জ্বলদর্চি

আফ্রিকার (নাইজিরিয়া)লোকগল্প /চিন্ময় দাশ

দূরদেশের লোকগল্প

কচ্ছপের কেরামতি—আফ্রিকা (নাইজিরিয়া)

চিন্ময় দাশ

তখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামছে। একটা কচ্ছপ ঘরে ফিরছে থপথপিয়ে। পাহাড় আর তেমন দূরে নয়। পাহাড়টার তলার দিকে, একটা খোঁদলের ভিতর, তার বাড়ি। 
সুঁড়ি রাস্তাটা পার হচ্ছে কচ্ছপ, উল্টো দিক থেকে একটা হাতি এসে হাজির। খাওয়া-দাওয়া সেরে হাতিও তখন ঘরে ফিরছে। কচ্ছপকে রাস্তা পার হতে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল। 
পাহাড়ের মত চেহারা হলে কী হবে, হাতি ভারি শান্তশিষ্ট জীব। দুনিয়াশুদ্ধ সবাই জানে, সামনে পড়লে, একটা কাঠপিঁপড়েকেও সে মারে না কোন দিন।
হাতি কচ্ছপকে ডেকে বলল—তাড়াতাড়ি রাস্তা ছাড়। দেরী করাস না।

দেখতে ছোট্টটি হলে কী হবে, কচ্ছপ ভয়ানক ধুর্ত। যাকে বলে, একেবারে মিট্মিটে শয়তান একটা। সে গুমোর দেখিয়ে বলল—কেন গো, রাস্তা ছেড়ে দিতে হবে কেন? পথ কি তোমার কেনা না কি? এই বন-পাহাড়ে আমরাও থাকি। 
এমনিতে হাতি মোটেই মন্দ জীব নয়। কিন্তু ভরা পেটে ঘরে ফেরার সময়, এই উটকো ঝামেলা কার ভালো লাগে?
সে বলল—বেশি তেজ দেখাস না। তোর ভালোর জন্যই বলছি। নইলে আলতো করে পা পড়ে গেলেও তো চিঁড়ে-চ্যাপ্টা হয়ে যাবি। তখন কী হবে? 
ভয় পেয়ে সরে যাবে কী, কচ্ছপ পথের মাঝখানেই দাঁড়িয়ে গেল—তাহলে দেখাই যাক, কেমন পিষে দিতে পারো। 
হাতি তখনও শান্ত—এখনও বলছি, ভালোয় ভালোয় সরে যা। কেন বেঘোরে মারা পড়বি? 
কচ্ছপের একই মরীয়া জবাব—ভালো-মন্দের কী আছে? দেখাও তোমার কত ক্ষমতা। এই আমি বসেই রইলাম এখানে।
চারটে পা আর লম্বা গলাখানা শরীরের ভিতর সেঁধিয়ে, থেবড়ে বসে গেল কচ্ছপ। এদিকে পুঁচকেটাকে আরও সাধাসাধি করলে, মান থাকবে না নিজের। হাতি এগিয়ে এল মরীয়া হয়ে।

কচ্ছপ তো যেমনটি ছিল, একেবারে তেমনটিই বসে আছে গোঁজ হয়ে। দেখা যাক, কার কত ক্ষমতা। হাতিরও আর ধৈর্য সইছে না। সে এগিয়ে এসে, সামনের পা-টা তুলে দিল কচ্ছপের উপর। 
কিন্তু কোথায় কী? কিছুই হোল না কচ্ছপের। হাতি পা সরিয়ে নিল। পিঠের ভার নেমে যেতে, মুখ বের করে একচোট হেসে নিল কচ্ছপ। বলল—চেহারায় তুমি বড় হতেই পারো। বিধাতা যাকে যেমনটি করে গড়েছেন, তার তো আর মার নাই। কিন্তু চেহারায় বড় বলে, গায়ের জোরেও বড় হবে, অতটা দম্ভ দেখিও না কাউকে। বলতে কী, গায়ের জোরের কথা উঠলে, আমিই তোমার চেয়ে বড়।

একথা শুনে, হাতি রাগল না। কাঁদল না। বরং হেসে উঠল জোর গলায়। আর সে কী হাসি। বন, পাহাড়, নদী, আকাশ, বাতাস সব কেঁপে উঠল তার অট্টহাস্যে। হাসির শব্দ মিলিয়ে গেলে, কচ্ছিপ বলল—হাসি দিয়ে তো আর শক্তির বিচার হয় না। তাহলে বরং একটা পরীক্ষা হয়ে যাক।

এমনিতেই হাতির চোখ খুবই ছোট। চোখ দুটো আরও কুঁচকে, হাতি বলল—পরীক্ষা মানে?
--পরীক্ষা মানে, গায়ের জোরের পরীক্ষা। কার গায়ে কতো জোর, দেখে নেওয়া যাক। 
--কিন্তু পরীক্ষাটা হবে কী ভাবে। 
--কুস্তি লড়ার কসরত নয়। ঠেলা-ঠেলিও নয়। কচ্ছপ বলল—টানা-টানির পরীক্ষা হবে। 
হাতি আবার হেসে অস্থির।– তুই ধরবি কী করে আমাকে, যে টানবি? 
কছপ বলল—কেউ কাউকে ধরব না আমরা। কাল সক্কাল সক্কাল এসো পাহাড়ের তলায়। একটা দড়ি যোগাড় করে রাখব। দড়ির দু’মাথায় ধরে টান লাগাব দু’জনে। বোঝা যাবে কার গায়ে কত জোর। 
মন্দ কৌতুক নয় তো! মাঝে মাঝে জীবনে এমন কিছু ঘটলে, একঘেয়েমি কাটে। ভালোই মজা হবে। প্রস্তাবে সায় দিয়ে , হাতি চলে গেল নিজের ডেরায়। 
মাথায় এখন অনেক কাজ। কচ্ছপ সোজা এসে হাজির হোল এক কাঠুরিয়ার ঘরে। লম্বা আর শক্ত একটা দড়ি ধার করল তার থেকে। বেড়ি পাকানো দড়ির স্তুপ পিঠে চাপিয়ে দিয়েছে লোকটা। থপথপিয়ে ঘরে ফিরে এল কচ্ছপ। 

চোখে ঘুম নাই সারা রাত, মতলব ভাঁজছে শুধু। ভোরের আলো ভালো করে ফোটার আগেই বেরিয়ে পড়ল। কাল যে পথে ফিরেছিল, সেদিকে গেল না। উলটো দিকের পথে গিয়ে বসে রইল। যেমনটি আশা করেছিল, তাই। একটু বাদেই ফোঁস ফোঁস করতে করতে এগিয়ে আসছে এক জলহস্তি। রাতের বেলায় চরতে বের হয় সে। সারা রাত মাঠের ঘাস খেয়ে পেট ভরিয়েছে। এখন নদীতে ফিরে যাচ্ছে। দশাসই চেহারা। কিন্তু পা চারখানা ছোট ছোট। ভারী চেহারা নিয়ে চলবার থপথপ শব্দ হচ্ছে। 
কাছাকাছি এসে, জলহস্তি তো অবাক—পিঠে এটা কী তোর? মোট বওয়া শুরু করলি কবে থেকে? 
কচ্ছপ বলল—মোট বইছি না মহারাজ। একটু খেলাধুলা করবার সাধ হয়েছে আপনার সাথে। 

মাঝেমাঝে জলেও নামতে হয় কচ্ছপকে। তাই জলের রাজাকে আপনি-আজ্ঞে করেই কথা বলে সব সময়। 
রাস্তার মাঝখানে পিঠ থেকে দড়ির বোঝা নামিয়ে দিল কচ্ছপ। দিয়ে বলল—আসুন। খেলাধুলার মাধ্যমে একটু শক্তি পরীক্ষা হয়ে যাক দুজনের। 
জলহস্তী একটু সময় ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল পুঁচকেটার দিকে। তারপর হেসে বলল—মাথা খারাপ হয়েছে না কি তোর। আমার সঙ্গে লড়বার সাধ? 
--নাগো, মহারাজ। মাথা খারাপ-টারাপের ব্যাপার নয়। মাঝে মাঝে সকলেরই নিজের শক্তি পরীক্ষা করে নেওয়া ভালো। তাতে উপকারই হয়। 
জলহস্তিরও বেশ কৌতুক বোধ হোল। একটু মজাই নাহয় করা যাক হতভাগাটার সাথে। বলল—পরীক্ষাটা হবে কীভাবে? 
বিশাল লম্বা দড়ি। তার একটা ডগা এনে কচ্ছপ বলল—এদিকটা আপনি কামড়ে ধরে থাকুন। আমি পাথরটার ওপারে গিয়ে অন্য ডগাটা কামড়ে ধরব। ওখান থেকে যেই হাঁক দিয়ে জানাব, অমনি দু’জনে টানতে শুরু করব দু’দিক থেকে। যদি আমাকে ফেলে দিতে পারেন, তাহলে আপনার জিত। আমি মেনে নেব, জোর আপনার গায়েই বেশি। 

--ঠিক আছে, যা তাহলে। তবে, তাড়াতাড়ি করবি। আমার আবার বিশ্রামের সময় হয়ে গেছে। সূর্য উঠে পড়লে, আমাকে একটু গড়িয়ে নিতেই হয়। 
কথা না বাড়িয়ে দড়ির অন্য ডগাটা ধরে, পাথরের ওদিকে চলে গেল কচ্ছপ। 
সেদিকে ততক্ষণে হাতি এসে হাজির হয়ে গেছে। কচ্ছপকে দেখে হাতি বলল—কোথায় ছিলি এতক্ষণ? সেই তখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি।
--এতখানা দড়ি বয়ে আনা চাট্টিখানি কথা না কি? তাতেই তো দেরী হয়ে গেল। কচ্ছপ বলল—যাকগে, আর দেরী নয়। শুরু করা যাক। দড়ির এই ডগাটা কামড়ে ধরে রাখো। আমি পাথরের ওদিকে গিয়ে অন্য ডগাটা ধরছি। আমি ওখান থেকে বললেই টান লাগাবে। বোঝা যাবে, কার গায়ে কত শক্তি।
হাতিকে দড়ি ধরিয়ে, কচ্ছপ চলে গেল পাথরের আড়ালে। এমন একটা জায়গা বেছে নিয়েছে, যেখান থেকে দুজনকেই চোখে রাখা যায়। কিন্তু নিজে থাকবে আড়ালে। 

দু’দিকে দুই মহারথী দড়ি কামড়ে দাঁড়িয়ে আছে। যুত করে বসে, কচ্ছপ চেঁচিয়ে বলল—লাগাও টান।
একদিকে ডাঙার হাতি। অন্যদিকে জলের হাতি। দুজনেই সমান বলশালী তারা। গায়ের জোর লাগিয়ে টানছে। ফলে যা হবার তাই হচ্ছে। এক চুলও পিছোতে পারছে না কেউ। তাতে জেদ বেড়ে যাচ্ছে আরও। দড়িতে টান লাগাচ্ছে আরও জোরে। 
কতক্ষণ এইভাবে চলতে লাগল। কচ্ছপ আরাম করে বসে, দুই মহারথীর দুরবস্থা দেখছে। ভারি মজা লাগছে তার।
হোল কী, দড়িরও তো একটা ক্ষমতা আছে টান সহ্য করবার। সময় যত গড়াছে, জেদ বাড়ছে দু’জনের। টানও বাড়ছে দড়িতে। এমন টানাটানি কতক্ষণ আর সইবে সে! 
এক সময় পটাং করে ছিঁড়ে গেল দড়িটা। অমনিই দুই প্রতিযোগীও ধপাস। দুজনেই আছাড় খেয়ে পড়ে গেল মাটিতে। গড়িয়েও গেল দু’তিন পাক। একেবারে নাস্তানাবুদ অবস্থা যাকে বলে।

পাথরে আড়ালে থেকেই হেসে উঠেছে কচ্ছপ—কেমন বুঝলে? দড়িটা ছিঁড়েছে। কিন্তু আমাকে নড়াতে পারোনি একটুও। যাও, এবার বাড়ি যাও। আর যেখানে যা খুশি  করো, আমার সামনে অন্তত, আর কখনো নিজেকে শক্তিমান বলে গুমোর দেখাতে এসো না।
দুই মহারথীর মুখে রা-টিও ফুটল না। লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে। মুখ ঘুরিয়ে সরে পড়ল নিজের রাস্তায়। 
তখন বেরিয়ে এল কচ্ছপ। মুখে  মুচকি হাসি। দড়ি গুছিয়ে, কাঠুরের বাড়ি চলল থপথপিয়ে।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments