জ্বলদর্চি

পদ্মপাতায় শিমুল-৬ /সীমা ব্যানার্জ্জী-রায়

পদ্মপাতায় শিমুল-৬

সীমা ব্যানার্জ্জী-রায়

জামালপুরের ভিক্টোরিয়া রোডের সাহেব পাড়ায় আমরা থাকতাম তখন। ছয়খানা ছোট-বড় ঘর নিয়ে এক বিশাল বাড়ি। সামনে পেছনে একহারা বারান্দা। পেছনে আউট হাউস। বাবা শখ করে একটা গরুও রেখেছিলেন, যাতে ছেলেমেয়েরা খাঁটি গরুর দুধ খেতে পায়। বাংলোর লোহার গেট দিয়ে ঢুকলেই দুপাশে ছিল নানান জাতের লিলি ফুলের গাছ। বাবার খুউব বাগানের শখ ছিল। আর লিলি ফুল ছিল খুব প্রিয়। রেলের বলে লাল রঙের কোয়ার্টার ছিল। বাগানের শখটা আমি পেয়েছি উত্তরাধিকার সূত্রে, দাদা দিদিদের কাছ থেকে তাই তো শুনে আসছি। হাসিমুখে বলল শিমুল।

--এটা কিন্তু সত্যি। বিয়ের পর কি সুন্দর ভাবে সব কাজ একা সামলাতে। একাই অবিন্যস্ত এক বাড়ি গুছিয়ে ফেললে। তোমার সেজবৌদি এসে বলেছিল, “ তুই কি করে একা এই বাড়ি গোছালি? না না-যাঃ! বিশ্বাস হয় না কিন্তু।” আমার শুনে খারাপ লেগেছিল, তবে আমার সেরকম অভ্যাস নেই কোনদিন কাউকে কিছু মুখের ওপর বলা। আর বাগান তো ...থাক। আর বলব না। বলো শুনি, বলে চা-এর কাপ থেকে শিপ করল পলাশ। চা টা ভালোই করি কি বলো? তোমার নদাদাও বলেন একই কথা। “পলাশ! চা আর কফি দারুণ করো ভোরবেলা। সকালের শুরুটা হয়ে ওঠে অভিলাষমতো উপহার।” হাহা হা...

--তা করো! খুব ভালো চা করো যত্ন, ভালবাসা আর উদ্যম মিশিয়ে। বলি ঠাকুরের কথায়: “ মিছরির রুটি সিধে করেই খাও আর আড় করেই খাও মিষ্টি লাগবেই।” বলেই হাসি হাসি মুখ করল শিমুল।

--শিমুল!তুমি তো রামকৃষ্ণ মিশনের দীক্ষিতা, তাই না? পলাশ কথার মাঝে জিজ্ঞাসা করে বসল।

--হ্যাঁ! সে আরেক গল্প। বলব সব ধীরে ধীরে। কি সুন্দর ঠাকুরের উপমা দিয়ে বললে। ঠাকুরের কথামৃত পড়তে খুব ভালো লাগে। সব কিছুই তোমার জন্য সম্ভব হয়েছে। আমিও মাঝে মাঝে আজকাল পড়ি ঠাকুরের বই।

--তুমি যে আমার সেই মিছরির রুটি। জীবনের সমস্ত সংগ্রামের সর্বশেষ উদ্দেশ্য যে শান্তি, তুমি আমার সেই শান্তি। আমি তো মন খারাপ লাগলেই পড়ি ঠাকুরের কথামৃত, আর সারদা মা। তুমি তো জানো, নদাদা দেশ থেকে এনে দিয়েছে। এদেশে আসবার সময় তো কিছুই আনতে পারি নি। তারপরেই তো ম্যান্ডেভিলির সেই ফ্ল্যাট বিক্রি করে দিল দাদারা দেশে যাবার নানান অসুবিধার জন্য।

যাই হোক, আমাদের জামালপুরের বাড়ির গল্প করি। আমাদের বাংলোর পেছনদিকে নিজের হাতে বাবা লাগিয়েছিলেন বোম্বাই আম গাছ, সজনে গাছ, পেয়ারা গাছ, কাঁঠাল গাছ, নিম গাছ আর বেল গাছ আরো কিছু কিছু গাছ। বাবা বলতেন, নিমগাছ আর বেলগাছ বাড়ির বাতাস শুদ্ধ রাখে। অত বড় বাগান পরিচর্যার জন্যে একজন বিহারী মালী ছিল। তার আবার এক অদ্ভুত নাম, 'খোপড়ি'। বাবা রেলের ওয়ার্কশপে তাকে কাজে ঢুকিয়ে দেন তাই সে শনি রবিবার আমাদের বাগানের কাজ করত।

আমরা ছিলাম পাঁচ ভাই আর চার বোন। সব ভাইদের নামের পিছনে গোপাল রাখা হয়েছিল কেন জানো?

--কেন? সত্যি তো! এটা তো খেয়াল করি নি আগে। বলো বলো শুনি।

-- কারণ, বাবার নামের শেষে গোপাল ছিল। ব্যানার্জ্জী বাড়ী ছিল পাঁচুগোপালের দোর ধরা। বনেদী বাড়ি। এখনও বাবার মামার বাড়ি আছে মধ্যই শ্রীরামপুরের সমুদ্রগড়ে। ঠাম্মা ছিলেন জমিদার চ্যাটার্জ্জী বাড়ির একমাত্র প্রথম মেয়ে সন্তান। তারপর ওনার তিন ভাই হয়েছিল। তাই খুব আদুরে ছিলেন। কারণ ঠাম্মার আগে যারাই জন্মেছিলেন আঁতুড়েই মারা যেতেন, সেজন্য জন্মের পরেই পাঁচ বছরের ঠাম্মাকে কুলীন দেখে চব্বিশ বছরের ঠাকুরদার সাথে বাগদত্তা করে রাখেন ওনার মা বাবা। একেবারে রূপকথা বলতে পারো। ঠাম্মাকে নিয়েও লেখা যায়। হাসি হাসি মুখ করে বলে উঠল শিমুল। একটা দারুণ রম্যরচনা হয়ে যাবে। উনি যে কী ভীষণ একটা রম্যচরিত্রের জলজ্যান্ত উদাহরণ ছিলেন, শুনলে তুমি অবাক হয়ে যাবে। জানো তো, নিজের স্বামী বেঁচে থাকা সত্ত্বেও ঠাকুরদাদার ওপর রাগ হলে সধবার সাজ খুলে ফেলে বিধবার সাজে বাইরে বেড়িয়ে যেতেন আমার বড়দিকে কোলে নিয়ে। কেউ যদি জিজ্ঞেস করত “ও মাসীমা এ কী সাজ আপনার?”

“বুড়োকে ঘাটে শুইয়ে এসেছি”। -বলে হনহন করে এগিয়ে যেতেন। এদিকে বাড়িতে রান্নার উনুনে জল ঢেলে দিয়ে বড়দিকে কোলে নিয়ে পাড়া বেড়াতে চলে যেতেন। কি কান্ড। হা হা হিহি করে দুজনেই হেসে উঠল।

--সে কি? ঐটুকু বয়সে বিয়ে? পুলিশ ধরে নি? হ্যাঁ জানি। আগে এরকমটাই হত...আমার দিদিমারও ওইরকম বিয়ে। হো হো করে হেসে বলে উঠল পলাশ। একটা মেয়ে নিজেকেই চিনল না তার আবার বিয়ে। কি সব কান্ড বলোতো?

তখনকার দিনে মেয়েরা খালি পুরুষের হাতের পুতুল সে ভাবনাকে তিনি মোটেই ধর্তব্যের মধ্যে আনতেন না। যদিও তিনি খুব তেজি এবং দাম্ভিক ছিলেন। মা কিন্তু কোনদিন নাকি সেসব কথা আলোচনা করেন নি কারুর সাথে। মা-এর স্বভাবই ওইরকম ছিল। আমাদের রাঙা পিসিমা দাদা দিদিদের কাছে ঠাকুমার সব গল্প বলেছিলেন।

এদিকে বাবা জন্মসূত্রে কিছু জমিজমা পেয়েছিলেন। সেখান থেকে জমির ধান, শাক -সবজি, ভুট্টার আর যা চাষ করা হত, সেগুলো বিক্রি হলে তার থেকেও পয়সা আসত। এইসব দেখাশুনা করতেন বাবার মামাতো ভাইরা। তাঁরা থাকেন এখনও ফুলিয়ায়। এই মামাতো ভাইদের বড় ও মেজ ছেলেদের ও বাবা নিজের কাছে রেখে রেলের চাকরিতে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। বোঝো বাবার কত আত্মদান ছিল।

পরে অবশ্য সেই সব জমি জায়গা মামাদাদুর সেজ আর নছেলে হস্তগত করেছিলেন। দাদারা কিছুই পায় নি সেসব। দাদারা বড় হয়ে জমি জায়গার সেখানে গেলে মামাদাদুর ছেলেরা বলেন, “ ওখানে গেলে কিন্তু জ্যান্ত ফিরে আসতে পারবি না। খালি জায়গা পেয়ে সব নক্সালরা বাসা বেঁধে আছে। কাজেই ভালোয় ভালোয় ওসব জায়গায় যাস না।” তখন নক্সালদের যুগ। তাই দাদারা আর সেখানে যায় নি। মামাদাদু নিজে যা দিয়েছিলেন তাই নিয়ে চলে আসে তারা। তারপর তো সবাই এখন এদেশে মানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বাস করছে।

আমাদের বাড়িতে থাকত এক ভিখিরি। সেই ভিখিরি ছিল অন্ধ। বাড়ির সবাই তাকে 'বুঢঢা' বলে ডাকত। ঐ বুঢঢাকে বাড়ির বারান্দায় এনে রেখেছিল আমার বড়দা। সে গল্প না হয় পরে বলছি। বাবাকে আবার সব ভাইবোনেরা খুউব ভয় পেত। কারণ বাবা ছিলেন অত্যন্ত রাশভারী কিন্তু দারুণ আমুদে মানুষ। মন ভালো থাকলে আদর করে বাড়িতে সবার সঙ্গে তখন বাঙাল ভাষা বলতেন। “আইস্ক্রিমবালা আসলে দাদা দিদিদের বলতেন, “আইস্ক্রিম খাবা না? নাআআগ হইছে?"

--বাঙাল ভাষা? সে কি? ঐ জন্য বোনেদের মধ্যে খালি তোমার বাঙাল বাড়িতে বিয়ে হয়েছে। তুমি বাবার আদুরী ছিলে তো, তাই।

--বাবা নিজের বিয়ের আগে তো রংপুরে একটা ট্রেনিং নিতে গেছিলেন। আর ওখানেই স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, যাঁকে 'রয়াল বেঙ্গল টাইগার' বলা হয়, ওনার বাড়িতেই বাবা এবং বাবার তিন বন্ধু থাকতেন। সময় পেলে বাবা আর তিন বন্ধু মিলে ওনার গোঁফে 'তা' দিতেন। জানি অনেকে হয়ত বিশ্বাস করবে না। কিন্তু মিথ্যে বলে কি আমি লাভবান হব? এসবই আমার দিদিয়ার মুখে শোনা। মনের মধ্যে এই সমস্ত ভাবগুলি হাতছানি দিয়ে যায় আমাদের! আমাদের মনের পাল্লাগুলো এক এক করে খুলে যায়। অজান্তে যখন শরীরের গ্রন্থি থেকে কোন রসক্ষরণ হয় তা কিন্তু আমরা টের পাই না। একেক ঘটনাকে অজান্তে আক্রমণ করে বসে। আর তাতে মিশে থাকে ব্যঞ্জনার প্রকাশ।

বাবা রেগে গেলে অবশ্য ইংরাজিতেই বকতেন সবাইকে। আর একেবারে লাল হয়ে যেতেন। খুব ফর্সা ছিলেন বাবা। বড়দি, বড়দা, আর মেজদা পেয়েছিলেন সেই রঙ।

--তুমি দেখেছো বাবার রাগ? পলাশ একটু মজা করে বলল।

--হ্যাঁ, গো। তবে আমাকে বকতেন না। ছোট ভাইকে বকতে দেখেছিলাম। আমি আর আমার ছোট ভাই ছিলাম ঠিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুগগা আর অপু। ঝাড়গ্রামের সবাই তাই বলত । ভাইকে বকলে আমিও কাঁদতাম।

বাবা অবাক হয়ে বলতেন, “তুমি কাঁদছ কেন? তোমাকে তো বকি নি। চোখ মোছো। বাবা আমার চোখের জল দেখতে পারতেন না।”

শুনেছি জামালপুরে থাকতে বাবা বাড়ি থেকে কাজে বের হলেই দাদারা নাকি দুষ্টুমিতে দাপাদাপি শুরু করে দিত আর ছোড়দিকে করত ম্যাসেঞ্জার গার্ল। তখন ওই বুঢঢা হত লোকাল গার্জেন।' বাবা বেরুলেই দাদাদের দুষ্টুমি দেখে সে শুরু করে দিত “এ খোঁকাবাবুরা! বামআন গেইলা ঘঅর /তো লাংগল তুইলা ধঅর।” একেই বলে প্রভুভক্তি।

আমরা তখন একেবারে খুদে ছিলাম। বাবার অফিসের বড়কর্তা ভাল্লাসাহেব অফিস থেকে রিটায়ার্ডমেন্ট নিয়ে অন্য শহরে চলে যাবার সময় একটা ছোট্ট স্প্যানিয়াল কুকুর দিয়ে যান সেজদাদাকে। তার নাম ছিল ‘টমি’। এই টমি ছিল আবার আমার বয়সী। টমি যখন আমাদের বাড়িতে এল, আমি তখন মোটে ছয় মাসের। ছিলাম সবার ছোট বোন। তাই সব চেয়ে আদরের, আহ্লাদী। শুধু বাবা মায়ের না, ভাইবোনদের কাছেও ছিলাম। সবাই যে যার পছন্দ মত নামে ডাকত আমাকে। এখনও ডাকে অবশ্য। ডাক্তারকাকা ডাকতেন বাতাসী, বড় জামাইবাবু সুন্দরী, সেজদা ডুং, নদা ডাকত পেখম(নেচে বেড়াতাম সব সময়), ঝাঙরি (ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া কোঁচকানো চুলের জন্য ওই নাম), অজিতদা বুড়ি, ছোট জামাইবাবু শিমুল, সিমটি’ জিপসি, এরকম আরও কত নাম।

--'জিপসি'? অদ্ভুত নাম তো? বাঙালির এই নাম শুনি নি কোনদিন।

--তুমি শুনবে কি ভাবে? তুমি তো আর বিহারে থাকো নি। 'জিপসি' এই  নাম-এর পিছনে নাকি একটা গল্প রয়েছে। বিহারে হালকা বৃষ্টিকে বলে 'জিপসি'। আমি যেদিন জন্মেছিলাম সে দিন সারা ক্ষণ ধরেই ঝিরঝির বৃষ্টি হয়েছিল তাই ঐ নামে আমার খুড়তুতো অজিতদাদা ডাকতেন। ছোদ্দা ,ছোটভাই আর তাদের বৌ-এরা আমাকে এখনও 'ভাই' বলে ডাকে। আসলে ছোদ্দার ওপর একটা ভাই ছিল। সে মারা যায়। তারপরই আমার জন্ম। সব সময় ছোদ্দা সেই ভাইকে খুঁজত।

তারপরেই আমি জন্মালে, দিদিয়া ওকে বলেছিল, “এই তো তোর ভাই।” তাই আমাকে- 'ভাই' বলেই ডাকা শুরু করে। ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া কালো চুল ছিল বলে এক পিসতুতো দাদা আমাকে 'ঝাঙরি' বলে ডাকত।

(চলবে)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments