জ্বলদর্চি

কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস অফলাইনে কিন্তু পরীক্ষা অনলাইনে : সিদ্ধান্তে ধোঁয়াশা /সজল কুমার মাইতি

কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস অফলাইনে কিন্তু পরীক্ষা অনলাইনে :  সিদ্ধান্তে ধোঁয়াশা

সজল কুমার মাইতি

২০২১ এর ১৬ ই নভেম্বর আমাদের রাজ্যে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অফলাইন ক্লাস চালু হয়ে গেছে। যদিও ক্লাস কিছুটা নিয়ন্ত্রিতভাবে শুরু হয়েছে ও চলছে। ছাত্রছাত্রীর উপস্থিতি মোটামুটি সন্তোষজনক। যদিও ধীরে ধীরে সেই হার অবনতির দিকে। শিক্ষকরা ও আসছেন। ক্লাস ও নিয়মিত হচ্ছে। স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসার লক্ষন উজ্জ্বল হচ্ছে। যদিও স্বাস্থ্যবিধি শিকেয় উঠেছে। ক্লাসরুম, বাথরুম নিয়মিত পরিষ্কার ও স্যানিটাইজেশনের বালাই নাই। এমন সময় নবগঠিত উচ্চ শিক্ষা কমিশনার কর্তৃক জারি করা এক নির্দেশিকা আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছে। এরফলে জনমানসে ও শিক্ষক সমাজে কিছু প্রশ্নচিহ্ন দেখা দিয়েছে। সরকারি এই সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা কতটা তা আমরা আলোচনা করে দেখতে পারি।

উচ্চ শিক্ষায় এডুকেশন ডাইরেক্টোরেটের এক ঐতিহাসিক ভূমিকা আছে। ব্রিটিশ আমল থেকে এই ডাইরেক্টোরেট চলে আসছে। এক সময় ব্রিটিশরা এই ডাইরেক্টোরেটের প্রধান পদ ডাইরেক্টর অফ পাবলিক ইন্সট্রাকশন বা ডি পি আই এর পদ অলংকৃত করতেন। পরবর্তীকালে ওয়েস্ট বেঙ্গল সিনিয়র এডুকেশন সার্ভিস থেকে এই পদ অলংকৃত হতে থাকার প্রথা প্রচলিত হয়। ডি পি আই পদাধিকার বলে Ex Office Secretary of Higher Education হতেন। ইদানীংকালে এই আলংকারিক পদ থেকে ডি পি আইকে বঞ্চিত করা হয়েছে। ' কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে' র মতো Education Directorate এর প্রধানের পদ থেকে ডি পি আইকে বঞ্চিত করে তাঁর মাথায় কমিশনারকে বসানো হয়েছে। ডাইরেক্টোরেটের শেষ কথা বলার অধিকার আর ডি পি আই র নেই। এক সময় ওয়েস্ট বেঙ্গল সিনিয়র এডুকেশন সার্ভিসের অধ্যাপক ভবতোষ দত্তের মতো ব্যক্তি এই ডি পি আই পদ অলংকৃত করেছেন। সরকারি এই সিদ্ধান্তে এডুকেশন সার্ভিস ও সিনিয়র এডুকেশন সার্ভিস তাদের গরিমা হারাল। বি সি এস বা আই এ এস সার্ভিস এর লোকজন যারা এডুকেশন সার্ভিস এর বিভিন্ন সূক্ষ ও জটিল প্রয়োজন সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ তাদের তত্ত্বাবধায়নে চলে গেল। একমাত্র সময় ই বলবে এই সিদ্ধান্ত ঠিক না ভুল। 

তা এই কমিশনারের এক নির্দেশের বলে দেখা গেল  প্রতিটি সেমিস্টারের পরীক্ষা নিতে হবে অনলাইনে। কারন এইসব সেমিস্টারের কিছু ক্লাস অনলাইনে হয়েছে। কিন্তু ঘটনা হল কিছু ক্লাস তো অফলাইনে ও হয়েছে। তার বিচার কিভাবে হবে? তার মানে কি প্রশাসক এই কথা বোঝাতে চেয়েছেন যে অনলাইনে ক্লাসে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা আদৌ হয় না বা হয় নি? সেজন্য ছাত্রছাত্রীদের বাড়িতে বসে অনলাইনে পরীক্ষা দেওয়ার এই সুব্যবস্থা। যার ফলে তারা বাড়িতে বসে সবার সঙ্গে আলোচনা করে বইপত্তর দেখে ইচ্ছেখুশীমতো পরীক্ষা নামক এক প্রহসনের উৎসবে অংশগ্রহন করতে পারবে। প্রশাসক এই সুব্যবস্থা তাদের জন্য করে দিচ্ছে। এতে ছাত্র খুশী। অভিভাবক ও খুশী। কোন ঝামেলা ঝঞ্ঝাট নেই। সবাই খুশী তো প্রশাসক ও খুশী। শিক্ষার সর্বনাশ হল। শিক্ষিতের সর্বনাশ হল। জ্ঞানার্জনের আদ্যশ্রাদ্ধ হল। পরে যেকোন কম্পিটিটিভ পরীক্ষা তার প্রমাণ হাতেনাতে পাওয়া যাবে। শুধু কিছু ক্লাস অনলাইনে হয়েছে এই যুক্তিতে যদি সেমিস্টার পরীক্ষা অনলাইনে নিতে হয় তবে কুযুক্তি কাকে বলা যায়? অফলাইন ক্লাস শুরুর পর ছাত্রছাত্রীরা যতটা গুরুত্বের সঙ্গে ক্লাস করা শুরু করেছিল, এই অনলাইন সেমিস্টার পরীক্ষা ঘোষণার পর সেই ক্লাসে উপস্থিতির হার ক্রমহ্রাসমান। শিক্ষকদের মধ্যে উৎসাহ উদ্দীপনা ও চুপসে যাওয়া বেলুনের মতো। ছাত্রদের ভবিষ্যতের জন্য এই সিদ্ধান্ত এক হঠকারী সিদ্ধান্ত হতে পারে। পড়াশোনায় ঘাটতি থাকলে তা অপূরণীয় ক্ষতি। ভবিষ্যতে জীবিকা নির্ণয়ে এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী। শিক্ষা ও জাতির অগ্রগতি ব্যাহত হতে বাধ্য। এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আমাদের আরও গভীরভাবে বিবেচনা করা উচিত ছিল।

কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্তের বৈপরীত্য লক্ষ্য করার মতো। নির্দেশিকা যখন সেমিস্টার পরীক্ষা অনলাইনে নিতে হবে, কিন্তু Internal Assessment নিতে হবে অফলাইনে। এর যুক্তি কি এবং কেন? তার উত্তর কারুর জানা আছে বলে মনে হয় না। ছোট অল্প মার্কের পরীক্ষা অফলাইনে অথচ বড় বেশি মার্কের পরীক্ষা অনলাইনে। এর ফলে কার কি সুবিধা হবে জানা নেই। তবে সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা নিয়ে অবশ্যই প্রশ্ন তোলা যায়। শিক্ষা ও ছাত্রদের ভবিষ্যতে আর ক্ষতি যদি করতে না চাই তাহলে আমাদের আরও অনেক বিচার বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত। যখন অনলাইন থেকে অফলাইনে ফেরার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি ও সেই ব্যাপারে সাহস দেখিয়ে সিদ্ধান্ত নিচ্ছি, তখন আর পিছন ফিরে তাকানোর প্রয়োজন খুব একটা নেই। যদি তা একান্ত জরুরি না হয়। বরং আমরা ভেবে দেখতে পারি, সেরকম পরিস্থিতি হলে পড়াশোনাটা অনলাইনে চালিয়ে  পরীক্ষাটা অফলাইন নিতে পারি কিনা ! তাহলে মান নির্ণয় নিয়ে প্রশ্ন ওঠা অনেকাংশে আটকানো যেতে পারে। ছাত্র কতটা শিখল তার ও একটা যাচাই হয়ে যায়। ভেবে দেখবেন প্লিজ।

সজল কুমার মাইতি।
প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান, বানিজ্য বিভাগ, হুগলী মহসীন কলেজ। পূর্বতন অধ্যাপক, গোয়েঙ্কা কলেজ অফ কমার্স এ্যান্ড বিজনেস অ্যাডমিনিষ্ট্রেশন, কলকাতা। চৌত্রিশ বছরের অধিক কাল ইউ জি ও পি জি শিক্ষা দানের অভিজ্ঞতা। বতর্মানে পশ্চিমবঙ্গের সরকারি কলেজের বানিজ্য বিষয়ে সিনিয়র সার্ভিসের একমাত্র অধ্যাপক।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇





Post a Comment

0 Comments