এবং মুগ্ধ হই। কিন্তু কেন মুগ্ধ হলাম ? ধরো আমি কুড়ি-একুশ বছর বয়সে ষোল-সতেরো বছরের একটি মেয়েকে দেখে আকৃষ্ট হলাম। তারপর বিচ্ছেদ ঘটল। তারপর বহু বছর কেটে গেল। এখন আমি সমরেশ মজুমদার। আমার বই পাঠক কেনে। আমি বইমেলাতে যাই। একদিন একটা সতেরো-আঠারো বছরের একটি মেয়ে আমার কাছে অটোগ্রাফ চাইতে এল। আমি দেখে চমকে উঠলাম। তাকে দেখে মনে পড়ল সেই মেয়েটিকে, যাকে দেখে আমি পঞ্চাশ-বাহান্ন বছর আগে আকৃষ্ট হয়েছিলাম। আমাকে চমকে তাকাতে দেখে মেয়েটি বলল, আমাকে একটা অটোগ্রাফ দিন। আমি জিজ্ঞাসা করলাম কি নাম? নামটা বলল। আমি লিখলাম। সেই পঞ্চাশ-বাহান্ন বছর আগে দেখা মেয়েটির নাম আমি ভুলে গেছি। এই মেয়েটি থাকে দুর্গাপুরে। জিজ্ঞাসা করলাম তোমার মামাবাড়ি কোথায়। বলল— জলপাইগুড়ি। জলপাইগুড়ি শোনামাত্রই আমি আর প্রশ্ন করলাম না। মেয়েটি বলল- আমার মায়ের কাছে আপনার কথা শুনেছি। আমি তখন গম্ভীর। আমি তখন নিজেকে গোটাচ্ছি—নিজেকে প্রকাশ করব না। কোন আবেগ নয়। কিন্তু বাড়িতে এসে মনটা উদাস হয়ে গেল। এই উদাস হওয়া থেকে আমি বাঁচলাম না। আর এই জীবন সত্যটা উপলব্ধি করেছিলাম ঐ কাহিনিতে। অশোক তখন সম্রাট হননি, তাঁকে একটি শোধন আশ্রমে পাঠানো হয়েছিল। সেখানে তিনি তিষ্যারক্ষাকে রেপ করেছিলেন। তিষ্যারক্ষা তারপর তাঁকেই ভেবে এসেছে। সেই উনিশ-কুড়ি বছরের ছেলেটিকে। এই লোলচর্ম বৃদ্ধ সম্রাট অশোককে তিনি স্বামী হিসেবে ভাবতে পারছেন না। ঠিক এই সময় রাজসভাতে কুনালের সাথে তাঁর দেখা হয়। চমকে ওঠেন। কুনালের মধ্যে যুবক অশোককে দেখতে পান। তারপর কুনালকে ভালোবেসে ফেলেন। ভালোবাসা পাবার জন্য তাঁর যে উদ্দামতা তা কুণালের কাছে, অশোকের কাছে নয়। আমার কাছে এটা রিলে-রেসের মতো মনে হয়েছিল। যেন একজনের ব্যাটন আর একজনের হাতে পৌঁছে গেল। তিষ্যারক্ষার প্রেমকে এভাবে বাংলা সাহিত্যে কেউ দেখেছেন কিনা জানি না, আমার কাছে নতুন।

প্রঃ-বৃদ্ধ অশোককে যদি তিষ্যারক্ষা সহ্য করতে নাই পারছিলেন তাহলে তাঁর সাথে রাজপ্রাসাদে এলেন কেন? এর পেছনে কি মনস্তত্ত্ব কাজ করেছে?

উঃ-তিষ্যারক্ষা প্রথমত গেলেন বাবার মুখ চেয়ে। কন্যাদায় থেকে বাবাকে মুক্তি দেওয়ার বাসনায়। তিনি এতদিন চিকিৎসা ও সংসারে বাবাকে সাহায্য করলেও সংসারটা তাঁর নয়। সে রকম একটা ভাবনা হতে পারে। অথবা ভারতবর্ষের সম্রাটের বাড়ি যাওয়ার কৌতূহলও হতে পারে। তাঁর দেওয়া সবকটা শর্ত যেমন আলাদা প্রাসাদ নির্মাণ, পদ্মাবতীকে সরিয়ে প্রধানা মহিষীর সম্মান প্রদান, নিজধর্ম পালন করার স্বাধীনতা সম্রাট অশোক মেনে নিলেন। এই মেনে নেওয়া প্রেমের জন্য নয়, প্রায়শ্চিত্তের জন্য। কিন্তু এই মেনে নেওয়াটাই অশোকের বিরাট পরাজয়। কলিঙ্গ যুদ্ধে অশোক জিতেছিলেন কিন্তু গৃহযুদ্ধে তিনি পরাজিত। সম্রাট অশোককে পরাজিত করার বাসনা থেকেই হয়তো বা তিষ্যারক্ষা প্রাসাদে এসেছিলেন। এটা নিয়ে সিনেমা হওয়ার কথা হয়েছিল। গল্পটা বিক্রিও হয়ে গিয়েছিল। মুম্বাই-এর এক বিখ্যাত পরিচালক কিনেছিলেন। তবে সিনেমাটা হয়নি।

প্রঃ- ‘দাউ দাউ আগুন’ উপন্যাসে যে আন্দোলনটাকে দেখানো হয়েছে তা কি একাত্তরের আন্দোলনের অসারতা বা ব্যর্থতাকে আবার একবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখার প্রয়াস ? আপনি কি নকশাল আন্দোলন এবং মাওবাদী আন্দোলনকে একই প্যারালালে নিয়ে আসছেন?

উঃ-দুটোকে মিলিয়ে দেওয়া যায় না। নকশাল আন্দোলন যদি ঘরের লোকের আন্দোলন হয়, তবে মাওবাদী আন্দোলন দূরের লোকের আন্দোলন। মাওবাদীদের সাথে লোকের সেই মিল নেই। যেটা নকশালদের সঙ্গে ছিল। মাওবাদীরা বলেনি মাসিমা খাবার দিন খিদে পেয়েছে। নকশালরা বলেছিল এবং মাসিমারা তাদের খাবার দিতেন। কংগ্রেস বা সিপিএম-এর চক্রান্ত এবং হুলিগানদের প্রবেশের পর যখন নকশালরা মূর্তি ভাঙা ইত্যাদি কাজ করতে থাকল তখন থেকেই তারা জনগণের দূরের লোক হয়ে গেল। দূরের বলব না ত্যাজ্যপুত্র হল। আর মাও ব্যাপারটাই তো শোনা কথা। মাও-এর ভাবনার সাথে ভারতবর্ষের কোন মিল নেই। যখন চিনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান ধ্বনিত হল তখন এ নিয়ে সমালোচনা কম হয়নি— চিনের কথা আসছে কেন? লং মার্চ-এর কথা আসছে কেন? মোটকথা মাওবাদী ব্যাপারটা গোড়া থেকেই আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না।


প্রঃ-কিন্তু‘দাউ দাউ আগুন’-এ আপনি কাহিনিকে উত্তরবঙ্গ থেকে সুন্দরবনে পাথরপ্রতিমাতে নিয়ে এলেন। এটা কি নকশালদের সাথে মাওবাদীদের একটা যোগসূত্র দেখানোর বাসনায় নয়?

উঃ-না-না। বিষয়টা একেবারেই বিচ্ছিন্ন। বিচ্ছিন্নভাবে যেমন কেউ কেউ এসে পড়ে, ঠিক সেইরকম। এটা হয়েছে লিখতে লিখতে—কাহিনির প্রয়োজনে।

অভিষেক --যাই হোক, সমরেশদা, তথ্য সমৃদ্ধ মতামত ও সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ জানাই। আরও অনেক প্রশ্ন থেকে গেল, যেগুলো নিয়ে আগামী কোনও দিন আলোচনা করা যাবে। ভালো থাকুন। 

  সমরেশ- তোমরাও সবাই ভালো থেকো।


জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

2 Comments

  1. খুব সুন্দর একান্ত ও আন্তরিক এই সাক্ষাৎকার জ্বলদর্চিতে। নিজের ভেতরের জন্ম নেওয়া কিছু প্রশ্নের উত্তরও পেলাম এখানে। বেশ ভালো লাগলো।

    ReplyDelete
  2. খুব সুন্দর লেখা

    ReplyDelete