জ্বলদর্চি

শাঁওলী মিত্র স্মরণে /পৌলমী ভট্টাচার্য

শাঁওলী মিত্র স্মরণে

পৌলমী ভট্টাচার্য

কলকাতা  বিশ্ববিদ্যালয়ের  ছাত্রী, তখন। সেমিনারের শেষে  আবৃত্তি  শোনাবার পালা। শোনালাম।
সবটা শোনার পর, পার্ক সার্কাসের  ঠিকানায়, দেখা করতে বললেন। সেটুকুই আমার সেদিনের ব্রহ্মকমল। বাড়ি ফিরে  সেকি উত্তেজনা!  আপনি ডেকেছেন। 
আশির দশকের প্রাইমারি ইস্কুলের  প্যাকাটি বাচ্চাটা শম্ভু মিত্রের নামমাহাত্ম না বুঝলেও  তখন থেকেই নামটির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা উন্নাসিক বামপন্থী ভ্রূ কোঁচকানোটাকে  চিনতো! আর,  এক আশ্চর্য, উদ্দীপনের মতো কিচ্ছু না বুঝেও,  টেপরেকর্ডে  বেজে চলা, অওদিপাউস এর সংলাপ... রক্তকরবীর গান...ডাকঘরের ডাক.. সবটাই কেমন যেন, দিব্য-আনন্দে  জায়গা করে নিত ভেতরে। পাকাপাকি ভাবে। অজান্তে।

রেডিও নাটকের মোহ তখন থেকে ভেতরে। সে নাটকে কন্ঠ  আপনার। সেই আমাদের মফস্বলি  ছোটবেলায়  মামাদের একটা নাটকের দল ছিল। ডাকসাইটে গ্রুপ থিয়েটারের সেই সময়ে,  আমরা মানে ছোটরা ছিলাম,  সাইড লাইনের বাইরে  বসে থাকা পার্টি। সেদিনের সেই সাইডলাইনের মেয়েটা নাটক দেখতে-দেখতে, কবিতা পড়তে - পড়তে  ,   কখন যে ধেড়ে হয়ে গেল, ক' জনের আর তা মনে আছে।....আর,তারপর, একদিন,  পার্ক সার্কাসের ঘরে  আপনারই আশ্চর্য প্রশ্ন, 
"থিয়েটার করবে তো ?"....

  না,  বলবার ধৃষ্টতা নেই।  হাঁ, বলবার স্থিরতা নেই। 
চূড়ান্ত দ্বিধা নিয়ে ঘাড় কাত করেছিলাম মাত্র।  বাকীটা আমার জীবন রসদ। আপনার ধারে কাছে যাঁরা গেছেন, হয়তো তাঁদের সবারই। .. রোজ, রিহার্সাল হতো আমাদের । রবিবার কেবল ছুটি। প্রতিবছর, ২২ আগস্ট, শ্রী শম্ভু মিত্রের জন্ম দিনে  নতুন নাটক। তার আগে জোড়দার তালিম।....তার আগে, আবৃত্তির ক্লাস।  গানের সরগম। আর, আগে পরে,  আপনাকে দেখা, কেবল আপনাকে।   মঞ্চে,  মহড়ায়,...  "নাথবতী অনাথবত্ "... "পুতুলখেলা ".... রোজ রোজ.... বড় কাছ থেকে.... বড় পাশে থেকে।  মোহিত হয়ে শিখেছি,.... গোগ্রাসে মুঠি ভরে তুলেছি সম্পদ।....... 
সাঁত্রের  " রাজনৈতিক হত্যা?" র  পরপরই অরওয়েলের  "পশুখামার "..... গোটা বাংলা জুড়ে আমরা ছুটেছি...শো এর পর শো.... অনেকগুলো দৃশ্য, আপনার সঙ্গে তখন মঞ্চে।  বুঝিয়েছেন। শিখিয়েছেন। রোজ। 

নিরঞ্জন সদনে আমাদের ফাইনাল রিহার্সাল।  শেষ হতে হতে,রাত দশটা।  বাড়ি ফিরবো কি করে!  বারাসাত ফেরা তখন, বেশ চিন্তার। আমরা তিনজন, যারা দূরেদূরের, তাদের আপনিই নিয়ে গেলেন, আপনার বাড়িতে। সে আমাদের তীর্থ দর্শন। দোতলার যে ঘরটায়  আমরা থাকবো.. ..ঠিক তার পাশের ঘরের দরজা খুলে দিয়েেছিলেন। আলতো ধুপের গন্ধ। টানটান বিছানা। বই বই আর  বই।  সেই ঘরটিতেই একসময় থাকতেন স্বয়ং শ্রী শম্ভু মিত্র। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছিল,সেদিন। গড় হয়ে প্রণাম করেছিলাম আমরা। 

তারপর, আপনার মুখে শোনা কত রাত্তির অব্দি কত গল্প। জীবনের,  নাটকের, মঞ্চের...  হয়ে ওঠার, রেখে দেবার, ভুলে  যাবার,... কত কত না মণিরত্ন। 
কেবল, একটা রাত্তির না।  শোয়ের বিরতিতে, গোল হয়ে বসে শুনেছি, কত  কত কথকতা। 
তখন, মোবাইল ফোনের দাপট  আসেনি। পটপট ছবি তোলবার নেশাটাও ছিল না।কেবল বুঁদ হয়ে থাকা। শোনার আনন্দে। জানার মাদকতায়। স্বভাব সংকুচিত আমি,  একটু যেন চুপটি করেই থাকতাম। অথচ,  আপনিই, টেনেটুনে ঠিক পৌঁছে দিতেন কাঙ্খিত লখ্যে। 
অকুন্ঠ স্নেহ পেয়েছি।ছোটখাট অজস্র ঘটনা তার নমুনা। 
ইতিহাসের পাতায় তখন সময়ের বাঁক! পথে নামলেন আপনি। সিঙ্গুরের জমি লড়াই। গণসই জোগাড়ের হিড়িক।  রাজনীতি থেকে দূরে থাকা আমি।  অবাক চোখে দেখেছি, সে ঢেউ। অভিনয় কৌশলের বাইরেও বাঁকা জল বেড়েছে চারপাশে। সই করতে  মন চায় নি। করি নি। তেছরা চোখের তাড়া ছিল না দলে, এমন তো নয়। আর,  আশ্চর্য এই যে,  আমার মতো অর্বাচীনের মানস-অবস্থান টিকে কি গভীর আশ্বাসে আগলে রেখেছেন, আপনি। চাপিয়ে দেন নি, স্বমত। 
থার্ড বেলের সতর্কতা, কার্টেন কল এর বিধুর আওয়াজ... সংলাপের আবেগ  ভেঙেছে...গড়েছে... প্রতি দিন ....আর, আপনি  বাড়তে দিয়েছেন যাবতীয় চারাগাছের ইচ্ছেগুলোকে। কিন্তু,অনায়াস দূরত্বে  সাজিয়ে রেখেছেন নিজস্ব  যাপনটুকু।  
বিতর্কের বুূদবুদ সেখানে তুচ্ছ।

রাজনৈতিক ডামাডোলের ঘেরাটোপে কখনও কোনও সুবিধার জন্য, কাছাকাছি যাই নি। আপনিও ডাকেন নি। কেবল, আকাডেমির উঠোনে  হঠাৎ দেখা হলে, থিয়েটার যে কেন আমি  করি না আর, তার মৃদু অনুযোগটুকু ঠিক কানে কানে বলেছেন!.... আমি কিছুতেই কখনও বলে উঠতে পারি নি আপনাকে, 
  নটবলয়ের শিক্ষনীয় উপাদান....  কতটা  করায়ত্ত হয়েছে আামার,  জানি না, কিন্তু, এক জীবন্ত জীবনদর্শনের সামনে দাঁড়িয়ে  মুহূর্তে মুহূর্তে আত্মস্মাত্ করেছি অনায়াস জীবনস্পৃহা...সেখানে, গাঁথা আছে আত্মাভিমান আর  নির্লিপ্তির বিমিশ্র আদল। তাই, আজ... আপনার     "ইচ্ছে পত্রে" র প্রসঙ্গে চমক লাগে না। এমনই তো, হওয়ার ছিল। কেবল, মাঘ নিশিথের  রাতে অরব  অন্ধকারের দিকে চেয়ে... আপনারই শেখানো উচ্চারণ.... মনে মনে আরও একবার বলি.... আরও একবার প্রণত হই আমার নট-আচার্যের পাদমূলে...

" জীবনের কোন-একটি ফলবান খন্ডকে / যদি জয় করে থাকি পরম দুঃখে / তবে দিয়ো তোমার মাটির ফোঁটার একটি তিলক কপালে।/সে চিহ্ন যাবে মিলিয়ে / যে রাত্রে সকল চিহ্ন পরম অচিনের মধ্যে যায় মিশে /... হে উদাসীন পৃথিবী, / আমাকে সম্পূর্ণ ভোলবার আগে / তোমার নির্মম পদপ্রান্তে / আজ রেখে যাই আমার প্রণতি। '..

পৌলমী ভট্টাচার্য 
এফ.এম. উপস্থাপক
আকাশবাণী কোলকাতা

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments