জ্বলদর্চি

নোবেলজয়ী আমেরিকান বৈজ্ঞানিক ড. মারিয়া গয়প্পার্ট মেয়ার 'ম্যাজিক সংখ্যা' / পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

বিজ্ঞানের অন্তরালে বিজ্ঞানী ।। পর্ব ― ৪৮


জার্মান বংশোদ্ভূত নোবেলজয়ী আমেরিকান বৈজ্ঞানিক ড. মারিয়া গয়প্পার্ট মেয়ার 

পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

'ম্যাজিক সংখ্যা' : নিউক্লিয়ার বিজ্ঞানের এক আশ্চর্য নাম্বার

জীবনে কে না চায় থিতু হতে? প্রশ্নটা যখন স্থায়িত্ব আর সুস্থিতির; কি জীব আর কি অ-জীব―কোথাও আপোষের প্রশ্ন-ই নেই। অধিকাংশ মানবের স্বপ্ন জীবনে স্থায়ী জীবিকা নির্বাহ করবার। তার জন্য লেখাপড়া, কঠোর সংগ্রাম, হার থেকে শিক্ষা নেওয়া-উঠে দাঁড়ানো, ব্যবসাপাতি― কী না করে সে? তা, এই স্বপ্ন দেখা কি জীবের একচেটিয়া অধিকার? বস্তুর ইচ্ছা-অনিচ্ছা বলে কিচ্ছুটি থাকতে নেই! জড় পদার্থের জগতে কি এমনতর প্রতিযোগিতার ঘনঘটা অব্যাহত? না-কি, যাযাবর জীবন যাপন করতে করতে, অপরের ফাইফরমাস খাটতে খাটতে খানিকটা ক্লান্ত সে? সুস্থির হওয়ার সুপ্ত বাসনা প্রবল মৌল পদার্থের দুনিয়ায়। এমনটা মনে হওয়ার কারণ নেই যে তারা অখুশি। তারা খুশি নয় বলেই পৃথিবীতে লক্ষ-নিযুত-কোটি যৌগের সমাহার। কারণ, অধিকাংশ মৌল পদার্থ অস্থির (unstable)। অস্থিরতা মৌলের অন্দরমহলে। অস্থিরতার কারণ ওদের পরমাণুর সবচেয়ে বাইরের কক্ষে ইলেকট্রনের ঘাটতি। ব্যতিক্রম ছয়টি নিষ্ক্রিয় মৌল (হিলিয়াম, নিয়ন, আর্গন, ক্রিপটন, জেনন ও রেডন)। এরা সবাই যেন সরকারি চাকুরে। বাকি মৌলরা এদের সমঝে চলে। আপাত নিষ্ক্রিয় বলার কারণ এরা কেউই রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অংশ নেয় না। অর্থাৎ, এরা নিষ্ক্রিয়। তাই, এরা সুস্থির। নিষ্ক্রিয় মৌল পদার্থের দিকে তাকিয়ে বাকিরা চায় সুস্থির হতে। অথচ সুস্থিত হওয়ার চাবিকাঠি তাদের জানা নেই। বেশিদিন গোপন থাকল না নিষ্ক্রিয় মৌলের সুস্থিতির আসল রহস্য। প্রকাশ পেল অষ্টক নীতি। অস্থির একটি মৌল পদার্থ এবার থেকে তার সবচেয়ে বাইরের কক্ষে আটটি ইলেকট্রন দেখিয়ে নিজের স্থায়িত্বের প্রমাণ দিতে পারবে। এটাই অষ্টক নীতি। ১৮৬৪ সালে বিজ্ঞানী নিউল্যান্ড এটি আবিষ্কার করেন।

  মৌলের তিনটি জাত। কেউ ধাতু। কেউ-বা অধাতু। আবার কেউ ধাতুকল্প। মৌলের সবচাইতে ছোট অংশ হল পরমাণু। পরমাণুর দুটি প্রকোষ্ঠ― মধ্যিখানে কেন্দ্রক বা নিউক্লিয়াস আর নিউক্লিয়াসের বাইরে সাতটি কক্ষ। কক্ষগুলি উপবৃত্তের মতো। পরমাণুর সংসারে দুটি প্রকোষ্ঠে তিন রকমের মৌলিক কণিকার বাস। বড় ইলেকট্রন (১৮৯৭)। মেজো প্রোটন (১৯১৯)। আর ছোট নিউট্রন (১৯৩২)। এদের মধ্যে বড়দা ইলেকট্রন আলাদা থাকে; স্থায়ী কক্ষপথগুলো'তে তার গোছানো সংসার। ইলেকট্রনের উপর মৌলের রাসায়নিক ধর্ম নির্ভর করে। প্রোটন আর নিউট্রন যেন মানিকজোড়, থাকে নিউক্লিয়াসে। একসঙ্গে এদের নিউক্লিয়ন বলে। মোট নিউক্লিয়ন সংখ্যা-ই ভরসংখ্যা। প্রোটন সংখ্যার পরিবর্তন হলে মৌলের ধর্মেরও বদল ঘটে। তা, সব মৌলের কেন্দ্রকের স্থায়িত্ব কি সমান? নাহ! তা সমান হয় না। ইউরেনিয়াম, রেডিয়াম, থোরিয়াম প্রভৃতি তেজস্ক্রিয় মৌলের নিউক্লিয়াস ভঙ্গুর। প্রতিনিয়ত ভাঙছে। নিউক্লিয়াস ভাঙনের ফলে বের হচ্ছে মারণ তেজস্ক্রিয় রশ্মি। আসলে, সুস্থিরতার মাপকাঠি এক এক নিউক্লিয়াসে একেক রকম। সুস্থিরতার গুটিকয়েক শর্ত।
 প্রথমত, পেয়ারিং এফেক্ট (Pairing Effect)। যে-নিউক্লিয়াসে প্রোটন ও নিউট্রন প্রত্যেকে জোড়ায় জোড়ায় থাকে, তারা সবচাইতে বেশি সুস্থির। বিজোড় প্রোটন আর বিজোড় নিউট্রন (ভরসংখ্যা জোড়) দিয়ে তৈরি নিউক্লিয়াস সবচেয়ে বেশি অস্থির প্রকৃতির হয়। একটি জোড় ও অপরটি বিজোড় (ভরসংখ্যা বিজোড়) সংখ্যার নিউক্লিয়াসের স্থায়িত্ব মাঝারি মানের হয়। দ্বিতীয়ত, অসমতা ঘটনা (Asymmetry Effect)। সাধারণভাবে হালকা মৌলের সুস্থিতির কারণ তাদের প্রোটন ও নিউট্রন সংখ্যা সমান। ভারী মৌলের নিউট্রন সংখ্যা প্রোটনের চাইতে তরতর বাড়তে থাকে। ভরসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রোটন-নিউট্রন সমতাও বিঘ্নিত হয়। সেজন্য সংশ্লিষ্ট নিউক্লিয়াস অস্থির হয়ে পড়ে। এটাই অসমতার নীতি। 
            

  এতসব কারণের পরেও কয়েকটি ক্ষেত্রে নিউক্লিয়াসের সুস্থিতির প্রকৃত কারণ অজানা থেকে যায়। নিউক্লিয়াসের এ হেন স্থায়িত্বের মাপকাঠি কী হবে? স্থায়িত্বের একমাত্র সূচক নিউক্লিয় বন্ধনশক্তি (Nuclear Binding Energy)। ন্যূনতম যে শক্তি পেলে একটি নিউক্লিয়াস ভেঙে যায় অথবা নির্দিষ্ট নিউক্লিয়াস তৈরি করা যায়, তা-ই নিউক্লিয় বন্ধনশক্তি। যে-নিউক্লিয়াসের বন্ধনশক্তি যত বেশি; সে তত স্থায়ী, তার ভাঙনে অনেক বেশি শক্তি ক্ষয় অবশ্যম্ভাবী। বিশেষ কিছু নিউক্লিয়াস রয়েছে, যাদের প্রোটন কিংবা নিউট্রন সংখ্যা ২, ৮, ২০, ২৮, ৫০, ৮২ ও ১২৬; তাদের নিউক্লিয়াসের স্থায়িত্ব আধুনিক পর্যায়সারণীর প্রতিবেশী মৌলের নিউক্লিয়াসের তুলনায় খুব বেশি। কারণ ওদের নিউক্লিয় বন্ধনশক্তি অসম্ভব রকমের বেশি। অথচ, তাদের ব্যাখ্যা করার কোনও থিওরি বা মডেল জানা নেই। প্রচলিত নিয়মকানুনের উর্দ্ধে। উপরে বর্ণিত প্রোটন সংখ্যাযুক্ত নিউক্লিয়াসের আচরণ যেন ধাঁধা-মেশানো। সেজন্য এ হেন সংখ্যাগুলি নিউক্লিয়ার ফিজিক্সে ম্যাজিক সংখ্যা নামে খ্যাত। ম্যাজিক সংখ্যার অস্তিত্ব ব্যাখ্যা করার মত প্রয়োজনীয় সূত্র বা সমীকরণের দারুণ আকাল তখন। দিশেহারা অবস্থা পণ্ডিতগণের। সঠিক পথ পাওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। অতঃপর এল বহু প্রত্যাশিত এক মডেল। শেল মডেল (Shell Model)। এ হেন মডেল সর্বপ্রথম ম্যাজিক সংখ্যার অস্তিত্বের সঠিক ব্যাখ্যা দেয়। আর এ মডেলের রূপকার একজন মহান মহিলা বৈজ্ঞানিক। মারিয়া গয়প্পার্ট মেয়ার। জাতে জার্মান। ঠিকানা আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র।  

  জার্মানির প্রুসিয়া অঞ্চলের ঘনবসতিপূর্ণ একটি প্রাচীন সিলেসিয়ান সিটি ছিল কাটোউৎজ। অধুনা শহরটি পোল্যান্ডে অবস্থিত; নাম কাটোউইস। এ হেন ছোট্ট শহরতলির বুকে মারিয়া গয়প্পার্ট-এর জন্ম ২৮শে জুন ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে। বাবা ফ্রেডরিক গয়প্পার্ট। মা মারিয়া নি উল্ফ। খুব সম্ভ্রান্ত গয়প্পার্ট ফ্যামিলি। আভিজাত্যের বুনোটে ঠাসা। বিগত পাঁচ প্রজন্ম ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর গয়প্পার্ট ফ্যামিলির পূর্বপুরুষরা। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। শিক্ষিত মার্জিত রুচিসম্পন্ন ড. ফ্রেডরিক গয়প্পার্ট গটিনজেন ইউনিভার্সিটির প্রফেসর। পেডিয়াট্রিক ডিপার্টমেন্ট। একমাত্র কণ্যার বয়স যখন মাত্র বছর চার, চাকুরি জয়েন করে সিনিয়র গয়প্পার্ট-এর পুরো ফ্যামিলি গটিনজেন চলে আসে। এ হেন নামকরা বাবার আদরের পরী ছিলেন ছোট্ট মারিয়া। মায়ের চাইতেও বাবার খুব নেওটা সে। ছোটবেলা থেকে ঘরময় সারাক্ষণ দস্যিপনায় মত্ত ছোট মারিয়া'কে লেখাপড়ায় উৎসাহ দেন বাবা। সেসময় মেয়েদের লেখাপড়ার ব্যাপারে সমাজের বাধা ছিল বিস্তর। সুযোগ সুবিধা বেশ কম। তার বাবা প্রায়শই বলতেন― হাউসওয়াইফ না, পড়াশুনা করে মেয়ের চাকুরে জীবন কাটানোতে তিনি বেশি খুশি। বড় হয়ে বাবার বিশ্বাসের মান রেখেছিলেন মারিয়া গয়প্পার্ট। পরিবারের ঐতিহ্য ধরে রেখেছিলেন। হয়েছিলেন সপ্তম জেনারেশন প্রফেসর।
        

  গটিনজেনে একটি স্কুল 'হোহেরে টেকনিশে' (Hohere Technische)। মিডল ক্লাস গার্লস স্টুডেন্টের অব্যর্থ ঠিকানা। সে-ই সব ছাত্রী, যারা মূলত উচ্চশিক্ষার বাসনা পোষণ করে। এ হেন স্কুলে মারিয়া'র লেখাপড়ায় হাতেখড়ি। এখানকার পাঠ চুকিয়ে পনেরো বছরের কিশোরী ভর্তি হয় একটি বেসরকারি স্কুল 'ফ্রাউএনস্টাডিয়াম' (Frauenstudium)-এ। স্কুলটি মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাডমিশন টেস্টের জন্য ছাত্রীদের কোচিং করায়। ইউনিভার্সিটির তেমনই এক ভর্তির পরীক্ষা 'অ্যাবিটুর' (about)। হোহেরে টেকনিশে স্কুল থেকে সেবার, ১৯২৩ সালে, 'অ্যাবিটুর' টেস্টে বসে চারজন মেয়ে আর জনা তিরিশ ছেলে। ওদের ভেতর সপ্তদশী মারিয়াও ছিল। যখন রেজাল্ট বের হল, দেখা গেল সকল ছাত্রীর সঙ্গে মাত্র একজন ছাত্র ভর্তির পরীক্ষায় পাস করেছে।

  এদিকে ভর্তির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে অষ্টাদশী মারিয়া ১৯২৪ সালের বসন্তে গটিনজেন ইউনিভার্সিটি'তে অ্যাডমিশন নেয়। পছন্দের বিষয় রাখে গণিত। সেসময় বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত পড়ার জোর ধুম পড়েছে, বিশেষত ছাত্রীদের। কারণটি বেশ অভিনব। জার্মানি জুড়ে গার্লস স্কুলগুলোতে মহিলা অঙ্ক-মাস্টারের দারুণ আকাল। অঙ্ক নিয়ে কলেজ পাস করলেই মিলবে স্কুল মাস্টারির নিরাপদ চাকুরি। বাকি সকলের মত তরুণী মারিয়াও গটিনজেন-এ ভর্তি হল অঙ্ক নিয়ে। এসময় ইউনিভার্সিটির গণিত বিভাগে আলো ছড়িয়ে স্বমহিমায় বিরাজমান একজন মহিলা প্রফেসর এমি নয়দার। মারিয়া'র ইউনিভার্সিটির পড়াশুনা সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল। গোল বাধাল একটা সেমিনার। ফিজিক্সে প্রথিতযশা একজন প্রফেসর-বৈজ্ঞানিক নোবেল জয়ী ড. ম্যাক্স বর্ন। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের উপর তার একটি সেমিনার আয়োজন করা হয়েছে গটিনজেনে। বিশ্ববিখ্যাত বৈজ্ঞানিকের লেকচার শুনতে অন্যান্য অনেকের মত তরুণী মারিয়াও গিয়েছে কনফারেন্স হলে। সেখানে ম্যাক্স বর্ন-এর বক্তৃতা শুনে ফিজিক্সের প্রেমে মজে গেলেন মিস মারিয়া। এতটাই ভালো লেগে গেল ফিজিক্স যে, ইউনিভার্সিটি'তে স্ট্রিম চেঞ্জ করে ফেললেন। গণিতের বদলে মাঝপথে শুরু হল ফিজিক্সের সফর। এরপর থেকে ফিজিক্স-ই তাঁর ধ্যান-জ্ঞান। স্নাতক, পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট পাস করে ১৯৩০ সালে পিএইচডি সম্পূর্ণ করেন তিনি। ডক্টরেটের বিষয়বস্তু― পরমাণু কর্তৃক দুটি ফোটন কণিকা শোষনের সম্ভাব্যতা। ফোটন হল তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ বিনিময়কারী কণিকা। তা, মৌলিকত্বে তাঁর রিসার্চের বিষয়টি বেশ নজরকাড়া। পরীক্ষক তিন তিনজন নোবেল লর‍্যিয়েট― প্রফেসর ম্যাক্স বর্ন (১৯৫৪), জেমস ফ্রাঙ্ক (১৯২৫) আর অ্যাডল্ফ অটো রেইনহোল্ড উইনডস (১৯২৮)। তবে সমস্যা একটাই। থিওরিটি হাতেনাতে প্রমাণ করার বিস্তর ঝামেলা। প্রমাণের সরাসরি কোনও উপায় জানা নেই। তিরিশ বছর পার হয়েছে। ১৯৬১ সালে 'লেজার'(LASER) এল। শক্তিশালী লেজারের আলোকে এবার প্রমাণিত হল মিস মারিয়া'র প্রতিপাদ্যটি। নোবেল জয়ী বৈজ্ঞানিক ড. ইউজিন উইগনার একদা এ হেন রিসার্চ পেপারটিকে 'a masterpiece of clarity and concreteness' বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। 
        

  ইতিপূর্বে রকিফেলার বৃত্তি নিয়ে তরুণ আমেরিকান গবেষক ড. জোসেফ এডওয়ার্ড মেয়ার গটিনজেনে পা রেখেছেন। বাড়ি ভাড়া নিয়ে উঠেছেন গয়প্পার্ট ফ্যামিলি'তে। প্রফেসর জেমস ফ্রাঙ্ক-এর সহকারী তিনি। এ হেন তরুণ গবেষকের প্রেমে পড়লেন বাড়ির মেয়ে মারিয়া। প্রেম গাঢ় হতে না-হতে বিয়ে করে ফেললেন তাঁরা। ১৯৩০ সালে উনিশে জানুয়ারি চার হাত এক হল। বিবাহের অব্যাহতি পরে নবদম্পতি আমেরিকা পাড়ি দিলেন। তাঁদের দুই সন্তান মারিয়া অ্যান আর পিটার কনরাড।

  আমেরিকা পৌঁছে দেশের প্রথম রিসার্চ ইন্সট্যুট জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটি জয়েন করেন ড. জোসেফ এডওয়ার্ড মেয়ার। এ হেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কায়দা-কানুন স্বজন পোষণের তীব্র বিরোধী। ঘোরতর নেপোটিজম বিরুদ্ধ। ফলে শ্রীমতী মেয়ার-এর অ্যাপয়েন্টমেন্ট আটকে যায়। পূর্ণ সময়ের অধ্যাপক তাঁর কপালে জুটল না। তার পরিবর্তে স্বল্প বেতনে ফিজিক্স বিভাগে গবেষণার অনুমতি দেওয়া হল তাঁকে। এতেই সন্তুষ্ট তিনি। মন দিয়ে গবেষণার কাজ করে চলেছেন। সেই সঙ্গে পরপর তিন বছর, ১৯৩১, ১৯৩২ ও ১৯৩৩ সালে গ্রীষ্মে নিজের দেশ জার্মানি ফিরে এলেন ছুটি কাটাতে। নিছক ছুটি কাটানো তাঁর উদ্দেশ্য নয়। গটিনজেনে প্রফেসর ম্যাক্স বর্ন-এর সঙ্গে যৌথভাবে কোয়ান্টাম মেকানিক্সে গবেষণাই মূল লক্ষ্য। সে-গবেষণায় ছেদ পড়ল ১৯৩৩ সালে জার্মানিতে হিটলারের নাৎসি দল ক্ষমতা দখল করায়। হিটলারের তীব্র ইহুদি বিদ্বেষ নীতির জেরে দেশজুড়ে তখন চরম অস্থিরতা। অরাজকতায় ভরে গেছে। ইহুদি নিধন আর বিতাড়নের নামে একনায়কতন্ত্র চলছে। এমন প্রেক্ষাপটে ম্যাক্স বর্ন আর জেমস ফ্রাঙ্ক চাকরি খোয়ালেন। 
        

  নিরুপায় মিসেস মেয়ার দেশের কথা ভেবে, দেশের মানুষের কথা স্মরণ করে বিদেশ-বিভুঁই-এ অশ্রুমোচন করছেন। ওদিকে তাঁর নিজের গবেষণা চরম প্রশ্নের সম্মুখে। জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটি ছেড়ে দিয়ে মহাফ্যাসাদে তিনি। কারণ প্রফেসর সিনিয়র মেয়ার কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি চলে এসেছেন। স্বামীর পিছু পিছু মিসেস মেয়ারও হাজির হলেন কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি। কিন্তু এখানে তাঁর কোনও কাজ নেই। সম্পূর্ণ বেকার জীবন। দয়া করে কলম্বিয়ার ফিজিক্সের চেয়ারম্যান জর্জ বি. পেগ্রাম তাঁকে একটা কাজ তো জুটিয়ে দিলেন; তবে বেতন দিতে অপারগ। তা-ই সই। নাই মামার চাইতে কানা মামা ভালো! অবৈতনিক গবেষণার কাজেও নিজেকে উজাড় করে দিলেন মিসেস মেয়ার। এখানে ১৯৩৯ সাল নাগাদ এসেছেন বৈজ্ঞানিক হেরল্ড উরেই আর এনরিকো ফের্মি। তাঁদের দুজনের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে গেল মিসেস মেয়ার-এর। ফের্মি'র অনুরোধে ইউরেনিয়ামোত্তর মৌল পদার্থের যোজক কক্ষ পর্যালোচনা শুরু করলেন তিনি। থমাস-ফের্মি মডেল কাজে লাগিয়ে তিনি ভবিষ্যৎবাণী করে বসলেন― বিরল মৃত্তিকা মৌলের মত কৃত্রিম ভারী মৌলগুলি নতুন শ্রেণী তৈরি করে। তাঁর এ ভবিষ্যৎবাণী অচিরেই সঠিক প্রমাণিত হয়েছিল। তাঁর সাফল্যের মুকুটে একটা নূতন পালক যুক্ত হল। ১৯৪১ সালে তিনি আমেরিকান ফিজিক্যাল সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হন। অতঃপর ১৯৪১ সালে ডিসেম্বরের হাড়কাঁপানো শীতে প্রথম বার ইউনিভার্সিটির বেতনভুক কর্মচারী হন মিসেস মেয়ার। সারাহ লরেন্স কলেজে পার্টটাইম বিজ্ঞান পড়ান তিনি।

  ১৯৪২-এর বসন্তে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র পুরোদস্তুর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। আর মিসেস মেয়ার পরমাণু বোমার গোপন প্রকল্প 'ম্যানহাটন প্রোজেক্ট'-এ অংশগ্রহণ করেন। আমেরিকার চার জায়গায় চলছে পরমাণু ভাঙার কাজ। এদের অন্যতম কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির 'সাবস্টিচিউট অ্যালয় মেটেরিয়ালস' (SAM) ল্যাবরেটরি। এখানে কাজ মূলত তেজস্ক্রিয় মৌল ইউরেনিয়াম (সংক্ষেপে, U) নিয়ে। ইউরেনিয়ামে প্রোটন রয়েছে ৯২টি। সমস্থানিক দুটো। U-২৩৫ আর U-২৩৮। U-২৩৫ নিউক্লিয়াসে রয়েছে ৯২টি প্রোটন আর ১৪৩টি নিউট্রন। U-২৩৮ নিউক্লিয়াসে প্রোটন ও নিউট্রনের সংখ্যা যথাক্রমে ৯২ ও ১৪৬। ইউরেনিয়াম দিয়ে যে-বোমা বানানোর ছক কষছিল পণ্ডিতরা; তাতে ইউরেনিয়াম-২৩৫ (U-২৩৫) প্রয়োজন, U-২৩৮ নয়। অথচ প্রকৃতিতে যে ইউরেনিয়াম পাওয়া যায়, তার ৯৯ শতাংশের অধিক থাকে ইউরেনিয়াম-২৩৮ (U-২৩৮)। U-২৩৫ পরিমাণ যৎসামান্য; এক শতাংশের কম। তাই ইউরেনিয়াম বোমা তৈরির প্রথম ধাপ― প্রাকৃতিক ইউরেনিয়াম থেকে U-২৩৫ সমস্থানিকটিকে আলাদা করার উপায় বের করা, যা আসলে খুব ঝুঁকিপূর্ণ আর ব্যয়বহুল। ম্যানহাটন প্রোজেক্টে ভঙ্গুর U-২৩৫ আইসোটোপ পৃথক করার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন শ্রীমতী মেয়ার। 
           

 প্রিয় পাঠকের স্মরণে থাকবে― এ হেন ইউরেনিয়াম বোমা 'লিটল বয়' নিক্ষেপ করা হয়েছিল জাপানের হিরোশিমায়; ১৯৪৫ সালের ৬-ই আগস্ট সকাল আটটা পনেরো মিনিটে। নিমেষে লক্ষাধিক জীবন ধুয়েমুছে সাফ হয়ে গেছিল সেদিন, যা ইতিহাসে এক গভীর ক্ষত। এদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ ঘোষণা হয়নি। তার আগেই বৈজ্ঞানিক এডওয়ার্ড টেলার আরও এক মারাত্মক নেশায় বুঁদ হয়ে আছেন। তাঁর মানস-সন্তান 'হাইড্রোজেন বোমা'। পরমাণু বোমার চেয়ে হাজারগুণ বেশি ক্ষমতা। বন্ধু টেলার-এর সুপারিশে সে-মারণ প্রোজেক্টে যুক্ত হলেন মিসেস মেয়ার। ১৯৪৫ সাল, ফেব্রুয়ারি মাস। প্রশান্ত মহাসাগরে যুদ্ধ চলছে। সিনিয়র মেয়ার'কে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো হল। শ্রীমতী মেয়ার চললেন লস অ্যালামস ল্যাবরেটরিতে বোমা তৈরির গোপন কারখানায়। তাঁদের ছেলেমেয়েরা থাকল নিউইয়র্কে। ১৯৪৫ সালের জুলাই মাসে পুরো পরিবার আবার একত্রিত হয় নিউইয়র্কে। ১৯৪৬ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে সিনিয়র জো মেয়ার শিকাগো ইউনিভার্সিটির কেমিস্ট্রি দপ্তরে নিযুক্ত হলেন প্রফেসর পদে। আর ফিজিক্সে সাময়িকভাবে সহকারী প্রফেসর তিনি। হাইড্রোজেন বোমার জনক এডওয়ার্ড টেলার শিকাগো এলে বন্ধুর সঙ্গে পুরাতন কাজে যোগ দেন। এই শিকাগোতে থাকাকালে ১৯৫০ সাল নাগাদ একটি থিসিস রিপোর্ট লেখেন। আর্টিকেলটি ম্যাজিক সংখ্যা নিয়ে। ম্যাজিক সংখ্যার অস্তিত্ব ব্যাখ্যা করে তিনি নিয়ে এলেন 'নিউক্লিয়ার শেল মডেল' (Nuclear Shell Model)। মডেলটি তিনি উদ্ভাবন করেছিলেন ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৯। 

  এই মডেল আবিষ্কার নিয়ে একটা বেশ মজার গল্প আছে। এনরিকো ফের্মি'কে বলা হয় 'ফিজিক্সের পোপ'। প্রখর বুদ্ধির অধিকারী। তাঁকে যেকোন প্রশ্ন দেওয়া হোক না কেন, তিনি তার সঠিক প্রত্যুত্তর অবশ্যই দেবেন। একদিন মিসেস মেয়ার-এর অফিসে বসে চাপা স্বরে কথা বলছেন ফের্মি। এমন সময় খুব দূরের একটি টেলিফোন কল আসে ফের্মি'র নামে। ফের্মি অফিস থেকে বের হয়ে যে-ই না দরজার কাছে এসে পৌঁছলেন, সামান্য থমকে দাঁড়ান। পিছন ফিরে শ্রীমতী মেয়ার'কে একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন তিনি। তাঁর জিজ্ঞাস্য ছিল― স্পিন-অরবিট কাপলিং কী? স্পিন-অরবিট কাপলিং-এর উপর নিউক্লিয়ার শেল মডেল দাঁড়িয়ে আছে। মিনিট দশেক পরে অফিসে ফিরলেন ফের্মি। চেয়ার টেনে নিয়ে মুখোমুখি বসলেন শ্রীমতী মেয়ার-এর। ওদিকে বান্ধবী বেশ উত্তেজিত। উত্তেজনায় টগবগ ফুটছেন। তিনি শেল মডেলের ব্যাখ্যা দিতে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। তাঁর এই হয়েছে এক দোষ! উত্তেজনার চোটে বোঝানোর বিষয়গুলি জড়িয়ে যাচ্ছে। কথাগুলি অস্পষ্ট। মুচকি হাসছেন ফের্মি। চেয়ার ছেড়ে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লেন তিনি। শ্রীমতী মেয়ার'কে ধীরে ধীরে বললেন―'আগামীকাল, যখন আপনি কম উত্তেজিত থাকবেন, শুনব আপনার সব ব্যাখ্যা।'

  সেদিন ফের্মি আন্দাজ করেছিলেন যে মিসেস মেয়ার নির্ঘাৎ ম্যাজিক সংখ্যার উৎপত্তির ব্যাখ্যা জেনে ফেলেছেন। এই আবিষ্কার নোবেল ইতিহাসে তাঁকে স্থান করে দেয়। ১৯৬৩ সালের ফিজিক্সে নোবেল পুরস্কার পেলেন ড. মারিয়া গয়প্পার্ট মেয়ার। ১৯০৩ সালে মাদাম কুরী'র নোবেল জয়ের ৬০ বছর বাদে নোবেল ইতিহাসের তিনি দ্বিতীয় উজ্জ্বল মহিলা ফিজিসিস্ট। প্রিয় পাঠক, আরও জানলে অবাক হবেন― ১৯০১ থেকে আজ (২০২১) পর্যন্ত যে ২১৮ জন পদার্থবিদ নোবেল পেয়েছেন, তার মধ্যে মাত্র তিনজন মহিলা ফিজিসিস্ট (১৯০৩-এ মাদাম কুরী, ১৯৬৩-এ মারিয়া গয়প্পার্ট মেয়ার আর ২০১৮-এ ডোন্না স্ট্রিকল্যান্ড)। 

  আরও বড় খবর― নোবেল বিজয়ের তিন বছর পূর্বে, ১৯৬০ সালে, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫৪ বছর বয়সী প্রৌঢ় বৈজ্ঞানিকের অধ্যাপকের চাকুরি পাকা হয়। তবে সে-সুখ দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ক্যালিফোর্নিয়া পৌঁছনোর অব্যাহতি পরে স্ট্রোকে আক্রান্ত হন তিনি। তার উপরেও গবেষণার কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। ১৯৭১-এ হল মেজর হার্ট-অ্যাটাক। এবার আর সেরে উঠতে পারলেন না। ১৯৭২ সালে ২০শে ফেব্রুয়ারি ক্যালিফোর্নিয়ার সান-ডিয়োগো'তে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন পরম শ্রদ্ধেয় এই মহান বৈজ্ঞানিক।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments