শিউলী গোপাল ও সেই ছেলেটা
অমিত কুমার রায়
বসে থাকলেই তারা মাথায় ভিড় করে
শীত করে কাঁপ ধরে।
ঢ্যাং পুকুরের পুবের পাড়ে
রোদ্দুর যখন প্রথম পড়ত,
ছোট জলা,পাশে খেজুর আম তালগাছে, মনে আছে
চুয়ান্ন বছর আগেও ছিল নারকেল সুপারি
বাবলা রলা নোনা আতারা পাশাপাশি।
শীতের শিউলী গোপালদা ঘর বানাতো
খেজুর পাতার কুটির !
আট বছরের ছেলেটার চোখে জিজ্ঞাসা
কেমন তার ভেতরটা দেখতে !!
লাজুক বড়ই, তবুও বলল আস্তে করে ---
গোপাল দাদা ভেতর ঘরটা কেমন দেখতে গো ?
শিউলী গোপাল মুচকি হেসে বলেছিল
আয় দেখে যা, আয় আয়।
খেজুর পাতার ছাওয়া ঘর দেখে
ছেলেটা মহানন্দে বলেছিল ---
বাঃ! কি সুন্দর ঘর
শীতলপাটির ঠাসা বুনোন গো !
বাবুই পাখির বাসার মত !
রাত্তিরে কি জোনাকি জ্বলে !
শিউলী গোপাল সস্নেহে
দূর বোকা, টুনটুনি হারকেন জ্বলে।
এখানে কে কে থাকে?
গোপালদা খেজুর রসে কড়াইয়ে জ্বাল দিতে দিতে বলল
আমি একা !
তোমার বাড়ি কোথায় ?
দুটো গেরাম টোপকে কাঁকরোল।
কখন বাড়ি যাও?
গাছে কলসি চড়িয়ে দুপুরে।
কি খাও?
সবাই যা খায় ভাত।
অবাক বালকের প্রশ্ন আর শেষ হতে চায়না !
শিউলী গোপালের মুখে কোনো বিরক্তির লেশমাত্র নেই !
আবার তার প্রশ্ন
ওই কলসিতে কি আছে?
মিষ্টি রস আছে, তুই খাবি?
যদি নেশা হয় মা মারবে যে !!
দূর বোকা, এ যে মিষ্টি রস।
এই " তুই " শব্দের মধ্যে ছেলেটা
যুঁই ফুলের গন্ধ পেত !
আন্তরিকতা স্নেহ ভালোবাসা।
যা আজও কোনো মূল্যে কেনা যায়না।
টাটকা মিষ্টি খেজুর রসের কথা শুনে
আট বছরের ছেলের মুখে লালা জন্মে
লালা ঘিটে বলেছিল --- রস দেবে ! আমার তো পয়সা নেই !!
আমি পয়সা চেয়েছি কি?
গোপালদা ছোট কাঁচের গ্লাস ধুয়ে
সেই রস কিশোর ছেলেটাকে দিতে
চেখে চেখে রেখে রেখে খেল !
তখন হৃদয়ের সঙ্গে হৃদয়ের
মধুর রস খেজুর রসের মিল ছিল।
এখন কৃত্রিম কেমিক্যাল মনে মধুর রস ধারা দুর্লভ।
সেই ছেলেটা এখন বাষট্টি বছরের বুড়ো।
সেই পথে গেলেই থমকে দাঁড়িয়ে দেখে
সেখানে খেজুর আম তাল
নারকেল সুপারি
বাবলা রলা নোনা, এঁদো জলা কেউ নেই !
সেখানে মস্ত মস্ত বাড়ি
গর্বিত উদ্ধত অহঙ্কারে উচ্চ !
সেখানে পুচ্ছ নাচায়না
শালিখ পায়রা দোয়েল কোয়েল কাক ফিঙে
ডুব দেয়না জলায় পানকৌড়ি ! ছোঁ মারতে আসেনা বক মাছরাঙা !
নির্জন সবুজ হারিয়ে গেছে কখন টের পায়নি বৃদ্ধ !
সেই পঞ্চবটী নেই রাম সম গোপালদাও নেই !
টিঁয়েরাও নেই,কোটর হারিয়ে অন্য কোথায় অন্য কোনোখানে হয়তো বা !
খেজুর রসের মতো মিষ্টি কথা
দাগ কাটেনা অন্তর পথে ,
শিউলী গোপালদা নেই বহুকাল
যার মনের মতো মিষ্টি ছিল
ভোরের বেলার খেজুর রস !
রসে জ্বাল দেওয়া নেই
নেই আর সৌগন্ধ ভাসা বাতাসে।
গর্বিত উদ্ধত অহঙ্কারী
বাড়ির ব্যস্ততা শরীরে বিলি কাটে !
জ্বালা করে ওঠে মন
বুক চেপে ধরে একহাতে
বাড়ি ফেরে একা
বাষট্টি বছরের বৃদ্ধ ছেলেটা !
এখন রস নেই অন্তরে
রস নেই মনে
রসের উৎপাদনে বড়ই কার্পণ্য,
যদি কোনো রস বেঁচে থাকে তো
তা এখন
গোঁড়ামির রস
ধান্দাবাজির রস
ঠগবাজির রস,
বোকা বানানোর রস
আঘাত হানার রস
শৃগাল ধূর্ত রস;
নতুন আনা রস
যুব- জাতটাকে বিষাক্ত করার রস।
ওরা রোদ্দুর পেতে চায়
ওদের অন্ধকারময় রসে
রসবড়ার মতো ভাসানো ভাসছে
কে যে কখন গালে পোরে !
লজ্জিত রস কেউ গায়ে মাখেনা
দর্পিত রসের গন্ধে জগত মাতোয়ারা !
সেই বনভূমি নেই
বাষট্টি বছরের বৃদ্ধ ছেলেটার অচেনা পথ আজ
কংক্রিটের জঙ্গলে মোড়া
কেউ নেই,
নেই বাঁকা হেলা সোজা খাড়া খেজুর মা !
যার নলের ডগা বেয়ে ঝরত
টপ টপ টপ রস
যে রস
মায়ের স্তনের দুধের মতো
রক্তের রূপান্তর
খেজুর রস
টপ টপ টপ !
নেই শিউলী গোপাল।
এই শীতে হাত বাড়িয়ে দেবে
কাঁচের গ্লাসের স্নেহের রস !
একটু তোমরা ভাল করে চেয়ে দেখো
বেদনার রসে পরিপূর্ণ
বৃদ্ধের চোখে টলমল করে
ঝরে পড়ে
টপ টপ টপ।
0 Comments