জ্বলদর্চি

পদ্মপাতায় শিমুল-৫/সীমা ব্যানার্জ্জী-রায়

পদ্মপাতায় শিমুল-৫

সীমা ব্যানার্জ্জী-রায়

জীবনের 'ক' ঘন্টা

জামালপুর, বিহার

এটা কিন্তু আত্মজীবনী নয়। তবে আত্মজীবনীর মতো করে লেখা অসংলগ্ন কিছু প্রলাপ। উপন্যাস হয়েছে কিনা জানি না, তবে বাস্তব কিছু থাকতে পারে।

প্রথমেই বলেছিলাম, ভাগ্যক্রমে আমি এক পরিযায়ী পাখী। বিহার, মেদিনীপুর, মধ্যপ্রদেশ, বর্ধমান, মহারাষ্ট্র, পশ্চিমবঙ্গ, এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লুইজিয়ানায় একটু একটু করে বেড়ে উঠলাম। অদ্ভুত তাই না? দাই, মাসী, বাই, ন্যানী শুনতে শুনতেই কখন বড় হয়ে উঠলাম। আমার খুব ভালো লাগে যখন যেখানে থেকেছি-সেখানকার সম্বন্ধে জানতে চেষ্টা করেছি।

আমার জন্ম বিহারের মুঙ্গের জেলার জামালপুর শহরে। এই জামালপুর নামের অর্থ কি বলতো? অর্থ হল 'সুন্দর শহর'। এখানেই ১৯৫৫ সালে প্রতিষ্ঠিত “আনন্দ মার্গ” মুভমেন্ট এর কর্তা প্রভাত রঞ্জন সরকারের জন্ম হয়। বিহারের বিখ্যাত হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার জে এন ঘোষদস্তিদার যিনি মারা যান ১৯৮০ সালে। এই ডাক্তার কাকাই আমাদের সময় অসময়ের পারিবারিক বন্ধু ছিলেন। আমি বিশ্বাস করি, “সম্পর্ক রক্তের বাঁধনে তৈরী হয় না, অনুভূতির বাঁধনে শক্ত পোক্ত ভাবে তৈরী হয়”। ছোটবেলায় জানতাম উনি আমাদের নিজেদের কাকা। পরে সব গল্প করব। প্রভাত রঞ্জন সরকার যখন 'আনন্দমার্গী” হন নি, তখন জামালপুরের রেলের চাকরীতে ঢুকিয়ে দেবার জন্য বাবার কাছে এসেছিলেন। বাবা ওনার অনুরোধ রেখেছিলেন। এই রেলওয়ের লোকোমোটিভ ওয়ার্কশপ ভারতের মধ্যে প্রথম রেলওয়ে ওয়ার্কশপ। ফেব্রুয়ারী ৮, ১৮৬২ সালে এই ওয়ার্কশপ স্থাপিত হয়।

--“আনন্দমার্গী”- সম্বন্ধে কিছু জানলে বলো না? নাম শুনেছিলাম ওনার। কিন্তু জানার আর সময় হয় নি তখন। আজ বললে বলে মনে পড়ল।

--শোনো তাহলে। ১৯৮২ সালে কলকাতার বালিগঞ্জের কাছে বিজন সেতু হত্যাকাণ্ডের নাম শুনেছিলে নিশ্চয়। আমরা তখন ম্যান্ডেভিলি গার্ডেন্সে ছিলাম। আনন্দবাজার পত্রিকায় দেখেছিলাম ষোল জন সন্ন্যাসী আর একজন নান কে গণহত্যা করা হয়েছিল। ওনাকে অনেকে 'সেন্ট টেরোরিস্ট' বলে। ওনার চরিত্র কেন যে হঠাৎ খারাপের দিকে গেছিল, জানি না সেসব।

--কেন গণহত্যা করা হয়েছিল, জানো? তুমি কিছু জানো নাকি ওনার চরিত্র সম্বন্ধে। জেনে থাকবে হয়ত দিদিয়া বা সেজদাদের কাছ থেকে।

--কিছু কিছু শুনেছিলাম। ওসব বলা যায় নাকি? না বাব্বাঃ বলতে লজ্জা লাগছে। গল্প শুনেছিলাম ছোদ্দিভাই-এর কাছে যে, উনি নাকি খুব হ্যান্ডসাম ছিলেন। ছোদ্দিভাই—এর এক বান্ধবী মিতালিদি ওনাকে দেখবার জন্য আর দীক্ষা নেবার জন্য বাড়ির অন্যান্যদের সাথে ওনার আশ্রমে গেছিলেন। তখন তো ওনার খুব নামডাক। তারপর? হাসি আসছে বড্ড। দূর এসব কী আর মুখে বলা যায় নাকি? আমি তো পারি না। কিছু মনে কোরো না।

 --না না ন্ন বলো বলো, প্লিজ! পলাশ উদবিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করল।

আচ্ছা বলছি, মিতালিদি ভেতরে যাবে কি করে ভাবছে। ওখানে গিয়ে দেখে একটা ঘর ধোঁয়াশা। সব কিছু আবছা।

সেখানে মিতালিদিদি ঢুকে দেখেছিল যে, উনি নাঙ্গাবাবা হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। মিতালিদিদি তো ঢুকে 'বাবা গো' বলে এক লাফে বাইরে...হি হিহি...যা তা। সবাই কি আর মহারাজ হতে পারে নাকি? দু তিন বছর আগে কম্পিউটার থেকে আনন্দবাজার পত্রিকায় পড়ছিলাম, এইরকম ভারতের নানা শহর থেকে বহু ভণ্ড সাধুদের ধরছে আর জেলে পুরে দিচ্ছে।

--এ বাব্বাঃ তাই নাকি? আমি অতশত জানি না। আমি তো পড়াশুনা শেষেই এদেশে এসে গেছি। আর আমি ওসব বিশ্বাসও করি না আদতে। ঠাকুর দেবতাও বিশ্বাস করতাম না আগে। এখন তোমার পাল্লায় পড়ে...

--আচ্ছা হয়েছে। আমাদের দেশ জানব না বুঝি কিছু? হাজার হোক, আমাদের জন্মভূমি, তাই না? শোনো এবার। আগেই তো বললাম, আমার খুব ভালো লাগে এসব জানতে।

ছোট্ট শহর এই 'জামাল(সুন্দর)পুর(শহর)।' চারিদিক সবুজ গাছে ভরা পাহাড় দিয়ে ঘেরা সেই শহর। গাছপালা দিয়ে সাজানো গোছানো পাহাড় যেমন দেখেছি আবার তেমনি খটখটে দাঁড়িয়ে আছে ক্যাকটাসের জামা পরা পাহাড়ও দেখলাম তোমার সাথে গিয়ে এ্যরাইজোনা, ফিনিক্স-এ। কত তফাৎ দুটোর মধ্যে। এই জন্যেই হয়ত পাহাড় আমার এত কাছের। জামালপুরের পাহাড়ের উপর এখনও আছে বিখ্যাত ডাকাতে কালী মন্দির। ঐ জন্যেই নাম কালীপাহাড়। তাই পাহাড়টাকে “কালী পাহাড়” নামে এক ডাকে চেনে সবাই। তার কোল বেয়ে বয়ে চলেছে গঙ্গা নদীর একটা অংশ। সেখানে মানুষ আর প্রকৃতির যেন লীলাখেলা চলে। মাঝখানে এই ছোট্ট শহরটি খুব ছিমছাম। এখন অবশ্য জানি না অনেক বদলে গেছে বোধহয় ঠিক আমার মতন।

বাবা শ্রীযুক্ত শ্রীপ্রাণগোপাল বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন ইস্টার্ন রেলওয়ের এ্যাকাউন্ট অফিসার। শুধু জামালপুরে না। বাবার কথা না বললে যেন আমার এই লেখার অনেক কিছু বাদ পড়ে যাবে। আমার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বাবাই ছিল আমার শরীরের মূল্যবান একটা অংশের মত। তাই বাবাকে নিয়েই শুরু করি।

ভারতের সমস্ত ইস্টার্ণ রেলওয়ের অফিসগুলোতে বাবাকে সবাই এক নামে চিনত। কারণ বাবা খুব পরোপকারী মানুষ ছিলেন। কারোর বিপদে আপদে তিনি সব সময় ঝাঁপিয়ে পড়তেন। শুনেছি এক একদিন তিনি পাঁচটা থেকে ছটা দাহ কাজ সম্পন্ন করতে যেতেন। একার রোজগারে, নিজের সংসার ছাড়াও বাবার মামাতো দাদার দুই ছেলেকে, নিজের তিন বিধবা বোনদের আর ভাগনা-ভাগনিদের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। ওনারাও তখন আমাদের বাড়িতেই থাকতেন। কোনরকম ভেদাভেদ রাখতেন না। তা ছাড়াও কন্যাদায়গ্রস্ত পিতাকে, পয়সার অভাবে কলেজে না ভর্তি হতে পারা ছাত্র এইরকম নানা সমাজসেবা মূলক কাজ করতেন বলে জামালপুরে খুব নাম ছিল বাবার।

বাবার ডাক নাম ছিল শিবু। ঠাকুমার কোন সন্তান না হওয়াতে শিব ঠাকুরের দোর ধরে তবে নাকি বাবার জন্ম হয়। বাবারা ছিলেন দুই ভাই আর তিন বোন। বাবাই সবার বড় ছিলেন। তাই বাবা খুব নিষ্ঠার সাথে সেই বড় ভাই-এর দায়িত্ব পালন করতেন । পিসিদের আর কাকাকে কোনদিন কোন কষ্ট বাবা পেতে দেন নি। আমার একমাত্র পিসতুতো দাদাও বাবার কাছে থেকে লেখাপড়া শিখে মানুষ হয়েছেন। আবার দুই বিধবা পিসিমাদের মেয়েদের বিয়ের ব্যবস্থা বাবাই করেন।
পিসতুতো দাদাকে 'রাঙাদা' বলে ডাকতাম। বাবার অমতে কেউ কোন কাজ করলে বাবা তাকে যতদূর সম্ভব শাস্তি দিতেন। রাঙাদা বাবাকে না জানিয়ে লুকিয়ে বৈদ্য বাড়ির মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন কালীঘাটে নিয়ে গিয়ে। বাবা জানতে পেরে রাঙাদাকে ত্যাজ্য পুত্র করেছিলেন, কারণ রাঙাদা তখনও নিজের পা-এ দাঁড়াননি। সেই সূত্রে বাবার এত রাগ। কিন্তু নিজের দায়িত্ব থেকে কোনদিন বিচ্যুত হন নি। তবে পরে ক্ষমাও করে দিয়েছিলেন। হয়ত সেই জন্যেই বাবা ঠাকুরের অকৃত্রিম আশীর্বাদ পেয়েছেন। বাবা বলতেন, “ক্ষমাই মানুষের পরম ধর্ম!”

বাবাও ঠাকুর, মা, স্বামীজির একনিষ্ঠ সাধক ছিলেন। বাবা ছিলেন ছয় ফুট এক ইঞ্চি লম্বা, মেদহীন। তাই নাকি সবাই বলতঃ “ওয়ান কাট ফিগার”। আর তেমনি ছিল তাঁর গলার আওয়াজ। একবার হাঁক দিলে এক মাইল দূরের লোক শুনতে পেত। কেমন একটা অদ্ভুত গুরুগম্ভীর স্বর ছিল, যা সাধারণত: শোনা যায় না, মানে আমি শুনি নি আজও। ভোরবেলায় বাবার সূর্যের দিকে তাকিয়ে সেই উদাত্ত কণ্ঠের মন্ত্র উচ্চারণ আজও কানে বাজে: “ওম্! জবাকুসুম শংকাশণ/ কাস্যপেয়ম মহাদ্যুতিম/ধান্তারিং সর্ব পাপঘ্নং/প্রণতহশ্মি দিবাকরম।”

--বুঝেছি, তাই তুমি সকালে ঘুম থেকে উঠেই জানলার পর্দা সরিয়ে দুই হাত জড়ো করে ওই মন্ত্র বলো? বাহ! খুব সুন্দর শিমুল। আজ জানতে পারলাম কেন ঘুম থেকে উঠে সূর্যস্তব করো। খুব ভালো লাগে শুনতে। তোমায় জিজ্ঞেস করব ভেবেছিলাম, যদি কিছু মনে করো তাই আর জিজ্ঞেস করা হয়ে ওঠে নি। আমি তো কিছুই জানি না। ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছিলাম। দাদুর বাড়িতে মানুষ। দাদুর খুব প্রিয়পাত্র ছিলাম।

--একদম ঠিক গো। শিমুল হাসি মুখে উত্তর দিল। বাবা যে আমার জীবনের একমাত্র হিরো। আবার অন্যদিকে শিক্ষক ও।

আমি ছোটবেলায় খুব ভয় পেতাম। বাবা আমাকে শিব মন্ত্র জপ করাও শিখিয়েছিলেন। তাই আমি এখনও বাবার দেওয়া মন্ত্র জপ করে রাত্রে শুই। সে এক মজার ঘটনা। আমি তখন বেশ ছোট। মেজদা মেজবৌদিকে তার বাপের বাড়ি রাখতে গেছে খড়গপুরে প্রথম ভাইপো হবে তাই। এদিকে রাতের বেলা আমি যথাযথই ভয়ে একেবারে কাবু। বাবা পালংকে ঘুমাতেন আর আমি পাশেই খাটিয়াতে শুতাম। হলে কি হবে একটু রাত হলেই 'বাবা' ও 'বাবা' করে কেঁপেটেপে কেঁদে উঠতাম। বাবা রেগে গিয়ে বলতেন, “উফফ! ভারী মুশকিল তো ! এ মেয়েকে নিয়ে আমার হয়েছে জ্বালা”- বলে বাবা মশারী থেকে বেড়িয়ে আমার মশারী খুলে দিতেন। বলতেন, “তোমার পড়াশুনা হবে না। শুধু শুধু এখানে পড়ে আছি এই বুড়ো বয়সে। নাও ওঠো! জপ করো তাহলে আর ভয় লাগবে না।” তখন অবশ্য আমি চোদ্দ বছরের মেয়ে। তার মানে বোঝো বাবাই আমার প্রথম মন্ত্রগুরু। বাবা শিব মন্ত্র শিখিয়ে দিয়েই আমাকে সব কুচিন্তা করা থেকে বাঁচবার পথ দেখিয়ে দিয়েছিলেন। তাই হয়ত কোনদিন খারাপ চিন্তা আমার মনে আসে নি। আবার একদিকে বাবা বোধহয় বুঝতেই পেরেছিলেন একদিন আমার দীক্ষা হবে তাই জপ কি করে করতে হয়, 'হাতের কর' কি ভাবে গুণতে হয়, শিখিয়ে দিয়েছিলেন। এটা অবশ্যই আমার মানসিক প্রেরণা।
(চলবে)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments