জ্বলদর্চি

সাইটোজেনেটিসিস্ট ও মেডিসিনে একমাত্র একক নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ড. বারবারা ম্যাকক্লিনটক/পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

বিজ্ঞানের অন্তরালে বিজ্ঞানী ।। পর্ব ― ৪৭

              
সাইটোজেনেটিসিস্ট ও মেডিসিনে একমাত্র একক 
নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ড. বারবারা ম্যাকক্লিনটক―
                
'Transposons' : একটি জেনেটিক আশ্চর্য

পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা


মানুষের জিন তার সমস্ত দোষগুনের আধার। ভূত-ভবিষ্যৎ-বর্তমানের পরাকাষ্ঠা। জীবনের নীলনকশা। জীবের বৃদ্ধি, প্রজনন, পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়া সহ যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করে জীবের সামগ্রিক ডিএনএ (ডি-অক্সিরাইবো নিউক্লিক অ্যাসিড, সংক্ষেপে DNA) বা জিনোম। জিন হল ক্রোমোজোমের মৌলিক একক বা ভিত্তিপ্রস্তর। সরু ধাতুর তৈরি তারে গাঁথা রঙ-বেরঙের পুঁতিদানার মতো জিনগুলিও ক্রোমোজোম নামক তারে গেঁথে থাকে। বিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত ধারণা ছিল যে, জিন একখান অটল সত্তা (Stable Entity)। এর পক্ষান্তরণ অসম্ভব। গোল বাধল চল্লিশের দশকে এসে। এক তরুণী মহিলা বিজ্ঞানী চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন। তাঁর কথায়, মোটেও না! মোটেও সকল জিনের স্থায়ী সত্তা নেই। জিনের স্থান বদলায়। বদলায় ওর ধর্ম, ক্রোমোজোমের গঠন। উদাহরণ স্বরূপ আনলেন ভুট্টার প্রসঙ্গ। মকাই-এর ক্রোমোজোমের ভাঙন ভালোভাবে লক্ষ্য করলেন তিনি। এ হেন ভাঙনে ক্রোমোজোমের ভেতরে জিনের অবস্থানগত পরিবর্তন লক্ষ্য করার মতো। পরিবর্তনক্ষম সে-সকল সচল উপাদানগুলিকে 'ট্রান্সপোজন' (Transposon) বলে। কোনও একটি চলমান ট্রান্সপোজন ক্রোমোজোমের যে-জায়গায় অন্তর্ভুক্ত হয়, তার পার্শ্ববর্তী জায়গার জিনগুলোর অভিব্যক্তি পরিবর্তন করতে সচেষ্ট হয়। শুধু ভুট্টা দানা নিয়ে নিজের গবেষণা সীমাবদ্ধ রাখলেন না; অন্যান্য পদার্থের ক্রোমোজোম নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যেতে থাকলেন তিনি, সাইটোজেনেটিক বৈজ্ঞানিক ড. বারবারা ম্যাকক্লিনটক। গবেষণার সমস্ত তথ্য এককাট্টা করে প্রবন্ধ ছাপতে দিলেন ১৯৫০ সালে। বের হল তাঁর আর্টিকেল, শিরোনাম 'PNAS Classic Article'। সে-আর্টিকেলের তথ্য ঘেটে জানা যায় যে, তাঁর আবিষ্কৃত প্রথম স্থানান্তরযোগ্য উপাদান হল দুটি― 'Ac' (Activator) আর 'Ds' (Dissociation)। 

  সেসময় উপাদান দুটির অস্তিত্ব ভুট্টার জিনতত্ত্ব দিয়ে প্রমাণ করা গেলেও তাঁর আবিষ্কারের স্বীকৃতি আসে তিন দশক পার করে। সত্তরের দশকে মল্যুকিউলার বায়োলজি আসার পর বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ট্রান্সপোজনগুলি দিনের আলোয় আসতে শুরু করে। আলোচনায় বাদ যায়নি বিভিন্ন ভাইরাস আর ব্যাকটেরিয়ার জিনের প্রসঙ্গও। সেসব খতিয়ে দেখে জানা গেল― আমাদের ৬৫% জিনোম আর ভুট্টার ৮৫% জিনোম তৈরি হয়েছে ট্রান্সপোজন জিনের সমন্বয়ে। এ হেন আবিষ্কারে মিস ম্যাকক্লিনটক-এর স্বীকৃতির দরজা হাট করে খুলে গেল। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে পেলেন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞান জাতীয় মেডেল। পুরস্কারটি তুলে দেন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন। প্রথম মহিলা হিসাবে জাতীয় বিজ্ঞান মেডেল পেয়েছিলেন তিনি। এক দশক পরে এল বিরাট সম্মাননা। ১৯৮৩ সালে এককভাবে মেডিসিনে নোবেল পুরস্কার জিতে নিলেন তিনি। তাঁর পূর্বে চিকিৎসাশাস্ত্রে একক নোবেল পুরস্কার কেউ পাননি। নোবেল জিতে উঠে প্রেস কনফারেন্সে কড়া ভাষায় কমিটিকে বিঁধলেন আজীবন মকাই-এর ক্রোমোজোম নিয়ে গবেষণায় মগ্ন থাকা বৈজ্ঞানিক ম্যাকক্লিনটক―

  'It might seem unfair to reward a person for having so much pleasure, over the years, asking the maize plant to solve specific problems and then watching its responses.'

স্বীকৃতি এসেছিল অনেক দেরিতে। জিনের স্থানান্তর নিয়ে লেখা তাঁর রিসার্চ রিপোর্ট বেরনোর ৩৫ বছর পর এবং তাঁর মৌলিক প্রবন্ধ 'PNAS Classic Article' ছাপার তেত্রিশ বছর পর এসেছিল নোবেল পুরস্কার। হয়তো সেজন্য খানিক মনক্ষুন্ন বৈজ্ঞানিক।
      

  
  এ হেন বিজ্ঞান-সাধিকা বারবারা ম্যাকক্লিনটক ১৯০২ সালের ১৬ই জুন তারিখে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন আমেরিকার হার্টফোর্ড-এ। বাবা থমাস হেনরি ম্যাকক্লিনটক একসময়ের ব্রিটিশ অভিবাসী শিশু। তিনি ছিলেন নামকরা হোমিওপ্যাথি ফিজিসিয়ান। মা মিসেস সারা হ্যান্ডি ম্যাকক্লিনটক। তিনশো বা তারও বেশি বছর আগে ব্রিটিশ তীর্থযাত্রীর দলে ভিড়ে মায়ের পূর্বপুরুষগণ ইংল্যান্ড ছেড়ে আমেরিকা পাড়ি জমায়। চার ভাইবোনের মধ্যে তৃতীয় বারবারা'র শৈশবে নাম ছিল এলিনয় ম্যাকক্লিনটক। খুব ছোটবেলায় বাবা-মা তার সে নাম বদলে দেয়। নূতন নাম রাখেন 'বারবারা'। শিশু বয়েস থেকে স্বাধীনভাবে বড় হতে থাকে সে। বয়স যখন মাত্র বছর তিন, ব্রুকলিন-এ কাকু-কাকিমার আশ্রয়ে তার বড় হয়ে ওঠা। লেখাপড়ায় হাতেখড়ি ব্রুকলিন-এর এরাসমাস হল হাই-স্কুলে। এখান থেকেই মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তরণ। ইতিমধ্যে, ১৯০৮ সাল থেকে পুরো ম্যাকক্লিনটক পরিবার ব্রুকলিন-এর স্থায়ী বাসিন্দা বনে যায়। মাধ্যমিক লেভেল থেকে ছোট্ট বারবারা'র বিজ্ঞানের প্রতি দারুণ টান। অসম্ভব ভালোবাসা। অল্প বয়সে, ১৯১৯ সালে, স্নাতক স্তরের পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হয় সে। সেবছরই করনেল-এর কৃষি কলেজে ভর্তি হয়ে যায়। ১৯২৩ সালে বোটানি'তে বিএসসি ডিগ্রি। ইতিপূর্বে, ১৯২১ সালে জিন বিষয়ে প্রাথমিক উৎসাহ উদ্দীপনা মিলে গিয়েছিল। জিন নিয়ে একটি কোর্স কমপ্লিট করে ফেলেছে সে। সেই শুরু। তারপর আর থামে থাকেনি জিন নিয়ে তাঁর গবেষণার অশ্বমেধের ঘোড়া।
      
  একজন জিন বিশেষজ্ঞ এবং উদ্ভিদ প্রজননবিদ ছিলেন প্রফেসর সি. বি. হাৎচিসন। মূলত তাঁর অধীনে গ্র্যাজুয়েট স্তর থেকে শুরু হল জিন বিষয়ক পড়াশুনা, কৌতূহল। অধ্যাপক হাৎচিসন তরুণী বারবারা'র উৎসাহ দেখে খানিকটা বিস্মিত। সেই সঙ্গে আনন্দিতও। বিশেষ একদিনের ঘটনা। ১৯২২ সাল। গ্র্যাজুয়েট স্তরে একটি জেনেটিক কোর্স চালু হয়েছে করনেল ইউনিভার্সিটিতে। কোর্সটিতে ভর্তির জন্য বারবারা'কে টেলিফোনে আমন্ত্রণ জানান প্রফেসর হাৎচিসন। এ হেন টেলিফোন কল ছাত্রীর জীবনে বিশেষ তাৎপর্য বয়ে আনে। পরে তিনি বলেছেন―

 'Obviously, this telephone call cast the die for my future. I remained with genetics thereafter.'

  কিছু দিন আগে পর্যন্ত করনেল-এর প্ল্যান্ট ব্রিডিং বিভাগে গার্লস স্টুডেন্ট প্রবেশের অনুমতি ছিল না। জিন ল্যাবে মহিলাদের পড়াশোনার অধিকার সম্পর্কিত বিল যখন পাস হয়, মিস বারবারা তখন কলেজের ছাত্রী। ফলে জিন নিয়ে ল্যাবে হাতেকলমে জানার দরজা হাট করে খুলে গেল কলেজে ঢুকে। তবুও, ১৯২৫ এবং ১৯২৭ সালে জেনেটিক্স-এর বদলে বোটানি'তে তাঁকে যথাক্রমে MS আর PhD ডিগ্রি দেওয়া হয়। স্নাতক স্তরে পড়ার সময় আর পোস্ট-গ্র্যাজুয়েটে বোটানির প্রশিক্ষক হিসাবে নিযুক্তির সময় একটি গ্রুপ তৈরি করা হয়, যার মূল উদ্দেশ্য সাইটোজেনেটিক্স ক্ষেত্রে নিরন্তর গবেষণা। সে-গ্রুপের একজন সহায়ক ছিলেন মিস ম্যাকক্লিনটক। প্রথমে, করনেল ল্যাবের বোটানিস্ট লোয়েল ফিৎজ র‍্যানডল্ক এবং পরে ড. লেস্টার ডব্লিউ শার্প-এর সঙ্গে রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসাবে কাজ শুরু করেন তিনি।
      
  তাঁর গবেষণার মূল ফোকাসকেন্দ্র ছিল ভুট্টার ক্রোমোজোমের ধর্ম পর্যালোচনা এবং আধুনিক উন্নত উপায় খুঁজে বের করা, যা প্রমাণ করবে ভুট্টার জিন সচল, স্থানান্তরে গমনক্ষম। ১৯২৯ সালে তিনি লিখলেন জেনেটিক্স পেপার। আর্টিকেলটি মূলত ট্রিপলয়েড ভুট্টা ক্রোমোজোমের গুনাগুনের উপর লেখা। এ হেন প্রবন্ধটি ভুট্টার জিনোম নিয়ে পণ্ডিতদের আগ্রহ বহুগুণ বাড়িয়ে তোলে। ভুট্টার জিনোম নিয়ে তাঁর গবেষণার কাজ সবে শুরু। তারপর সারাটা জীবন ওই জিন তথা ডিএনএ (DNA)-এর বিবর্তন গবেষণায় কাটিয়ে দেন তিনি। এরই পুরস্কার হিসেবে ৮১ বছর বয়সে জিতে নিয়েছিলেন নোবেল প্রাইজ। 

  এর মাঝে তাঁর জীবনে রয়েছে অনেক লড়াই। কঠিন সংগ্রাম। টালমাটাল তিরিশের দশক পেরিয়ে ১৯৪০-এ মিসৌরি ইউনিভার্সিটিতে অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর পদে তিনি যোগ দিলেন। বেতন বেশ ভালো; তিন হাজার ডলার। অথচ, বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে খুশি হননি কুমারী ম্যাকক্লিনটক। কেন জানি তাঁর শুধু মনে হচ্ছে যে, মিসৌরি'তে খুব বেশি কিছুই করার নেই তাঁর। যদিও জোরদার চলছে গবেষণার কাজ। বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের পজিশন নিয়ে খানিক চিন্তিত তিনি। সেজন্য তিনি ঠিক করেছেন― অন্য কোথাও কাজের পরিবেশ খোঁজ শুরু করাই শ্রেয়। যদিও তিনি অবগত আছেন, ১৯৪২-এর বসন্তে মিসৌরি ইউনিভার্সিটিতে তাঁর পদোন্নতি হবে। সহকর্মীদের কাছে নিজের গুরুত্ব হারানো যদি একটা কারণ হয়, আরেকটি কারণ সম্ভবত প্রশাসনিক কাজে আস্থা রাখার ধৈর্যের অভাব। সুতরাং তিনি মনস্থির করে ফেলেছেন― মিসৌরি ছাড়বেন।
        

  ১৯৪১ সালের প্রথম দিকে ক'দিনের জন্য মিসৌরি থেকে ছুটি চাইলেন মিস বারবারা। ছুটিতে হন্যে হয়ে খুঁজে চলেছেন বিকল্প চাকুরীর ব্যবস্থা। খোঁজ মিলল তেমন চাকুরী। কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে এল লোভনীয় প্রস্তাব। সাদরে গ্রহণ করলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং প্রফেসরের নিশ্চিত ঠাঁই। কাকতলীয় দেখা হয়ে গেল একদা করনেল-এর সতীর্থ প্রফেসর মারকুস রোডস-এর সঙ্গে। কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির লং আইল্যান্ডে রয়েছে 'কোল্ড স্প্রিং হারবার' ল্যাবরেটরি। সেখানকার নিজের তৈরি রিসার্চ ল্যাবে গবেষণার সবুজ সংকেত দিলেন ড. রোডস। ১৯৪১ সালের ডিসেম্বরে কনকনে ঠাণ্ডায় আরও একটা অফার এল। অফারটি মূলত জিন গবেষকের। এবারের অফারটি আসে জেনেটিক্স কোল্ড স্প্রিং হারবার ল্যাব‍রেটরি ডিপার্টমেন্টের ওয়াশিংটনের কারনেগি ইন্সট্যুট থেকে। এমন চমৎকার প্রস্তাবে সাড়া না-দেওয়া বোকামি! লুফে নিলেন মিস ম্যাকক্লিনটক। এখানে থাকাকালে উন্নত মানের জিন গবেষণা আলাদা মাত্রা পায়। ১৯৪৪ সালে তৃতীয় মহিলা হিসাবে 'ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্স'-এ নির্বাচিত হন। পরের বছর, ১৯৪৫ সালে 'জেনেটিক্স সোসাইটি অব আমেরিকা'-এর প্রথম মহিলা প্রেসিডেন্টের পদ অলংকৃত করেন তিনি। অবশ্য ১৯৩৯ সাল থেকে একনাগাড়ে দীর্ঘদিন সহসভাপতি'র দায়িত্ব নিষ্ঠা ভরে পালন করে এসেছেন। ১৯৬৭ সালে এখান থেকে কর্মজীবনে অখণ্ড অবসর গ্রহণ। অবসর নিলেও একফোঁটা বিশ্রাম নেননি আজীবন। গবেষণার কাজ চলেছে নিরন্তর। 
       

এখানে ভুট্টার দানার ক্রোমোজোমের উপর কাজ করেই ১৯৮৩ সালে মিলেছিল নোবেল প্রাইজ। নোবেল জয়ের পর লং-আইল্যান্ডের কোল্ড স্প্রিং হারবার ল্যাবে একজন মূখ্য দলপতি আর গবেষক হিসাবে বাকি জীবনটা স্বচ্ছন্দে কাটিয়ে দেন তিনি। শেষমেশ, নিউইয়র্কের হানটিংটন সিটিতে, ৯০ বছর বয়সে, ১৯৯২ সালের দোসরা সেপ্টেম্বর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন চিরকুমারী ড. বারবারা ম্যাকক্লিনটক।

তথ্যসূত্র :
●Barbara McClintock and the Discovery of Jumping Genes (Transposons) ― Nature
●Barbara McClintock ― Facts : NobelPrize.org
●Barbara McClintock―American Scientist : Britannica
●Women Who Changed Science ― Barbara McClintock : The Nobel Prize
●Barbara McClintock ― Wikipedia 

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇




Post a Comment

0 Comments