জ্বলদর্চি

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা /ষষ্ঠ পর্ব /প্রীতম সেনগুপ্ত


শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা

ষষ্ঠ পর্ব

প্রীতম সেনগুপ্ত


১৮৮২ সাল। চৈত্র মাস। গ্রীষ্ম-শীত কোনোটিই তেমন প্রবল নয়। নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া। ঠাকুরের কাছে রাত্রিযাপন করছেন বাবুরাম। তিনি ও রামদয়াল ঠাকুরের ঘরের পূর্বদিকের বারান্দায় শয়ন করেছেন। রাখাল ঘরে শুয়েছেন। প্রায় একঘন্টা পর ঠাকুর পরিধেয় কাপড় বগলে করে মাতালের মতো টলতে টলতে বাইরের বারান্দায় চলে এলেন। রামদয়ালকে জিজ্ঞাসা করলেন,“হ্যাঁ গা, ঘুমুলে?” বাবুরাম ও রামদয়াল উভয়েই শয্যা থেকে উঠে বসলেন। এরপরের অংশটুকু ব্রহ্মচারী অক্ষয়চৈতন্য রচিত ‘প্রেমানন্দ প্রেমকথা’ গ্রন্থটি থেকে উদ্ধৃত করলাম। যা রয়েছে সংলাপের আকারে।
         “ঠাকুর-- দেখ, তাকে একবার আসতে বোলো। তার জন্য আমার বুকের ভিতরটা (বগল হইতে কাপড় লইয়া মোড়া দিয়া) এইরকম মোড়া দিচ্চে, যেন গামছা নিংড়ুচ্চে! তুমি একবার তাকে আসতে বোলো। 
        রামদয়াল-- আজ্ঞে, আমি কালই তার সঙ্গে দেখা করে বলব আপনার সঙ্গে দেখা করতে। বলব, তিনি আপনার জন্য অস্থির হয়েচেন, একবার গিয়ে দেখা করে আসুন। 
         ঠাকুর-- হ্যাঁ, তার জন্য মনটা বড় চঞ্চল হয়েছে, একটিবার দেখা করে যেতে বল। 
        রামদয়াল-- আমি রাতটা পোহালেই তাঁর কাছে যাব! আপনি চিন্তা করবেন না, তিনি ভাল আছেন। আর আপনি অস্থির হয়েচেন শুনলেই তিনি আসবেন।
             বাবুরাম ভাবিতে লাগিলেন, এ কী ভালবাসা! এত অস্থির! এঁর এত ভালবাসা, আর সে লোকটা কেমন? একবার আসে না! তাঁহার কোমল প্রাণে ব্যথা বাজিল।
            ঠাকুর নিজের ঘরের কয়েক পদ গিয়াই আবার ফিরিয়া আসিয়া বলিলেন, তবে বোলো, একবার তাকে আসতে বোলো। বার বার ঐ একই কথা বলিয়া টলিতে টলিতে ঘরে গিয়া শয়ন করিলেন, কিন্তু অধিকক্ষণ থাকিতে পারিলেন না। প্রায় একঘন্টা পরে পুনরায় পরিধেয় কাপড়খানি বগলে করিয়া টলিতে টলিতে রামদয়ালের নিকট আসিয়া বসিলেন ও বলিতে লাগিলেন-- নরেন বড় শুদ্ধসত্ত্ব, সাক্ষাৎ নারায়ণ! তাকে না দেখলে থাকতে পারি না। তার জন্য প্রাণটা ছটফট করছে, সে যেন একবার আসে। সমস্ত রাত্রি ঘণ্টায় ঘণ্টায় ঠাকুর এইরূপ করিলেন। নিশাবসান হইল।”
   বস্তুতপক্ষে ঠাকুরের এই অপার্থিব ভালোবাসার স্পর্শ পেয়েছিলেন তাঁর সমস্ত ত্যাগী সন্ন্যাসী সন্তানেরা। অবতার পার্ষদেরা তাঁর ঈশ্বরীয় প্রেমস্পর্শে জীবন সঁপে দেন চরণতলে। পরবর্তীকালে ঠাকুরের ভালোবাসার কথা উল্লেখ করে মঠের সাধু-ব্রহ্মচারীদের বাবুরাম মহারাজ বলতেন,“আমি কি আর তোদের ভালবাসি? যদি ভালবাসতাম তাহলে তোরা আমার আজীবন গোলাম হয়ে থাকতিস। আহা, ঠাকুর আমাদের কত ভালবাসতেন! তার শতাংশের এক ভাগও আমরা তোদের ভালবাসি না। কোন কোন দিন রাত্রে তাঁকে হাওয়া করতে করতে আমি ঘুমিয়ে পড়তুম; তিনি আমাকে তাঁর মশারির ভেতর নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিতেন। আমি আপত্তি করতুম, কারণ তাঁর বিছানা আমার ব্যবহার করা কি ঠিক? তাতে তিনি বলতেন, ‘বাইরে তোকে মশায় কামড়াবে; যখন দরকার হবে আমি জাগিয়ে দেব।’ ” কলকাতা থেকে দক্ষিণেশ্বরে দীর্ঘসময় না এলে ঠাকুর চঞ্চল হয়ে পড়তেন। প্রখর গ্রীষ্মের তাপ অগ্রাহ্য করে তাঁর জন্য কলকাতায় ছুটে চলে আসতেন। ১৮৮৫ সালে এইরকমই চৈত্রমাসের একদিনে বাগবাজারে বলরাম বসুর বাসভবনে ( পরবর্তীকালে যা বলরাম মন্দির নামে খ্যাত হয়) এসে বলেছিলেন , “বলে ফেলেছি-- তিনটের সময় যাব, তাই আসছি; কিন্তু বড় ধূপ! ... ছোট নরেনের জন্য আর বাবুরামের জন্য এলাম।” (শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত, তৃতীয় ভাগ)

            বাবুরাম মেধাবী ছাত্র ছিলেন না। উপরন্তু ঠাকুরের সংস্পর্শে আসার ফলে ব্যবহারিক শিক্ষাপদ্ধতি বা শিক্ষালয় থেকে মন বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে। বিশেষভাবে জাগরিত ধর্মচেতনাই যে এর কারণ তা বলা বাহুল্য। ফলস্বরূপ ১৮৮৫ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় তিনি উত্তীর্ণ হতে পারলেন না। এই সংবাদ শুনে শ্রীরামকৃষ্ণ সহাস্যে বলেছিলেন, “ভালই তো-- ও পাশমুক্ত হল। যার যটা পাশ, তার তটা পাশ( অর্থাৎ বন্ধন)।” এই কথা শুনে বাবুরাম হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলেন। ১৮৮৬ সালে ঠাকুরের দেহত্যাগের পর বরানগর মঠ স্থাপিত হয়। এই প্রসঙ্গে এটা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে আঁটপুর স্থানটি যেমন বাবুরাম মহারাজের জন্মস্থান হিসেবে গরিমাময়, তেমনই রামকৃষ্ণ ভাবান্দোলনের ক্ষেত্রে এটির অন্য বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। ১৮৮৬ সালে বড়দিনের সময় ঠাকুরের ত্যাগী যুবক ভক্তদের অনেকেই আঁটপুরে বাবুরামের বাড়িতে এসেছিলেন। এঁরা হলেন-- নরেন্দ্র, শরৎ, শশী, তারক, কালী, নিরঞ্জন, গঙ্গাধর, সারদা ও বাবুরাম তো ছিলেনই। এখানে বৃক্ষমূলে ধুনি জ্বালিয়ে তাঁরা সৎপ্রসঙ্গ করতেন। এমনই এক নিশায় বিশেষভাবে উদ্দীপিত হয়ে নরেন্দ্র যিশুর ত্যাগ, বৈরাগ্য, পবিত্রতা ও প্রেমের কথা আলোচনা করতে করতে বিহ্বল হয়ে পড়েন। এই সূত্র ধরেই তিনি সন্ন্যাস জীবনের উচ্চ আদর্শ ত্যাগ, কষ্টসহিষ্ণুতা, তপস্যার ভাবটি উপস্থিত সকলের মনে এমনভাবে সঞ্চারিত করলেন যে, সেদিন তাঁরা দৃঢ়সংকল্প করলেন ভবিষ্যত জীবন সন্ন্যাসের আদর্শে নিবেদিত করবেন। সেই মুহূর্তেই প্রজ্জ্বলিত ধুনির সম্মুখে তাঁরা প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করলেন। আশ্চর্যের বিষয় সেটি ছিল ২৪ ডিসেম্বরের রাত, অর্থাৎ যিশুর আবির্ভাবের প্রাক-ক্ষণ! অথচ এই বিষয়ে তাঁরা কেউই সচেতন ছিলেন না। আঁটপুর থেকে ফিরে আসার পর সন্ন্যাস গ্রহণের কালে বাবুরামের সন্ন্যাস নাম রাখা হল প্রেমানন্দ। ঠাকুর তাঁর সম্পর্কে যেসব কথা বলেছিলেন সেসব স্মরণ করেই এই নামকরণ। বরানগর ও পরবর্তীকালে আলমবাজার মঠে স্বামী প্রেমানন্দ অপরাপর গুরুভাইদের সঙ্গে কঠোর তপশ্চর্যায় রত হলেন। শ্রীরামকৃষ্ণই ছিলেন যে তপস্যার কেন্দ্রবিন্দু। তাঁকে ধ্রুবতারা করেই এগিয়ে চলতে থাকল জীবন। ১৮৮৭ সালে গুরুভাই স্বামী সারদানন্দ ও স্বামী অভেদানন্দের সঙ্গে ৺পুরীধামে যান, শ্রীরামকৃষ্ণদেবের জন্মোৎসবের পরপরই। ১৮৯০ সালের কোনো একসময়ে কাশীতে যান ও সেখানে জীবন্মুক্ত মহাপুরুষ ত্রৈলঙ্গস্বামীকে দর্শন করেন। ভাস্করানন্দ স্বামীরও সাক্ষাৎলাভ করেন সেখানে। এইসময় স্বামীজী গাজীপুরে অবস্থান করছিলেন। আবার ১৮৯৫ সালে উত্তর ভারতে বিভিন্ন তীর্থ দর্শনান্তে বৃন্দাবনে এসে উপস্থিত হন বাবুরাম মহারাজ। সেখানে ‘কালাবাবুর কুঞ্জে’ ছিলেন, সারাদিন আপনভাবে তন্ময় হয়ে থাকতেন। কিছুদিন পরে ব্রহ্মচারী কালীকৃষ্ণ (স্বামী বিরজানন্দ) তাঁর সঙ্গে যোগ দিলেন। ইতিমধ্যে সংবাদ এল আচার্য বিবেকানন্দ ভারতে প্রত্যাবর্তন করছেন। স্বামীজীর প্রবলতম আকর্ষণ শক্তি উপেক্ষা করে কার সাধ্যি! ১৮৯৬-এর শেষভাগে তাঁরা কলকাতার অভিমুখে চললেন। মাঝে জয়রামবাটিতে শ্রীশ্রীমায়ের দর্শন সেরে, ৺তারকেশ্বর দর্শনান্তে আঁটপুরে এসে পৌঁছন। জয়রামবাটিতে প্রায় পনেরো দিন ছিলেন। আর আঁটপুরে দু-তিনদিন থেকে আলমবাজার মঠে এসে দেখলেন ইতিমধ্যে চার পাঁচদিন আগেই স্বামীজী সেখানে এসে উপস্থিত হয়েছেন। বিশ্বজয়ী বিবেকানন্দ!

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments