চেতনে,স্মরণে, বিস্মরণে দীপাবলি
আবীর ভট্টাচার্য্য
মফস্বলী শিক্ষককন্যা। শৈশব-কৈশোর কেটেছে জেলাশহরে। সময়টা ছিলো আশির দশকের শেষ, নব্বইয়ের শুরু। ধনতেরাস বা ঐ জাতীয় উৎসব তখনও বাঙালী মধ্যবিত্ত জীবনকে গ্রাস করেনি। তখনো কালীপূজা ছিলো সারারাতের রামপ্রসাদী গান গাওয়া বাঙালী উৎসব, পরেরদিন ভোররাতের আবশ্যিক কাজ ছিলো ন্যাপথলিনের গন্ধ রয়ে যাওয়া ট্রাঙ্ক থেকে সদ্য বার হওয়া স্কার্ফ,সোয়েটার চাপিয়ে সদলবলে ঠাকুর দেখতে যাওয়া, ফিরে এসে আগের দিনের বেঁচে যাওয়া তুবড়ি, ফুলঝুরি রোদে দেওয়া,পাড়ার বিচ্ছু ভাইটি কুকুরের লেজে কালীপটকা বাঁধলে তার কান মুলে দেওয়া... আরও কতো দরকারী-অদরকারী কাজকর্ম!...
তখনকার দিনে তো আর তেমন ভুবন-উষ্ণায়ন ছিলোনা, আমাদের ছোটবেলায় কালীপূজায় ঠান্ডা পড়ে যেত বইকি! আরও সতর্কতার কারণ ছিলো, তারপরে পরেই থাকতো ভাতৃদ্বিতীয়া, ভোর ভোর উঠে স্নান সেরে যমদুয়ারে কাঁটা ফেলে ভাইয়ের কপালে ফোঁটা দেওয়া; নারীজীবনের খুব, খুব প্রিয় এক মধুর পরম্পরা।
সারাবছরের প্রতীক্ষা থাকতো স্কুলের সেকেন্ড টার্মিনাল পরীক্ষার পরে শারদীয়া উৎসব শেষে এই কয়দিনের পুজোর ছুটির দিকে। দেশের বাড়ির দুর্গোৎসব শেষে মামাবাড়ি বেড়াতে যাওয়া; অনেকক্ষণ সময় ধরে গুয়া প্যাসেঞ্জারে চেপে টাটা পেরিয়ে চাইবাসা, ছোটখাটো টিলাময় পাহাড়ি জনপদের ধুলোমাখা, সাদা-সরল আদিবাসী মানুষজনের সঙ্গ, আদিগন্ত মেঘভারহীন নীল আকাশ,ঝোপঝাড়-গুল্ম আর এখানে ওখানে পথচলতি ঝর্ণার জল গায়ে মেখে ফিরে আসা নিজের শহরে ঠিক কালীপুজোর আগে-আগে; স্কুল খুললে পরীক্ষা, মনেমনে কেমন যেন এক ভয়ভয় অনুভূতির সঙ্গ দিতো ইতিউতি বাড়ির ছাদে টাঙানো কুয়াশালীন হৈমন্তীরাতের মায়াময় আকাশপ্রদীপ।
ঠাকুমার মুখে গল্প শুনতাম, বছরের শুধুমাত্র এই পিতৃপক্ষেই কালের নিয়মে হারিয়ে যাওয়া আমাদের পুর্বপুরুষেরা কখনও কখনও এইসব সময়ে ফিরে আসেন মরজগতে তাঁদের উত্তরপুরুষের মায়ার টানে, মহালয়ায় জলাঞ্জলি নিবেদিত হয় তাঁদের উদ্দেশ্যে। দেবীপক্ষের আলোময়তায় হয়তো তাঁরা লুকিয়ে থাকেন কয়েকদিন; আবার ফিরে আসেন কৃষ্ণপক্ষে, তাঁদের জন্য জ্বালানো হয় আকাশ-প্রদীপ,যে পথনির্দেশ তাঁদের পৌঁছে দেয় অনেকদিন আগে ফেলে যাওয়া তাঁদেরই মায়ার ঠিকানায়। আবার পক্ষশেষে ভূতচতুর্দশীর সন্ধ্যায় চৌদ্দটি আপন হাতে বানানো জলন্ত প্রদীপ ঠাকুরঘর,গোয়ালঘর,খিড়কিদুয়ার,সিংহদুয়ার সহ বাড়ির বিভিন্ন বিশেষ বিশেষ জায়গায় বসিয়ে উত্তরপুরুষ দেখিয়ে দেন তাঁদের ফিরে যাওয়ার পথ। আবার বছরভ'র অপেক্ষা, ভালোবাসার,ফিরে আসার। তাই হয়তো নিয়ম এই যে, শেষবাতিটি বাড়ির নৈঋতকোণে জ্বালিয়ে আর ফিরে দেখতে নেই, হতেই পারেন তাঁরা জাগতিক মায়ামুক্ত,তবু দৈবাৎ সন্তানের অশ্রুসিক্ত মুখ যদি পিছু টানে!
এরপরে শুরু হয় পাঠকাঠির মশাল জ্বালিয়ে মশা তাড়ানো…'ধা রে মশা ধা,তালবনকে যা' সব ছোট্ট ছোট্ট ভাইবোন-বন্ধুবান্ধব মিলে হুটোপাটির সুখ...সে কি ভোলা যায়!
তরপরে চলতো মায়েদের লক্ষ্মীপূজা, শেষে ছোটদের নিয়ে অলক্ষ্মী-বিদায়। একালের ছেলেমেয়েরা সে সুখে বঞ্চিত হলেও,পুরনো কুলো পিটিয়ে পুকুরপাড়ে অলক্ষ্মীবিদায়ের সময় চোরাগোপ্তা দুষ্টুমি এখনও সেই সুখস্মৃতি আমাদের বয়সীদের মনে পড়ে। এই সময়েই গোবরজলের আলপনায় অলক্ষ্মীসহ সমস্ত অশুভ শক্তি,রোগভোগকেও বিদায় জানানো হয় হয়তো। মনে আছে,পইপই করে শেখানো মায়েদের নির্দেশ, কোজাগরী লক্ষ্মীর পা আঁকা হবে ঘরের দিকে, তিনি যেন গৃহে অচলা থাকেন আর অলক্ষ্মীর পা আঁকা হোত উল্টোদিকে যাতে সে আর ফিরতে না পারে। নারীমনের এই শুভচেতনা,আজন্মকাল হয়তো এভাবেই তার সংসার ও পরিজনকে সুরক্ষিত করে রাখে তার শক্তি,জ্ঞান, নিঃশর্ত ত্যাগ আর ভালোবাসায়।
পরেরদিন শুরু সাড়ম্বরে কালীপূজা। দশ-মহাবিদ্যার এক শক্তিময়ী রূপ হলেও বর্তমান এই বাংলায় তাঁর রূপটি পালযুগের সহজ তান্ত্রিক আন্দোলনের ফসল, এমনটাই মনে করেন পন্ডিতেরা। তাই মাতৃকারূপ শ্যামবর্ণ ,দুইপাশে থাকেন ডাকিনী ও যোগিনী, যাঁরা বজ্রযোগিনীর দুই পার্শ্বচরী:বজ্রবর্ণিনী ও বজ্রবৈরোচনীর স্মৃতি বহন করেন। আজ হয়তো ডাকিনী, যোগিনী কথাগুলি নঙর্থক অর্থে ব্যবহৃত হয় আমাদের সমাজে,তবে তন্ত্রসাধনায় এই নারী জ্ঞানসিদ্ধ পান্ডিত্যের ঐতিহ্য বহন করে নারীচেতনায় আলো ছড়ান।
আমরা,বর্তমান শহুরে মানুষেরা বিশ্বায়ন,বিজ্ঞাপন বা অপরাপর প্রাদেশিক আচার অনুষ্ঠান আত্মস্হ করার ইচ্ছেয় কালীপূজার সঙ্গে ধনতেরাস বা গহনা কেনাকে আজ গুলিয়ে ফেলি, কিন্তু ধনতেরাস প্রকৃতপক্ষে কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশতম দিন। পুরাণকথায় আমাদের সকলেরই জানা আছে, সমুদ্র মন্হনকালে নাগরাজ বাসুকিকে রজ্জু বানিয়ে দেবতা ও অসূরেরা ক্ষীরোদসাগর মন্হন করেছিলেন,মন্হনকালে উঠেছিলেন ধন্বন্তরী এবং ধনদেবী লক্ষী। ধন্বন্তরীর চারটি হাতে ছিলো অমৃতকলস,আয়ুর্বেদগ্রন্হ,ধানের শীষ ও শঙ্খ। স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যায়, তিনি ছিলেন চিকিৎসক দেবতা। যমরাজের অভিশাপ থেকে; মৃত্যু, মারী, ক্ষতি, ভয়, দুর্যোগ থেকে জীবনরক্ষার প্রয়াসেই এই দিনগুলিতে তাই ঘরবাড়ি পরিষ্কার দীপধুপ জ্বালানো,সম্পদক্রয়ের প্রথা।
ঐ একই উদ্দেশ্যে ঐদিন চৌদ্দ-শাক খাওয়ারও প্রচলন গ্রামবাংলায়। নির্দিষ্ট কিছু শাকপাতা,যেমন "ওল-কেঁউ-কালকাশুন্দে-বেতো- সর্ষে- নিম- জয়ন্তী -পুঁইপাতা- হিঞ্চে-সঞ্চে-পলতা -সৌলক- গুলঞ্চ-ধনেপাতা-শুষনি" খাওয়ানো হয় রীতির মোড়কে,যেগুলির প্রতিটিই ওষধিগুনে সমৃদ্ধ এবং আসন্ন শীতের নানারকম অসুখবিসুখ থেকে শরীরকে সুরক্ষিত রাখতে জরুরি ভুমিকা নেয়। মনে রাখতে হবে, আমাদের দেশে সর্বস্তরে চিকিৎসা পরিসেবার অভাব হয়তো এভাবেই মিটোতে চাইতেন সমাজপতি এবং গৃহস্থ মায়েরা, আর তাতে যে তাঁরা একেবারেই সফল হতেন না,তা বলা যায় না।
যাইহোক, এমন সব দিনে, বারংবার ফিরে আসতে ইচ্ছে হয় স্মৃতির দুয়ারে,যারা আছে,যারা নেই, তাদের সবাইকে সঙ্গে নিয়েই নিত্যবহমান আমাদের জীবনধারা। উৎসব আসে,উৎসব যায়। প্রাত্যহিকতার ব্যস্ততায় হয়তো ভুলে যাই সংস্কারবন্ধন, কিন্তু এমন সব উৎসব মনে পড়ায়,অতীন্দ্রিয়বাদের সারসত্য, সমাজ-সংসার মিছে সব…''চূর্ণ হোক স্বার্থ,সাধ,মান, হৃদয় শ্মশান,নাচুক তাহাতে শ্যামা''--বিবেকানন্দ রচিত এই কালীস্তবের দ্যোতনায়, এক আরাত্রিক ও নৈব্যক্তিক আনন্দচেতনায় ঋদ্ধ হয় আমাদের অন্তর, শুধুই প্রজ্জ্বলিত দীপে নয়, সচেতন শুভ-ইচ্ছার মঙ্গল-আলোয়, আসুন সবাই জ্বালাই মনের আলো,শুভ হোক দীপাবলি।
জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
1 Comments
এত মায়া থাকে তোমার লেখায়!!!
ReplyDelete