জ্বলদর্চি

স্বামী বিবেকানন্দ : চিন্তা ও দর্শন /অবিনাশ সেনগুপ্ত

স্বামী বিবেকানন্দ : চিন্তা ও দর্শন

অবিনাশ সেনগুপ্ত

স্বামী বিবেকানন্দ ১৮৬৩ সালে কলকাতার এক বনেদী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। স্বামীজির চিন্তা ভাবনার উপর তাঁর পিতার বেশ বড় ভূমিকা ছিল, পিতা ছিলেন যুক্তিনির্ভর মানসিকতাসম্পন্ন এবং মায়ের ছিল ধর্মীয় মনোভাব। প্রথম দিকে বিবেকানন্দ পশ্চিমী দর্শন ভাবনার সঙ্গে সুপরিচিত ছিলেন, এবং যৌক্তিক প্রমাণ ও বাস্তব পরীক্ষা ছাড়া তিনি কোনো বিষয়কেই গ্রহণে অপারগ ছিলেন। কিন্তু তাঁর মনের অন্য একটি দিক ছিল যেক্ষেত্রে তিনি আধ্যাত্মিক ধারণা এবং নির্লিপ্ততার চর্চাও করতেন। ঈশ্বর আছেন কিনা সেটা জানার জন্য মাত্র ১৯ বছর বয়সে তিনি শ্রীরামকৃষ্ণের শরণাপন্ন হন এবং তাঁর সাধুতা ও পবিত্রতায় মুগ্ধ হন। রামকৃষ্ণের মৃত্যুর পরে পরেই বিবেকানন্দ একজন ধর্মীয় সন্ন্যাসীতে পরিণত হন এবং সমস্ত ভারতবর্ষ পরিভ্রমণ করেন। উচ্চ, নীচ, শিক্ষিত অশিক্ষিত সমস্ত ধরনের মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করেন। তিনি সাধারণ মানুষের ক্ষয়িষ্ণু অবস্থা লক্ষ্য করে হতাশ ছিলেন। সাধারণ দেশবাসী ধনী ও অর্থলোভী পুরোহিতদের দ্বারা শোষিত ছিলেন এবং ক্ষুধা অজ্ঞতা ও ভগ্ন স্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন। তিনি দ্রুত বুঝেছিলেন যে আধ্যাত্মিকতা তাঁদের দুঃখ দুর্দশার জন্য দায়ী নয়। তিনি তাঁর গুরুর উপদেশ স্মরণে রেখে দেশের পীড়িত শোষিত মানুষদের উপরে তুলে ধরার চেষ্টা করেন এবং একই সঙ্গে তাদেরকে ভারতবর্ষের উজ্জ্বল ঐতিহ্যের কথা মনে করালেন যা ভগবত গীতা ও উপনিষদে স্পষ্টভাবে উল্লেখিত আছে।

উনিশ শতকের বহু ভারতীয় সংস্কারক কতটা সংস্কার করা হবে এবং কোনটা বাধ্যতামূলক তার মধ্যে সুন্দর ভারসাম্য রেখেছিলেন। বিজ্ঞান ও ধর্মের মধ্যে তাঁরা একটা সামঞ্জস্য রাখার চেষ্টা করেছিলেন। বিদ্যাসাগর, অক্ষয় কুমার দত্ত ও ব্রজেন্দ্রনাথ শীল প্রমুখরা ধর্মীয় ধারণাকে একটা বিজ্ঞানসম্মত রূপ দেবার চেষ্টা করেছিলেন। স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন হিন্দু ধর্মের এক অন্যতম এবং অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। নতুন প্রচলিত ইংরেজি শিক্ষার ফল হিসাবে বিবেকানন্দ বিভিন্ন পশ্চিমী জ্ঞান ও আদর্শের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। তিনি জানতেন যে ধর্মের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ খুঁটিনাটি বিষয় যেমন, ঈশ্বর ও আত্মার অস্তিত্ব ও প্রকৃতি সম্পর্কে চূড়ান্ত ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব নয় কোনো যুক্তি বা আলোচনার দ্বারা। ধর্মীয় সত্যকে জানার জন্য বিবেকানন্দ পতঞ্জলির যোগসূত্রের উপর নির্ভর রাজযোগার কথা বলেছিলেন। যেটা অনেকটাই বিজ্ঞানসম্মত বলে মনে করা হয়।

তিনি পশ্চিম থেকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির শিক্ষা নেবার কথা বলেন যা তৎকালীন ভারতবর্ষে অন্যতম প্রয়োজনীয় ছিল। এবং পশ্চিমের জন্য তিনি ভারতীয় আধ্যাত্মিকতার প্রচার চেয়েছিলেন যা পশ্চিমকে তার ধৈর্যহীনতা ও উদ্বেগ থেকে রক্ষা করবে। তার মিশন ছিল জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক। আমেরিকায় তিনি ভারতীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে পশ্চিমীদের বহু ভুল ধারণাকে নসাৎ করেন। তাঁর আমেরিকা সফর আমেরিকার চিন্তাবিদদের হিন্দু দর্শনকে ভালভাবে বুঝতে সাহায্য করেছিল। যেটা ছিল তাঁদের কাছে খুব প্রামাণ্য ও যথাযথ। তিনি অদ্বৈত বেদান্তের শক্তিশালী দর্শনের কথা বলেন যাকে হিন্দু দার্শনিক চিন্তা ও চর্চার ক্ষেত্রে গর্ব বলে গণ্য করেন বিবেকানন্দ। তাঁর বক্তৃতা লেখাপত্র ও ব্যক্তিগত চর্চা থেকে আত্মার অমরত্ব, অস্তিত্বের একত্ব, মানব জাতির সংহতি ও ধর্মের ঐক্যতান সম্পর্কে তাঁর চিন্তার পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি আমেরিকানদের মনে করিয়ে দেন যে, এই ধারণাগুলি গণতন্ত্রের আধ্যাত্মিক শক্তি, মানব অধিকার, নৈতিক আইন এবং এটা তাদের ধর্মীয় দ্বন্দ্ব থেকে রক্ষা করবে। তাঁর মতে অদ্বৈতবাদের চরম বাস্তব ধারণা বা ব্রাহ্মণ্যবাদ গোটা সৃষ্টিকে প্রসারিত করেছে এবং যা মতবিরোধ ও দ্বন্দ্ব থেকে মুক্ত এবং  যা মতবিরোধ ও দ্বন্দ্ব থেকে মুক্ত এবং সকলের কল্যাণের জন্য সহায়ক।

বিবেকানন্দ পাশ্চাত্য থেকে বিজ্ঞান প্রযুক্তি বা কোনো সম্পদ আনয়ন করেননি। ভারতের তৎকালীন রাজনৈতিক অবস্থায় ব্যাপক হারে জ্ঞানের বিনিময় সম্ভব ছিল না। তবে ১৯৪৭ সালের পর থেকে অবস্থার পরিবর্তন ঘটে এবং পাণ্ডিত্যের আদান প্রদান ঘটতে থাকার পরিস্থিতি তৈরী হয় প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে। স্বামীজির মৃত্যুর পর রামকৃষ্ণ মিশনের মাধ্যমে তাঁর শিষ্যরা তার বাণীকে পালন করতে থাকেন। এবং মানবতার জন্য সত্যের জন্য কাজ করে চলেছেন। তিনি মানুষের প্রাত্যহিক কর্মের মধ্য দিয়ে বেদান্ত দর্শনকে মেনে চলার কথা বলেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর বহু বেদান্ত সোসাইটি তৈরী হয় পৃথিবীর নানা প্রান্তে। তাঁর মতে বিভিন্ন জ্ঞানের চর্চার মধ্যে কোনো বিরোধ নেই বরং তা পরিপুরক। তিনি কোলকাতার কাছে বেলুড়ে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন যেখানে প্রাচ্য অতীন্দ্রিয়বাদ ও পশ্চিমী বিজ্ঞান চর্চা সম্পন্ন হবে। তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে বোঝাপড়ার একান্ত প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিলেন। যার ফলে বিশ্বের বহু জটিল সমস্যার সমাধান সম্ভব হতে পারে।

তিনি মনে করেন, এই পৃথিবীতে মানুষ খুব বেশী দিন বিচ্ছিন্নভাবে থাকতে পারবে না। আমরা সবাই একটি চিন্তার সাগরে বসবাস করছি, যা আমাদের অতীন্দ্রিয় অভিজ্ঞতার মধ্যে, আমাদের বিজ্ঞানীদের, কবিদের, দার্শনিকদের সংগঠিত জ্ঞানের মাধ্যমে, মহাপুরুষদের সমস্ত বাণী ও বাক্যের মধ্যে ভেসে আছে। বিবেকানন্দ একটি মানুষের সংগঠন কল্পনা করেছিলেন যেখানে সমস্ত ছড়িয়ে থাকা আদর্শ ও ধারণাগুলোর সমন্বয় ঘটবে যার দ্বারা বর্তমান প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে থাকা অসামঞ্জস্যের সমাধান ঘটবে।

কিছু ভারতীয় দার্শনিকগণ দাবী করেছিলেন যে বিবেকানন্দ আমেরিকায় হিন্দু মতবাদের প্রচারে ভারতীয় ঐতিহ্য ও শুদ্ধতার কিছু বদল ঘটিয়ে ছিলেন। কিন্তু বর্তমান কালে পজিটিভিসমে বিশ্বাসী আধুনিক বিশ্বের মানুষদের কাছে বেদ  উপনিষদের সত্যকার অর্থ বোঝাটা খুব কষ্টের বিষয় নয়। আসলে এটা বুঝতে হবে যে, ঐতিহ্য জিনিসটি শুধু পুরানো নয় এটা আধুনিক চিন্তা চেতনার সঙ্গেও মিশে আছে। তাই বিবেকানন্দ ঐতিহ্যের আনুষ্ঠানিক অর্থের বাহিরে গিয়ে তার অত্যন্ত গভীর অর্থে পৌঁছেছিলেন। যা তাঁকে একটা বিশ্বজনীন এবং প্রসারিত পরিচিতি দিয়েছিলো। এবং তিনি বলিষ্ঠভাবে পুরানো জ্ঞানকে যেমন গ্রহণ করেন তেমনই হিন্দু ধর্মের বহু ভুল ব্যাখাকে তিনি সংশোধিত আকারে প্রচার করেন। তাই তিনি পশ্চিম ও প্রাচ্যের মধ্যে ফাটলকে দূর করেন পশ্চিমকে গ্রহণের মধ্য দিয়ে।

এটা ভাবা উচিত নয় যে বিবেকানন্দ প্রাচীন আর্য-বৈদিক নীতিগুলোকে ভুল ব্যাখ্যা করেছেন কারণ তিনি এর গভীরে ডুব নিয়েছিলেন এবং সেই জ্ঞানগুলিকে আধুনিক ভাষায় প্রকাশ করেছিলেন। বিবেকানন্দ তাঁর পরম গুরু রামকৃষ্ণের সমস্ত ধর্মের জাতের সম্মিলিত দার্শনিক ধারণাকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছানোর দূত হিসেবেও কাজ করেছেন। রামকৃষ্ণ মনে করতেন তাঁর মানবতার বাণী বিবেকানন্দই সমস্ত পৃথিবীতে মেলে ধরবেন। তিনি প্রাচীন আর্য জ্ঞান ও আধুনিক পাশ্চাত্য ধারণার মধ্যে মেলবন্ধন ঘটান। তিনি ভারতীয় জাতির প্রতি বিশ্বব্যাপী আকর্ষণ টেনে আনতে সফল হয়েছিলেন। প্রথমে আমেরিকা, তারপর ইউরোপে তিনি ভারতীয় ঐতিহ্যের প্রচার করেন।

ব্রাহ্মদের সঙ্গে স্বামীজির মেলামেশা তাঁর মধ্যে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি করতে এবং জাতীয়তা সম্পর্কে বোধ তৈরীতে সহায়তা করেছিল। রামকৃষ্ণের প্রভাব তাঁকে সংশয়বাদ থেকে প্রাচীন ভারতের ঐতিহ্যের অতীন্দ্রিয়বাদের দিকে টেনে নিয়ে যায়। তিনি হিন্দু ধর্মের প্রতিনিধি হিসাবে ইউরোপ এশিয়া ও আমেরিকা সফর করেন। ঠিক যে সময় স্বামীজির প্রাথমিক ধারণাগুলো তৈরী হচ্ছিল সেই সময় জাতীয়তাবোধ সম্পর্কে বিভিন্ন চিন্তা ভাবনাগুলো দানা পাকাচ্ছিল।

বিবেকানন্দের লেখা ও বক্তৃতা থেকে তিনটি ধারণা পরিষ্কার পাওয়া যায়। প্রথমত, তাঁর মূল লক্ষ্য সম্পর্কে পরিষ্কার চেতনা যেটি ঐতিহাসিকভাবে আবশ্যক। দ্বিতীয়ত, তাঁর ভারতীয় আত্মার অবিনশ্বরতা বিষয়ে প্রত্যয় এবং ভারতীয় আধ্যাত্মিকতার অপরাজেয়তার ধারণা। তৃতীয়টি হলো জাতীয়তাবাদ, যেটিকে ভারতবর্ষের মূল লক্ষ্য পূরণের অন্যতম কার্যকর ও পর্যাপ্ত কারণ বলে মনে করা যেতে পারে। বিবেকানন্দ ছিলেন বেদান্ত দর্শনের অন্যতম উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। তিনি অত্যন্ত দ্রুত এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকার ১১টি খণ্ড শেষ করেছিলেন। তিনি ছিলেন ঈশ্বরের রাজ্যের তীর্থযাত্রী এবং শোষিতদের কাছে যোদ্ধা। দেশের নৈতিক ও সামাজিক অর্থনৈতিক বিষয় সম্পর্কে তাঁর অগাধ জ্ঞান ছিল। তিনি কঠোর তপস্যাচর্চা এবং সামাজিক রাজনৈতিক উভয় বিষয়ে প্রচার করেছিলেন। তাঁর স্বল্প সময়ের জীবনকালে তিনি আশ্চর্য রকম সফলতা অর্জন করেছিলেন।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇



Post a Comment

0 Comments