জ্বলদর্চি

দূরদেশের লোকগল্প—ফ্রান্স (ইউরোপ)/ (তিন জন তাঁতিবউ)/চিন্ময় দাশ

দূরদেশের লোকগল্প—ফ্রান্স (ইউরোপ)


চিন্ময় দাশ 

তিন জন তাঁতিবউ

এক গ্রামে থাকত এক বুড়ি আর তার মেয়ে। খুবই গরীব তারা। তবে, হোলই বা গরীব, মেয়েটি দেখতে যেমন ভারি সুন্দর, গুণেও তেমনি লক্ষ্মী। 
দেখতে সুন্দর বলে মেয়েটির কিন্তু কোন দেমাক নাই। সারাদিন কাজ করে যাচ্ছে। মুখে হাসিটি কিন্তু লেগেই আছে সব সময়।

গাঁয়ের বুক চিরে গিয়েছে কতকালে প্রাচীন এক রাজপথ। সেই রাস্তার ধারেই বড়সড় এক সরাইখানা। বুড়ির বাড়িটা তার পাশেই। 
সকাল সাতটা বাজলেই বুড়ি বলবে—সাতটা বেজে গেল! এটা একেবারে নিত্যদিনের ব্যাপার। সাতটা বাজল কী, বুড়ি ঐ একটা কথা আওড়াবেই। আসলে বুড়ি বলছে, সাত-সাতখানা স্যুপের প্লেট সাবাড় করে ফেলেছে তার মেয়ে।
এক দিনের ঘটনা। সূর্য ডুবতে বসেছে। সোনার আলোয় ভেসে যাচ্ছে চার দিক। একটা জুড়িগাড়ি এসে থামল সরাইখানায়।

  গাড়ির ভেতরের সওয়ারকে দেখবে কী?  দুটো ঘোড়া আর কোচোয়ানের উপরেই চোখ আটকে গিয়েছে সকলের। এমন জেল্লাদার পোষাক আগে দেখেনি কেউ কখনো। চোখ ফেরানোই দায় হয়েছে। 
কোচোয়ান দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে ধরতে, গাড়ির সওয়ার নামল ভেতর থেকে। একজন যুবক পুরুষ। কী অপরূপ রূপ তার। গায়ের রঙ যেন ফেটে পড়ছে। তেমনি মহার্ঘ আর ঝলমলে পোষার তার গায়ে। 
কোচওয়ানের কাছে পরিচয় জানল সবাই। যুবকটি সে দেশেরই রাজকুমার। দেশভ্রমণে বেরিয়েছে। হঠাতই খেয়াল চেপেছে, রাস্তার ধারে কোন সরাইখানায় কাটাবে একটা রাত।
সাজো সাজো রব পড়ে গেছে সরাইখানায়। দেশের রাজকুমার এসে উঠেছে এখানে। কত বড় সৌভাগ্যের ব্যাপার তাদের। মালিক ছুটছে হন্তদন্ত হয়ে। দৌড়াদৌড়ি করছে কর্মচারীর দল। রসুইখানায় পাচকের মাথায় হাত। রাজকুমারের মুখে রুচবে, এমন রান্না পারবে তো করতে?

দোতলায় সবচেয়ে বড় দু’খানা ঘর বরাদ্দ হয়েছে রাজকুমারের জন্য। পূব আর দক্ষিণ দু’দিক খোলা। বারান্দা আছে দু’দিকেই। কোন হেলদোল নাই রাজকুমারের। দক্ষিণের বারান্দায় গিয়ে বসে আছে নিজের মনে।
বারান্দার আরাম চেয়ারে বসেই, বুড়ির মেয়েটি চোখে পড়ল রাজকুমারের। চোখের পলক পড়ে না যেন আর। স্থির তাকিয়ে রইল মেয়েটির দিকে। দেখেই ভালো লেগে গেল মেয়েটিকে তার।
সারা রাত ঘুম হোল না রাজকুমারের। দু’চোখের পাতা এক হোল না। সুন্দর কোমল নিষ্পাপ একটি গ্রাম্য বালিকার মুখ সারা রাত ভেসে বেড়াতে লাগল চোখের সামনে।
সকালে উঠেই রাজার ছেলে আবার বারান্দায়। ঠিক সাতটা বাজে তখন। কিন্তু মেয়েটিকে চোখে পড়ল না। তখনই এক বুড়ির গলা কানে এল—এবার সাতটা বেজে গেল।

কথাগুলো কানে গেল রাজকুমারে। কিন্তু মগজে ঢুকল না কিছুই। এমন কথার কী অর্থ হতে পারে? বলারই বা কারণটা কী? 
রাজকুমার অতি মান্যগণ্য অতিথি। তাঁর ডাক পেয়ে, দৌড়ে এল সরাইখানার মালিক। বুড়ির কথার অর্থ জানতে চাইল রাজকুমার। 
মালিক জবাব দিল—হুজুর, ভারি গরীব মানুষ ওরা। মেয়ের খাটাখাটুনিতেই পেট চলে মা-মেয়ের। প্রতিদিন সকাল সাতটা বাজলে, এই একটা কথাই বলতে শুনি বুড়ি মাকে। আমার মনে হয়, বোনার হাত ভালো মেয়েটির। ভালো কাপড় বুনতে পারে বোধ হয়। সাতটা না বাজতেই, সাত তকলি সূতো বোনা হয়ে যায় তার। নিশ্চয়ই সেটাই বলে তার মা।
খানিক ক্ষণ কী যেন ভাবল রাজকুমার। তারপর তরতর করে নেমে, সোজা বুড়ির ঘরে গিয়ে হাজির হোল। 
সরাইখানাটা একেবারে ঘরের পাশেই। একজন রাজকুমার যে কাল এসে এখানে উঠেছে, সে খবর বুড়ি শুনেছে। শুনেছে তার মেয়েও। কিন্তু সেই রাজকুমার তাদের মতো গরীবের কুঁড়েঘরে এসে হাজির হবে, সেটা বুড়ি কল্পনাও করতে পারছে না। কোথায় বসাবে, কী বলে সম্ভাষণ করবে অতিথিকে, কিছুই ঢুকছে না বুড়ির মাথায়।

কোন ভূমিকা নয়। রাজকুমার সরাসরি বুড়িকে বলল-- একটি মেয়ে আছে তোমার? 
বুড়ি বলল-- আছেই তো। গাঁশুদ্ধ সবাই জানে সে কথা। 
--আমি তাকে বিয়ে করব বলে এসেছি। 
এবারে বুড়ি একটু থমকে গেল। বলে কী এই ছেলে! এ যে অভাগীর কপালে চাঁদের উদয়। স্বপ্ন দেখছি না তো?
বুড়ি তোতলা গলায় বলল—তা কী করে হয়? 
রাজকুমারে মুখে হাসি। বুড়ির কুন্ঠাকে পাত্তাই দিল না। বরং কৌতুক করে বলল—বিয়ে যেভাবে হয়, এক্কেবারে সেভাবেই হবে। পুরুত আসবে। লোকজন আসবে। আমোদ-আহ্লাদ, খাওয়া-দাওয়া সবই হবে। 
সরাইখানার মালিক লেগে গেল কোমর বেঁধে। লোকজন লাগিয়ে, ম্যারাপ বেঁধে—এলাহি বন্দোবস্ত করে ফেলল সে। তিন দিন ধরে মহাভোজ খেল আশপাশের সব গাঁয়ের লোকেরা। নাচ-গান-বাজনা চলল সেই সাথে পাল্লা দিয়ে।

তার পর? গরীবের অভাগী মেয়ে জুড়িগাড়ী চেপে একেবারে রানির সাজে রাজবাড়ী রওনা হয়ে গেল গ্রাম ছেড়ে।
বছর কয়েক পরের ঘটনা। রাজকুমার তখন রাজা হয়েছে। পাটরানি হয়েছে মেয়েটি। একদিন সাজ সাজ রব রাজবাড়িতে। কী, না রাজা যাবে যুদ্ধে। সৈন্য-সামন্ত, লোক-লস্কর, হাতি-ঘোড়া সব সাজানো হয়েছে। 
রানির মুখ ভার। বায়না ধরেছে, আমাকেও নিয়ে চলো। আমি একা একা কী করব এখানে বসে বসে। 
যুদ্ধে যাওয়ার সময় বলে কথা। যত আদরেরই হোক না কেন, রানির এমন আব্দার তো আর মানা যায় না। বেশি ভাবতে হোল না রাজাকে। সরাইওয়ালার কথা মনে পড়ে গেল তার-- আমার মনে হয়, ভালো কাপড় বুনতে পারে বুড়ির মেয়েটি।
তিন ঘর ভর্তি করে রেশম এনে মজুদ করল রাজা। রানিকে বলল—এই নাও, তোমার সময় কাটাবার ব্যবস্থা করে দিয়ে গেলাম। রেশম রইল তিন ঘর ভর্তি। বোনার কাজে তুমি ওস্তাদ। সেটা আমার জানা হয়ে গেছে। সব বুনে রেখো।
আসলে হয়েছে কী, রাজকুমারকে সরাইওয়ালা বলেছিল তার অনুমানের কথা। সঠিক করে কিছুই জানত না সে। প্রকৃতপক্ষে বোনার কাজ কিছুই জানে না মেয়েটি। তাঁত তো সে তার জীবনে দেখেনি। মাকু কাকে বলে, জানেই না। কোনদিন কোন তকলি ধরেনি নিজের হাত।

তিন ঘর ভর্তি রেশম দেখে, তার তো মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। কী করা যাবে এই পাহাড় সমান রেশম নিয়ে? ভয়ে ভাবনায় জল গড়াতে লাগল দু’চোখ বেয়ে। 
সেসময় তিনটে বুড়ি যাচ্ছিল রাজবাড়ির সামনের পথ দিয়ে। জানালার ধারে বসে রানিকে কাঁদতে দেখে, থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল তারা। যতটা পারে মাথা ঝুঁকিয়ে, লম্বা পেন্নাম ঠুকে জানতে চাইল--কী হয়েছে, রানিমা? কাঁদো কেন অমন করে? 
নিজের ঝামেলার কথা খুলে বলল রানি। শুনে তারা জবাব দিল—কেঁদে কী হবে, রানিমা? কান্নায় তো কোন সমাধান হয় না। চেষ্টা করতে হয়। 
সেকথায় রানি কাঁদে আরও অঝোরে—কী করে চেষ্টা করবো? বোনার কাজ কিছুই জানি না আমি। 
তা দেখে, বুড়িরা নিজেরা কী বলাবলি করে নিল প্রথমে। বলল—ঠিক আছে, কান্না থামাও। আমরা তোমার রেশম বুনে দেব। 
রানি বলল—কিন্তু রাজামশাইর তো আসবার সময়  হয়ে গিয়েছে। এদিকে রেশম তো কম নয়। তিনটে ঘর ভরা। 
--সে ভাবনা তোমার নয় গো, আমাদের। দায় নিয়েছি যখন, সময়েই কাজ শেষ করে দেব। কাল সকালে উঠেই তুমি কাজ পেয়ে যাবে।

একজন বুড় বলল—তবে, রানিমা, একটা শর্ত আছে। সেটা যদি রাখবে বলো, তবেই করব কাজটা।
রানি তো ভারি খুশী সেকথায়—বলো, কী তোমাদের শর্ত? যা চাইবে তাই দেব তোমাদের। রাজার ঘরে কোন কিছুর অভাব নাই।
--না, গো, না। কিছু চাই না আমরা। কিছুই দিতে হবে আমাদের। শুধু একটা কথা রাখতে হবে।
-- বলো, কী কথা?
এক বুড়ি বলল—রাজামশাই যেদিন আসবে, সেদিনের ভোজসভায় নেমন্তন্ন করতে হবে আমাদের। আমরা সেই আসরে যোগ দিতে চাই।
রানি তো পারলে এক পাক নেচে নেয় এমন সহজ শর্ত শুনে। সে রাজী হয়ে গেল। কাজে রাজী হয়ে গেল তিন বুড়িও। তারা বলল—আমরা তো তোমাদের বাড়িতেই থাকছি, কাজটার জন্য। ভোজের আসর বসলে, রাজামশাই যখন আমাদের ডেকে আনবার জন্য বলবে তোমাকে, তুমি এগিয়ে সিঁড়ির মুখটা পর্যন্ত যাবে কেবল। উপরে উঠবে না। আমাদের ডাক দেবে—বড় মাসী, মেজ মাসী, ছোট মাসী—আসরে চলে এসো তোমরা। খাবার দেওয়া হয়েছে। যেমনটা বললাম, ঠিক তেমনটাই করতে হবে। কিছু বেশি নয়, কমও নয়।

--হ্যাঁ, তাই করবো। এ আর এমন কী কাজ!
--আর একটা কথা। আমরা যে চেহারায় বেরুই না কেন, একেবারেই চমকে যাবে না। কোন কথা বলবে না মুখ ফুটে। শর্ত এটুকুই।
বুড়ি তিনজনকে ওপরে নিয়ে গেল রানি। তিনটে ঘর দেখিয়ে বলল—এই তোমাদের ঘর। এই রইল রেশম। দ্যাখো, কী করতে পারো। 
মিষ্টি হাসি তিন জনের মুখেই—মনে কোন ভাবনা না রেখে, ঘরে যাও, রানিমা। কথাগুলো মনে রেখো কেবল। 
রানি নেমে যেতেই চটপট কাজে লেগে গেল তিনজনে। রাতের মধ্যেই তাদের কাজ সারা হয়ে গেল। এক টুকরো সরু সূতোও পড়ে রইল না রেশমের। সকাল হোল যখন, সুন্দর নক্সা করা রেশমের কাপড় তিনটা ঘরে ডাঁই করা। 
রানির অনুমান ঠিক। পরের দিনই রাজা ফিরে এল যুদ্ধ জয় করে।  বিরাট ভোজের আয়োজন হয়েছে। সব রেশম বোনা হয়েছে, জেনে রাজা খুশী। রানির তিন জন আত্মীয়া এসেছে একথা জেনে, রাজা আরও খুশী। 
ভোজের আসর শুরু হতে, রাজা মোলায়েম গলা করে রানিকে বলল— কইগো, ডাকো তোমার কুটুম্বদের। 
বুড়িদের  কথা মাথায় রেখেছে রানি।  যেমনটি বলা আছে, হবহু সেই মত, কয়েক পা হেঁটে সিঁড়ির মুখে গিয়ে রানি হাঁক দিল—বড় মাসী, মেজো মাসী, ছোট মাসী! তোমরা চলে এসো এবার। আসর শুরু হবে।
সিঁড়ি দিয়ে নেমে এল তিজন। তখনই ভয়াণক একটা গুঞ্জন শুরুর হোল গোটা আসর জুড়ে। হবে না-ই বা কেন? তিন জনের দিকে চেয়ে, রানিরই মূর্ছা যাবার জোগাড়। ভয়ে আঁতকে উঠতে যাচ্ছিল নিজেই। এমন কুতসিত, কদাকার চেহারার মানুষ, কেউ দেখেনি কোন দিন।

তিনজনের যে বড় জন, সে আছে সামনে। তার দুচোখের পাতা ঝুলতে ঝুলতে নেমে এসেছে একেবারে বুক পর্যন্ত। দ্বিতীয় জনের ঠোঁট দুটো তার হাঁটুতে এসে ঠেকেছে। তৃতীয় জনের হাত দু’খানা লম্বা হয়ে এসে ঠেকেছে একেবারে মাটিতে। যেন সে দুটো দিয়ে সারা রাজবাড়ি ঝাঁট দিয়ে দেওয়া যায়। 
অন্যদের কথা বাদ দেওয়া যাক। রাজাও ভয় পেয়ে গেছে এমন চেহারা দেখে। প্রথম বুড়ি বলল—রাজামশাই, ভালোই জানি আমরা, ভারি কদাকার চেহারা হয়েছে  আমাদের। তবে, তার দায় আমাদের নয়। রাজামশাই, তুমিই দায়ী এজন্য। 
রাজা যেমন অবাক, তেমনি রেগেও গিয়েছে এ কথা শুনে। আসরে কারও মুখে রা নাই। এত সাহস হোল কী করে বুড়িটার!
বুড়ি বলল—তোমার দেওয়া তিন ঘর ভর্তি রেশম বুনেছি আমি। রেশমের সরু সূতোয় নক্সাদার কাপড় বুনতে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি লাগে। সেই কাজ করতে গিয়ে এই হাল হয়েছে আমার চোখের।  
দ্বিতীয় জন বলল— চিকন বুননের জন্য সূতোকে আরও সরু করতে হয়, ভিজিয়ে নিতে হয়। অনবরত ঠোঁটে আঙ্গুল বুলিয়ে বুলিয়ে চোখের এই অবস্থা হয়েছে আমার।

--তিন-তিনটে ঘর ভর্তি রেশম। চাট্টিখানি জিনিষ না কি? তৃতীয় বুড়ি বলল-- মাকু ঠেলতে ঠেলতে এই দশা আমার হাতের। 
বড় বুড়ি গলা তুলে বলল- এবার ভাবো সবাই মিলে, একা রানিমা বুনলে, কী দশাটাই না হোত মেয়ের!
রাজার তো লজ্জায় মাথা কাটা যায়। কথাটি নাই আসরে কারও মুখে।

কবিরাজকে ডেকে পাঠানো হোল। সে এসে ভার নিল তিন বুড়িকে সারিয়ে তোলার। রাজার ঘরেই রয়ে গেল তারা। সুখেই থাকে তিন বুড়ি।
সুখে আছে রাজা আর রানিও। কোন কাজই আর নাই রানির। কোন দিন মুখ ফুটে কুটোটি নাড়বার কথাও তাকে বলে না রাজামশাই।

আরও পড়ুন 
শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ উপমামৃত     

Post a Comment

0 Comments