জ্বলদর্চি

ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা -৫৭/(উৎসব-৬)





সম্পাদকীয়,
উৎসব মানেই সাজগোজ আর ভালো ভালো খাওয়া দাওয়া। আরে শুধু কি আমরাই সাজি নাকি! মা দুগগা কেমন সাজেন তার একটা ছোট্ট নমুনা ছবি পাঠিয়ে দেখিয়েছে নীলাব্জ আঙ্কেল। মৃন্ময়ীও দুগগা মায়ের অপূর্ব ছবি এঁকে পাঠিয়েছে। শুধু কি দুগগা কালী ঠাকুরও তো খুব সাজগোজ করেছে পুজো উপলক্ষ্যে। সাজবে নাই বা কেন? এই পুজো উপলক্ষ্যে কত কত মানুষ দুগগা মাকে, কালীকে দেখতে আসে তা কি আর আমরা গুণে শেষ করতে পারব? এই তো দুগগা পুজো দেখতে শ্রীকান্ত আঙেকলের গল্পের গণপুরের রাজবাড়ি যাচ্ছে অঞ্জনরা, পুজো উপলক্ষ্যে সুস্মিতা ম্যামের গল্পের তিতিরের বাবা বাড়ি ফিরছে। আরে তার থেকেও বড়ো খবর পুজো উপলক্ষ্যে বাদামতলা আষাঢ় সঙ্ঘের ক্লাবে সৌরভ গাঙ্গুলি আসছে। কি করে জানলাম? তপশ্রী আন্টির উপন্যাস পড়ে জানলাম তো। পুজো তো প্রায় শেষ হব হব। দশমীর দিন রাবণ বধ হয় অনেক জায়গায়। তার একটা অপূর্ব ছবি এঁকে পাঠিয়েছে তোমাদের বন্ধু শ্রেয়া বিষয়ী। রাবণ মানেই যে খারাপ তা কিন্তু নয়। রামায়ণ পড়লে বুঝতে পারবে রাবণ কেমন। শুধু রামায়ণ নয় অয়ন আঙ্কেলের লেখা নামায়নও পড়তে পারো।  দারুণ লাগবে। নামায়নই বলো আর শ্রীপর্ণা আন্টির নামকরণ, নাম শুনে কারোকে বিচার করতে যেও না কিন্তু। তাহলেই দেবাশীষ আঙ্কেলের গল্পের বিনয় স্যারের মতো অবস্থা হবে। তবে এটা ঠিক যতই সাজো আর যতোই খাও দাও করোনা কিন্তু এখনও পুরোপুরি যায় নি। তাই আমি তো সৌমী আন্টির গল্প পড়া মাত্রই ঠিক করে নিলাম অন্য গ্রহে চলে যাব। আর অন্য গ্রহে না গেলেও চাঁদে চলে যাব। যারা কুকুর ভালোবাসো তাদের জন্য সুখবর আছে। চাঁদের অন্ধকার পিঠে চন্দ্র কুকুর থাকে, চিন্তা নেই। কি করে জানলাম? দীপক জেঠুর লেখা মায়নামারের গল্পটা পড়ে। তোমরাও পড়ে দেখ না। 
দুই সমাদৃতার ছড়া / গল্প পড়ে জানিও কিন্তু। পড়তে বলছি বলে রেগে গেছ দেখছি। আচ্ছা পড়া ছেড়ে সকলে কে আগে শব্দ জব্দ করে পাঠাতে পারে দেখি। স্কুল আর খুলে এল বলে। উৎসব সংখ্যার লেখা প্রকাশেরও আর মাত্র একটি বাকি। তারপর স্কুল, সাঁতার, অঙ্কন, স্পোর্টস, নাচ, গান, আর পরীক্ষা  পরীক্ষা আর পরীক্ষা। কি তাই তো? আসুক ফিরে সেসব দিন। - মৌসুমী ঘোষ




ধারাবাহিক উপন্যাস

গোলোকধাঁধা
তপশ্রী পাল
( শেষ পর্ব) 

কথায় বলে যে খায় চিনি তাঁকে যোগান চিন্তামণি! ঠিক এই সময় একটা হৈহৈ পড়ে গেলো! বাদামতলা আষাঢ় সঙ্ঘের প্যান্ডেলে দাদা সৌরভ গাঙ্গুলি আসছেন! মূহূর্তে সিকিউরিটিরা সবাই উঠে দাঁড়ালো! ব্যারিকেডের বাঁশ খুলে দরজা করে দেওয়া হলো! সবাই দাদার সঙ্গে সেলফি তোলার জন্য ব্যস্ত, অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য অস্থির! কারো আর কোনদিকে নজর নেই! সিকিউরিটিদের নজরও শুধু দাদার দিকে! নীলোৎপল বললো “এই সুযোগ! শোন, তোরা এখানেই দাঁড়া! আমি অটোগ্রাফ নেওয়ার ছলে টুক করে দাদার দলের পিছন পিছন ঢুকে যাবো ঠিক!” ওরা ভয়ে ভয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। নীলোৎপলদাই ভরসা এখন! নীলোৎপলদা দাদার পিছন পিছন অটোগ্রাফ খাতা নিয়ে যেতেই সিকিউরিটি আটকালো “ভিতরে যাওয়া বারণ!” দাদা ওর কাঁচুমাচু মুখ দেখে বললেন “তোমার নাম কী? ক্রিকেট খেলো?” ব্যাস নীলোৎপলকে পায় কে? সে তো স্কুলের টিমে খেলে! গড়গড় করে নিজের খেলা নিয়ে কতো কী বলে গেলো। দাদা হেসে বললেন “ও আমার সঙ্গে প্যান্ডেল অবধি চলুক। সই করে ছেড়ে দিচ্ছি আমি এক্ষুণি!” নীলোৎপল হাসি মুখে এগিয়ে গেলো দাদার দলের সঙ্গে মিশে। এরপর অধীর অপেক্ষা!
    
  দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই সুদক্ষিণা বললো “তোরা ঐ নীল জামা পরা লোকটাকে দেখছিস?” সৌজন্য তাকিয়ে দেখে একটা সিড়িঙ্গে লোক এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে। সুদক্ষিণা বললো “লোকটা কিন্তু অনেকক্ষণ ঠিক ওখানে দাঁড়িয়ে আছে আর আমাদের লক্ষ্য করছে। এটা দেখেছিস?” উপল বললো “সে তো কতো লোকই দাঁড়িয়ে থাকে প্যান্ডেলে!” “না, না ও আমাদের ছবিও তুলেছে। আমি খেয়াল করেছি।“ আবার সবাই লোকটার দিকে তাকালো। কিন্তু আর দেখতে পেলো না লোকটাকে। সুদক্ষিণা বললো “কেউ আমাদের রেগুলার ফলো করছে, বুঝেছিস?” “হতে পারে যারা এই কম্পিটিশন ডেকেছে, তাঁদের লোক! ওদের তো লক্ষ্য রাখতেই হবে।“ বললো সৌজন্য। “উঁহু, লোকটার মতলব সুবিধের নয় মনে হচ্ছে। কেন যেন আমার মনে হচ্ছে আমাদের খুব বিপদ আসছে! আজ ড্রাইভারও নেই সঙ্গে!” বললো সুদক্ষিণা। সবারই এবার একটু ভয় লাগলো। সন্ধে নেমে আসছে! বাকী কেউ কি সমাধান করতে পারেনি নাকি আগেই সমাধান করে নিয়ে গেছে শেষ সূত্র? তাই বা কে জানে? অনেকক্ষণ ভিতরে গেছে নীলোৎপলদা। এতোক্ষণে তো বেরোনো উচিত ছিলো! দাদার দলই বা কোথায়? মন্দিরা বললো “মনে হয় পিছনের দিকে বেরোনোর রাস্তা আছে। ওদিক দিয়ে বেরিয়ে গেছে!” হতে পারে, কিন্তু নীলোৎপলদা গেলো কোথায়! ওরা যখন খুব চিন্তায় পড়ে গেছে, ঠিক তখনি শোনে মাইকে ওদের নাম ডাকা হচ্ছে। পুজো কমিটির অফিসে চলে আসার জন্য! এ কী রে বাবা! রাস্তায় আরেকটু এগিয়ে একটা ছোট প্যান্ডেল মতো করে তাতে এই পুজো যতো প্রাইজ পেয়েছে সব সাজানো আছে। সেখানেই বসে আছেন পুজো কমিটির লোকজন। তাড়াতাড়ি সেখানে গেলো ওরা। দেখে নীলোৎপলদাকে ধরে রেখেছে ওরা। একজন আঙ্কল বললেন “নীলোৎপল তোমাদের ডাকতে বললো। তোমরা বুঝি ট্রেজার হান্ট করছো? সেটা বলবে তো! আর কেউ তো এই অবধি পৌঁছোতেই পারেনি। তোমরা এতোদূর এসেছো জানলে আমরাই তোমাদের ভিতরে পৌঁছে দিতাম। আমাদের বলাই ছিলো। তা না, নীলোৎপল একা একা একটা শিবমন্দিরে ঢুকেছিলো! ব্যাস আমাদের সিসি ক্যামেরায় ক্যাচ কট কট! আমরা তো ছাড়ছিলাম না। শেষে সব শুনে বুঝতে পারলাম! তোমাদের বন্ধুকে এবারের মতো ছেড়ে দিলাম। আর কখনো কমিটিকে না বলে এরকম করবে না!” যাক বাবা! আর কেউ এই অবধি পৌঁছোয়নি। 

  অন্ধকার হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌঁছতে হবে অথচ একটা উবেরও পাওয়া যাচ্ছে না। সব বুকড! চুপিচুপি নীলাঞ্জনকে জিজ্ঞাসা করে সৌজন্য “শিবমন্দিরের মধ্যে সূত্রের কাগজ পেয়েছিস?” নীলোৎপলদা বললো “না, ধুতরো পেয়েছি শুধু। আর কিচ্ছু নেই।“ সৌজন্য মাথায় হাত দিলো “সে কী! তাহলে এতো কষ্ট করে কিছুই পেলাম না! আমাদের আগেই আর কেউ নিয়ে গেছে নাকি!” ঠোঁট ওল্টালো নীলোৎপল। বললো “বুঝতে পারছি না। বাড়ি গিয়ে সবাই মিটিং-এ ঢুকবি আবার!” গলি দিয়ে বড়রাস্তায় গিয়ে বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়ালো ওরা। যদি বাস বা ইয়েলো ট্যাক্সি পাওয়া যায়! হঠাত একটা ইয়েলো ট্যাক্সি ঘ্যাঁচ করে দাঁড়ালো ওদের সামনে। ওরা তো হাতে চাঁদ পেলো। সবাইকে নামিয়ে সৌজন্যকে বাড়ি ফিরতে হবে। সবাই উঠে পড়লো হৈহৈ করে। নীলোৎপলদা ড্রাইভারকে ডিরেকশন দিয়ে দিলো। খানিক পরে গাড়িটা যে রাস্তায় এসে পড়লো সেটা ওরা কেউই ঠিক চিনতে পারলো না! ড্রাইভার বললো “এটা শর্টকাট!” মন্দিরার মনটা কেমন ছ্যাত করে উঠলো। ও চুপিচুপি বললো “ওঠার সময় খেয়াল করিনি। হ্যাঁ রে সুদক্ষিণা আয়নায় দ্যাখ তো – এই লোকটাই প্যান্ডেলে আমাদের লক্ষ্য করছিলো নাকি! এর গায়েও তো নীল শার্ট!” সুদক্ষিণা চমকে আয়না দিয়ে তাকিয়ে দেখে সেই চোখ! সর্বনাশ! তাড়াতাড়ি বাকীদের বলে ওরা! নীলোৎপল বলে “গাড়ি দাঁড় করান! আমরা নেমে যাবো! আপনি কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন!” “চুপ করে বসে থাক! চেল্লালে গুলি চালাবো!” কর্কশস্বরে বলে ওঠে লোকটা! ওর এক হাত ড্যাশবোর্ডের তলা থেকে বার করে আনে একটা রিভলবার!” একটা শীতল প্রবাহ বয়ে যায় ওদের শিরদাঁড়া দিয়ে! একটু পরেই গাড়িতে উঠে আসে আরো দুটো লোক! ওরা বুঝলো চীৎকার করে কোন লাভ হবে না। গাড়িতে এখন গাদাগাদি করে ওরা নজন আর ড্রাইভার! নীলোৎপল বললো “আমরা মনে হচ্ছে বাইপাসে পড়লাম! কোনদিকে নিয়ে যাচ্ছে কে জানে? সামান্য একটা ট্রেজার হান্টের খেলা খেলতে এসে এমন বিপদে পড়বো ভাবিনি রে! কী এমন আছে ঐ প্যান্ডেলে? এমনি কোন গিফট হলে এরা থোড়ি কিডন্যাপ করতো আমাদের? অন্য কোন ব্যাপার আছে!”

  প্রায় নটা নাগাদ ওদের সবাইকে একটা বাড়িতে ডাম্প করলো লোকগুলো। জায়গাটা কোথায় কিছু বোঝা যাচ্ছে না। শুধু ট্রেনের আওয়াজে বোঝা যাচ্ছে রেললাইনের কাছে কোথাও! লোকগুলো বললো “কালকে কোন প্যান্ডেলে যাবি শীগগিরি বল! তোদের ছেড়ে দেবো!” নীলোৎপল বললো “সেটা সল্ভ করারই তো কোন সময় পেলাম না! আমরা নিজেরাই জানি না!” “চালাকি হচ্ছে? বেশ দুঘন্টা টাইম দিলাম। রাতের খাবার দিয়ে যাচ্ছি! দুঘন্টা পরে আসবো। তখন যদি না বলিস দেখবি কী হয়!” তালা বন্ধ করে চলে গেলো লোকদুটো! 

  চিন্তায় ঘরবার করছেন সৌজন্যর বাবা মা। উপল নীলোৎপলের বাবাও ফোন করেছিলেন। একে একে অন্যরাও করবে এবার! কোথায় গেলো সাত সাতটা ছেলেমেয়ে! সৌজন্যর মা কান্নাকাটি আর বকাবকি করছেন বাবাকে “তোমার কোন আক্কেল নেই! ছেড়ে দিয়ে এলে ছেলেমেয়েগুলোকে! এখন কী জবাব দেবো ওদের যদি কিছু হয়? মন্দিরার মা ফোন করেছিলেন! মেয়েগুলোর যদি কিছু হয়, মুখ দেখাবার জায়গা থাকবে না!” 
  সৌজন্যর বাবা বললেন “আমার জন্যই যখন এতো বিপদ, আমি এক্ষুণি পুলিশে খবর দেবো!” লালবাজারের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান মিস্টার পাকড়াশী সৌজন্যর বাবার বিশেষ বন্ধু। তাকেই ফোনে ধরলেন তিনি। সব কথা শুনে বেশ চিন্তায় পড়ে গেলেন মিস্টার পাকড়াশী! সোজা কথা নয়, সাত সাতটা ছেলেমেয়ে নিখোঁজ!
  মাঝরাতের পর, হঠাত একটা ফোন এলো সৌজন্যর বাবা সৌরভ চৌধুরীর কাছে একটা অজানা নম্বর থেকে “সৌরভ চৌধুরী বলছেন? আমি জিভাগোর হেড অনিকেত মল্লিক বলছি!” “কে আপনি? আমি তো চিনি না আপনাকে!” “আমার একটা প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সি আছে জিভাগো বলে! আমরা খবর পেয়েছিলাম লালবাজার গোয়েন্দা বিভাগ থেকে যে একটা খুব কুখ্যাত গ্যাং এর মাথা, কিছু সোনার বিস্কুট কলকাতায় এনেছিলো, কিন্তু সে ধরা পড়ে যায়। এখন সে জেলে। সে ভয় পাচ্ছিলো যে সে ধরা পড়ে যাবে। কারণ তার বিরুদ্ধে ইন্টারপোল রেড অ্যালার্ট ছিলো! শেষ মূহূর্তে সে তার বাড়ির কাছে একটা পুজো প্যান্ডেলে সোনার বিস্কুটগুলো লুকিয়ে রাখে আর কোথাও লুকোবার সময় ও সুযোগ না পেয়ে! পরে তার দল বিভিন্ন জায়গা থেকে প্ল্যান মতো কলকাতায় জড়ো হয়। তারা এখন হন্যে হয়ে বিস্কুটগুলো খুঁজছে। 

  সেই কুখ্যাত জালিয়াতটি ধরা পড়ার আগে, পাছে পুলিশে সেই পুজো প্যান্ডেলের নাম জেনে যায়, তাই কিছু চিরকুট রেখে যায় ধাঁধার মতো, যার সমাধান করতে পারলে ওগুলো পাওয়া যাবে। দলের লোকেরা তার কোন সমাধান করতে না পেরে, একটা ট্রেজার হান্ট অ্যানাউন্স করে কাগজে আর সেই সূত্রগুলো দেয় এক এক করে। যদি কেউ সমাধান করতে পারে তাহলে ওরা শেষে গিয়ে তাদের ধরে মালগুলো উদ্ধার করবে। আচ্ছা আপনাদের ছেলেমেয়েরা কি কোন ট্রেজার হান্ট সল্ভ করছিলো কদিন ধরে?” 
“হ্যাঁ! সে তো সেই কাগজে বেরোনোর পর থেকেই!” বললেন সৌরভ চৌধুরী। 
“হুম, দুয়ে দুয়ে চার! ছেলেমেয়েদের খুব বুদ্ধি! ওরা ধাঁধাগুলো সল্ভ করে ফেলে একে একে এবং প্রায় শেষে পৌঁছে যায়। সত্যি বলতে কি আমরা আর কেউ সেগুলো এতো তাড়াতাড়ি সল্ভ করতে পারিনি! বাচ্চাগুলো খুব বিপদজনক কাজে নেমেছে!  আজ সেই গ্যাংটাই ওদের কিডন্যাপ করেছে সম্ভবতঃ। আমরা আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ওদের খোঁজে বেরোবো। শুধু তাই না, আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট আকাশও অবশেষে ধাঁধাগুলো সলভ করে বাদামতলা অবধি বুঝে ফেলেছে। তার আগেই ছেলেমেয়েগুলো সেখানে পৌঁছে যায় এবং বিপদে পড়ে! কিন্তু এরপর শেষ সূত্র কী তা ওরাই জানে। আপনারা চিন্তা করবেন না। ওদের কোন ক্ষতি হতে দেব না।“ বলে সৌরভ চৌধুরী আর কিছু বলার আগেই ফোনটা কেটে দিলেন।
            
অন্ধকার স্যাঁতস্যাঁতে ঘরটায় বসে শীত শীত করছিলো নীলোৎপলের! হাতে সময় খুব কম। লোকটা রুটি চিকেন রেখে গেছে। খাওয়ার কোন ইচ্ছে নেই, তবু ওরা এক আধটা রুটি খেয়ে নিলো কারণ সবারই খুব খিদে পেয়েছিলো। মন্দিরা বললো “দেখলি? ব্যাটারা আমাদের অষ্টমীর দিন চিকেন খাইয়ে দিলো!” সুদক্ষিণা বললো “শাস্ত্রমতে নবমী পড়ে গেছে রে!” সৌজন্য বললো “এবার কাজের কথা হোক! নীলোৎপলদা তুমি কী পেলে শিবমন্দিরে বলো।“ “এইগুলো” বলে পকেট থেকে একগাদা আধ শুকনো ধুতরো ফুল বার করলো নীলোৎপল! সবাই অবাক হয়ে গেলো! তবে কি এটাই সূত্র? কিন্তু কী করে? 

  হঠাৎ কী মনে করে ফুল গুণতে লাগলো মন্দিরা। বললো 
“অংক যোগ দিলে পরে 
যতো নম্বর হয়
          ধুতরো ফুলের মাঝে 
আছে পরিচয়! 
  এবার অংকের মানে আলাদা! সূত্রটা আসলে আগের ধাঁধাতেই দেওয়া ছিলো মনে হচ্ছে রে! ভেবে দ্যাখ!” সবাই অবাক হয়ে তাকালো ওর দিকে। সত্যিই তো! কারো মাথায় আসেনি! ফুল গুণে গুণে ঠিক তেইশটা হলো। তাহলে? এটা কী কোন প্যান্ডেলের দিকে ইঙ্গিত করছে? হঠাত প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো শিবম “ভবানীপুর তেইশ পল্লীর পুজো! আমার বাড়ির কাছে! প্রত্যেক বছর যাই! জানিস ওখানকার ঠাকুর বিসর্জন হয় না! সোনালী রঙের পিতলের বিরাট দুর্গা! ওখানকার দুর্গামন্দিরে একদম প্রতিষ্ঠিত!” মন্দিরা বললো “হুম, সেই জন্যই তেইশ পল্লী!” “কী জন্য বলতো?” বললো উপল। “সম্ভবতঃ, যাই লুকোনো হোক, সেটা পুজোর অনেক আগেই হয়েছিলো। কারণ পঞ্চমী থেকে তো সূত্রগুলো সবাই পেতেই শুরু করলো! আর অন্য প্যান্ডেলে তো অতো আগে প্রতিমা ঢোকেই না। ফাঁকা প্যান্ডেলে কোথায় লুকোবে?” বললো মন্দিরা। নীলোৎপল বললো “কথাটা মন্দ না। কিন্তু শেষের প্যান্ডেলে জিনিসটা তো পঞ্চমীর পরেও লুকোনো যেতো, তাহলে আগে কেন?” 

  মন্দিরা বললো “সেটা একটা প্রশ্ন…তবে কি, যে লুকিয়েছে সে………” সৌজন্য বলে “সে… কী?” চুপ করে যায় মন্দিরা! বলে “উঁহু বুঝতে পারছি না রে। কী লুকিয়ে রাখা হয়েছে সেটাই তো জানি না! 

  “জিনিসটা কী জিনিস আর কোথায় রাখলো?” বললো সুদক্ষিণা। অভিজ্ঞান বললো “জিনিসটা নিশ্চই দামী! নইলে আমাদের কিডন্যাপ হতে হতো না!” হঠাত মন্দিরা বললো “আচ্ছা, তেইশ পল্লীর দুর্গা প্রতিমা সোনালী রঙের ঝকঝকে পিতলের বললি, না? তাহলে জিনিসটা সোনার কিছু নয়তো? সোনালী রঙের মধ্যে সহজে চোখে পড়বে না!” “উঃ তোর মাথাটা বাঁধিয়ে রাখতে হয়!” বললো সৌজন্য “মনে হয় সোনার কিছু লুকিয়েছে! আর ঠাকুরের গায়েই কোথাও লুকোনো আছে সেটা!” নীলোৎপল বললো “ঠাকুরের অস্ত্রের সঙ্গে হতে পারে, বেদীতে হতে পারে, সিংহ, অসুর, দুর্গার চার ছেলেমেয়ে, তাদের বাহন, যে কোন জায়গায় থাকতে পারে! খুঁজে বার করা শক্ত!” “উঁহু, অস্ত্রের সঙ্গে হবে না। অস্ত্র পরে পরানো হয়।“ বললো সুদক্ষিণা। নীলোৎপল বললো “দেখা গেলে চলবে না! তাই কারো হাতে বা গায়ে থাকার চান্স কম। অতএব পড়ে থাকে বেদী, সিংহ, অসুর! অথবা দুর্গার চার ছেলেমেয়ের কারো বাহন! এর চেয়ে বেশী এখন বোঝা অসম্ভব!”    

  সবাই নিশ্চিন্ত হলো! যাক কিছু সূত্র তো পাওয়া গেলো! কিন্তু ঠিক কোথায় থাকতে পারে সেগুলো? কথা বলতে বলতেই ঘরে ঢুকলো লোকগুলো। হাতে রিভলবার। ওদের দিকে তাক করা। সবাই বেশ ভয় পেয়ে গেছে! নীল জামা লোকটা দাঁত বার করে বললো ”হে হে! তোদের খুব বুদ্ধি! নির্ঘাত বার করে ফেলেছিস! বল এবার!” ওরা জানে চুপ করে থেকে লাভ নেই। নীলোৎপল বললো “আমরা প্যান্ডেলটা আন্দাজ করেছি। আর কিচ্ছু জানি না! আমাদের ছেড়ে দাও প্লিস!” “ম্যালা বকবক করবি না! ‘ছেড়ে দাও না!’ বলি তোদের ছাড়লে আমাদের মুন্ডু নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে!” বলে এক থাপ্পড় লাগালো নীলোৎপলকে! বাকীদের গা রাগে রিরি করছে। কিন্তু হাত পা বাঁধা! কিচ্ছু করতে পারবে না। “শোন! কাল নবমী! আমাদের সঙ্গে যাবি সেই প্যান্ডেলে! তারপর আমরা দেখে নেবো!”   

  সারারাত জেগে কাটালো হান্টার সেভেন! সৌজন্য বললো “আচ্ছা ওদের ভুল প্যান্ডেলে নিয়ে গেলে হয় না?” নীলোৎপল বললো “তাহলে ওরা আমাদের ছাড়বে ভাবছিস? এমন মার দেবে সে সহ্য করার ক্ষমতা তোর নেই! তার চেয়ে প্যান্ডেলে নিয়ে চল, তারপর দেখা যাবে। এতোদিন ধরে আমরা কষ্ট করছি। গোটা পুজোটা টেনশনে কাটলো, আর ফাইন্যালি কী আছে জানবো না? কৌতুহল হচ্ছে না তোদের? কেনই বা এরা আমাদের পিছনে লাগলো সেটা জানতে? ইশ, আমার ফোনটাও নিয়ে নিয়েছে ব্যাটারা, কাউকে কনট্যাক্ট করার উপায় নেই!” সবাই চুপচাপ শুনে গেলো। কারো মুখে কোন কথা নেই। 

  দুশ্চিন্তায় জেগে কাটলো হান্টার সেভেনের বাবা মায়ের। কী জানি পুলিশ কিছু করতে পারবে কী না? 

  জিভাগোর অনিকেত মল্লিকও সারারাত জেগে কাটালেন। মিস্টার পাকড়াশীকে অনিকেত বলে দিয়েছেন প্রতিটা পুজো প্যান্ডেলে যেন পুলিশ থাকে প্লেন ড্রেসে, খুব অ্যালার্ট হয়ে। কোন অস্বাভাবিক অ্যাকটিভিটি দেখলেই যেন খবর দেয়। যে করে হোক ওদের ধরে বাচ্চাগুলোকে উদ্ধার করতেই হবে। নীলোৎপলের টাওয়ার লোকেশন ট্র্যাক করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু যথারীতি ওর ফোন অফ। নির্ঘাত কেড়ে নিয়েছে। 

  সকাল হতেই লোকগুলো এসে ওদের মুখহাত ধুয়ে নিতে বললো । তারপর সাতজনকে ভাগ ভাগ করে দুটো গাড়িতে তুললো। তেইশ পল্লীর দুর্গামন্দিরের বেশ খানিকটা দূরে গাড়ি রেখে দুটো আলাদা গ্রুপে হাঁটিয়ে নিয়ে চললো ওদের। নীলোৎপলকে বললো “এই পালের গোদা, শোন, তোদের প্রত্যেকের দিকে কিন্তু বন্দুক তাক করা আছে! কোন চালাকির চেষ্টা করলে বিপদ আছে মনে রাখিস! সিধা হেঁটে পুজোমন্ডপে ঢোক!” পুজোমন্ডপে ঢোকার মুখেই একটা লোকের সঙ্গে চোখাচুখি হয়ে গেলো নীলোৎপলের। একদৃষ্টে ওদের লক্ষ্য করছে লোকটা! তবে কি কিডন্যাপারদের কেউ? আবার তাকিয়ে দেখলো লোকটা হাওয়া। “ডাল মে জরুর কুছ কালা হ্যায়।“ ফিসফিস করে বললো নীলোৎপল। পিছনে থেকে একটা লোক ওর পিঠে খোঁচা মেরে বললো “কী ফিসফিস করছিস? ঢোক ভিতরে!” 

  ভিতরে নবমী পুজো সবে শেষ হয়েছে! পুরোহিতমশাই এক কোণে বিশ্রাম নিচ্ছেন আর কাগজের কাপে চা খাচ্ছেন! পুজোর কর্মকর্তারা এক জায়গায় বসে গোল হয়ে আড্ডা মারছেন। একটু পরে অঞ্জলি শুরু হবে। তার জোগাড়যন্ত্রে ব্যস্ত মহিলারা। প্যান্ডেলে ইতি উতি ছড়ানো লোকজন। বেশী ভীড় নেই। সত্যিই দেখার মতো প্রতিমা! বোঝাই যায় না সোনার না পিতলের। ইতিমধ্যে ওদের গ্রুপের শিবম, মন্দিরা, সৌজন্য যারা আলাদা আসছিলো, তারাও ঢুকে গেছে। শিবম বললো “দেখেছিস, কী দারুণ প্রতিমা? প্রতি বছর এই সময় একবার পালিশ হয়।“ পিছনে গ্যাং এর লোকগুলো রাগী চোখে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। নীলোৎপল হাত নেড়ে বললো “একটু ধৈর্য ধরতে হবে। আমরাও জানি না কোথায় কী আছে। ঠাকুরের কাছে তাড়াতাড়ি পৌঁছনোর ব্যবস্থা করতে হবে, অথচ কেউ সন্দেহ করলে আটকে দেবে।“ ফিসফিস করে মন্দিরার কানে কানে বললো “তুই ছোটখাটো আছিস। এগিয়ে বেদীর কাছে চলে যা। এখানে সুবিধা হলো বেদী বেশী উঁচু নয়। যেন তুই প্রণাম করছিস এইভাবে বেদীর আসেপাশে কিছু আছে কি না দেখে আয় ঝট করে।“ ঘাড় নেড়ে আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলো মন্দিরা। কেউ ওকে লক্ষ্য করছে না। দুর্গার বেদীর সামনে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করতে করতে হঠাত ঘাড় উঁচিয়ে দেখে সামনেই সিংহের পিঠের ওপরে যেখানে দুর্গার পা, সেখানে বেশ কিছু ফুল বেলপাতা। ওগুলো হাত দিয়ে একটু সরাতেই কী একটা চিকচিক করে উঠলো! এমন সময় পিছন থেকে কে একটা চেঁচিয়ে বললো “এই খুকি ওখানে কী করছিস? ঠাকুরের অতো কাছে যাওয়ার নিয়ম নেই। চলে আয় পিছনে!” 

  তাড়াতাড়ি ভয় পেয়ে সরে এলো মন্দিরা। নীলোৎপলের পাশে এসে দাঁড়াতেই পিছন থেকে গ্যাং এর লোকটা বললো “কী দেখলি! বল শিগগির নইলে –“ তাড়াতাড়ি মন্দিরা বললো “কিছু না তো! আ-আমি তো প্রণাম করছিলাম!” “ঠিক আছে। আমরা দেখে নেবো!” বলে লোকটা আরেকটা লোককে বললো “এই ছোটন, এগুলোকে গাড়িতে নিয়ে বসা!” ছোটন লোকটা কড়া গলায় বললো “আমরা সার্চ করে নেবো অঞ্জলির পর প্যান্ডেল ফাঁকা হলে! তোরা গাড়িতে চল!” বলে আবার পিছনে বন্দুক ঠেকালো। ওরা চুপচাপ দুর্গামন্ডপ থেকে বেরিয়ে এলো। বেরোতেই দুদিক থেকে কতগুলো লোক খপ করে ধরলো লোকদুটোকে! আর একটি লোক হাসি মুখে ওদের সাতজনকে বললো “কোনো ভয় নেই। পুলিশের ভ্যানে গিয়ে বোসো।“ নীলোৎপল, উপল, সৌজন্য চোখাচুখি করলো! তবে কি এক বদমাশের দল থেকে আরেক দলের খপ্পরে পড়লো! কিন্তু এদের তো তেমন মনে হচ্ছে না! একটু এগিয়ে সত্যিই কয়েকটা পুলিশ ভ্যান! উঠে পড়লো ওরা। দেখাই যাক না, কী হয়! গ্যাং এর লোকগুলোকেও অন্য ভ্যানে তোলা হয়েছে। ততক্ষণে পুজো কমিটির লোকজন কৌতুহলে বাইরে বেরিয়ে এসেছে! যে লোকটা হাসি মুখে ওদের ভ্যানে উঠতে বলেছিলো, সে কমিটির লোকদের কী সব বলতে লাগলো! ব্যাস সবাই দৌড়ে গেলো ভিতরে! প্রচন্ড কৌতুহলে নীলোৎপল, সৌজন্য, মন্দিরা নেমে এসেছে ভ্যান থেকে! ওরাও ভিতরে গেলো! মন্দিরাকে হাসিমুখ ভদ্রলোক বললেন “তুমিই দেখিয়ে দাও তবে!” মন্দিরা গিয়ে সিংহের পিঠের ওপর যেখানে দুর্গার পা, সেখানে ফুল পাতা সরিয়ে বার করলো একটা সোনালী রঙের সরু লম্বা বাক্স! একেবারে সেঁটে আছে সিংহের পিঠে! সেটা খুলতেই ঝকঝক করে উঠলো অন্ততঃ তিরিশটা সোনার বিস্কুট! হাসিমুখ লোকটি পুজো কমিটিকে বললো “আমার নাম অনিকেত মল্লিক। আমি প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সি জিভাগোর মালিক। আন্তর্জাতিক বাজারে এর দাম কতো হবে বলুন তো? কয়েক কোটি টাকা! বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়ে ঢুকেছে সীমান্ত দিয়ে পুজোর কিছুদিন আগে! ওগুলো কেন ও কী করে এখানে এলো সে আরেক লম্বা গল্প! বলবো সবাইকে! তবে তার আগে এদের বাবা মার কাছে পৌঁছে দিতেই হবে! এরা না থাকলে এই রহস্য পুলিশ সমাধান করতে পারতো না। জিনিসগুলো বদমাইশদের খপ্পরেই পড়তো! 

  গাড়িতে উঠে নীলোৎপল অনিকেত মল্লিককে জিজ্ঞাসা করলো “আঙ্কল আপনি এখানে এলেন কী করে?” অনিকেত পাশের ছেলেটিকে দেখিয়ে বললো “এর নাম আকাশ! এরও তোমাদের মতো বুদ্ধি! আমার সঙ্গে কাজ করে। সব প্যান্ডেলেই পুলিশ পোস্ট করা হয়েছিলো সৌজন্যর বাবা কাল গোয়েন্দা দফতরে মিস্টার পাকড়াশীকে ফোন করার পর।  এই প্যান্ডেলেই যে পাওয়া যাবে তা জানতাম না। কিন্তু আকাশ বললো “স্যার, সোনার জিনিস সোনালী রঙের কিছুর সঙ্গে রাখা থাকলে চোখে পড়বে না! তারপর প্যান্ডেল আর প্রতিমা এ বছর কোথায় কীরকম হয়েছে খোঁজ নেওয়া হলো। সোনালী রঙের দুর্গা এই একটিই। তা ছাড়া এদের গ্যাং লিডার ধরা পড়ার আগেই এগুলো লুকিয়েছিলো। তাই সেটা পুজোর বেশ কয়েকদিন আগেই, ইন ফ্যাক্ট মহালয়ার আগে করা হয়। আর এতো আগে দুর্গা শুধু এখানেই থাকা সম্ভব। বাকী জায়গায় পরে ঠাকুর আসে। এই সব ভেবে আমি আর আকাশ এই প্যান্ডেলে ছিলাম। ঢোকার সময় আকাশের চোখে পড়ে কয়েকটি ছেলেমেয়ে ঢুকছে আর একজনের পিঠে লুকিয়ে বন্দুকের নল ধরে আছে আরেকটি লোক! ব্যাস! এই ঈশারা পেতেই মিস্টার পাকড়াশীকে ফোন করে পুরো ফোর্স এখানে পাঠানো হয় আর ধরা পড়ে গ্যাংটা! তোমাদের তারিফ যতো করা হয় কম! খুব সাহস আর বুদ্ধি তোমাদের! তোমরা ট্রেজার হান্টের গিফট পেলে না বটে, কিন্তু পুলিশ থেকে তোমাদের স্পেশাল প্রাইজের ব্যবস্থা আমি করবো! সবাই একসাথে বললো “হিপ হিপ হুররে! থ্রি চিয়ার্স ফর হান্টার সেভেন!” 
(শেষ)


চন্দ্র-কুকুর ও চন্দ্রগ্রহণ
(মায়ানমারের প্রচলিত রূপকথা)

দীপক কুমার মাইতি

মায়ানমারের উত্তরভাগের রাজ্য কাছিন।  হাকাকাবোরাজি এখানকার উচ্চতম পর্বত। এর পাদদেশে লিসু উপজাতির মানুষরা বাস করে। বহুযুগ আগের কথা। মেঘ তখন একটা গামলার আকারে দেশটাকে ঢেকে রাখত। লিসুদের নাগালের মধ্যে থাকত মেঘরাজ্য। মেঘরাজ্যে তখন বাস করত ন্যাটস দেবতারা। প্রধান দেবতা ছিলেন থ্যাগিয়ামিন। এই দেবতাদের এক একজন ছিলেন মাটি, জল, বাতাস, মেঘ, পাহাড়,নদী, অরণ্যের নিয়ন্ত্রণকারী দেবতা। থ্যাগিয়ামিন মানুষদের সাহায্য করতে ভালোবাসতেন। লিসুরা ইচ্ছে করলেই হাকাকাবরাজি পর্বতে চড়ে মেঘরাজ্যে যেতে পারত। সহজেই দেখা করতে পারত দেবরাজ থ্যাগিয়ামিনের সাথে। লিসুরা বিপদে পড়লেই তাঁর সাহায্য প্রার্থনা করত। তাঁর হুকুমে অন্য দেবতারা লিসুদের সাহায্য করতেন।

  একবার প্রচণ্ড গরম পড়েছে। লিসুরা গরমে কাহিল। তারা পাহাড়ে উঠে সোজা  থ্যাগিয়ামিনের কাছে পৌঁছায়। গরমে তাদের কষ্টের কথা নিবেদন করে। প্রতিকারের আর্জিও জানায়। দেবরাজ থ্যাগিয়ামিনের হুকুমে মেঘের দেবতা মেঘ দিয়ে ছায়া সৃষ্টি করলেন। বৃষ্টির দেবতা বৃষ্টিপাত ঘটিয়ে শীতলতা প্রদান করলেন। দূর হল প্রচণ্ড দাবদাহ। বেশ আরামে ছিল লিসুরা। গোল বাধল নিজেদের দোষে। সেবার একদল লিসু গেছে বৃষ্টির হওয়ার ও আর একদল গেছে বৃষ্টি না হওয়ার আবেদন নিয়ে। শুরু হয়ে গেল নিজেদের মধ্যে ঝগড়া। থ্যগিয়ামিনের সামনে নিজেদের মধ্যে মারামারি শুরু করল। তাই দেখে রেগে গেলেন দেবরাজ থ্যাগিয়ামিন। মেঘরাজ্যকে মানুষের নাগালের বাইরে অনেক উঁচুতে তুলে নিয়ে গেলেন। শুরু হয়ে গেল মানুষ ও দেবতার দূরত্ব। লিসুরা তখন খুব কষ্টে। তাদের আর সাহায্য করার কেউ নেই। লিসুরা ছিল চন্দ্র উপাসক। ন্যাটস দেবতারা রুষ্ট হয়েছেন। তারা চন্দ্রদেবের স্তব করতে থাকে। চন্দ্রদেব সন্তুষ্ট হন। চন্দ্রদেব বললেন, “আমি তোমাদের সাহায্য করতে পারি। তোমরা একটি বড় লম্বা সিঁড়ি তৈরি কর। সিঁড়ি বেয়ে চন্দ্রলোকে আসতে হবে। তবে এখানে আসতে হলে দুটো শর্ত মানতে হবে। প্রথম শর্ত হল, তোমাদের প্রতিনিধি হয়ে কেবল মাত্র একজন চন্দ্রলোকে আসতে পারবে। দ্বিতীয় শর্ত - সিঁড়ির নিচে একটি গরম জলের পাত্র ও দুটি প্রজ্জ্বলিত প্রদীপ রাখতে হবে। চন্দ্রলোক থেকে প্রতিনিধি ফিরে আসা পর্যন্ত জল গরম রাখতে হবে ও প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখতে হবে। শর্ত ভঙ্গ হলেই সিঁড়ি ভেঙে ধ্বংস হয়ে যাবে। তোমাদের জন্য চন্দ্রলোকের দুয়ার চিরকালের জন্য বন্ধ হয়ে যাবে।”

  একবার লিসু গ্রামে শুরু হল ভালুকের উপদ্রব। রাতে ভালুকের দল জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসত। ঢুকে পড়ত গ্রামে।  মানুষ ও গৃহপালিত পশু তুলে নিয়ে তাদের খেয়ে ফেলতে লাগল। ভয়ে দিশেহারা লিসুরা। ঠিক করল চন্দ্রদেবের কাছে তাদের প্রতিনিধি পাঠাবে। সকলে মিলে একটি বিশাল সিঁড়ি বানাল। লিসুদের সবচেয়ে বড় বীরকে প্রতিনিধি নির্বাচন করল। সিঁড়ি বেয়ে বীর চন্দ্রদেবের কাছে পৌঁছে গেল। চন্দ্রদেব সন্তুষ্ট হয়ে একটি হিংস্র কুকুরকে দিয়ে বললেন, “এই কুকুর সব ভালুককে মেরে জঙ্গলে তাড়িয়ে দেবে। ভালুকরা আর কোনদিন লোকালয়ে আসবে না। তোমাদের কাজ হয়ে গেলে আমার কুকুরকে ফেরত দিয়ে যাবে।”
চন্দ্র-কুকুর লিসু গ্রামে এসে ভালুকদের আক্রমণ শুরু করে। প্রথমে ভালুকরা ভেবেছিল একটা কুকুর কী আর করতে পারবে! কিন্তু হিংস্র চন্দ্র-কুকুরের সাথে ভালুকরা পেরে ওঠে না।  অনেক ভালুকের প্রাণ যায়। ভালুকরাজ চন্দ্র-কুকুরের কাছে সন্ধির প্রস্তাব দেয়। চন্দ্র-কুকুর বলে, “তোরা কোনদিন লোকালয়ে এসে মানুষের ক্ষতি করতে পারবি না। গভীর জঙ্গলেই থাকবি। তবেই তোদের ছেড়ে দিতে পারি।”

  চন্দ্র-কুকুরের কাজ শেষ। লিসু বীর সিঁড়ি বেয়ে চলেছে চন্দ্রলোকে তাকে ফিরিয়ে দিতে। সকলের মন খারাপ। চন্দ্র-কুকুর সান্ত্বনা দিয়ে বলে, “চন্দ্রদেবের গায়ে আমার ছাপ দেখে বুঝবে আমি তোমাদের পাশে আছি। চন্দ্রলোকের পিছনের দিকে আমার বাস। যে দিকটা তোমরা দেখতে পাওনা। তবে বছরের কোন এক পূর্ণিমায় আমি তোমাদের খোঁজ নিতে আসব।”
লিসু বীর চন্দ্রলোকে গিয়ে চন্দ্র-কুকুরকে ফেরত দেয়। তখনই ঘটে বিপত্তি। প্রতিদিন একজন লিসু গরম জলের পাত্র ও প্রদীপের নজরদারি করত। সে রাতে নজরদার ঘুমিয়ে পড়ে। সকালে ঘুম ভাঙতে নজরদার দেখে গরম জলের পাত্রের জল ঠান্ডা হয়ে গেছে। লোকটি ভয়ে পাত্রের জল ফেলে তাতে নতুন গরম জল ঢালে। কিন্তু তাড়াহুড়োতে সে জ্বলন্ত প্রদীপে জল ঢেলে দেয়। প্রদীপ নিভে যায়। সঙ্গে সঙ্গে সিঁড়িটি হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে। উঁচু থেকে লিসু বীর মাটিতে পড়ে যায়। সে মারা যায়। চন্দ্রদেব রুষ্ট হন। তিনিও ন্যাটস দেবতাদের মতন অনেক উঁচুতে চলে যান। লিসুরা মুষড়ে পড়ে। তারা ঠিক করে তারা খুব সাবধানে থাকবে। দেবতারা রুষ্ট  হন এমন কোন কাজ করবে না । দেবতারা যেন একদম তাদের না ছেড়ে যায়।
 
 এক পূর্ণিমায় চন্দ্র-কুকুর লিসুরা কেমন আছে দেখতে আসে। তখন চাঁদের উজ্জ্বল আলো চারিদিকে ঝলমল করছে। দূর থেকে চন্দ্র-কুকুর তীব্র আলোয় কিছু দেখতে পায় না। সে একটি চাদর এনে চাঁদকে ঢেকে দেয়। চারিদিক অন্ধকার হয়ে যায়। লিসুরা ভয় পেয়ে যায়। ভাবে, চন্দ্রদেব নিশ্চয়ই তাদের উপর রুষ্ট হয়েছেন। তিনি আকাশ থেকে তাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। তারা শাঁখ, করতাল যোগে উচ্চ স্বরে চন্দ্রদেবের স্তব করতে থাকে। চন্দ্র-কুকুর ভাবে লিসুরা সুখে আছে। তাই আনন্দে নামগান করছে। সে চাদর সরিয়ে নেয়। আবার আগের মতন লিসু গ্রাম চাঁদের আলোয় ঝলমল করে ওঠে। লিসুরা স্বস্তি পায়। 

  সেই থেকে লিসুরা চন্দ্রগ্রহণের দিন এখনও উচ্চস্বরে চন্দ্রদেবের নামগান করার রীতি বজায় রেখেছে।




তিতিরের পুজোর আনন্দ

সুস্মিতা সাহা 


আর ক'দিন?' এক, দুই, তিন, চার- হাতের কর গুনে গুনে তিতির বলে, 'ওমা মা, আর পঁয়তাল্লিশ দিন বাকি গো পুজো আসতে, কি মজা কি মজা। 'কিন্তু এখনো তো তিতিরের হলুদ রঙের শাড়ি কেনা হোলো না। এবারে তো তিতির অষ্টমীর সকালে শাড়ি পরে অঞ্জলি দেবে। নাহ্ বাবা যে কবে আসবে কলকাতা থেকে? বাবা বলেছে যে এবার তিতিরের শাড়ি নিজে কিনে আনবে। সঙ্গে মাথার রঙিন রিবন, হাতের চুড়ি গলার হার সব। আর আনবে ট্রেনের কালো কমলা ও সবুজ ঝাল ঝাল লজেন্স।এর মধ্যেই তিতিরের বন্ধুরা জেনে গেছে কিনা। ওদের জন্য তো লজেন্স বেশি বেশি করে আনতে বলেছে আর আছে সবিতা মাসির ছেলে বিকু। সবিতা মাসি খুব ভালবাসে তিতিরকে। বিকেলের দিকে যখন কাজ করে ফেরে তখন তিতিরের জন্য কারো গাছের ডাশাঁ পেয়ারা, কারো গাছের কাঁচা আম কোচঁড়ে মুড়ে নিয়ে আসে। তারপর পা ছড়িয়ে বসে ওদের বাড়ির উঠোনের এক কোণে, একটু বিটনুন, একটু চিনি, সামান্য কাঁচা লঙ্কা কুচি দিয়ে ভালো করে মেখে হাতে হাতে খাওয়া তিনজনে মিলে- বিকু, তিতির আর সবিতা মাসি। মা কখনো প্রদীপের সলতে পাকাতে পাকাতে, কখনো আচারের বয়াম রোদ খাইয়ে তাকে তুলতে তুলতে বলে, ' সবিতা, না বলে আনো নি তো এসব? এরকম কোরো না। আর আমার মেয়েকে দিও না।'''আরে বৌমনি, আমারে তো ডেকে ডেকে দিলো ও বাড়ির মেজগিন্নিমা। বিশ্বেস করেন, আমি কি চুরি কইরা বাচ্চা গো দিমু নাহি?''''আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে, যাও এবার ঘরে গিয়ে বিকুর হাত পা ধুইয়ে ওকে পড়তে বসাও তো। ওকে তো এবার স্কুলে ভর্তি হতে হবে।''
কেমন একটা কাঁচা হলুদের মতো রোদ উঠেছে না আজ সকালে। ঘুমটা ভেঙে গেল তিতিরের ভোরে ভোরে, একটা গান শোনা যাচ্ছে না! হ্যাঁ তিতির ঠিক জানে অষ্টমী মাসি ওর ছোট্ট বোনকে নিয়ে এই সময়ে আসে প্রত্যেক বছর মা দুগগার গান গাইতে গাইতে। শিউলি ফুলের গন্ধ মাসির সাদা লাল শাড়িতে।
''ওমা মা, দাও না একটু চাল ডাল।''
বাব্বা সাতসকালে উঠেছিস যে বড়ো, আমি দিয়ে এসেছি সিধে অষ্টমীকে। যা দ্যাখ গিয়ে বারান্দায় বসে চা খাচ্ছে দুই বোনে।

  পুজো তার মানে এসেই গেল- কই বাবা এখনো কোন খবর দিলো না তো- কবে আসবে তুমি বাবা? সব বন্ধুদের পুজোর নতুন জামা হয়ে গেছে তো। মহালয়ার আগের রাত নেমে এসেছে - মায়ের চোখটা থেকে থেকে ছলছল করছে। তিতির জানে যে দাদাইয়ের জন্য মায়ের মন খারাপ হয়ে যায় এই দিনে। 
রাতের দিকে শিউলি ফুলের গন্ধ ভেসে আসছে খুব - কেমন মা মা গন্ধ চারদিকে। মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে তিতির। ''মা তুমি কাঁদছো? আর কষ্ট কোরো না মা। দাদাই তো তারা হয়ে গেছে আকাশে বলো।''

  কালকে সবাই তো ঠাকুর দেখতে যাবে বলছে। পুরোনো জামা পরেই কি যাবে তিতির? চোখে জল ভরে আসে তিতিরের। 

  ঢাক বাজছে - আরে আজ তো সপ্তমী। কিন্তু? 
''তিতির, তোর বাবা খবর পাঠিয়েছে রে, আজকে রাত হয়ে যাবে বাড়ি আসতে আসতে।'' 
মুখটা কালো হয়ে যায় মেয়ের - তবুও চুপ করে বাগানে দাঁড়ায় সে। 
''এই যে তিতির সোনা, এই নাও তোমার চুলের রিবন, জামা, আর এই তোমার হজমি লজেন্স।''
বাবার সঙ্গে কথা বলবে না তিতির, একদম না। এতো রাত করে আসতে হয় বুঝি? 

  '' অভিমান করে না তিতির, জানো কেন আমি আসতে পারি নি আগে? এই যে দেখছো করোনা নামের একটা খুব দুষ্টু ভাইরাস আমাদের সকলের জীবন একেবারে অসুস্থ করে দিচ্ছে।তারপর ঝড়,বৃষ্টি সব মিলে খুব খারাপ অবস্থায় আছে মানুষ। আমরা কয়েকজন মিলে কিছু জনকে এই তিনমাস রোজ অল্প কিছু খাবার দিয়েছিলাম। পুজোর সময়ে নতুন জামা পেয়ে কি হাসি ওদের চোখে মুখে।
  আমি তো জানি আমার সোনা মা খুব খুশি হবে এই কথা শুনে। এবার আর বাবার উপর রাগ নেই তো?'' 
সবিতা মাসি বিকুকে নিয়ে আজ নতুন জামা কাপড় পরে মা দুগগার মুখ দেখছে। 

  তিতিরও তিতিরের মা বাবার সঙ্গে আজ ঠাকুর দেখতে বেরিয়েছে। ও হ্যাঁ মাস্ক পরে কিন্তু সবাই। 
ঐ দুষ্টু ভাইরাসটা আশেপাশেই আছে যে।
তবে মানুষের মুখে হাসি আছে আর মনে আছে জোর। 
এবার তিতিরের মন খুশ - খুব খুশি।




নামায়ন 

অয়ন বন্দ্যোপাধ্যায় 


এক

হোন্ডাগাড়ির গুন্ডা ছেলে

ডান্ডা নিয়ে ছোটে—

কান্ড দেখে চন্ডীখুড়োর

মুণ্ডু ঘুরে ওঠে!


দুই

বঙ্কুবাবু কুংফু শিখে

শঙ্কা গেলেন ভুলে—

শঙ্কুকাকা মংপু থেকে

কম্পু পাঠান স্কুলে!


তিন 

বুল্‌টি এলো কুলটি থেকে

 Foolটি হয়ে ভোরে... 

ভুলটি ছিল চুলটি খোলা

দুলটি গেছে প’ড়ে... 


চার

টুম্পাদিদি ঘুমপাড়িয়ে

দুমকা যাবেন ট্রেনে—

গুম্ফা ঢুকে পালাইলামা

দুম্বা আনেন টেনে! 



পাঁচ

জন্তু দেখে হন্তদন্ত

সন্তু ফেরে বাড়ি—

অন্তুপিসে তিনতুড়িতে 

পান্তুয়া চার-হাঁড়ি!


ছয়

হুমকি শুনে চুমকিমাসির

ঘুমটি গেল সবে—

রুমকি কোথা? রুম কি ফাঁকা?

গুম কি হল তবে?


সাত

ষণ্ডা সে-লোক মণ্ডামিঠাই

গণ্ডা গণ্ডা খায় ধারে... 

ফান্ডা যে তার ভন্ডামিটাই

বাকবিতণ্ডা তাই বাড়ে! 


আট

জঙ্গল ফুঁড়ে মঙ্গলডাকু

দঙ্গল নিয়ে হাজির

চম্বল থেকে এসেছে পাজিরা

সম্বল নেবে? হাঁ জি!


নয়

গুপ্তমশাই খুব তো লেখেন

লুপ্ত প্রাণীর ‘থিসিস’

সুপ্ত ছিলেন মুক্ত-মনে

স্বপ্নে হাজার ‘স্পিসিস’... 


দশ

ছবি আঁকে অভিরাম

‘হবি’ খুবই প্রিয়

কবিতার মতো সবই?

তবে কিনে নিও! 


এগারো

লঙ্কার ঝাঁঝে ওঙ্কারপিসে

হুংকার দিয়ে ধমকায়

তড়পানি শুনে মহা-আতঙ্কে 

কংকালও ভাগে রণপায়! 


বারো

সম্পদ নিয়ে চম্পট দিল

সম্পতলাল সাউ

সম্পত্তি কি কম পড়ছিল! 

গায়ে-গত্তির লাউ! 


তেরো

কন্টক যদি পায়ে বিঁধে যায়

হন্টন দেবে কীকরে!

মণ-টাক তুলো ব্যান্ডেজে-মুড়ে

বন্টন করো ভিতরে! 


চোদ্দ

মন্দ বলেনি পুরন্দর-দা

‘মন-দিয়ে-পড়া ফল দেয়’

সন্ধে-সন্ধে মন্দিরে যাওয়া

অন্তর-বুকে বল দেয়


পনেরো

দরজা খুলে চর্যা এল

ঘর যাবে না সে-আর!

বাইরে কুকুর তরজা-করে

গর্জায়—‘নট ফেয়ার’!


ষোলো

‘নামায়ন’ লিখে হ্যাঁ, অয়নবাবু

কুমায়ুন গেল ঘুরতে—

খোলা বাতায়ন, ইতিহাস-বই

হুমায়ূন বলে, ‘সুর দে’


 



নামকরণ

শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়

 

খোকা গেল করতে শিকার

মোষের পিঠে চড়ে

হাঁসটা দেখে ছুঁড়ল তীর 

কাকটা গেল মরে।

 

বলল খোকা বনভোজনে

সেই মাংসই খাবে

এবার থেকে কাকগুলোকে

ডাহুক ডাকা হবে।

 

নামের ফেরে জগৎ ঘোরে

নামেই পরিচয়

আমকে যদি আমড়া বলি

কীই বা ক্ষতি হয়?

 

চালকে যদি চালতা বলি

ফ্যানটা গেলে নেব;

কাকের মাংস লাগলে তেতো 

প্রথম পাতে খাব।




শারদ শব্দজব্দ
নির্মাতা:  সুব্রত দেব

সূত্র:
পাশাপাশি:  ১)  পত্নী পরিচয়ে শিব, দেবীকে যিনি ত্রিশূল দান করেন ৫) ---- দেহি ৭) অন্য নামে দেবী দুর্গা, পথের পাঁচালীর দুর্গা জননী ৯) দেবী দুর্গা; ত্রি ---- ১১) বিষ্ণুর এক অবতার ১২) এই দিনেই গঙ্গা পুজো ১৩) লঙ্কার রাজা রাবণ,যাঁকে  বধের জন্য অকালবোধন ১৪) দেবীকে কমন্ডলু প্রদানকারী দেব ব্রহ্মা

উপর নিচ:
১) দেবীর দক্ষিণে লক্ষ্মী ৩) অন্য নামে মা দুর্গা
৪) বাহন পরিচয় দেবী সরস্বতী ৬) অসুর বিনাশ করে দেবী হলেন ---৮) একান্ন পীঠের অন্যতম: '---- স্থল '
মনে না পড়লে ' লোক ' বসিয়ে দাও
১০)এই ফুল শরতের প্রতীক ১১) অভয়দান এর মুদ্রা
১২) পুজোর শেষ দিন 


খুকুর চিঠি

সমাদৃতা রায়
নবম শ্রেণী, উত্তরপাড়া গার্লস হাই স্কুল, হুগলি


নীল আকাশের কাছে গেলো
প্রথম চিঠি আমার
বললাম খুবই হতো ভালো
হতাম যদি যমজ বোন তোমার।
বরণে হতাম নীল
মোর বুকে উড়ত শত শত চিল।
জুড়ে পৃথিবীর দিগন্ত রেখা।
আমায় যেত দেখা।।
 সাদামেঘের ভেলার কাছে গেলো
দ্বিতীয় চিঠি আমার
বললাম খুবই ভালো হতো তোমার মত করতাম যদি
দেশে দেশে পারারার।।
বরণে হতাম সাদা তুলোর মতো।।
তোমার সাথেও খেলা করতাম যত।।
কেউ দিত না বকুনি কেউ করতো না মানা। ।
তোমার কথা আগে থেকেই আছে মোর জানা।।
আকাশ বা মেঘ আমায় ডাকো তুমি ।।
ইতি তোমাদের বন্ধু রুমি।।


রামুর দুষ্টুমি

সমাদৃতা হালদার
অষ্টম শ্রেণী, পাঠভবন, কোলকাতা

রামু পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে। সে বাবামায়ের কথা শুনলেও পড়াশুনোয় ভাল রেজাল্ট করতো না। বিশেষ করে অঙ্ক আর বাংলায় কোনদিন ভাল নম্বর পেতো না। পড়াশুনোয় ভাল ছিল না বলে ওর বাবা রামুকে অনেক টিউশনে দিয়েছে। তাতেও রামুর একই দশা! কারণ রামু যেখানে পড়তে যেত সেখানে গিয়ে ও ঘুমিয়ে পড়তো। এজন্য রামুর দিদিমণিও ওকে আর পড়ায় নি। সে স্কুলে যাওয়ার নাম শুনলে হয় অসুস্থতার ভাণ করে বা বাইরে গিয়ে খেলা করে। 

  সেবার ঘটেছিল আর এক কাণ্ড। রামু আর কিছু না হারালেও জলের বোতল হারাবেই। তা রামুকে ওর বাবা আবার একটা নতুন বোতল কিনে দেয়। সে বারে ওর স্কুলে পরীক্ষা চলছিল বলে ওকে স্কুলে যেতেই হয়েছিল। স্কুল থেকে বেরোবার সময় ও দেখে নিয়েছিল ওর বোতলটা আছে কি না। কারণ বাবা বলে দিয়েছে এবার হারালে আর একটা বোতলও কিনে দেবে না। রামু প্রত্যেক দিন স্কুল শেষ হলে মাঠে চলে যায় ওর বন্ধুদের সাথে ফুটবল খেলতে। কিন্তু ওখানে গিয়ে হলো আর এক কাণ্ড। ওর বন্ধু অভিজিৎ ইয়ার্কি করে রামুর পায়ে পা দিয়ে দেয়। ব্যস্...রামু গেল রেগে। শুরু হলো হাতাহাতি। তারপর এ ওকে ধরে মারে, তো ও একে ধরে মারে। যখন পাখিরা সন্ধ্যের বিছানা টেনে দিলো, তখন ওরা মারপিট ছেড়ে, একে অপরের নিন্দা করতে করতে খেলার মাঠ ছেড়ে বাড়ি চলে গেলো। এর ফাঁকে কখন যে জলের বোতল নিতে ভুলে গেছে, খেয়াল নেই। রাতে ওর বাবা যখন ওকে বোতলের কথা জিগ্যেস করলো, ওর তো তখন অবস্থা খারাপ! সেটা আর পাওয়া গেল না। অগত্যা ফের বেধড়ক পিটুনি পড়লো। মা সেদিন না ঠেকালে আরও কত ঘা পড়তো, কে জানে। ওর পাশে শুয়ে মা ওকে অনেক করে বোঝাল, আদর করলো। 

  এরপর থেকে রামু আর কোনদিনই জলের বোতল হারায় নি কিংবা স্কুল কামাই করে নি। তার রেজাল্টও ভাল হতে লাগলো।

  এখন রামু পুলিশে চাকরি করে। ছোটবেলার কথা মনে পড়লে চোখে জল আসে। 'হাজার চেষ্টা করলেও ছোটবেলার দিনগুলো ফিরে পাওয়া যায় না।' মনে মনে বলে রামু।


গণপুরের রাজবাড়িরহস্য  

শ্রীকান্ত অধিকারী 

রাঙাপিসির মামাশ্বশুরের বাড়ি গণপুর । গণপুরের রায়চৌধুরি বাড়ি। ওই তালুকের রাজবাড়ি। সেই রাজবাড়ি থেকে এবারের দুর্গাপুজোর নেমন্তন্ন। একদিন নয় দু’দিন নয় পাক্কা চারদিনের প্যাকেজ। সেই প্যাকেজে মা বাবা ছোটু অঞ্জন সবাই ছুটি কাটাতে সেই শহর থেকে গণপুরে রায়চৌধুরিদের রাজবাড়ি । যে সে পুজো নয় একবারে রাজাদের বাড়ির পুজো। খাওয়া দাওয়া থেকে জমজমাট পুজোর অনুষ্ঠান। কত কত মানুষজন পুজো দেখতে আসবে । শোনা যায় ওই পুজোর প্রসাদ নাকি প্রথমে বনের যে কোনও পশুকে খাওয়ানো হয় । আগে ওই পশু খাবে তবে মানুষে খেতে পাবে। শুনেই ছোটুর গা শিউরে ওঠে। সত্যি নারে দাদা ? 
আমি ঠিক জানি না রে। ওটা রাঙাপিসি জানে।পুজোতে তো রাঙাপিসি যাচ্ছেই , জিগ্যেস করে নিস।--দাদা বলে।   

কত কথা যে মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে।ছটফটিয়ে ওঠে ছোটু। 

  পরদিন দু’ভাই বোনে বাবা মায়ের সঙ্গে হাজির গণপুরের রায়চৌধুরির রাজবাড়িতে । পিচ রাস্তা থেকে সোজা লালামাটির মাঝে ঢালাই রাস্তা ধরে নামতেই জঙ্গল আঁকড়ে ধরল ওদের। শুধু বিশাল বিশাল শালগাছ আর ছোট ছোট ঝোঁপে ঢাকা পড়েছে এই রাস্তা। মাঝে মাঝে রাস্তা থেকে সংকীর্ণ শাখা লালমাটির রাস্তা বেরিয়ে আবার এ পাশে ওপাশে জঙ্গলের ভেতরে ঢুকে পড়েছে।ছোটু ওর দাদার গা ঘেঁষে জানালা দিয়ে বাইরে চোখ রাখে। বেশ কিছুটা যেতেই জঙ্গল পাতলা হতে শুরু করে । ঠিক তখনি বাবা বলে দাঁড়াও দাঁড়াও । গাড়ি থমকে দাঁড়ায়। মা বলে , এই বনের মধ্যে গাড়ি থামালে কেন, টয়লেট ফয়লেট পেয়েছে নাকি ? 
-- নামো । একটা জিনিস দেখায়। ওরা নামতেই বাবা হাঁটতে শুরু করে। পেছন পেছন ওরা । কিছুদূর যেতেই দেখে একটা ঢিবি । ভালো করে দেখলে বোঝা যায় আগে কখনও এখানে চার দেওয়ালের কোনো বাড়ি ছিল । এখন ঢিবির আকার নিয়েছে । তার ওপর আগাছা লতাপাতার জঙ্গল । তবে এখন পাথরের খুঁটো পোঁতা । বাবা বলল প্রণাম কর। খুব জাগ্রত কালী । ডাকাতে কালী ।এক সময় জঙ্গলের  মধ্যে ডাকাতেরা থাকত । ডাকাতি করার আগে মাকে পুজো দিয়ে বলি দিয়ে তবে বেরোতো। মানুষ বলি ।  
একে জঙ্গল । ছায়া ছায়া । ওরা ছাড়া কেউ কোত্থাও নেই। তাতে আবার ডাকাতে কালী মা । মানুষ বলি! গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল ছোটুর। 
মা বলল ঠিক আছে ঠিক আছে । এবার চল দেখি। দ্রুত ছোটুর হাত ধরে গাড়িতে চেপে বসল । 
বাবা গাড়ির সিটে এলিয়ে বসতে বসতে ফিসফিস করে বলল , ভয় পেলে বুঝি। এটা জঙ্গলের পূর্ব দিকের সম্মুখের অংশ । পেছনের দিকে আর একটা । বহুদিন ধরে পড়ে আছে। বছরে একবার মাত্র পুজো হয় মাঘ মাসে।   ফিরে আসার সময় না হয় দেখা যাবে। 
রাজবাড়িতে পৌঁছানো অব্দি মা আর কোনও কথা বলল না । 
 
পুরোনো রাজবাড়ি । তবে এখনও তোরণ দুটি দাঁড়িয়ে থাকার অবয়ব রয়েছে।মাথায় কোনও বাঘ , সিংহ বা হাতি নেই । দুটো বিশাল আকারের পাগড়ি পরা গোঁফওলা লোক হাতে তরোয়াল উঁচিয়ে আছে। তোরণ থেকে পায়ে হেঁটে সিংহ দরজা পেরিয়ে মূল রাজবাড়ি , এখনও সুন্দর ভাবে বর্তমান। তবে পুজো উপলক্ষে নতুন রং করা হয়েছে ।  
দাদা বলল ঐ দ্যাখ ।  
ঘাড় ঘোরাতেই ছোটুর চোখ চড়কগাছ। মা ভবানীর মন্দির। মূর্তি নেই । তবে কারুকার্যখচিত এক সুন্দর দেবালয়। দরজা সরু । মন্দিরে ঢোকার মুখে দরজার মাথায় টেরাকোটার কাজ ।ছোটু হাঁ করে তাকিয়ে দেখতে দেখতে কানে আসে কে যেন ভারী গলায় বলে ওঠে ওগুলো চন্ড বধের ছবি । শুম্ভ নিশুম্ভের সঙ্গে মা দুর্গার যুদ্ধের ছবি।  টিভিতে দেখিস না মহালয়াতে কেমন দেবী দুর্গা মহিষাসুর বধ করে । সেই ছবি । ছোটু চমকে ওঠে –রাঙাপিসি !
ও রাঙাপিসি এখানে ওই পাথরের খুঁটো কই ? দেখছিনা তো । এখানে বলি হবে না? 
--না না এখানে বলি হয় না। বলি দেওয়া বারণ । ভবানীমা রাগ করেন । 
--তবে যে ওখানে দেখলাম। 
--কোথায় ? 
ওই যে ডাকাতেকালীমার ভাঙা মন্দিরে । 
-- ওর মা কোত্থেকে দ্রুত এসে বলে , ওর বাবার কান্ড দেখুন , বাচ্চামেয়ে ওই ডাকাতে কালী মন্দিরে ওকে কেউ নিয়ে যায়? ছোটুকে টেনে নিয়ে চলে যায় ওর মা ।   
  এই দেবালয়ে মাতৃআজ্ঞা না নেওয়া পর্যন্ত রাজবাড়িতে প্রবেশ নিষেধ । আজ্ঞা নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করেই গোলকধাঁধায় পড়ে ।  বাঁধানো প্রশস্ত উঠোনের চারপাশে সব ঘর । ঘরের সঙ্গে গোল গোল পাথরের থাম দেওয়া বারান্দা । ঝোলানো । আর কি সব কারুকার্য। কত ফুল কত ছবি। সার সার সাজানো রাজ পরম্পরা পূর্বরাজাদের ছবি। সবই আঁকা । পোর্ট্রেট। পাশে পাশে নানান আকারের তরোয়াল । কোনওটা খাপখোলা আবার কোনওটা খাপে ঢাকা। পিসি বলে এই হল দোর্দণ্ড প্রতাপশালী রাজা চন্দ্রচূড় রায়চৌধুরি । আর এই হল তার পৌত্র দ্বিতীয় চন্দ্রচূড় রায়চৌধুরি । এদিকে আয় দেখবি ,--ছোটু দাদাকে ডেকে নেয় । ওই দ্যাখ – অঞ্জন বড়ো বড়ো চোখ করে দেখে দেয়ালে দেয়ালে যাদুঘরে রাখা জন্তু জানোয়ারের মত রাজবাড়ির বসবার ঘরে ঝোলানো রয়েছে  বাঘের চামড়া  হরিণের খুলি , হায়নার চোয়াল ,  হাতির দাঁতের মত অতি মূল্যবান জিনিস। পড়ে আছে অবহেলায় !    এসব দেখে তো ছোটু থ। তারপর তো ঘর । ঘরের পর ঘর।  মাঝখানে দু দিক থেকে প্যঁচানো সিঁড়ি । খাটুন্দির রাজবাড়ির মত। না দেখলে বিশ্বাসই হত না। আপনি প্রকাশ পায় এই বাড়ির পূর্বের ঐতিহ্য। সম্পদের প্রাচুর্য । এমনিই সম্ভ্রম জাগে। ওরা দ্বিতলের একটা রুমে জায়গা নিয়েছে। যেখান থেকে দরদালান অনেকটা কাছে। মা ভবানীমন্দির স্পষ্ট দেখা যায় । আর পুবদিকে অদূরে জঙ্গল । ঘন না হলেও অনেকটা জমাট । ইউক্যালিপ্টাস আর সোনাঝুরি গাছ পরে লাগানো হয়েছে । 
ষষ্ঠীর সন্ধেতে পুজো হয়ে গেলে সবাই এক সঙ্গে গোল করে বসে । এই রাজবাড়ির আরও চারজনের সঙ্গে ছোটুর ভাব হয়েছে। গণেশ , শিবানী , গঙ্গা আর কার্তিক। এক সঙ্গে ঘিরে রয়েছে রাঙাপিসিকে । রাঙাপিসিও আজ অন্যভাবে সেজেছে । গরদের কাপড় পরে কপালে চন্দনের একটা বড় চাঁদপানা টিপ নিয়ে ওদের সঙ্গে গল্পে ব্যস্ত। 

  ছোটুর সেই একই প্রশ্ন , রাঙাপিসি এই মন্দিরে বলি কেন হয় না গো ? মানুষ বলি ? 
না না মানুষ টানুষ নয় রায়চৌধুরি রাজারা এখানে বুনো মহিষ বলি দিত।  সে অনেক কাল আগে। তখন রাজা ছিল চন্দ্রচূড় চৌধুরি । রায় টাইটেল নয় উপাধি। নবাব আলীবর্দীর সময় এই দিকটা ঘন জঙ্গলে ঢাকা ছিল । জঙ্গলের ভেতর ভেতর ছোট ছোট পরিবার। প্রায় সবই আদিবাসী , সাঁওতাল , লড় , কোঁড়া ভুঁইয়া বাগদি হাঁড়ি ডোমেদের বাস। বাগদিরা রাজার পালকি বইতো। আর ডোমরা ছিল দাড়োয়ান পেয়াদা। কখনও কখনও এদের নিয়ে তৈরি করা সৈন্যরা বন থেকে ধরে আনত হরিণ । কখনও হরিণও বলি দিত। অতীব ক্ষমতার অধিকারি ছিল রাজা  চন্দ্রচূড়। বর্গীদের আক্রমণ থেকে প্রজাদের রক্ষা করার জন্য এই মায়ের কাছে এলে মা চিন্তা মুক্ত করেন। তার পর এই মা নাকি রাজবাড়ির সব মেয়েদের নিয়ে খড়্গ হাতে রুখে দাঁড়ান । সে এক ভয়ানক যুদ্ধ । সেই যুদ্ধে বর্গীরা ভয় পেয়ে ঊড়িষ্যার দিকে চলে যায়। সেই অসম্ভবকে সম্ভব করার জন্য নবাব রাজা চন্দ্রচূড়কে ‘রায়’ উপাধি দিয়ে সম্মান জানান। সেই থেকে রাজা চন্দ্রচূড় রায়চৌধুরি। তারপর তিনি দেহ রাখলেন। ক্রমে ক্রমে জঙ্গল পাতলা হতে লাগল।  বনের জীবজন্তুও কমতে থাকে । তখন ছাগল বলি চালু হল । রাজা চন্দ্রচূড় চলে গেলে তারপর তার মত প্রতাপশালী রাজা আর পাওয়া গেল না। দিনে দিনে প্রজাদের প্রতি অবহেলা বাড়তে লাগল । এমনিতে সাঁওতাল পরগনা সহ বঙ্গে প্রবল খরা আরম্ভ হল ।  নদী নালা পুকুর জলাশয়ে  সে রকম জল থাকল না। ওই ডোম কোঁড়া বাগদিরা রাজদরবারে কাজ হারিয়ে ফেলল। খাবারে টান পড়ল। দ্রুত চুরি ডাকাতি বাড়তে লাগল। ঠগী নামে একদল দস্যু রাস্তার রাহিদের প্রচন্ড উৎপাত শুরু করল । এদিকে  গ্রামের পর গ্রাম চলল ডাকাতি। জঙ্গলের এখানে সেখানে ডাকাতেরা কালীমায়ের মন্দির করে তাদের একটা করে আস্তানা গড়ে তুলল । তারপর ... । 
রাঙাপিসির কাছে পুরোনোদিনের গল্প শুনতে শুনতে ছোটুর ভীষণ ভয় করতে লাগল। বলল, দাদা  চ, আর শুনব না। আমার ভয় করছে। 
দাদা হেসে ফেলল , ধুর বোকা , সে তো তখন ছিল । এখন তো বলিই হয় না। 
রাঙাপিসি বলল , আজ থাক না হয় কালকে আবার শেষটা শোনাব।   
ষষ্ঠীর পুজো শেষ হয়ে গেল। রাতে লুচি নবরত্ন বঁদে দিয়ে আহার করার পর যে যার নিজের শোয়ার ঘরে চলে গেল । দোতলার বিশাল ঘরে ওরা দু ভাইবোন আর রাঙাপিসি । এখন চাঁদ উঠবেনা । তবে রাজবাড়ির পুজো বলে আলোয় আলোয় বন্যা বয়ে যাবে তাও না। এ বাড়ির নিয়ম অনুযায়ী ভবানীমন্দির ও রাজবাড়ির চারপাশ ,শুধুই ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালানো হয়। ঠিক যেন দীপাবলি । এখনও দু একটা প্রদীপ দুর্বল আলোর শিখা নিয়ে হেলে হেলে ঊঠছে। হয়তো জঙ্গলের ওপাশ থেকে যেখানে তারাপীঠের কড়কড়ে নদী আপন বেগে জঙ্গলের ভেতর বয়ে চলেছে। এখানে সেই অন্ধকারের ভেতর থেকে এক গাঢ় জমাট অন্ধকার জানান দেয় ওখানে কিছু আছে। সেই অন্ধকারের ঝোঁক বারান্দা হয়ে ওদের ঘরে ঢুকেছে । সিড়িঁর কাছে ঘিয়ের বড় প্রদীপ জ্বলছে। একটা  ক্ষীণ আলো এসে মাঝে মাঝে আবছা রহস্যময় করে তুলছে। চোখ বন্ধ না করলেও চোখ আপনেই বুজে আসে।  
একবার শুধু অঞ্জন বলল , রাঙাপিসি ডাকাত কখনও দেখেছ। 
--হুঁ । 
-- ডাকাতের কালী পুজো ? 
-- ধুর ডাকাতরা পুজো করার সময় অন্য কাউকে জানতে দেয় নাকি!  
-- ওরা কি সত্যি সত্যি মানুষ বলি দিত ? 
ও পাশে ছোটু  এপাশ ওপাশ করে শেষে রাঙাপিসির কোলের কাছে কাপড়ে মুখ গুঁজে দেয় । 
রাঙাপিসি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল ছোটুর মুখ গুঁজে শুয়ে পড়া দেখে বলে, সে আমি কী করে জানব। নে শুয়ে পড় । কালকে আবার ভবানীমাকে দোলায় আনতে হবে।  

  রাজবাড়ি এখন শান্ত । অদূরে বাজনদারদের কক্ষ থেকে ক্ষীণ ডুম ডুমা ডুম ডুম বাজনা  অঞ্জনের কানে আসছে। সন্ধেতে আজ ওরা বাজিয়ে লোকেদের মনোরঞ্জন করেছে। কালকেও করবে। হয়তো তারই প্রস্তুতি চলছে। কিছুক্ষণ পর হয়তো সে শব্দও থাকবে না। ধীরে ধীরে ওরা ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। 
হঠাৎ খটখট খটখট করে একটানা শব্দ হতেই অঞ্জনের ঘুম ভেঙে যায় । কান সজাগ করে ভাল করে শোনার চেষ্টা করে । এত রাতে কীসের আওয়াজ । ঠিক ছুটন্ত ঘোড়ার মত যেন । কিন্তু এতো রাতে ঘোড়া ! কোত্থেকে এলো । বড়ো তাড়াতাড়ি খাট থেকে নেমে বারান্দাঘেঁষে দাঁড়ায় । আধো আলো আধো অন্ধকারে এই অচেনা রাজবাড়ির কোনও কিছুই ভালো করে দেখতে পায় না। খুব মিস করছে ওর ট্যাবটাকে। ট্যাব বা মোবাইল ফোন বাড়িতে রেখে এসেছে । ও আনতে চেয়েছিল । কিন্তু মা আনতে দেয়নি, —পুজোর ছুটি কাটাতে যাচ্ছ। মামা মাসি পিসি ভাইবোনদের সঙ্গে আনন্দ করবে তা না মোবাইল ট্যাব ধরে এক কোণে মুখ গুঁজে গোঁজ হয়ে বসে থাকবে। তোমার যদি মনে হয় ওতেই তোমার আনন্দ তাহলে তোমাকে আর মামাবাড়ি গিয়ে কাজ  নেই । ঘরে একাই থাক। হোম ডেলিভারির ছেলেটাকে বলে দেব ঠিক সময়ে তোমাকে তোমার খাবার দিয়ে যাবে।   
   
  কিন্তু সে সব ভাবার সময় পেল না অঞ্জন । ধীরে ধীরে খটখট খটখট শব্দটা আরও কাছে আসতে লাগল । হঠাৎ দূরে বনের মধ্যে হাজার হাজার মশালের মত আগুন লিক লিক করে ছোটাছুটি করতে শুরু করল ।  
অঞ্জনের শরীরে অদ্ভুত শিহরণ খেলে যায়। --কী এ সব!  আর ঘোড়াগুলোই বা কোত্থেকে আসছে । বনের মধ্যে কী করছে ? এক সঙ্গে অনেকগুলো প্রশ্ন সেই রাতের অন্ধকারের অঞ্জনের মনে তোলপাড় করে চলল । 
 সে রাতে ভাবতে ভাবতে কোনও কার্যকারণ সূত্র সে আবিস্কার করতে পারল না। যখন ঘুম থেকে উঠল তখন কানের কাছে সানাইয়ের মিষ্টি সুর ওর মন দুলিয়ে দিল । 
  সবাই সকালে স্নান সেরে নতুন নতুন নানা রঙের জামা কাপড় পরে  চলল মা পিসিদের সঙ্গে । 
আগে আগে নহবত আর সানাই বাদকেরা চলল। রাস্তা ধারে ধারে গৃহস্থের গিন্নি মা’রা হাতে ছোট ছোট পিতলের কলসি নিয়ে দাঁড়িয়ে । রাজবাড়ির ভবানীমায়ের দোলা আনতে চলল । ছোটু অঞ্জনের হাত ধরে বা কখনও  তিড়িং বিড়িং করে নেচে নেচে চলল । 
রাঙাপিসি এক সময় ফিস ফিস করে অঞ্জনকে বলে, রাতে অমন ভুল বকছিলি কেন? দিলুমামাকে বলবি, ও মুখে দু’ফোঁটা ফেলে দেবে। গ্যাস-অম্বল হয়েছে বোধ হয়। দু মিনিটেই ধুসফাস ।  
-- রাঙাপিসি ঢোল বাজনদারদের তো দেখছি না? কাল রাতে যে ঢোলের বাজনা শুনেছিল সেটা সে বলল না। 
-- ওরে এখানে এই রাজবাড়িতে ঢোল ঢাক হয়না শুধু নহবত হয়। দেখছিস না আগে আগে নহবতের দল চলেছে।      
কিন্তু ঘোড়ার খুরের আওয়াজ! বনের মধ্যে হাজার হাজার মশাল ! --- বলতে গিয়েও সে কথাগুলো গিলে নিলো। বললে হয়তো এখুনি ওর ভবানীমা আনতে ওই দিঘির পারে যাওয়া হবে না। সোজা নিয়ে চলে যাবে দিলুমামার কাছে। তারপর দিলুমামা ওর চেম্বার খুলে বইপত্র ঘেঁটে ওর সিমটম শুনে ওষুধ দিতে দিতে ভবানীমাকে দিঘি থেকে নিয়ে আসা হয়ে যাবে।  পুজোর মজাটাই মাটি । পাশে চলা রিংকি মাসীর কাছ থেকে শাঁখটা নিয়ে পুঁ পুঁ করে বাজাতে বাজাতে আর সবের সঙ্গে এগিয়ে চলে।

   সন্ধেতে যথারীতি রাঙাপিসি বেশ কতগুলো পুচকে ছেলে মেয়ে নিয়ে বসে গল্প জুড়ে দিয়েছে। কিছুক্ষণ আগে নহবতের দল ডুম ডুম ডুম ঢুম ঢুমা ঢুম ঢুমা ঢুম বোলে সন্ধ্যারতি বাজিয়ে নহবতগুলো পাশে সরিয়ে মজলিশ বসিয়েছে।  বড়োরা একদিকে মন্দিরের চাতালে বসে পুজোর পরিকল্পনা করতে ব্যস্ত। নবমীর দিনে পঞ্চগ্রাম নেমতন্ন করতে হবে। নবমীর প্রসাদ খেতে আশপাশের গ্রাম থেকে বহু লোক আসে । ঠিক মত ব্যবস্থা না করলে তাদের সম্মান রক্ষা করতে হিমশিম খেয়ে যাবে । সেই গল্পই করছিল রাঙাপিসি । একেবারে মহাভোজ । লুচি মিষ্টি পোলাও থেকে ক্ষীর মালাই মোহন ভোগ সব থাকে । যখন ছাগল বলি হত তখন এই সব প্রজাদের প্রসাদে পাঁঠার ঝোলও থাকত। তবে এখন ... কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল রঞ্জন থামিয়ে দিয়ে বলে,---  কবে থেকে বলি বন্ধ হয়ে গেল রাঙাপিসি ? 
--- ওই যে যেবার রাজা দ্বিতীয় চন্দ্রচূড় রায়চৌধুরিকে ডাকাতে ধরে নিয়ে গেল । তারপর আর তার কোনও খবর পাওয়া গেল না ।
--মেরে ফেলেছিল না হাড়িকাঠে দিয়ে বলি দিয়েছিল ? রঞ্জনের মুখ কেমন যেন শক্ত হয়ে এলো ।  
--তোর যত পাকা পাকা কথা । এসব আজগুবি গল্প কোত্থেকে শুনলি?  
না রাঙাপিসি আজগুবি নয় আমি একা নয় এ গ্রামের সবাই জানে । এমন কি ওই নহবত বাজনদারেরাও। রঞ্জনের এমন বড়দের মত কথা শুনে পাশে বসা ছেলেমেয়েরা ওর দিকেই তাকিয়ে রইল । --রাজা দ্বিতীয় চন্দ্রচূড় তো চন্দ্রচূড় রায়চৌধুরির পৌত্র ছিল। তিনিও অনেকটা দাদুর মত শক্তিশালী ছিলেন। তাই তিনি ওই ডাকাতদের বাড়বাড়ন্ত সহ্য করতে পারেন নি। বেধে যেত মাঝে মাঝেই যুদ্ধ। তাইতো রাঙাপিসি?  আর এমনি এক ভবানী পুজোর রাতে অতর্কিতে ডাকাতেরা আক্রমণ করলে দ্বিতীয় চন্দ্রচূড় রায়চৌধুরি হারিয়ে যায়। পরের দিন মুণ্ডহীন দেহটা ডাকাতে কালীতলায় পড়ে থাকতে দেখা যায় । আর শোনা যায়  দুশোর মত ডাকাতের দল ভবানীমায়ের তাড়া খেয়ে তারাপীঠের জঙ্গলের মাঝে কড়কড়ে নদীর জলে ভেসে গিয়েছিল। 
--সে সব আজগুবি বানানো গল্প ,  কেন শুনিস বল তো!---  রাঙাপিসি বলে।  চল চল সবাই খেয়ে নিবি । ওই দ্যাখ খাবারের ব্যবস্থা করেছে। রাজবাড়ির বিশাল চত্বরেই দুজন দুদিকে বড়ো বড়ো  ঘিয়ের প্রদীপ নিয়ে এসে বসিয়ে দিল। এক জন তাতে ঘি দিয়ে গেল । তৎক্ষনাৎ একটা হলদে আলো চতুর্পার্শ্বে ছড়িয়ে পড়ল ।
সপ্তমীর রাত । গভীর ঘুমে সব আচ্ছন্ন। রঞ্জনের চোখে ঘুম নেই। ওদিকে বাজনদারদের  নহবতের  কোনও শব্দ সে পেল না। আজ যেন বড্ড শান্ত। একবার ঘার তুলে  ভবানী মন্দিরের দিকে তাকিয়ে দেখল। না আজও তেমন আলো জ্বলে নি। সেই দু একটা প্রদীপের শিখা টিল টিল করছে। একটু পরেই সেগুলোও নিভে যাবে।  ঠিক সময়ে কে যেন সিঁড়িতে প্রদীপের আলো জ্বেলে দিয়ে গেছে। চিন্তা থাকলেও ক্লান্ত শরীরে ঘুম মানে না । এক সময় রঞ্জনের ঘুম আসতে খুব দেরি হয় না। হঠাৎ সেই ঢোলের ঢম ঢমা ঢম ঢম ঢমা ঢম বোল ভেসে এলো । ঠিক বাজনদারের ঘরের দিক থেকে। চুপ করে রইল পরের শব্দের জন্য। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। শুনতে পেল কারা যেন ঘোড়া ছুটিয়ে এ দিকেই  আসছে। কান পেতে রইল। একটানা খটখট খটখট  করে খুরের আওয়াজ হয়েই চলল। আর কোনো ঝুঁকি নিল না। সোজা বারান্দা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে অদূরে বনের দিকে চোখ রাখল। ঘন অন্ধকারের পর যেন আরও একটা অন্ধকারের জমাটে চাদর ওদিকে ঝোলানো। কী করবে বুঝে ওঠার আগেই দূরে বনের মধ্যে আবার সেই মশালেরা ছুটে বেড়ালো এদিক ওদিক করে।  কি আশ্চর্য ! আজ যেন ঘোড়ার খুরের আওয়াজ আরও কাছে শোনালো । আরো কাছে । দেখতে দেখতে চারিদিক আলো করে কয়েক হাজার মশালের আলোতে চোখ ঝলসে উঠল । ভালো করে চোখে কচলিয়ে আবার তাকাল। দেখল , প্রায় শ’খানেক ঘোড়ায় চড়ে মুখে কাপড় বেঁধে হাতে দায়ের মত কিছু নিয়ে ভবানীমন্দিরের চারিদিকে ঘুরল । তারপর  চোখের নিমেষে ঝড়ের গতিতে যেদিকে এসেছিল সেই দিকেই চলে গেল। চোখের পলকে যেন এসব ঘটে গেল । বড়ো ঠাই কাঠ হয়ে দেখতে দেখতে নিজের অস্তিত্ব বুঝে উঠতে পারছিল না। সে কোনও রকমে আবার বিছানায় এসে শুয়ে পড়ল । পাশে ছোটু আর রাঙাপিসির কোনও সাড়া পেল না। এখনও  বুকের মাঝখানটা দ্রুত ওঠা নামা করছে। চোখ মুজতে পারল না অনেকক্ষণ ।  
পরের দিন সে গতকাল রাতের ঘটনা কাউকে বলল না। শুধু ঘুম থেকে উঠে সোজা ভবানী মন্দিরে গিয়ে মন্দিরের চারপাশটা ভালো করে ঘুরে ঘুরে দেখলো । ঘোড়ার খুরের কোনও ছাপ দেখতে পেল না। তারপর সে গেল , বাজনদারদের ঘরে । এখনও ওরা ঘুমোচ্ছে। কে যেন খুক খুক করে কেশে উঠল। তেমন নতুন কিছু  দেখতে পেল না। জানলায় মুখ এনে আধো অন্ধকারে ঘরের ভেতর উঁকি দিল । ওরা শুয়ে আছে। নহবতগুলো একদিকে রাখা। কাপড়ে ঢাকা। ভেতরে কোনও  ঢাক বা ঢোল দেখতে পেল না। অথচ কালকে রাতে সত্যি সত্যি ঢোলই বেজেছিল । কেন না ঢোলের আওয়াজ সে চেনে। যেখানে সে হাওয়াইন গীটার শেখে সেই স্কুলে ঢাক ঢোল ট্রিপল প্যাড ড্রাম শ্রীখোল মন্দিরা মৃদঙ্গ সব বাজনা দেখানো হয়। তার চিনতে ভুল হয় না। কাল রাতে যে বাজনা বেজেছিল সেই বাজনা এখানে বাজনদারদের কাছে নেই। সেই সকালে  ঘুরতে ঘুরতে রাজবাড়ির পেছনের দিকে চলে যায়। বিশাল বড়পুকুর । বড়ো বড়ো ঘাসে ডুবে গেছে। ছোট বড়ো প্রচুর খেজুর গাছের ঝোপ । এদিক থেকেও ঘোড়ায় চড়ে কেউ আসার কোনও চিহ্ন পেল না। শুধু অবাক হয়ে দেখল কতদূর এমনই সব ঝোঁপে ঢেকে আছে। মাঝে মাঝে ইটের দেওয়াল মাথা তুলে জেগে রয়েছে। হয়তো আরও জাঁকজমকে ভরে  উঠত সে সময় । ঘোড়াশালে ঘোড়া । হাতিশালে হাতি । আস্তাবলের কাছাকাছি থাকত মাহুত আর ঘোড়সওয়াররা। তন্ময় হয়ে সেই সবই ভাবছিল । হঠাৎ সামনের  ঝোঁপে সর সর করে কী একটা চলে যেতেই গোটা শরীর ঠান্ডা হয়ে এলো । এদিক ওদিক চেয়ে দেখল কেউ কোত্থাও নেই । সে দ্রুত সেই স্থান ত্যাগ করল। অল্প বিস্তর ভয় পেল বটে কিন্তু রাতের সেই কৌতূহল মিটল না। রঞ্জন সোজা বনের রাস্তা ধরল । যেদিকে ওরা এসেছিল সেই দিকে। মাঝে মাঝে কাঠ কাটতে আসা মানুষদের শুধিয়ে নিল – ডাকাতে কালী মন্দিরটা কোন দিকে? ও যখন ডাকাতে কালীতলায় এসে পৌঁছুল তখন সূর্য অনেকটা ওপরে । কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে । তবু বনের মাঝে আলো ছায়ায় ভালোই লাগছিল । রঞ্জনের নজরে ছিল কালী মন্দিরটা। একটু দূরে দাঁড়িয়ে ভাঙা মন্দিরের চারপাশটা তীক্ষ্ণভাবে দেখে নিচ্ছিল। আপাতত মন্দিরের কিছু নেই । দেখলে বোঝা যায় যে একটা পাকা বাড়ি ছিল হয়তো কোনও কালে। তারই ভগ্নাবশেষ ছড়িয়ে রয়েছে। ভালো করে লক্ষ্য করে বর্তমানের ঘনকের আকারে বেশ মোটা মোটা ইট দিয়ে তৈরি নয় । সব গিরিপাথর দিয়ে তৈরি । ঝোঁপঝার লতাগুল্মের মাঝেও উঁচু হয়ে একটা পাথরের খন্ড দাঁড়িয়ে আছে। সামনে পাথরেরই হাড়িকাঠ। গায়ের নিচটা জমাট কালচে । ধারে কাছে কাউকে  দেখতে পেল না। সে শুধু ভাবছিল এখানে ডাকাতেরা কালী পুজো করে ডাকাতি করতে যেত আর রাজবাড়ির দারোয়ান পেয়াদা বরকন্দাজ পারতপক্ষে সেই লেঠেলরা কিছু বলবে না তাই কি হয়! তবে ভেতর ভেতর সেই এক প্রশ্ন কোনও মশাল বা ঘোড়ার খুরের কোনও চিহ্ন রয়েছে কিনা। না!  কাল কেন , এপাশে অন্তত বছর খানেক কোনও জন্তু জানোয়ার পা দিয়েছে বলে মনে  হলো না। --তাহলে ! গত দুদিনের ঘটনার সঙ্গে এই বনের ভেতরের পরিবেশ মেলাতে পারল না। হঠাৎ ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় ওকে সজাগ করে দিল ওকে কেউ দেখছে। একেবারে কানের কাছে কারও হোসফোঁস আওয়াজ । ঘুরে দাঁড়াতেই পিঠে হাত। --কী দেখছ বাবু? পুজো দেখতে এয়েছ বুঝি? ভবানী মায়ের পুজো তো রাজবাড়িতে – রঞ্জন দ্যাখে পেছনে একটা ধুমধুমে কালো শক্তপোক্ত লোক।  হাতে তরোয়ালের মত কিছু  । ভয়ে গলা শুকিয়ে ঊঠল। কোনও কথা বলতে পারল না। --এদিকে আসতে নেই। দেখছ না কেমন আব্জ । পা যেন আর চলে না। দৌড়ে যে সে পালিয়ে আসবে সে ক্ষমতাও  নেই। কোনও রকমে নিজেকে শক্ত করে দে ছুট। 

  ভবানীমন্দিরে এসে দ্যাখে , অষ্টমী পুজোর তোরজোর চলছে। মাবাবাকে কে দেখতে পেল না। তবে বাবাকে দেখল বেশ কয়েক জনের সঙ্গে গল্প করতে ।  কিছুটা আশ্বস্ত হলেও বিদ্যুৎ চমকের মত খেয়াল হলো প্রধান  দরজার সেই পাগড়িমাথায় পাকানো মোচওলা লোকগুলোর মত দেখতে ছিল ডাকাতে কালী মন্দিরের সেই লোকটা।  দ্রুত আরেকবার প্রধান দরজার সামনে আসতেই স্তম্ভিত হয়ে যায়। হ্যাঁ ঠিক ওদের মতই দেখতে। একই রঙ, একই শরীরের পাকানো গঠন। আর দাঁড়িয়ে থাকে না বড়ো। সোজা ভবানীমায়ের মন্দিরে । 
মন্দিরে ঢোকার মুখে দ্যাখে কীসের একটা জটলা। রাজবাড়ির মামা বড়ো দাদু গ্রামের আরও দু একজন  ফিসফিস করে কিছু বলছে। চোখেমুখে উদ্বিগ্নতার ভাব। সেও দাঁড়ায়। 
 
  হেথায় হোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছিস কেন ? আজ আষ্টমী । সাবধানে থাকবি । কখন রাঙাপিসি ওর পাশে এসে পড়েছে ও বুঝতেই পারেনি। --আর পটকা বোমাও ফাটাবি না।  

  কি আশ্চর্য ! তাইতো ! ও খেয়ালই করেনি, এই রাজবাড়ি আসা থেকে এখনও পর্যন্ত কোনও পটকাবাজি ফাটানোর শব্দ পায়নি। রাজবাড়ি না হোক এতো বড়ো গ্রামে কোনও জায়গা থেকে বাজি ফাটানোর শব্দও ভেসে আসেনি। এতক্ষণে খেয়াল হলো , ওর লাগেজ ব্যাগে বেশ কয়েকটা বাজির প্যাকেট  আলাদা করে রাখা আছে। দুর্গাপুজো আর বাজি ফাটাবে না তাকি হয় !  কিন্তু ঘটনাক্রমে কোনও বাজি ফাটানো দেখতে বা শুনতে না পাওয়ায় সে বেমালুম বাজির কথা ভুলেগেছিল । তার ওপরে রাতের সেই ঘটনাগুলো ,  মনের মধ্যে তোলপাড় তোলে। 
 
  ছোটু দাদার হাত ধরে টানে।– দেখবি আয় , কারা মন্দিরের সামনে একটা বিশাল পাথর ফেলে দিয়ে গেছে। দেখবি আয়। 
অঞ্জন এবার বোঝে এই জটলার কারণ। কাছে যেতেই চমকে ওঠে । এ তো পাথর নয়। হাড়িকাঠ । পাথরের হাড়িকাঠ । এইমাত্র জঙ্গলের  ভেতরে ডাকাতে কালী মন্দিরে একই গিরিপাথুরে হাড়িকাঠ দেখে এলো। একই   রকম সারা গায়ে জমাট কালচে ছোপ । কিন্তু এখানে কে নিয়ে এলো ? এই প্রশ্ন এখন সারা রাজবাড়ির আনাচে কানাচে। --মহা অমঙ্গল । সেই পাথরের হাড়িকাঠটাকে রাজবাড়ির পশ্চিমদিকে জলা জঙ্গলে গর্ত খুড়ে মাটি ঢাকা দিয়ে পরে ঘাসের চাঙ চাপিয়ে দিয়েছে রাজবাড়ির পোষ্য হাঁড়ি বাগদি কিছু মজুরেরা। তবু সারদিন চরম উৎকন্ঠায় কাটে রাজবাড়িতে। অষ্টমীর ক্ষণ। কোনও রকম ত্রুটি যেন না ঘটে। প্রত্যেক ছেলেমেয়েদের ধরে ধরে বলে দেওয়া হলো খুব সাবধানে যেন থাকে। অষ্টমীর রাতটুকু পেরোলে হয়। সন্ধে গড়াতে না গড়াতেই ডুম ডুডুম ডুম করে নহবতের বাজনা বেজে ওঠে। আজকের মত পুজো শেষ । 
তাড়াতাড়ি রাতের প্রসাদ খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ে সবাই। আজ যেন সারারাত প্রদীপের আলো না নেভে,-- রাজবাড়ির বড়ো কর্তার আদেশ। তাই এখনও গোটা রাজবাড়ি আলোকোজ্জ্বল । ধিমে আলোয় রাজবাড়ির বাইরেটা তাই আরও অন্ধকার লাগছে। কিচ্ছু দেখা যায় না। রঞ্জন বালিশের ওপর হাত দিয়ে মাথা উঁচু করে ভাবে এই বুঝি ডম ডমা ডম ডম ডমা ডম ঢোলের আওয়াজ ভেসে এলো। তারপর সেই ঘোড়ার খুরের খট খট শব্দ । কিন্তু অনেকক্ষণ জেগে থাকার পর যখন কোনও শব্দ এলো না তখনও ওই শব্দগুলো না আসার কারণ হিসেবে সারা রাত প্রদীপ জ্বালানো ব্যাপারটা ধরে নিল এবং এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল। 
কিন্তু ওর ধারণা ভুল ছিল । হঠাৎ ডম ডমা ডম  ডম ডমা ডম ঢোলের ক্ষীণ শব্দ সঙ্গে তাল মিলিয়ে খটখট খটখট করে সেই ছুটন্ত ঘোড়ার শব্দ। ধরফরিয়ে ওঠে বড়ো। পাশে অঘোরে ঘুমোচ্ছে রাঙাপিসি । ছোটু রাঙাপিসির কোমরে একটা পা তুলে দিয়েছে । নিঃশব্দে খাট থেকে নামতেই বুঝতে পারে চারদিক বড়োই অন্ধকার। প্রদীপ হয়তো ঘি শূন্য । বারান্দার জানালা দিয়ে বনের মাঝে তাকিয়ে দেখে কোনও আলো জ্বলছে কিনা। কিন্তু এতই অন্ধকার বাইরে কোন দিকে তাকাবে সেটাও ধারনা করতে পারছে না । কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে।  কিন্তু আজ কোনও মশাল দেখতে পেল না। ভবানীমন্দিরেও কোনও প্রদীপ জ্বলছে না। তার বদলে  ছপা ছপ ছপা ছপ ছপ ছপ করে কীসের শব্দ শুনতে পেল। আর কারা যেন ফিসফিস করে কিছু বলা-কওয়া করছে।  কিছুক্ষণ হয় তো এভাবেই ছিল । হঠাৎ খেয়াল হয় ও যেদিকে তাকিয়ে আছে ঠিক তার ডান কোণ বরাবর দূর স্থান আলোকিত । সেখান থেকে রাজবাড়ির পিছনদিক পড়ছে। ওই জায়গাটা ভালো করে দেখতে গেলে ওকে সিঁড়ি বেয়ে পাশের দরদালানের ঘোরানো এবং কিছুটা গম্বুজ আকৃতির খোলা অংশে পৌঁছাতে হবে। কিন্তু ওর কাছে কোনও আলো নেই । 
অঞ্জন কিছু না ভেবে হাতড়ে হাতড়ে অনেকটা অন্ধের মত আন্দাজে সিঁড়ি ধরে নামতে থাকে । একবার ভাবে রাঙাপিসিকে একবার জানালে হতো । কিন্তু সে বড় কেলেংকারি হয়ে যাবে। শেষ কালে আসল ঘটনাটা জানতে পারব না। তার ওপর সেই হোমিওপ্যাথি ডাক্তার মামা তো আছেই। তার চেয়ে ব্যাপারটা তো দেখি। গম্বুজ আকৃতির সেই খোলা অংশে পৌঁছাতেই স্পষ্ট মশালের লাইন দেখতে পেল। মশালগুলো দ্রুত এই রাজবাড়ির দিকেই আসছে। ঠিক সকালে যেদিকে গেছিল । খেজুর গাছের বনের দিকটায়। ওদিক দিয়ে ডাকাতে কালী মন্দিরে সোজা যাওয়া যায়। আবার মূল রাস্তায় পৌঁছে ভবানী মন্দিরেও আসা যায়। সে মাথা হেলিয়ে ভবানী মন্দিরটা একবার দেখে নেয়। না এখন সেখানে কোনও প্রদীপ জ্বলছে না। কিন্তু ঢোলের দলের আওয়াজটা ঐদিক থেকেই যেন আসছে। ধীরে ধীরে শব্দটা স্পষ্ট হচ্ছে। অঞ্জন কিছুতেই বুঝতে পারল না যে দিকে মশালের দল ঠিক তার বিপরীত দিকে ঢোলের বাজনা। ভাবতে ভাবতেই বনের ভেতর থেকে রে রে করে ছুটে আসে ঘোড়ার চড়া কিছু মানুষ । পিছন পিছন মশালের  দল। নিমেষে ভবানী মন্দিরের অঙ্গন আলোয় ঝলসে ওঠে । সে এক ভীষণ শব্দের কোলাহল । একদিকে খটখট খটখট করে ঘোড়ার খুরের শব্দ , ঘোড়সওয়ারের আর মশালবাহিনীর রে রে করে চিৎকার সঙ্গে ঢোলের ডুম ডুমা ডুম ডুম ডুমা ডুম বাজনা। কান ভেদ করে বুকে গিয়ে আছড়ে পড়ছে। সঙ্গে সঙ্গে পিছনে আস্তাবলের দিকে থেকে ভবানী মন্দিরের দিকে ছুটে চলে ঘোড়সওয়ারের দল। নিমেষে তরোয়ালের ঝনঝনানি আহত ঘোড়ার আর্ত চিৎকার চোখের সামনে এমন ভয়ঙ্কর পরিস্থিতে অঞ্জন ঘাবরে যায়।  এমনটা যে হবে ভাবতে পারেনি। এত আলো তবু মুখগুলো কারও চিনতে পারল  না। এমনি ভাবে ভয়ে বিহ্বল হয়ে সে যখন একটা যুদ্ধের প্রকৃত দর্শক হয়ে হতচকিত ঠিক তখন সে আবিস্কার করে , যুদ্ধক্ষেত্রের মাঝে তড়িৎ গতিতে তরোয়াল চালাচ্ছে সে আর কেউ  নয়,-- স্বয়ং রাজা দ্বিতীয় চন্দ্রচূড় রায়চৌধুরি। সোনালি শিরস্ত্রান বুকে বর্ম আর হাতে বিশাল তরবারি । ঝলকে ঝলকে উঠছে তরবারি। কখনও  শত্রুদের রুধিরে রঙিন হয়ে চমকে চমকে উঠছে। রুধিরের ফোঁটা টপ টপ করে পড়ছে । উল্লাসে ফেটে পড়ছে রাজসেনা। তবু কি জানি কী হলো , রাজা দ্বিতীয়  চন্দ্রচূড় রায়চৌধুরিকে আর দেখতে পাওয়া গেল না। সেনারা দিশেহারা হয়ে কিছুক্ষণের জন্য যুদ্ধ বন্ধ করে রাজতল্লাসে এদিক ওদিক খুঁজে বেড়াতে লাগল।   
 
  উত্তেজনার তাড়নায় অঞ্জন যে কখন দোতলার সিঁড়ি ধরে ধরে কখন প্রাসাদাঙ্গন পেরিয়ে সিংহ দরজা খুলে ভবানীমায়ের প্রাঙ্গণে এসে পড়েছে খেয়ালই করে নি। তার নজর এখন সেই ডাকাতগুলোর দিকে যারা এই মাত্র যুদ্ধক্ষেত্র থেকে দ্বিতীয় রাজা চন্দ্রচূড়কে মুখে কালো কাপড় চাপা দিয়ে চুরি করে পালাচ্ছে। এই অদ্ভূত কৌশল রাজসেনাদের দৃষ্টি এড়িয়ে গেলেও অঞ্জনের দৃষ্টিকে ফাঁকি দিতে পারল না।  
  
ভবানীমায়ের সামনে এমনতর প্রবঞ্চনা ! অঞ্জন নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না। ওর শরীরে অদ্ভূত এক শক্তি খেলে গেল। সামনে পড়ে থাকা অর্ধমৃত সৈনিকের হাত থেকে তরবারি তুলে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক প্রভুহীন অশ্বের পিঠে চড়ে ছুটে চলল।  যেদিকে ডাকাতের দল রাজাকে নিয়ে গেছে । পিছু নিতে নিতে পৌঁছে গেল গভীর জঙ্গলে । দূরের ছুটন্ত ডাকাতের হাতে জ্বলন্ত মশালের আলোয় রাস্তা কোনও রকমে দেখা যায়।  জঙ্গলের এক জায়গায় ওরা থামলে সেও থামে ।  তারপর অপেক্ষা করে ওদের পরবর্তী কার্যকলাপের জন্য। মশালগুলো মাটিতে গেঁথে দিতেই স্পষ্ট হয়ে এলো এক পাথুরে মুর্তি। লাল টকটকে তার অবয়ব। চমকে উঠল অঞ্জন , এ তো কালীমা । আর তারপরেই ‘মা মা’  বলে উদ্দাম চিৎকারে জঙ্গল কেঁপে উঠল । কিছ বুঝে ওঠার আগেই রাজার মুখ থেকে কালো কাপড় সরিয়ে একটা লম্বা পাথরের গোঁড়ায় হাত পা বাঁধা রাজা দ্বিতীয় চন্দ্রচূড়ের মাথাটা বেঁধে ‘জয় মা’ বলে এক ডাকাত গর্দানে তরবারি বসিয়ে দিল । অঞ্জনের কান্নায় চিৎকার বেরিয়ে আসতে চাইছিল ঠিক সেই ক্ষণেই আবির্ভূত হল এক নারী মূর্তি। নিমেষে তাঁর অস্ত্র আঘাত হানল ডাকাতদের ওপর। ছত্রভঙ্গ হয়ে ডাকাতেরা ছুটে পালাল জঙ্গলের ভেতর । যেদিকে কড়কড়ে নদী রয়েছে । এদিকে পিছন পিছন চলল সেই নারী মুর্তি। ভীত ক্লান্ত অঞ্জন আর ঘোড়ার পিঠে বসে থাকত পারল না। জঙ্গলের মধ্যেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ল । চোখদুটো নুইয়ে পড়ার আগে একবার দেখতে পেয়েছিল সামনে এক পাগড়িওলা দাড়োয়ানকে । হাতে ছিল তরোয়াল।    
রাজবাড়ির মস্ত পাথুরে ভবানীমণ্ডপে যখন অঞ্জন চোখ মেলল। -- দেখে , তাকে ঘিরে কত লোক । মামা মামীমা, মাসী, দাদু এমন কি নহবত বাজনদারেরা গোল গোল চোখে তার দিকে চেয়ে আছে। চাপা কোলাহল । সেই কোলাহল এড়িয়ে রাঙাপিসি কানের কাছে এসে বলে, বলেছিলাম দিলুমামার কাছে দু ফোঁটা খেয়ে নে। গ্যাস অম্বল হলে সাত ভূতের কাট কাটে ! এবার তো আমার কথা শুনবি ! –বলেই রাঙাপিসি অঞ্জনকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে। 



টিকু আর কনিস্ক

সৌমী আচার্য্য

বারো বছরের টিকু মনেপ্রাণে জানে ক‍্যাপ্টেন আমেরিকা একদিন না একদিন ওর সাথে দেখা করতে আসবেই।নতুন কেনা কম্পিউটার থেকে রোজ সংকেত পাঠানোর চেষ্টা করে মহাকাশে।মাঝেমধ্যে রাতে বাগানের পশ্চিম কোণে বড়ো জামরুল গাছটার নীচে চুপিচুপি এসে দাঁড়ায়।এখান থেকে আকাশটা অনেক বড়ো দেখায়।সেদিন রাতে খোলা মাঠে জোনাকিদের মেলা বসেছে আকাশেও তারার হাট।টিকু একমনে স্পেসশিপ খুঁজছিলো।হঠাৎ কয়েকটা আলো গোল গোল করে ঘুরতে লাগলো মাঠের শরীর ঘেঁষে।টিকু জানে ওগুলো টর্চের আলো।তার সাথে বেশ কিছু ছায়ামূর্তির দৌড়াদৌড়ি।বড়ো বড়ো চোখ করে ও দেখতে দেখতে ভাবতে লাগলো ইনফিনিটি ওয়ার শুরু হয়েছে শিওর।পা টিপেটিপে জামরুল গাছে চড়ে বসলো।দূরে তাকিয়ে থাকলেও বুঝতে পারলো তার খুব কাছেই কার যেন নিশ্বাসের আওয়াজ।নীচে চোখ দিতেই আবছা আলোয় দেখে একটা লোক হামাগুড়ি দিয়ে ওদের বাগানে ঢুকছে তারকাঁটা উঁচু করে।লোকটা শত্রুপক্ষের না বন্ধু সেটা বোঝার রাস্তা খুঁজছিলো টিকু ততক্ষণে লোকটা জামরুল গাছ পেরিয়ে বাগানের মাঝখানে গরুর গাড়ির কাছে এসে চিৎপাত হয়ে শুয়ে পড়লো।ওদিকে বোমা ভৌ ভৌ করে বাড়ি মাথায় করছে।টিকু দ্রুত লোকটার কাছে এসে বুঝলো অজ্ঞান হয়ে গেছে।বাবার গাড়ি তোলার গড়ান দিয়ে হাত ধরে টেনে বারান্দায় তুলে সোজা নিজের ঘরে নিয়ে এলো।ভালো মন্দ পরে দেখা যাবে ।বারান্দায় তালা দিয়ে ঘরে এসে জলের বোতল থেকে জল ছিটিয়ে দিলো লোকটার মুখে।সবজে নাইট ল‍্যাম্পের আলোয় তাকে ক‍্যাপ্টেন আমেরিকার মতোই লাগছে তবে খুবই রোগা।টিকু সহজেই হাত ধরে টেনে নিয়ে এসেছে।জল দেবার পর পিটপিট করে ওর দিকে তাকালো লোকটা ধচমচ করে উঠে বসতেই টিকু গম্ভীর ভাবে বলে উঠলো,বাইরে যারা ঘোরাফেরা করছে তারা তোমায় খুঁজছে?আমি ভালো লোক।ক‍্যাপ্টেন আমেরিকার ভক্ত।তুমি কে খারাপ না ভালো?

-আমি ভালোই হবো বোধহয়।

চিঁচিঁ করে উত্তর দিলো লোকটা।টিকুর কেন জানি মনে হলো এর খাওয়া হয়নি।গলাটা আরো গম্ভীর করে বললো,তুমি কি খাবে কিছু?

-তা খিদে পেয়েছে ঠিকই কিন্তু আমায় পালাতে হবে যে এখনি।

-কেন?

-নইলে ওরা ধরে ফেলবে।আজ প্রায় ধরে ফেলেছিল কোনমতে পালিয়ে এসেছি।

-এবাড়িতে বোমা আছে।

-বোমা?কেন?

-আরে বোমা আমার কুকুর।তাছাড়া আমার বাবার অনেক জমি ঐ বাগানের ডানদিকটায় ছোটছোট ঘরগুলোতে মুনিষরা থাকে ওদের গায়ে খুব জোর তুমি চিন্তা করো না।এই নাও ক‍্যাডবেরী খাও।সকালে মা লুচি,পায়েস দেবে।

লোকটা চুপচাপ খেতে লাগলো।টিকু আবছা আলোয় বুঝলো লোকটা আসলে ওর মাসতোতো দাদা চন্দ্রনীলের বয়েসী।পঁচিশ বছর হবে হয়তো।জিজ্ঞাসা করলো,তোমার নাম কি?

-আমার নাম?ধরো কনিস্ক।

-ধরবো কেন?সত‍্যি নাম নেই?

-আছে তবে আসলে...

-ও,আমায় ভরসা হচ্ছেনা?

-না ঠিক তা নয়।

  টিকু বুঝলো নামটা গোপন রাখতে চাইছে।কারো ব‍্যক্তিগত ব‍্যাপারে নাক গলানো পছন্দ নয় তাই আর প্রশ্ন না করে বললো,কনিস্কদা আমি শুলাম।তুমি চাইলে আমার পাশে শুতে পারো।কনিস্ক ঘাড় নাড়লো।তারপর থেকে তিনদিন হয়ে গেলো কনিস্ক এ বাড়িতেই রয়েছে।রাতের ঘটনাটা বাবা মাকে পুরোটা জানানোয় তারা কনিস্ককে নিশ্চিন্ত থাকতে ভরসা দিয়েছে।কনিস্কের জ্ঞান সব বিষয়ে অসাধারণ।ক‍্যাপ্টেন মার্ভেলের বিড়াল যে নিক ফিউরির একটা চোখ কানা করে দিয়েছে এই কথাও কনিস্ক জানে আবার দুর্যোধনের বোনের নাম দুঃশালা সেটাও জানে।গতদিন টিকু দেখেছে কনিস্কদা মাকে গার্লিক ব্রেড করা শেখাচ্ছিলো মন দিয়ে।তবে বাজার থেকে ফিরে আজ টিকুর বাবা সূর্যকান্ত খুবই মুশড়ে পড়লেন।

  -শান্তিনিকেতন এখন আর আগের মতো নেই বুঝলে টিকুর মা।অতো বড়ো মাপের বিজ্ঞানী চিন্তারূপ পুতুতুণ্ডু তাকে নাকি তিনদিন ধরে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।রাঙামাটিতে তার নিজস্ব বাড়ি থেকে উধাও।ঘর দুয়ার ভাঙচুর করে রেখে গেছে।

  কথাটা শুনেই কনিস্ক ছটফট করে উঠলো।হাতের আখের গুড়ের শরবতের গ্লাস টেবিলে রেখে বললো,আমায় যেতে হবে,এভাবে চলতে থাকলে আমি ধরা পড়ে যাব।সূর্যকান্ত চশমাটা নাকের ডগায় এনে বললো,কিছু বললে কনিস্ক?টিকু দেখলো কনিস্ক কিচ্ছু বললো না মুখটা কালো করে চলে গেলো।রাতে খুটখুট আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেলো টিকুর। আওয়াজটা টানা হয়েই চলেছে।ওর ঘরের দরজা খোলা পাশে ফাঁকা বালিশ।খুব ধীরে বাইরে এসে দেখলো বারান্দার গ্রিল ভেজানো। চুপিচুপি আওয়াজটায় কান রেখে এগোতেই দেখে কনিস্ক একটা যন্ত্র নিয়ে কিছু করছে।চুপচাপ গাছের আড়াল থেকে টিকু দেখতে লাগলো।খুটখুট আওয়াজটা থেমে যেতেই হালকা বেগুনি আলো যন্ত্রটা থেকে সামনের শিরিষ গাছ পড়লো।গাছটা দুলে উঠলো।

-তুমি হাজার চেষ্টা করেও আমাদের রাখতে পারবে না।

গাছটা কথা বলছে!কি তিক্ষ্ণ আওয়াজ।আশ্চর্য!টিকুর গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো।দেখলো কনিস্কদা হাত জোড় করে বলছে,কিছু কি করা যায় না?

-না,যায় না।আজ রাতে হোলোস্কা থেকে ক‍্যাপ্টেন রুহ্  এখানকার তিনশো গাছ নিয়ে যাবে।পড়ে থাকবে কেবল তাদের কঙ্কাল।মানুষ বুঝতেও পারবে না।ধীরে ধীরে অক্সিজেন কমতে কমতে ফুরিয়ে যাবে।আর পৃথিবী ধূসর ছাই হয়ে যাবে।

-আমি যে এই পৃথিবীকে বড়ো ভালোবাসি কিছু কি করা যায় না?

  -মানুষের লোভ কমাবে কি করে?আমরা যখন প্রিং মিল্কিওয়ে থেকে পৃথিবীতে আসি তখন কথা ছিলো আমরা বন্ধু হয়ে সাহায‍্য করবো অক্সিজেন দেব।পৃথিবীর আবহাওয়া পাল্টে সুন্দর করে দেব।হঠাৎ একদিন মানুষ দাবী করলো আমরা কথা বললে তাদের নাকি সমস‍্যা হচ্ছে।আমাদের গলা তীক্ষ্ণ।আমরা বন্ধুর দায়িত্ব পালন করলাম।নীরব হলাম আর তারা আমাদের কষ্ট বোঝা ছেড়ে দিলে।নিজেদের স্বার্থে যথেচ্ছ ভাবে হত‍্যা করলো আমাদের।ক‍্যাপ্টেন রুহ্ আমাদের বাঁচাতে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।পৃথিবীর উপর হোলোস্কার বাসিন্দাদের খুব রাগ।

  কনিস্ক হতাশ হয়ে তাকিয়ে থাকে আকাশে।টিকু দেখে হালকা কমলা আলো নেমে আসছে ওদের বাগানে।আলোটা মাটির উপরে স্হির হয়ে কিছুক্ষণ তিরতির করে কাঁপলো তারপর রঙ পাল্টে গাঢ় সবুজ হতেই চুইইইইই করে আকাশে তীব্রগতিতে উঠে মিলিয়ে গেল।কনিস্ক হালকা বেগুনি আলোটা যন্ত্র থেকে ফেললো শিরিষ গাছে।গাছটা স্হির।হতাশ হয়ে বসে পড়লো কনিস্ক।

-চলে গেছে,নেই।

টিকুর মাথা বনবন করছে,কান ভোঁ ভোঁ করছে।চোখ পিটপিট করে বললো,কনিস্কদা এসব কি হচ্ছে?

-মহা বিপদ টিকু।এবার সব শেষ।

-একটু বুঝিয়ে বলবে?

-বলবো,চলো ঘরে যাই। 

ঘরে এসে কিছুক্ষণ গালে হাত দিয়ে চুপ করে বসে থাকলো কনিস্ক।তারপর বললো,টিকু আমি যদি বলি,আমি ভবিষ্যৎ থেকে এসেছি তুমি কি বিশ্বাস করবে?আমার নাম গ৩০২১।

টিকু চোখ সরু করে তাকিয়ে বললো,প্রমাণ থাকলে করবো।তবে এটা কেমন নাম?

  কনিস্ক মৃদু হেসে বললো,এখন মানুষের নাম এমন সংখ‍্যাতেই হয়।এরপর নিজের পকেট থেকে একটা ছোট চিপ মতো বার করলো,তারপর সেটা টিকুর কানের পিছনে সেট করতেই,টিকু স্পষ্ট সিনেমার মতো চোখের সামনে কিছু ছবি দেখতে পেল।মুখে মুখোশ পরে বহু লোক শহর ময় হেঁটে বেরাচ্ছে।মুখোশ থেকে নল বেরিয়ে পিঠের সিলিণ্ডারে আটকানো।শহরটা কেমন যেন রঙহীন।চতুর্দিক কালচে,ধোঁয়া ধোঁয়া।কিছু একটা চরম অসংগতি শহরটায়।লোকজন খুব কম।টিকু বলে উঠলো,এটা কি গো?

-তোমার শহর আজ থেকে মাত্র পঞ্চান্ন বছর পর।

-কি বলছো কনিস্কদা?

-ঠিকই বলছি।যে অসংগতিটা তুমি দেখছো সেটা গাছপালা না থাকা।তুমি স্ক্রিনের ডানদিকে ধরে এগোতে থাকো,দৃশ‍্য বদলাতে থাকবে।হ‍্যাঁ এগোচ্ছো তো!কি দেখতে পাচ্ছো একটা জেলখানার মতো জায়গা?অনেক পাহারা সেখানে বুঝতে পারছো।

-পারছি।এখানে কি আছে?

-এই শহরের একমাত্র পার্ক।যেখানে অতি কষ্টে বিয়াল্লিশটা গাছকে বাঁচানো হয়েছে।কিছু এলাকা জুড়ে ঘাস আছে। এখানে প্রবেশের টিকিট মূল‍্য কত বলতো টিকু?এককোটি টাকা।

-কি বলছো?

-ঠিকই বলছি।বিশুদ্ধ অক্সিজেন নিতে বড়লোকরাই কেবল এখানে আসেন।আমার পিছনে যারা লেগে রয়েছে তারা ভবিষ্যৎ এবং বর্তমান দুটো জায়গাতেই আছে।কারণটা বুঝিয়ে বলছি তোমায়।আমাদের পৃথিবীতে কেউই এখন পঁয়ত্রিশ বছরের বেশি বাঁচে না।এটা আমায় ভীষণ পীড়া দিত।কলেজে পড়া কালীন আমি রিসার্চ শুরু করি।আমার গবেষণাপত্র সারা পৃথিবীতে সেরা তিনে জায়গা করে নিলে আমি হোলোস্কা,লিকো আর প্রিং এর মধ‍্যে যে কোন একটা গ্রহে বিনা খরচে যাবার টিকিট পাই।আমি হোলোস্কায় যাই।সেখানে আমি এমন একটা জিনিস পাই যা দিয়ে অতীতে সফর করা যায়,কি বলতো জিনিসটা?

  টিকু চোখ বড় করে বললো,টাইমমেশিন?কনিস্ক হেসে বললো,নাহ্।আমার কাছে ঐ তোমার টাইমস্টোনের মতো একটা জিনিস আছে।হোলোস্কা গ্রহ সফরের সময় নিয়োসথিরু আমায় দিয়েছিলো।

-নিয়োসথিরু কে?

-সে এক মহান বৃক্ষ।কোটি কোটি বয়স তার।কেউ কেউ বলে এই সব কিছু তারই সৃষ্টি।

-ভগবান!

  কনিস্ক হেসে বলে,হ‍্যাঁ ভগবান তো বটেই।এই পৃথিবীতে গাছেদের সেই পাঠিয়েছিল।হোলোস্কা ভিজিট করে বুঝতে পারি একদিন পৃথিবীও কত সুন্দর ছিল।নিয়োসথিরুর সাথে দুদিন আলাপচারিতায় জানলাম তিনিও কষ্ট পাচ্ছেন পৃথিবীর করুণ পরিণতিতে কিন্তু হোলোস্কা গ্রহের বাসিন্দাদের রাগ এতটুকু কমেনি।তারা ঐ পার্কে বন্দী গাছেদের প্রাণ নিয়ে আসতে চায়।এই কাজে রুহ্ হলেন নেতা।নিয়োসথিরু আমায় একটা স্টোন দেন যেটার সাহায‍্যে আমি অতীতে এসেছি।যদি কোনভাবে গাছেদের অপমৃত‍্যু ঠেকাতে পারি তবে পৃথিবী বেঁচে যাবে হয়তো।হয়তো আমার পৃথিবী ধূসর হবে না।

-কিন্তু তোমাকে কারা ধরতে চায়?আর কেন?

  -রুহ্ চায়না আমি পৃথিবীকে সবুজ রাখতে সফল হই।তার মানুষের উপর ভীষণ ঘৃণা।মানুষের মতো স্বার্থপর কেউ নেই বলেই তার বিশ্বাস।তাই আমায় আটকাতে চায়।আর এই বর্তমানের কিছু লোভী লোক বুঝতে পেরেছে আমার কিছু আশ্চর্য ক্ষমতা আছে।যেমন ধরো আমার ভেতর এমন একটা সফটওয়‍্যার আছে যে আমি সহজেই মানুষের মন পড়তে পারি।মানে ভালো মন্দ বুঝতে পারি,মনের কথাও বুঝতে পারি।যেমন তুমি এখন ভাবছো আমি সত‍্যিই ক‍্যাপ্টান আমেরিকা কি না!।ভালোবাসা ছাড়া সব বুঝতে পারি আমি।আবার আমি মাটি দেখে বলতে পারি তার নীচে কি খনিজ আছে এইসব।চিন্তারূপ পুতুতুণ্ডের কাছে আমি সেক্রেটারি হিসেবে জয়েন করি।তাকে আমিই চুজ করেছিলাম।তিনি বড়ো ভালো মানুষ।পৃথিবীর আবহাওয়া কি করে রক্ষা করা যায় তাই নিয়ে নিরন্তর পরিশ্রম করছেন।নানাভাবে তিনি বুঝে যান আমার ক্ষমতাগুলো।কথাও দেন আমাকে সাহায‍্য করবেন।এরপর থেকেই গণ্ডগোল শুরু।ওনাকে আক্রমণ করা হয়েছে আমার জন‍্যেই।

  অনেকক্ষণ কথা বলে হাঁপাতে লাগলো কনিস্ক।টিকু তাড়াতাড়ি জল এগিয়ে দিল।দৌড়ে ফ্রিজ থেকে একটা ক‍্যাডবেরী এনে দিল।চুপচাপ খেয়ে নিল কনিস্ক।তারপর ঘুমিয়ে গেল।টিকুর কিন্তু ঘুম এলো না।ওর মনের ভেতর ঝড় চলছে।এমন সবুজে সবুজ শান্তিনিকেতন ধূসর কালো হয়ে যাবে?অক্সিজেন সিলিণ্ডার নিয়ে ঘুরবে মানুষ?ভাবতে থাকে টিকু।ভাবতে ভাবতে একটা পথ বের করেও ফেলে।তখনি কনিস্ককে ঘুম থেকে ডাকে।সবটা শুনে কনিস্ক বুকে জড়িয়ে ধরে টিকুকে।

-চলো এখনি যাবো।আমার হাত শক্ত করে ধরে থাকবে ছাড়বে না।

  টিকু প্রবল ঝড়ের মধ‍্যে দিয়ে যেন উড়ে চলেছে।শোঁ শোঁ করে সব পিছনে সরে যাচ্ছে।টাইমস্টোন সাংঘাতিক শক্তিশালী।ওরা এসে থামলো ফাঁকা মাঠে।ঐ যে কমলা আলোটা নেমে আসছে।যন্ত্রটার পিছন দিকটা খোলা।দৌড় লাগালো দুজনে।সোজা ঢুকে গেল মহাকাশযানটার ভেতরে।একটা বড় চেয়ারে বসে আছে রুহ্।

-রুহ্দা,আমার একটা কথা বলার আছে একটু শোনো।

  চেয়ারটা ঘুরতেই ঘাবড়ে যায় টিকু।মানুষের মতো অথচ শরীরের উপরের অংশটুকু গাছ।ঠিক যেন এণ্ডগেমের গ্রুট।কমলা আলো তার চোখে ঝলসে উঠলো।

-কে তুমি কেন এসেছো?নেমে যাও আমার যান থেকে নইলে ছাই করে দেব।

-আমার মা বলেন,সবকিছু ধ্বংস করা সহজ কিন্তু ধৈর্য্য ধরে তাকে গড়ে তোলা বা সংশোধন করা কঠিন।এই যে দেখ আমার হাতের লেখা খুব খারাপ।শুধু বকা খেতাম।রাগের চোটে আরো খারাপ করে লিখতাম।মা একদিন আদর করে বললো,খারাপ কে আদর করো যত্ন করো টিকু দেখবে সে আদর বোঝে।তুমি জানো রুহ্দা আমি এবার হাতের লেখায় সেকেণ্ড প্রাইজ পেয়েছি।আর তুমি তো গ্রুট।গ্রুট কি খারাপ চাইতে পারে বল?

-কি বলতে চাও তুমি?আর এই গ্রুটটা কি?

-গ্রুট হল বন্ধু গাছ মানুষ।শোনো এভাবে পৃথিবী থেকে গাছেদের প্রাণ নিয়ে যেওনা প্লিজ।বরং চলো না সবাই মিলে এমন কিছু করি যাতে পৃথিবী সুস্থ থাকে।

-অসম্ভব,মানুষের মতো লোভী প্রাণীদের জন‍্য কিছু করবো না।

-এ পৃথিবীতে কত ভালো মানুষ তো আছেন বলো।তাদের কথা ভাবো।তারা কত গাছ ভালোবাসেন।সেই ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা যারা আমার মতো তাদের যদি শেখানো যায় গাছ আসলে বন্ধু তবে কেমন হবে বলো?

রুহ্ হঠাৎ চুপ হয়ে যায়।তাহলে পৃথিবীতে সবাই খারাপ নয়।গাছ কেউ কেউ ভালোবাসে।কনিস্ক নিজের চিপটা রুহ্কে দেয়।সেটা স্ক্রিনে লাগিয়ে সারা পৃথিবীতে কে কোথায় কি ভাবে গাছেদের বাঁচানোর জন‍্য লড়াই করছে মন দিয়ে দেখে রুহ্।কমলা আলোটা আস্তে আস্তে শান্ত হয়ে সাদাটে হয়ে আসে।রুহ্ হাত বাড়িয়ে দেয় টিকুর দিকে,কথা দাও চেষ্টা করবে গাছেদের বাঁচানোর জন‍্য।চোখে জল নিয়ে টিকু বলে,করবো কথা দিলাম।

 টিকু এখন সারা পৃথিবীতে পরিচিত নাম।সবুজ  টাইমস্টোন নামে তার গড়ে তোলা দল বৃক্ষরোপণ,গাছ বাঁচাও আন্দোলন সহ নানা কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।দারুণ সফলতা পেয়েছে টিকু।আর মজার ব‍্যাপার হলো কেউ যদি টিকুর সামনে এসে মনে মনে ভাবে গাছ কাটার কথা টিকু অমনি তার হাত চেপে ধরে।তারপর শুরু হয় তাকে বোঝানো।কি করে সে অন‍্যের মনের কথা বোঝে তোমরা তো বুঝেই গেছো।ঠিক ধরেছো কনিস্ক এর জন‍্যে দায়ী।কনিস্কর শহর এখন অনেক সবুজ হয়ে উঠেছে।কাউকে অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে ঘুরতে হয় না।আর রুহ্!সে ভীষণ খুশি।পৃথিবীকে বাঁচাতেই তো শিখেয়েছিল নিয়োসথিরু।


আলোকিত অনুভব
          
দেবাশীষ মুখোপাধ্যায়

বিনয়বাবুর পরিচয় দাপুটে শিক্ষকের। শ্রীরামপুর ব্লকে সকলেই ওনাকে চেনে রাসভারী গম্ভীর শিক্ষক হিসাবে।ইংরাজির শিক্ষক বিনয়বাবুর পান্ডিত্যও প্রশংসিত। স্কুলে ছাত্ররা বেশ সমীহ করে ওকে। চোখে হাই পাওয়ারের চশমা পরে ওনার চাউনি যেন এক্স-রে মেশিনের নীচে দাঁড় করিয়ে দেয় ছাত্রদের।

       দীর্ঘ বাইশ বছরের শিক্ষকতা জীবনে অনেক অভিজ্ঞতা ওনার ঝুলিতে।তাই নবীন ও প্রবীন সকল সহকর্মীই নিজেদের সমস্যায় ওনার পরামর্শ নেন।এদিক দিয়ে বিনয়বাবুকে সকলে বড়দাদার ভূমিকায় পায়। অদ্ভূত ওনার চরিত্র --সমস্যা থেকে বের হবার রাস্তা যেন ওনার চেনা।সকলেই তাই আড়ালে তাকে 'বিপদ্ তাড়ণ '
বলে।

      এই বিনয়বাবুর সেইদিন এক অদ্ভূত অভিজ্ঞতা হল। শৃঙ্খলার সমস্যা উঁচু দিকের ক্লাসগুলোতে বেশি হয় বলে ওনার ক্লাস নবম থেকে দ্বাদশ পর্যন্ত। ওনার ক্লাস থাকলে ছেলেরা একটু সতর্ক থাকে। পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত ওনার ক্লাস থাকে না। সেদিন অনেক সহকর্মী অনুপস্থিত।তাই ষষ্ঠ শ্রেণীর 'ক' বিভাগে বাংলার ক্লাসে ওকে পাঠান হল।

      ঐ ক্লাসের ছেলেদের সাথে বিনয়বাবুর বিশেষ পরিচয় নেই। ছেলেরাও ওনার ক্লাস করে না বলে ওনার রাসভারী চরিত্রের পরিচয় পায় নি। ক্লাসে গিয়ে দেখলেন যথারীতি ছেলেগুলো চূড়ান্ত হইচই করছে। উনি থামানোর চেষ্টা করলেন।গলার আওয়াজ এবং ওনার চাউনিতে কিছু ছিল যাতে ছেলেরা স্পষ্টই বুঝে গেল,এ মাটি বেশ শক্ত।উনিও সেভাবে ক্লাসের রাশ ধরলেন।

        নামকরা স্কুল।তাই বেশ ভালো পরিবারের ছেলেরাই এ স্কুলে আসে।গোলগাল চেহারার দুষ্টুমিভরা মুখগুলোক সামনে দেখলেন। ছেলেগুলোর মুখে যেন ক্লান্তির ছাপ।দিনের শেষ ক্লাস।যেন সকলের আর ক্লাসে মন নেই। ব্যাপারটা উপলব্ধি করেই বিনয়বাবু ওদের একটা গল্প লিখতে বললেন। বিষয়টা উনিই দিয়ে দিলেন ---" রাস্তায় যেতে যেতে হঠাৎ একটা আহত পাখির বাচ্চাকে তুমি দেখলে। বাচ্চাটিকে নিয়ে তুমি কি করবে? " শব্দ সীমা নেই। তবে লিখতে হবে প্রত্যেককেই।সময়,কুড়ি মিনিট।

       বিষয়টা একেবারে নতুন।তাই ছেলেরা আগ্রহ নিয়ে শুরু করল। লিখতে লিখতে অনেকে আবার কিছু বিষয় জানতে চাইল। বিনয় বাবু সকলের প্রশ্নের সুন্দরভাবে উত্তর দিলেন। ছেলেরা খুব খুশি মনে লেখা শুরু করল। তৃতীয় বেঞ্চের কোণে বসে এক গোলগাল চেহারার ছেলে। লিখতে লিখতে পাশের ছেলেটাকে কিছু বলছে আর হাসছে। উনি কয়েকবার লক্ষ্য করলেন। যেহেতু লিখছে তাই আর বকাবকি করলেন না। কিন্তু অমনোযোগী ছেলেটা তার নজরে রইল।

        কুড়ি মিনিট শেষ হতেই বিনয়বাবু লেখা থামাতে বললেন সকলকে।দেখে মনে হল সকলেই কিছু না কিছু লিখেছে। উনি বুঝলেন, বিষয়টা ছুঁয়েছে সকলকে। প্রথম বেঞ্চের দুটি ছেলে বলার পর উনি ঐ অমনোযোগী ছাত্রটিকে ওর লেখা পড়তে বললেন।ছেলেটি নাম বলল, রাজসিক মন্ডল।নামটি বেশ পছন্দ হল ওর। কিন্তু ছেলেটি খাতাটা নিয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। কিছুতেই পড়বে না। অবশেষে ওনার বকুনিতে কাচুমাচু হয়ে শুরু করল----" টিউশন থেকে বন্ধুরা মিলে বাড়ি ফেরার পথে রাস্তায় একটা পাখির বাচ্চাকে পড়ে থাকতে দেখলাম। বাচ্চাটার গায়ে কাটা দাগ।বেড়ালে আঁচড়ে দিয়েছে বোধহয়। আমরা বন্ধুরা মিলে পাখিছানাটাকে রাস্তা থেকে তুললাম...।"

        এই পর্যন্ত ঠিক ছিল।বিনয়বাবুর ভালোও লাগছিল।তাই কয়েকবার 'বাঃবাঃ--বেশ বেশ' করে উঠলেন। কিন্তু তার পরের অংশ শুনে আক্কেল গুড়ুম্।ছেলেটা পড়ে চলল---" বন্ধুরা মিলে ঠিক করলাম পাখিটাকে রোস্ট করে খাব।তাই আমাদের বাড়ির পিছনে গাছের আড়ালে নিয়ে গিয়ে বাচ্চাটার গায়ে লাল পিঁপড়ে ছেড়ে দিলাম। পিঁপড়েগুলোর কামড়ে বাচ্চাটা একটু ফুলে গেল।একটু মোটা হল। এবার বাচ্চাটিকে মেরে পালকগুলো ছাড়ালাম।তারপর শুকনো পাতা জ্বালিয়ে আগুন ধরালাম।তাতে সেঁকে বিটনুন দিয়ে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেতে লাগলাম শিক কাবাবের মত। সকলে ভাগে অল্প করে পেল।আর একটু বেশি মাংস হলে ভালো লাগতো....."

        বিনয়বাবু চমকে উঠলেন।কী নৃশংস! কী অমানবিক !এরকম বর্বরতা এই বয়সের বাচ্চার মনে।হা ভগবান, কি পরিবেশে বড়ো হচ্ছে ছেলেটা ! ওনার মাথাটা ঝিমঝিম করতে লাগলো। এতো বছরের শিক্ষকতা জীবনে এরকম ঘটনা একদম বিরল। সত্যিই নামের মতোই কর্মকাণ্ড।রাজসিকই বটে ! ক্লাসের অন্য বাচ্চারা হইহই করে উঠল।ও ভাবল, বেশ ভালো হচ্ছে। সোৎসাহে পড়তে লাগল বাকি অংশ ---" পালকগুলো যত্ন করে প্যাকেটে মুড়ে রাখলাম।ওয়েলেক্সে পালক বিক্রির পরিকল্পনা হল। কিছু আদিবাসী টাকাপয়সা নিয়ে এল কিনতে। আমরা আদিবাসী গুলোকে গাছে বেঁধে খুব পেটালাম। ওদের টাকাপয়সা কেড়ে নিয়ে আমরা দোকান থেকে পিৎজা বার্গার কিনে খেলাম। লোকগুলো গাছে বাঁধা অবস্থায় পালিয়ে এলাম।"

      পাঠ শেষ।চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটা।রাগে অগ্নিশর্মা বিনয়বাবু বলে উঠলেন --"বাবা রাজসিক, তোমার বাড়ি কোথায়?"
রাজসিকের সপ্রতিভ উত্তর--"বাসস্ট্যান্ডের পাশের দোতলা বাড়িটা আমাদের স্যার।"
ছেলেটার উত্তর দেবার ধরনে বিনয়বাবু বুঝলেন ছেলেটার একটু বড়লোকি দম্ভ আছে।
----"তোমার বাবা কি করেন?"
-----"আমোদপুর হাইস্কুলের হেডমাস্টার।"
----"মা কি বাড়িতেই থাকেন? না চাকরি করেন?"
----"মা ও স্কুলে পড়ান।বিনোদমোহিনী গার্লস স্কুলের ভূগোলের ম্যাডাম।"
      কথা বলার সময় উনি লক্ষ করলেন ছেলেটার কথাবার্তায় এক গর্বের ভঙ্গি। বাবা মা দুজনেই শিক্ষকতা করেন। মনে হল,এটা ওর গর্বের বিষয়। কিন্তু লেখাটা যে স্যারের খারাপ লাগতে পারে,এ বোধটাই নেই। বুঝলেন, ছেলেটা শরীরেই বড়ো হচ্ছে। মানসিক সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হচ্ছে না। হঠাৎ রাজসিক বলে উঠল--"লেখাটা ভালো হয়েছে স্যার?"

        বিনয়বাবু এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না। বলে উঠলেন--"একশো চল্লিশ টাকা কেজি মুরগির মাংস কিনে খাওয়ানোর মত ক্ষমতাও কি তোর বাবার নেই রে ?"

       স্যারের রাগের ছোঁয়াচ পেল রাজসিক। সঙ্গে সারা ক্লাস। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছেলেটা। ক্লাস শেষের ঘন্টা বাজল।ব্যাগ কাঁধে ছেলেরা বাড়ি যাবার জন্য তৈরি। একরাশ মন খারাপের মেঘ বিনয়বাবুর হৃদয় জুড়ে। আস্তে আস্তে ক্লাসের বাইরে বেরিয়ে এলেন।এতদিনের শিক্ষক জীবনে রাজসিক যেন এক জীবন্ত জিজ্ঞাসা এখন। ছেলেটা বিপথগামী হয়ে পড়ছে। এক্ষুনি ওর বাবা মার সাথে কথা বলা প্রয়োজন। নাহলে বড়ো দেরি হয়ে যাবে। টলোমলো পায়ে এগিয়ে চললেন বসার ঘরের দিকে।

      হঠাৎ রাজসিক সামনে।বিনয়বাবু চমকে উঠলেন।পায়ে হাত দিয়ে ও বলে উঠল--"বাবাকে বলবেন না স্যার।আর কখনো হবে না।"
       বিনয়বাবু ছেলেটির চোখের দিকে তাকালেন। জলভরা লাল দুটো চোখ। ঠিক পদ্মের মত। অভিজ্ঞ উনিও দ্বিধায়। অনুতাপ? নাকি বাবার ভয়? ছেলেটার মাথায় একবার হাত ছুঁইয়ে এগিয়ে চললেন।এক অসহায় কান্না যেন ওনার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। মুখে চোখে জল দিয়ে একটু শান্ত হলেন। মনে মনে ঠিক করলেন, ছেলেটাকে একটা সুযোগ দেওয়া যাক।

      সময় তার আপন ছন্দে চলে।ঐ ঘটনার পর কেটে গেছে অনেকগুলো মাস। ওর মনে এখন সেই ঘটনার রেশ প্রায় ফিকে। একদিন হঠাৎ সকাল থেকে ওনার শরীর ঠিক স্বাভাবিক ছন্দে নেই। কেমন খারাপ লাগা শরীর জুড়ে। কিন্তু স্কুলে পরিচালন সমিতির একটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিং থাকায় উনি অসুস্থ শরীর নিয়েই স্কুলের পথে। ট্রেন থেকে নেমে মিনিট চারেকের হাঁটা পথ। হেঁটেই চললেন। স্কুলের গেটের কাছে একটা জটলা নজরে এল। রাস্তার পাশে কিছু পথচারির সাথে ওনার স্কুলের কিছু ছাত্র ভিড় করে।একটু এগোতেই স্যারকে দেখে ছাত্রদের ভিড় পাতলা। ফাঁক দিয়ে দেখতে পেলেন একটা ছাত্র পরম মমতায় একটা কুকুর ছানার বাঁ পা রুমাল দিয়ে ব্যান্ডেজ ‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌ করে দিচ্ছে। ক্ষতস্থান দিয়ে রক্ত পড়ছে।হয়ত ছানাটা রাস্তার ওপর চলে এসেছিল। সাইকেল বা রিক্সায় ধাক্কা দিয়েছে।বোতল থেকে জল বার করে ছেলেটা ছানাটার মুখে দিল। কষ্টের চিৎকার থামিয়ে ছানাটা জল খেল কিছুটা।বিনয়বাবুর বুকের পাঁজরে আবেগের ছলাৎ ছল। জলে ভেজা চোখে উনি দেখলেন ছেলেটা ওর টিফিনের এক টুকরো পাউরুটি কুকুর ছানাটাকে খাওয়াচ্ছে। ধ্যানমগ্ন যেন। একমনে জীবসেবা । এদিকে ছানাটাও ভালোবাসার স্পর্শ পেয়ে পাউরুটিতে কামড় দিচ্ছে।

      গর্বে মাথাটা যেন আকাশ ছুঁতে চাইছে বিনয়বাবুর।তারই ছাত্রের মানবিক মুখ আজ তাকে বিচলিত বিহ্বল করে তুলেছে। এগিয়ে গেলেন ছেলেটার কাছে। ওর পিঠে হাত রাখলেন। চমকে ছেলেটা মুখ তুলে পিছনে তাকাল। একরাশ বিস্ময়।এ তো সেই রাজসিক !সেই ছোট্ট অমানবিক ছেলেটা আজ এতো বড়ো মনের মালিক হয়েছে।

     বিনয়বাবু আর ওর সামনে দাঁড়াতে পারলেন না। বড়ো ধাক্কা তার হৃদয় জুড়ে।এই ঘুনপোকা ধরা সমাজে রাজসিক আজ জ্যান্ত বিস্ময় ! শিক্ষক হিসাবে এই পরিবর্তনটাই তো চেয়েছিলেন উনি। শিক্ষক হিসাবে এই মানবিক পরিবর্তনই চান সব ছাত্রের। একবুক ভরসা পেলেন। কাঁপতে থাকা এই বিপন্ন সময়ে তাহলে এরকম পরিবর্তন ও আসে ! হ্যাঁ হ্যাঁ,আসতে বাধ্য।বুক ভরে শ্বাস নিয়ে যেন ভিতরে ভিতরে বলে উঠলেন--শিক্ষক সমাজ আজও মরেনি। চারপাশের অপপ্রচারের মাঝেও আজও তারা মাথা উঁচু করে। আকাশের দিকে তাকালেন। দেখলেন ,সবুজ তাজা নবীন প্রাণগুলো উদার আকাশের নীলিমায় রামধনুর রঙ মেখে খেলা করে চলেছে......


শারদ শব্দজব্দের সমাধান:
পাশাপাশি: ১) উমাপতি ৫) জয়ং ৭) সর্বজয়া
৯) নয়না ১১) বরাহ ১২) দশহরা ১৩) লঙ্কেশ ১৪) জয়পাল
উপর নিচ: ২) পদ্মাসনা ৩)  বিজয়া ৪) হংস বাহনা
৬)  দানব দলনী ৮) জন ১০) কাশ ১১) বরাভয়
১২)  দশমী

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

1 Comments

  1. খুব সুন্দর সব গল্প কবিতা বড় এবংছোটো
    সকলের উপযোগী।

    ReplyDelete