জ্বলদর্চি

পথে যেতে যেতে- ২ /রোশেনারা খান

পথে যেতে যেতে- ২

রোশেনারা খান


আমাদের গ্রামের নাম 'মঙ্গলাপোতা'। এই নামের পেছনে দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। সে ইতিহাস সময়ে জানাব। আমার প্রাথমিক পড়াশোনা গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে। নাম ছিল মঙ্গলাপোতা প্রাথমিক বিদ্যালয়। জঙ্গলের কোলে আমাদের বিদ্যালয় বা স্কুলের প্রাকৃতিক পরিবেশটি খুবই মনোরম ছিল। স্কুল বলতে খড়ের ছাউনি দেওয়া লম্বা  একখানা মাটির চালাঘর। দুখানা চেয়ার, দুখানা টেবিল, দুটি ব্ল্যাকবোর্ড, এই ছিল আমাদের স্কুলের আসবাব। স্কুলঘরের মেঝে চার ভাগে ভাগ করে প্রথম শ্রেণি থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত ছাত্রছাত্রীরা আসন পেতে বসতাম।  স্কুলের চারপাশে বট, অশ্বত্থ, বকুল, পাকুড় বেল, আম ইত্যাদি বড় বড় গাছের সঙ্গে টগর, কল্কে, জবা, মাধবীলতা ইত্যাদি ফুলের গাছও ছিল। আসলে এখানে একটি কালীমন্দির ছিল। মন্দিরের পূজারীর বাড়ি ছিল পাশের তাঁতি পাড়ায়। একদিন রাতে পূজারীর বাড়িতে ডাকাত পড়ে। বাড়ির লোকেদের মারধোর করে, মহিলাদের গা থেকে গহনা কেড়ে নেয়। এরপর পূজারীর পরিবারের এখানে থাকা নিরাপদ মনে হয়না। তারা গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়ার উদ্যোগ নেন। তখন মঙ্গলাপোতার রাজা শ্রী রাঘবেন্দ্র সিংহদেব তাঁর পাড়ায় বসবাসের জন্য পূজারীকে কিছু জমি দান করেলে, তাঁরা বাড়ি তৈরি করে  সেখানেই তিনি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। এখানের মন্দিরটি ধিরে ধিরে ভেঙ্গে মাটিতেই মিশে যায় । তবে ওই কালী মন্দিরের কারণে এই জায়গাটির নাম ‘কালীমাড়া’ই থেকে গেছে। অনেকে স্কুলটিকেও কালীমাড়া স্কুলও বলত।

              বর্ষাকালে জঙ্গলের ঝর্ণার জল যে নালা দিয়ে গড়িয়ে এসে গ্রামের উত্তর প্রান্তে শিলাবতী নদীতে মেশে, সেটাই ছিল আমাদের স্কুল যাওয়ার রাস্তা। বর্ষার সময় খালি পায়ে বইস্লেট কোমরে নিয়ে স্কুলে যেতে বেশ মজা পেতাম। প্রকৃতিকে এত কাছ থেকে দেখা ও চেনা সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার। স্কুলে যাওয়ার পথে কতরকম পাখি, প্রজাপতি, ফড়িং, কাঠবিড়ালী, নেউল, ভেলভেট পোকা, কাঁচপোকা এমনকি সাপেরও দেখা পেতাম। সবচেয়ে সুন্দর ছিল ভেলভেট পোকা।  বর্ষা কালেই এদের দেখা মিলত। ভেজা মাটির ওপর এরা অনেকটা জায়গাজুড়ে ঝাঁক বেঁধে বিছানো থাকত। এত সুন্দর রং যে দূর থেকে দেখে মনে হত যেন লাল ভেলভেটের আসন পাতা আছে।  কাঁচপোকাও দেখতে খুব সুন্দর। এই পোকা দিয়ে চরকি বানাতাম।  কাঁচপোকার সবুজ ঝকমকে ডানা থেকে অনেকে টিপ বানিয়ে পরত।  জঙ্গলে বড় মোটা মোটা কেঁচো, কেন্নোও দেখা যেত। ভয় না পেলেও ঘেন্না করত। আমাদের স্কুলে ঘণ্টাও ছিলনা, তাই ঘণ্টা বাজানোর লোকও ছিলনা। আমরা গাছের তলায় বসে খেলতাম আর মাঝে মাঝে পাখিদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কিচির মিচির লাগিয়ে দিতাম। তারপর কেউ না কেউ দেখতে পেতাম জঙ্গলের রাস্তা দিয়ে সাইকেলে চড়ে নতুন মাস্টারমশাই বা হেড মাস্টারমশাই আসছেন, অমনি আমরা দৌড়ে এসে যে যার আসনে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা শুরু করে দিতাম।  আমাদের স্কুলে এই দুজনই মাস্টারমশাই ছিলেন। স্কুলের কোনো বড় ছেলে তাঁতিপাড়া থেকে বালতিতে করে জল এনে রাখত, মাস্টারমশাইদের পা ধোয়ার জন্য। বছরের বছর ফেল করা কয়েকজন ছাত্র ছিল। তারাই স্কুলঘর ঝাঁট দিত, জল নিয়ে আসত, এমন কি পড়া না পারলে মার খাওয়ার জন্য তাদেরই ছড়ি ভেঙ্গে আনতে হত। রাজাদের পরিবারের ‘কালোসোনা’ নামে এক বিধবা মহিলার অনুদানে আমরা তাকে ‘কালোপিসি’ বলতাম। সরস্বতী পুজোর দিন কালোপিসি  স্কুলে আসতেন এবং পুজোর তদারকি করতেন। প্রতিমা সাজাতেন, নিজেহাতে আমাদের লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়ে প্রসাদ বিলি করতেন,  ভাসানের দিনেও আসতেন। দই-চিঁড়ে মেখে শালপাতায় করে আমাদের খেতে দিতেন।
              রোজ সকালে জানলার ধারে বসে বাবার কাছে পড়তাম। বাড়িতে পড়ে অনেকটা পড়ায় এগিয়ে গেছলাম। তাই বাবা আমাকে একেবারে দ্বিতীয় শ্রেণীতে ভর্তি করে দিয়েছিলেন। পরে বৃত্তি পরীক্ষার ফর্মফিলাপের সময় দেখা গেল পরীক্ষা দেওয়ার যে বয়স, আমার তা হচ্ছেনা। হেড মাস্টারমশাই বাবাকে ডেকে নিয়ে আসতে বললেন। বাড়ি গিয়ে বাবাকে ডেকে নিয়ে এলে, পরীক্ষা দিতে পারবনা শুনে, মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে পরামর্শ করে আমার বয়স ২৫/১১/১৯৫৭ থেকে বাড়িয়ে ২০/০৪/১৯৫৭ করা হল। এটাই আমার প্রমাণিত জন্ম তারিখ।
            ৬ এর দশকে যখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি, তখন নিরুবাবু  খুন হয়ে গেলেন। উনি আমার বন্ধুর কাকা ছিলেন। তখন কিন্তু গ্রাম- গঞ্জে খুন-খারাপি খুবই কম হত। রাজনৈতিক খুন হতনা বললেই হয়। তিন ভাইয়ের মধ্যে নিরুবাবু ছোটো ছিলেন।  গ্রামে তখনও মানুষ থানাপুলিশ না করে রাজার কাছে নালিশ জানাতেন। গ্রাম্য শালিসি সভাতেও অভিযোগের মীমাংসা হত।  নিরুবাবু মাতব্বর গোছের লোক ছিলেন। রাজা না হলেও বিভিন্ন  গ্রামে শালিসিতে যেতেন। এই কারনে তাঁর অনেক শত্রুও তৈরি হয়েছিল। বাড়িতে দুজন স্ত্রী থাকা স্বত্বেও পরনারীতে প্রবল আসক্তি ছিল। নদীর ওপারের গ্রামে এক বিধবা মহিলাকে রক্ষিতা হিসেবে রেখেছিলেন। প্রায়দিন রাতে তার ঘরে রাত কাটাতেন। গ্রাম্য ভাষায় সেই মহিলাকে আড়ালে নিরুবাবুর ‘নাড়’ বলা হত। একদিন সন্ধ্যায়  একটি লোক ওনাকে খড়কুশমা বাজার থেকে ডেকে নিয়ে যায়।  কয়েকদিন পর জঙ্গলে সিগারেটের প্যাকট, সাদা লুঙ্গি পরতেন, সেই লুঙ্গির টুকরো পাওয়া যেতে বাড়িতে কান্নার রোল উঠল। এই ক’দিন কেউ কিছু জানতে পারেনি, আজ প্রচুর লোক জড় হয়েছে। আমিও গিয়ে দেখলাম ওনার প্রথমা স্ত্রী ভাশুরের ছেলেদের বলছেন, ওরে দেখনা হাত-পা ভেঙ্গে জঙ্গলে ফেলে গেছে নাকি। সব জায়গা খুঁজে শেষে হাত-পা ও মুণ্ডু বিহীন ধড়টুকু পাওয়া গেছল। ময়না তদন্তের পর ওটাই দাহ করা  হয়েছিল। এর মাসছয় পরে নদীর বালি থেকে পচা বস্তার মধ্যে হাত-পায়ের হাড় পাওয়া যায়। সেগুলকে ভাল বস্তায় ভরে বাঁকে ঝুলিয়ে আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে যখন নিয়ে যাচ্ছিল, অনেকের সঙ্গে আমিও গেছলাম। বস্তাদুটি একটি মাঠে ঢালা হতে দেখলাম একটা হাতের কঙ্কালের বাহুতে বেশ বড় সোনার তাগা বাঁধা আছে। মিনের কাজ করা তাগা্য় ‘ওঁ’ লেখা রয়েছে। সে রাতে ভয়ের চোটে ঘুমতে পারিনি। ওনার প্রথম স্ত্রী দুই ছেলে মেয়ে নিয়ে দাদাদের কাছে চলে গেছলেন। দ্বিতীয় স্ত্রীর একছেলে ও পাঁচ মেয়েকে নিয়ে খুব দুর্দশার মধ্যে পড়েন।
(ক্রমশ) 

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

1 Comments

  1. পরবর্তী কিস্তির অপেক্ষায় রইলাম।

    ReplyDelete