জ্বলদর্চি

বিজ্ঞান-সাধিকা অধ্যাপিকা লিজা মাইটনার ― 'জার্মানির মাদাম কুরি' /পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

বিজ্ঞানের অন্তরালে বিজ্ঞানী ।। পর্ব ― ৪১


বিজ্ঞান-সাধিকা অধ্যাপিকা লিজা মাইটনার ― 'জার্মানির মাদাম কুরি' 

পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা


অটো হান-এর মাথায় হাত! চোখে সর্ষেফুল! মাথা ধরে ধপাস করে বসে পড়লেন চেয়ারে। দারুণ অসহায় বোধ করছেন। ঘটনার আকস্মিকতায় তিনি বিহ্বল। কিংকর্তব্যবিমূঢ়!

'হিটলারের গেস্টাপো বাহিনী অতি সম্প্রতি আবিষ্কার করেছে― মিস লিজা মাইটনার না-কি পুরোপুরি আর্য নন। যেকোনও সময় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হতে পারে'― গোপনে এমন হৃদয় বিদারক কথা শুনিয়ে গেল প্রফেসর হান-এর এক ছাত্র। 

তারপর থেকে প্রফেসরের মাথা অকেজো। আসলে কুমারী মাইটনার ডালহেম-এ কেইজার উইলহেল্ম ইন্সট্যুট-এ প্রফেসরের প্রিয় শিষ্যা। মানসকন্যা! নিবিড় সম্পর্ক। কুমারী মাইটনার-এর অভাবে জার্মানির শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান মন্দির ডালহেম ইন্সট্যুট-এর বুনিয়াদ ধসে পড়বে ভেবে অতিশয় শিউরে উঠছেন প্রৌঢ় বৈজ্ঞানিক হান (১৮৭৯―১৯৬৮)।

উপায়ন্তর না-দেখে তিনি ছুটলেন ম্যাক্স প্লাঙ্ক-এর নিকট। কোয়ান্টাম থিওরি'র (১৯০০) জনক ম্যাক্স প্লাঙ্ক (১৮৫৮―১৯৪৭)। দুজনে পরামর্শ করে ছুটে গেলেন বার্লিনে; সরাসরি অ্যাডলফ হিটলার-এর সঙ্গে দেখা করতে। দুজন বিজ্ঞান-ভিক্ষুর কথা শুনে-টুনে অ্যাডলফ হিটলার-এর শ্লেষ-মাখা জবাব―
'আপনারা কি মনে করেন এই ফ্রয়লাইন লিজা মাইটনার-এর পাণ্ডিত্য সেই ইহুদি-বাচ্চা আইনস্টাইন-এর চাইতেও বেশি?'
নতমস্তকে ফিরে এলেন হান আর প্লাঙ্ক, বার্লিন থেকে ডালহেম। সেটা ১৯৩৮ সাল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ দোরগোড়ায় শিঙ্গা ফুঁকছে। সামনেই গ্রীষ্মাবকাশের ছুটি। সুযোগ দেখে একদিন গ্রীষ্মাবকাশ কাটানোর অছিলায় গোপনে ডালহেম ত্যাগ করলেন চিরকুমারী মাইটনার।

সুইডেনের দক্ষিণপ্রান্তে সমুদ্রতীরের একটি ছোট্ট জনপদ কুংগলভ (Kungalv)। বেশ শান্ত নিরিবিলি জায়গা। আর দারুণ মনোরম। একা একাই সেখানে ঘাঁটি গাড়লেন মিস লিজা। অলসতায় সময় কাটছে। কিছুদিন পর সেখানে ক্রিশমাস ছুটি কাটাতে এলেন তাঁর বোনপো ডক্টর অটো রবার্ট ফ্রিশ (১৯০৪―১৯৭৯)। একজন প্রথম শ্রেণীর পদার্থবিজ্ঞানী। তিনিও জার্মানি থেকে বিতাড়িত। আপাতত তাঁর ঠাঁই কোপেনহেগেনে; প্রফেসর নীলস বোহর-এর ছত্রছায়ায় তাঁর আস্তানা, গবেষণা। মাসির নিকট বেড়াতে এসে একটা দুর্ধর্ষ জিনিস আবিষ্কার করেছেন ফ্রিশ। ঠিক আবিষ্কার করেছেন বললে বোধহয় ভুল বলা হবে; বলা ঠিক অদ্ভূত এক সত্য ঘটনার সাক্ষী রইলেন। 
    
একটি মুখবন্ধ মোটা খাম এল মিস লিজা'র ঠিকানায়। চিঠির প্রেরক অধ্যাপক অটো হান, ডালহেম। ততদিনে প্রফেসর হান আর তাঁর দক্ষিণহস্ত ডক্টর ফ্রিৎজ স্ট্র্যাসম্যান ডালহেম-এ কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ বাঁধিয়ে দিয়েছেন। হাতেকলমে নিউক্লিয়ার ফিশন (Nuclear Fission বা নিউক্লিয় বিভাজন) ঘটনার সফল ল্যাবরেটরি পরীক্ষা সম্পন্ন করেছেন দুজনে। আর দূরে বসে প্রফেসর হান-এর পরীক্ষালব্ধ ফলাফলের বিজ্ঞানসম্মত সবিস্তার চূড়ান্ত ব্যাখ্যা প্রদান করলেন প্রফেসর হান-এর মানসকন্যা কুমারী মাইটনার। এ যেন গুরু-শিষ্যার এক অসাধারণ আত্মিক যোগসাজশ! সমসাময়িক দুটি ভিন্ন আর্টিকেল― একটি ডালহেম থেকে আর একটি সুইডেনের ছোট্ট শহরতলি থেকে ছাপতে গেল পত্রিকা অফিস। আর তার সাক্ষী রইলেন অটো ফ্রিশ। এইসময় সুইডেন থেকে মা শ্রীমতি অগাস্টি মাইটনার ফ্রিশ'কে তিনি চিঠি লিখলেন―
'সুইডেন-এর পাইন জঙ্গলে হাতি পাওয়া যায় বিশ্বাস কর? এখানে এসে দেখি তোমার বোন জঙ্গলে আস্ত একটা হাতি ধরে ফেলেছেন। আমরা দুজনে হাতিটার ল্যাজ চেপে ধরেছি―কিন্তু এতবড় জন্তুটাকে নিয়ে কী করব বুঝে উঠতে পারছি না!'

আসলে ডালহেম থেকে আসা চিঠিটা পড়ার পর মিস লিজা যেন ক্ষেপে উঠলেন। ফ্রিশ'কে সবিস্তারে পুরো ঘটনা খুলে বললেন। প্রথমটায় ফ্রিশ-এর বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি। বৃহদাকার হাতির সঙ্গে মশার যুদ্ধে ক্ষুদ্র প্রাণীটির জেতার সম্ভাবনা কতখানি? শূন্য! অথচ মাসি মশার জয়ের কথা বলছেন। অবাস্তব সম্ভাবনা! পুঙ্খানুপুঙ্খ ব্যাখ্যা করে সব বুঝিয়ে দিলেন মাসিমা লিজা। এতক্ষণে ফ্রিশ-এর জ্ঞান চক্ষু উন্মিলিত হল। দিনের আলোর মতো পরিস্কার হল সবকিছু। মুর্খ! মুর্খ আমরা! এ সহজ জিনিসটা কারও বোধগম্য হয়নি এতদিন। পরমাণুর নিস্তড়িৎ কণিকা নিউট্রন। তড়িৎ-শূন্য হওয়ার বিস্তর সুবিধা। অসীম শক্তিশালী পরমাণুর ধনাত্মক নিউক্লিয়াসকে ধাক্কা মারতে খুব বেশি বেগ পেতে হয় না নিউট্রনের। এ হেন উচ্চ শক্তির কণিকা দিয়ে ইউরেনিয়াম পরমাণু'কে তীব্র আঘাত করলে ইউরেনিয়াম কেন্দ্রক বা নিউক্লিয়াস ভেঙে দু'টুকরো হয়ে যায়। ধনাত্মক কেন্দ্রকের ভাঙনে মাঝারি ভরের বেরিয়াম নিউক্লিয়াস জন্ম নেয় আর প্রচুর নিউক্লিয় শক্তির মুক্তি ঘটে। এ হেন নিউক্লিয় বিক্রিয়ার উপযুক্ত শব্দবন্ধ কী হবে? বিজ্ঞানী অটো ফ্রিশ তার নাম দিলেন 'ফিশন' (Fission)। নিউক্লিয়ার ফিশন। কেন্দ্রকের বিভাজন। মানবসভ্যতার ইতিহাসে সবচাইতে বড় শত্রু অ্যাটম বোমা তৈরির গুরুত্বপূর্ণ প্রথম ধাপ হল এই নিউক্লিয়ার ফিশন।

আপাত অসম্ভব নিউক্লিয়ার ফিশন আবিষ্কার করে শোরগোল ফেলে দিলেন বিজ্ঞানী অটো হান। সেরার শিরোপা ছিনিয়ে নিলেন। রসায়নে নোবেল জয় করলেন তিনি, ১৯৪৪-এ। আর তিনি, মিস লিজা মেইটনার! দীর্ঘ প্রায় তিন দশকের উপর ডালহেম-এ প্রফেসর হান-এর রিসার্চ-ছায়াসঙ্গী ছিলেন। সে-ই তিনি রয়ে গেলেন উপেক্ষার অন্ধকার গলিতে। শুধু একবার কিংবা দুবার নয়, ১৯২৪ থেকে ১৯৪৮ পর্যন্ত রসায়নে উনিশ বার ও ১৯৩৭ থেকে ১৯৬৫ সালের মধ্যে ফিজিক্সে উনত্রিশ বার― সবমিলিয়ে মোট প্রায় আটচল্লিশ (৪৮) বার তাঁর নাম নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিল। নিয়তির কী নিষ্ঠুর পরিহাস! একবারের জন্যও তাঁর ভাগ্যে নোবেল-শিকে ছিঁড়ল না। অথচ, বিশ্বখ্যাত তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন (১৮৭৯―১৯৫৫) তাঁকে অভিহিত করেছেন― 'জার্মানির ম্যারি কুরি'।
          

অসম্ভব প্রতিভাবান কে এই লিজা মাইটনার? কী তাঁর পরিচয়? ১৮৭৮ সালের নভেম্বর মাসের সাত তারিখে এলিজা মাইটনার-এর জন্ম, অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনার লিওপোল্ডস্ট্যাডট-এ। মা শ্রীমতি হেডউইগ মাইটনার। মুক্তমনা পিতা ফিলিপ মাইটনার অস্ট্রিয়ার একজন প্রথিতযশা উকিল। বিজ্ঞান আর গণিতে তুখোড় পণ্ডিত এলিজা মাইটনার নিজেই নিজের নাম 'এলিজা' পরিবর্তন করে 'লিজা' হয়েছেন। ইউনিভার্সিটি অফ ভিয়েনা থেকে ফিজিক্সে ডক্টরাল ডিগ্রি ১৯০৬ সালে। ১৯০৭-এ জার্মানির ডালহেম-এ বেড়াতে গেলেন ফ্রেডরিখ উইলহেল্ম ইউনিভার্সিটি'র নামকরা অধ্যাপক ম্যাক্স প্লাঙ্ক-এর ক্লাস করতে। সেখান থেকে ডালহেম-এ কেইজার উইলহেল্ম ইউনিভার্সিটি'তে পাকাপাকি অবস্থান, প্রফেসর অটো হান-এর তত্ত্বাবধানে। রেডিও-অ্যাক্টিভিটি নিয়ে দুজনের গবেষণা শুরু। ইতিমধ্যে ১৯১৪ সালের জুলাই মাসে, তখনও প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়নি, যুদ্ধের কাজে ঘরছাড়া প্রফেসর অটো হান। ল্যান্ডয়্যার রেজিমেন্টে আর্মিতে যোগ দিতে বাধ্য হলেন। পরের জুলাই'তে নিজের গবেষণার কাজে ভিয়েনা পৌঁছলেন মিস লিজা। ভিয়েনা গিয়ে দারুণ ফেঁসে গেলেন। ফিরতে পারলেন না ডালহেম। একজন রঞ্জন রশ্মি (এক্স-রে) এক্সপার্ট হিসাবে নার্স-টেকনিসিয়ান হয়ে তাঁকে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠিয়ে দেয় অস্ট্রিয়ান আর্মি। যুদ্ধ ভূমি থেকে ফেরত আসা ১৯১৬ সালের অক্টোবরে। এসে অব্দি ডালহেম ইন্সট্যুট-এ গবেষণার কাজে লেগে পড়লেন। ১৯১৭ সালের জানুয়ারিতে কেইজার উইলহেল্ম ইন্সট্যুট-এর পদার্থবিদ্যা বিভাগের প্রধান নিযুক্ত হন। কয়েকদিন পর ডালহেমে ফিরে আসেন প্রফেসর হান ও রসায়ন বিভাগের প্রধানের পদ অলংকৃত করেন। পুনরায় যৌথভাবে কাজ শুরু করেন অধ্যাপক হান আর মিস লিজা। এরই ফলশ্রুতি ১৯১৮ সালের মার্চে 'প্রোট্যাক্টিনিয়াম' (চিহ্ন ― Pa) মৌল আবিষ্কার। ১৯২৩-এ 'অগার এফেক্ট' (বিকিরণহীন স্থানান্তর)। যদিও এর দু'বছর পর বৈজ্ঞানিক পিয়ের ভিক্টর অগার সেটি পুনরায় আবিষ্কার করে শোরগোল ফেলে দেয়। প্রফেসর অগার মিস লিজা'কে কৃতিত্ব প্রদান করতে কার্পণ্য করেননি। তারপর এল ১৯৩৮ সাল। তাড়া করে বেড়ায় সে-ই দুঃস্বপ্ন। জার্মানি থেকে বিতাড়িত মিস লিজা। চলে গেলেন সুইডেন, নিভৃতবাসে। ওদিকে ১৯৩৯ সালের জানুয়ারি মাসে অধ্যাপক হান আর ড. স্ট্র্যাসম্যান নিউক্লিয়ার ফিশন আর্টিকেল প্রকাশ করলেন। নিভৃতবাস থেকে পরের মাসে কুমারী মাইটনার আর তাঁর বোনপো অটো ফ্রিশ ছাপলেন কেন্দ্রকের বিভাজনের তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা সংবলিত প্রবন্ধ। 
       
শুরু হয়ে গেল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। লণ্ডভণ্ড সবকিছু। উলটপালট হয়ে গেল ঘর-বাড়ি-ক্ষেত-খামার। ছড়িয়ে পড়ল আপন মানুষজন-আত্মীয়-বন্ধুবান্ধব। চিরতরে হারিয়ে গেল চেনা পরিবেশ। বাতাসে বারুদের গন্ধ। পাল্টাতে থাকল কাজের ঠিকানা। গবেষণা। শেষমেশ, ১৯৬০ সালে অবসর। ১৯৬৮-তে চিরবিদায়। অক্টোবর মাসের সাতাশ তারিখে কেমব্রিজে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন শান্তিকামী এই মহিয়সী মহিলা।

মৃত্যুর পর তাঁর নামে একটি মৌলের নামকরণ করা হয় 'মাইটনারিয়াম-১০৯' (বিশ্বের সবচেয়ে ভারী জানা-শোনা মৌল: চিহ্ন―Mt)। আদতে, তিনি ছিলেন পদার্থবিদ্যায় ভিয়েনা ইউনিভার্সিটির প্রথম এবং বিশ্বের দ্বিতীয় মহিলা ডক্টরেট। জার্মানিতে ফিজিক্সের প্রথম মহিলা পূর্ণাঙ্গ অধ্যাপক তিনি। অনেকের মতে, বিংশ শতাব্দীর সবচাইতে তাৎপর্যপূর্ণ মহিলা সায়েন্টিস্ট-এর নাম চিরকুমারী লিজা মাইটনার।

তথ্যসূত্র :
বিশ্বাসঘাতক ― নারায়ণ সান্যাল
এ সায়েন্টিফিক অটোবায়োগ্রাফি ― অটো হান
লিজা মাইটনার, ১৮৭৮ ― ১৯৬৮ : অটো রবার্ট ফ্রিশ
উইকিপিডিয়া, বিভিন্ন পত্রপত্রিকা

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments