জ্বলদর্চি

টুসু পরব /ভাস্করব্রত পতি

পশ্চিমবঙ্গের লৌকিক উৎসব - পর্ব ৪


টুসু পরব

ভাস্করব্রত পতি

"যৌবন বাড়ছে গো দিনে দিনে।
বাপে মায়ে ধমক দিছে দেখে আমার যৌবনে।।
তবু আমি সময় বুঝে দেখা করি গোপনে।
সকাল বেলা উঠছে সূর্য যেমন অরুণ বরণে।। 
যৌবন জ্বালা বড় জ্বালা সইতে লারি জীবনে।
তেমনি আমার মনের যৌবন বাড়ছে গো দিনে দিনে,
এই যৌবনে হয় গো মনে ঝাঁপ দিব লদীর বানে।।"
এ গান টুসু পরবের। সাধারণ মানুষের অতি সাধারণ মনের ভাষায় সঞ্জিত টুসু গানের কথা আর সুর। লোকায়ত দেবী টুসু বারবার ধরা দেয় তাঁর মানবী রূপ নিয়ে। এই লৌকিক দেবতা টুসুকে সামনে রেখে পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম সীমান্ত এলাকা জুড়ে আপামর জনসাধারণের মনের গহিন থেকে উঠে আসে আবেগ, আনন্দ, আকাঙ্ক্ষা, দুঃখ, যন্ত্রনা, কষ্ট, ভালোবাসা। আর অকপটে উথলে ওঠে জমিয়ে রাখা সুপ্ত বাসনাগুলোর আর্তনাদ। টুসু পরবের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত টুসু গান। গাঁয়ের অপাপবিদ্ধ মানুষগুলোর একান্ত নিজস্ব মনন, চিন্তন আর বুননে প্রতিভাত এই টুসু গান। একটা লৌকিক উৎসবের সাথে মিশে গিয়েছে এই লোকগান। যে গানে ফুটে ওঠে প্রান্তিক মানুষের মনের ভাষা। বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, ঝাড়গ্রাম, পশ্চিম মেদিনীপুর, বর্ধমান, বীরভূম সহ পূর্ব মেদিনীপুর, হুগলীর কিছু অংশে টুসুর ব্যাপ্তী। পার্শ্ববর্তী বিহার, ঝাড়খণ্ড এবং ওড়িশাতেও টুসুর প্রভাব সুষ্পষ্ট।


টুসুর নামকরণ 

পৌষ মাস হল 'পুষ্যা' নক্ষত্র যুক্ত মাস। 'পুষ্য' অর্থে বিষ্ণু। পুষ্যার অপর নাম 'তিষ্য'। এই তিষ্য থেকেই এসেছে তুষু বা টুসু। মানিকলাল সিংহের মতে, টুসু কৃষিলক্ষ্মীর বাণিজ্যযাত্রা। ধানের খোসাকে বলে 'তুঁষ' বা 'তুষ'। এটি মৃত ধানের রূপ। ড. বিনয় মাহাতো লিখেছেন, "জলাশয়ে টুসু বিসর্জনের অর্থ হল মৃত শস্যকে কবর দেওয়া। মৃতকে কবর দেওয়ার অনুষ্ঠান হলেও টুসু উৎসব শোকোৎসব নয়। বরং মৃতের অবশ্যম্ভাবী পুনর্জন্মকে ত্বরান্বিত করার জন্য যাদুক্রিয়ার মাধ্যমে আনন্দোৎসব। গোবর, পিটুলিগোলা প্রভৃতি উর্বরতাশক্তিকে বৃদ্ধি করে মৃত শস্যের পুনর্জন্মকে তরান্বিত করার কৌশল মাত্র।" তবে 'টুসু' অর্থে 'টুসটুসে'। একদম সতেজ। অনুঢ়া মহিলাদের দ্বারা পরিচালিত হয় এই উৎসব। তাই টুসুর নামকরণ এভাবেও হতে পারে বলে অনেকের অভিমত।

টুসু গানে কুমারী মনের কামনা বাসনা পূর্ণতা আকাঙ্খা প্রার্থনা আর ইচ্ছাপূরণের ভাবনার নির্যাস প্রত্যয়িত হয়। ড. সুহৃদ কুমার ভৌমিক এবং জেমস ডি রবিনসন লিখেছেন, "Tushu is a female deity, worshipped for the whole month, but for what purpose this deity is worshipped has not been ascertained. Some think that she is the emblem of wealth and others take her to be the incarnation of the Goddess Ganga, the most sacred river Ganges. Perhaps in the beginning it was a folk festival of harvest time in the tribal zone, and it had no link with religion though it will be lost into Hindu practice, conjoining with various local deities."

মুণ্ডারী ভাষায় 'টুসু'র অর্থ পুতুল। Austro Asiatic গোষ্ঠীর 'টুসাউ' থেকে 'টুসু' আসতে পারে বলে মনে করেন ড. সুহৃদ কুমার ভৌমিক। এর অর্থ টাটকা ফুলের গুচ্ছ। "Perhaps tushu is a non-Sanskrit word from an Austro-Asiatic Kol origin, to mean flower, a bunch of flowers, bud etc. In Santali baha tushu means a bunch of flowers; tushu means simply a bud, a leaf of a bud-a symbol of youth and beauty. Tushu-this word has been taken to express the heart's beauty and joy." তিনি লিখেছেন, "Tushu is a folk festival without any touch of religion or a ritual brata but that it was to be celebrated when wealth, paddy or the main crops were gathered into the granaries from the farms to guard against loss." 

মিশরীয় দেবতা টেষুব {Teshub [also written Teshup, Teššup, or Tešup; cuneiform, hieroglyphic Luwian (DEUS) TONITRUS, read as Tarhunzas] was the Hurrian god of sky, thunder, and storms.} থেকে টুসুর উৎপত্তি হয়েছে বলে কেউ কেউ মনে করেন। কিন্তু 'টেষুব' হল পুরুষ দেবতা। আর টুসু হল নারী দেবতা। তেমনি মধ্যপ্রদেশের একটি লোক উৎসবের নাম 'টেসু'। যদিও তা শষ্য উৎসব নয়, নবরাত্রি ও দশেরার সঙ্গে সংমিশ্রিত। তাই 'টেসু' থেকে 'টুসু' সৃষ্টির সম্ভাবনা নেই।


টুসু মূর্তি

সব যায়গায় টুসু মূর্তির চল নেই। বাঁকুড়া, ঝাড়গ্রাম, পশ্চিম মেদিনীপুর, পূর্ব মেদিনীপুরে টুসুর মূর্তিপূজা হয়। পার্শ্ববর্তী ঝাড়খণ্ডের ঘাটশীলা, রাঁচি, টাটাতেও টুসু মূর্তি দেখা যায় বিচিত্র রকমের। পদতলে থাকে ময়ূর, মকর কিংবা পদ্মফুল। পাঁশকুড়ার আটাং গ্রামের টুসু দেবীর পদতলে হাঁস রয়েছে। রঙিন শাড়ি পরিহিত হলুদ বর্ণের টুসু দেবীর দেহে চুড়ি, দুল, হার দেখা গিয়েছে। সাধারণত এক হাত লম্বা উচ্চতায়। ড. আশুতোষ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, "কোনো কোনো অঞ্চলে (টুসুর) প্রতিমা নির্মাণের প্রথা প্রচলিত আছে। মুর্তিটি বাহনহীনা, সাভরণা, গভীর হলুদ রং, উচ্চতা অনধিক এক হাত। ইহার উপর ভাদুপ্রতিমার প্রভাব স্পষ্ট।" ঝাড়গ্রামের গোপীবল্লভপুর ২ ব্লকের নাদনগেড়িয়াতে রয়েছে একমাত্র টুসু মন্দির। বাঁকুড়া জেলার দক্ষিণ প্রান্তে কংসাবতী নদীর পাড়ে পোরকুলে হয় একদিনের বিখ্যাত টুসু মেলা। নদীর এপারে পোরকুল আর অন্যদিকে ঘোড়াধরা ও বারগাঁ ( রাণীবাঁধ থানা )। বারগাঁর কোল ঘেঁষে টুসুর নৃত্যগীত চলে। আর নদীর খাতের জলে মকরস্নান ও টুসু ভাসানো হয়। 
পুরুলিয়া জেলায় টুসুর মূর্তির বদলে 'চৌডল' বা 'চতুর্দোলা' বেশ আকর্ষণীয়। বাঁকুড়াতেও চৌডল বিসর্জন বিখ্যাত। বাস্তবিকই, টুসু পরবে কাগজের চৌডল ব্যবহৃত হয়। এ প্রসঙ্গে ড. সুহৃদ কুমার ভৌমিক লিখেছেন, "Chaudal (chaturdola) or a flower-house, a kind of palanquine in which Tushu should be placed, is so decorated with colourful papers and flowers that it has become the symbol of Tushu itself now and it is immersed into water. It is amazing for a stranger to see countless chaudals (choturdola) or flower-houses being immersed into the stream at the fairs."

ইদানিং টুসুমূর্তি গুলোর পোশাকে রঙিন কাগজের ব্যবহার লক্ষ্য করা যাচ্ছে। পুরুলিয়ার আড়শার বেলকুড়ি, বড়টাঁড়, সেনাবনা, আড়শা, বামুনডিহা হাটে বিক্রি হয় চৌডল। সাধারণ চৌডলের দাম ৩০০-৩৫০ টাকা হলেও চৌডল প্রতিযোগিতার জন্য ৪০০০-৫০০০ টাকা দামের চৌডলেরও বরাত মেলে শিল্পীদের। পুরুলিয়ার কংসাবতীর দুই পাড়ে মকরের দিন চৌডলের মেলা বসে। বাহারি চৌডলে রঙিন হয়ে ওঠে গাঁয়ের হাট। এই দৃশ্য টুসু পরবের এক অন্যতম পর্ব।

টুসু পরবের উপচার 

অগ্রহায়ণের সংক্রান্তিতে টুসুর প্রতিষ্ঠা হয়। অর্থাৎ 'টুসু পাতা' হয়। সমগ্র পৌষমাস জুড়ে চলে বাড়ি বাড়ি টুসুর আরাধনা। এই 'আঘন সাঁকরাইত' তথা অগ্রহায়ণের সংক্রান্তির দিন (ছোট মকর) কৃষির শেষ হিসাবে ক্ষেতে রাখা ধানের আঁটিকে 'ডিনিমাঞ' করে (এই ধানের গুচ্ছকে অন্যত্র বলে 'মোটবিড়া' বা 'মুটবিড়া') খামারে আনা হয়। কোনও মহিলার যদি শেষ বয়স হয় অর্থাৎ বুড়ি হয়ে যায় তাহলে তাঁকে আমরা 'ডিনিমাঞ', 'কুনুমাঞ' ইত্যাদি বলে সম্মান জ্ঞাপন করি। তারই অনুরূপ কৃষির শেষ স্মৃতি সম্পর্কিত ধানকে 'ডিনিমাঞ' বলা হয়। 'ডিনিমাঞ' শব্দ থেকে 'দিদিমা' শব্দের উৎপত্তি হয়েছে বলে মনে করেন গবেষক গৌতম মাহাতো। আর ঐদিনেই নতুন শস্য ধানের সাথে কুমারি মেয়েরা টুসু পাতায়। 

সন্ধ্যাবেলায় কুমারী মেয়েরা একটি পাত্রে (শূন্যগর্ভ মৃৎপাত্রকে বলে 'টুসুখলা' বা 'আলোখলা') চালের গুঁড়ো মাখিয়ে সেখানে তুঁষ রাখেন। তারপর তুঁষের ওপর ধান, কাড়ুলি বাছুরের গোবরের পাঁচটি, সাতটি বা নয়টি ছোট ছোট মন্ড, দূর্বা ঘাস, সর্ষে ফুল, আলোচাল, আকন্দফুল, বাসক ফুল, গাঁদা ফুলের মালা, সিঁদুর, কড়ি ইত্যাদি রেখে পাত্রটির গায়ে হলুদ রঙের টিপ লাগিয়ে পাত্রটিকে কাঠের পিঁড়ি বা কুলুঙ্গীর ওপর রেখে দেওয়া হয়। প্রতিদিন সন্ধ্যার পরে তা টুসু দেবী হিসেবে পূজা করা হয়। আর চলে টুসুর বন্দনাগান - যা কিনা টুসুগান। এটি আসলে ফসল তোলা এবং ফসল ঘরে তোলার উৎসবের গান। 

পৌষের শীতের সন্ধ্যায় টুসখলার সামনে যে বন্দনা গান, তা আসলে টুসুর 'শীতল ভোগ' নিবেদন। এই লৌকিক উপচারে দেবীর উদ্দেশ্যে চিঁড়ে, গুড়, বাতাসা, মুড়ি, ছোলা (কলাই কইড়কইড়া মুড়ি অর্থাৎ ছোলা ও কুসুম বীজের সঙ্গে হলুদ মাখানো মুড়ি, নারকেলপুর, তিলপুর এবং চাঁছিপুর) ইত্যাদি ভোগ নিবেদন করা হয়। এই উৎসবে বৃদ্ধা কিংবা বিধবা নারীর যোগ দেওয়ার রীতি নেই। প্রতি সন্ধ্যায় কুমারী মেয়েরা টুসুখলার কাছে গোল হয়ে বসে নিবিষ্ট মনে এবং শুদ্ধাচারে সমস্বরে টুসুর বন্দনাগান গেয়ে টুসু জাগায় --

"উঠ উঠ উঠ টুসু
তুমায় উঠ করাইতে আইসেছি
আমরা যে সব সঙ্গীসাথী
তুমার পূজায় বইসেছি"!

টুসু পরবের শেষ দিনগুলি --
টুসু উৎসব পালনের ক্ষেত্রে পৌষের শেষ চারদিন পরিচিত 'আঁউড়ি', 'চাঁউড়ি', 'বাঁউড়ি', 'মকর' এবং 'আখান' নামে।

"আঁউড়ি" - এই দিন লক্ষ্মীদেবীকে আবাহন করা হয়। 'আঁউড়ি' অর্থে আগমণি বা আনয়ন। টুসু পরবের যাবতীয় উপকরণ একত্রিত করে রাখার প্রাকপ্রস্তুতির নামই 'আঁউড়ি'।
"চাঁউড়ি" - 'চাঁউড়ি' শব্দটি 'আঁচানো' শব্দ থেকে উদ্ভুত হতে পারে।
চাঁউড়ি> চাউণি> আ-আগম হয়ে আঁচাউণি> আঁচানো
'আঁচানো' শব্দের অর্থ পরিস্কার বা পরিচ্ছন্ন বা ধৌত করা। চাঁউড়ির দিন পরিবার ও সমাজের অনিষ্টকারী অর্থাৎ অপ্রয়োজনীয় জিনিসগুলো জঙ্গলের নির্জন স্থানে ফেলে আসা হয়। পরিবেশ স্বচ্ছ রাখার একটা প্রয়াস। গাঁয়ের মেয়েরা ঘরদোর গোবর দিয়ে ভালো করে নিকোয়। আসলে এই দিনটায় লক্ষ্মীদেবী চাহেন, তথা কৃপাবৃষ্টি করেন। এই দিনে চাল কুটা হয়। তথা গুঁড়ি কুটার দিন। 

"বাঁউড়ি" - এই দিনে দেবীকে গৃহবন্দী করা হয়। 'বন্ধনী' থেকে এসেছে 'বাউনি'। তা পরিবর্তিত হয়ে 'বাঁউড়ি' হয়েছে। এই দিনে অনেক কৃষক পরিবারের গৃহকর্তীরা খড়ের টুকরো দিয়ে 'বাঁউড়ি বাঁধা' সারেন। বাড়তি খাদ্য শষ্য ভবিষ‍্যতের জন্য সঞ্চয় করা অর্থাৎ ধান পুড়া বাঁধা হয়। অন্যান্য এলাকায় তা মকর সংক্রান্তির দিন বিকেলে বাঁধা হয়। বলা হয় 'আউনি বাউনি' বা 'বিচালী' বাঁধা। বাঁউড়িতে নানা ধরনের পিঠে পুলি হয় গেরস্থের বাড়িতে। সবে নতুন ধান কৃষকের ঘরে চালে পরিনত হয়েছে। সেই চালের গুঁড়ি দিয়েই বিভিন্ন পিঠা তৈরি হয়। যার অন‍্যতম হল মাংসপিঠা।

এই দিন রাতে হয় 'টুসু জাগরণ'। সারা রাত ধরে চলে টুসু গান। নানা ভাবে সেই রাতে সেজে ওঠে টুসুমনি। রাত্রি বেলায় এই সময়ে খুব ঠাণ্ডার কারণে শোয়ার আগে পায়ে সরিষার তেল ভালো করে মালিশ করা হয়। বিশ্বাস যে, কোন অপদেবতার নজর লাগবে না গায়ে। বাঁউড়ির দিনে বিভিন্ন যায়গায় যে হাট হয়, তা 'বাঁউড়ি হাট' নামে পরিচিত। এইদিন অনেক যায়গায় মোরগ লড়াইও হয়।

"মকর" - বাঁউড়ির পরেরদিন 'মকর সাঁকরাইত' বা মকর সংক্রান্তি। অর্থাৎ কুড়মালি বছরের শেষ 'জাড় মাস' (পুষ) এর শেষ দিন। এইদিনে মকর ডুব ও টুসু ভাসানো অন্যতম প্রথা। সারারাত জাগরণের পর টুসু গান গাইতে গাইতে টুসুখলাকে নিয়ে যাওয়া হয় স্থানীয় জলাশয়ে। চৌডলে চাপিয়েও নিয়ে যাওয়া হয় শোভাযাত্রা সহকারে। টুসু বিসর্জন তথা টুসু ভাসানের পরেই মকরস্নান। প্রান্তিক মানুষের কাছে এই উৎসব দুর্গাপূজার মতোই জনপ্রিয়। মকরস্নানে গঙ্গাস্নানের পুণ্য অর্জিত হয়। এরপরেই নতুন জামা কাপড় (লইতন কাপড়) পরার রেওয়াজ রয়েছে। তারপর সেখানে বসেই খাওয়া হয় 'গড়গইড়া' পিঠা।

মকরস্নানের পর জলাশয়ের ধারে 'মকর কুঁড়িয়া' বা 'কুমা জ্বালানো' হয়। আসলে শীতের হাত থেকে বাঁচতে একটু উত্তাপের খোঁজে এই প্রথা। 'ম্যাড়াঘর'ও বলে। অর্থাৎ ভেড়ার গোয়াল। ভেড়ার গোয়ালে আগুন দেওয়া আসলে গোপ শ্রেণীর প্রভাব সুষ্পষ্ট। বাঁকুড়াতে মেড়ালি গোপ এবং পূবালী গোপ - এই দুই শ্রেণীর আদিবাসী গোপ সম্প্রদায়ের অবস্থান রয়েছে। দোলের চাঁচরির সময় কোথাও কোথাও 'ন্যাড়া পোড়ানো' র কথা বলা হয়। 

শুকনো ডাল, খেজুর পাতা, বাবলা পাতা, শুকনো খড় দিয়ে বানানো 'মকর কুঁড়িয়া' টুসু পরবের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। দোল উৎসবের চাঁচর জ্বালানোর মতো হলেও এখানে খুঁজে পাওয়া যায় প্রান্তিক মানুষের একান্ত নিজস্ব প্রাণচাঞ্চল্য। এই মুহূর্তে প্রায় হারিয়ে যাওয়া এই প্রথার স্মৃতিচারণে লেখক সুদীপ কুমার খাঁড়া জানিয়েছেন অদ্ভুত অভিজ্ঞতার কথা - "তালবাংশা, খেজুরপাতা আর বাবলাডাল শুকানো হতো একমাস ধরে ফাঁকা জমিতে। আর শালপাতা জঙ্গল থেকে কেটে আনা হতো মকরের দিন পাঁচেক আগে। একটা চাপা কম্পিটিশান চলতো কারা কত বেশি সংখ্যায় মকর কুঁড়িয়া বানাতে পারে। তাছাড়া আমাদের দক্ষিণ মাথার কম্পিটিশান ছিল পাশের গ্রাম লোহাঝালিয়ার সাথে। মকরের তিনদিন আগে থেকে গ্রামের মাথা থেকে চাঁপাখাল পর্যন্ত গ্যাপ রেখে রেখে গর্ত করা হতো বাবলা ডাল পুঁতে মকর কুঁড়িয়া বানাবার জন্য একটা গর্ত আর যেখানে তালবাংশা, খেজুরপাতা বা শালপাতা দিয়ে কুড়িয়া হবে সেখানে পাশাপাশি তিনটি গর্ত করা হতো শাবল দিয়ে। আর মকরের আগের দিন বাঁউড়ির সকাল থেকে এই গর্তগুলিতে তালবাংশা, খেজুরপাতা, শালপাতা আর বাবলাডালকে পুঁতে দাঁড় করিয়ে তৈরি করা হতো 'মকর কুঁড়িয়া'। তারপর বেলার দিকে গ্রামের বাড়ি বাড়ি থেকে শুকনো খড় আদায় করে দেওয়া হতো কুঁড়িয়া গুলিতে। বাবলা ডালের উপরে খড় দিয়ে কুঁড়িয়া সাজাতে অনেক বেশি খড় লাগতো। দুপুরে বাড়ি বাড়ি চাঁদা আদায় করে দলের যাঁরা একটু বয়সে বড় তাঁরা সাত আট কিলোমিটার দুরে বাহাগাড়িয়া গ্রামে যেত বোম আর হাউই কিনতে। তারপর রাত দুটোর দিকে দলের সবাইকে জাগিয়ে আর বাড়ির বড়দের সঙ্গে নিয়ে দলবেঁধে খালধার যেতাম। সেখানে কনকনে ঠান্ডার ওই রাতে মকরস্নান সারতো দলের দু একজন। তারপর কুঁড়িয়া জ্বালানো শুরু হতো। আর সাথে সাথে চলত বোম ফাটানো আর হাউই ছোঁড়া। সব কুঁড়িয়া পোড়ানো শেষ হতে হতে সূর্য উঠে যেত।"
মকরচানের দিন 'মকর পাতানো' বা 'ফুল পাতানো' বা 'সই পাতানো' খুব প্রিয় অনুষ্ঠান। আসলে একজন তরুণ আরেকজন তরুণ কিংবা একজন তরুণী আরেকজন তরুণীর সাথে 'ফুল' পাতায়। আসলে বিপদের দিনে ঐ 'ফুল' নামক নারী বা পুরুষ নিজের আত্মীয়ের মতোই যাতে আপনার 'জন' হয়ে ওঠে -- এই ভাবনায়। কোথাও কোথাও এই ফুল পাতানো মকর সংক্রান্তির দু তিন দিন পরেও হয়।

"আমার টুসু ফুল করেছে
ঝাড়গাঁ গড়ের রাণীকে।
মনে মনে চিঠি ছাড়ে
গলাপ ফুলের ভিতরে।"

গবেষক শিক্ষক গৌতম মাহাতোর কথায়, "কুড়মি উপজাতি বছরের শেষ দিনটিতে যাবতীয় পুরোনো সবটুকুই বিসর্জন দিয়ে স্নান সারেন। মকর পরিশুদ্ধিতার দিন। আর পুর্বপুরুষদের পরম্পরা স্মরণের দিন। আগামি বছরের সূচনা 'যাত্রার' দিন ধরে আপামর কৃষিজীবী কুড়মি সম্প্রদায়ের মানুষ তাঁদের হাল বা লাঙ্গল থেকে ধান রাখার ডোল-পুড়ার সংস্কার ও পরিচ্ছন্নতার পরবের নামই মকর পরব।"
"আখান" -- মকরের পরের দিন তথা পয়লা মাঘ হয় আখান। সীমান্ত বঙ্গে মাঘের প্রথম দিনেই 'এখ্য়ান যাত্রা' বা 'আইখান যাত্রা' পালিত হয়।
অক্ষ অয়ণ > এখ্খান > আইখান > আখান
যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি লিখেছেন, "ষোলশত বৎসর পূর্বে পৌষ সংক্রান্তির দিন উত্তরায়ণ দিন আরম্ভ হইত। পরদিন ১ লা মাঘ নূতন বৎসর আরম্ভ হইত।" এই দিনটা কুড়মালি নববর্ষ। তাঁদের কাছে ১২ টি মাস হল - মধুমাস, বিহা মাস, মহুআ মাস, নিরন মাস, ধরন মাস, বেরসা মাস, রপা মাস, করম মাস, টান মাস, সঁহরাই মাস, মাইসর মাস এবং জাড় মাস। 

এদিন ভোরে কাস্তে গরম করে 'চিড়ুদাগ' দেওয়া হয়। বাইটা দিয়ে দড়ি তৈরি করা হয়। সারা বাড়িতে গোবর দিয়ে লাতা দেওয়ার পর স্নান সেরে সেই ভিজে কাপড়েই গরু বা মহিষকে (এঁদের পা ধুইয়ে সিঙে তেল মাখিয়ে বরণ করে বাড়ির বউ) লাঙ্গলে জুড়ে জমিতে আড়াই পাক লাঙ্গল করে বাড়িতে ফিরে আসে। এই প্রথা হল 'হালচার' বা 'হালপুইন্যা'। এভাবেই আখান দিনে কৃষিকাজের আরম্ভ করে কুড়মি সম্রদায়ের মানুষ জন। আসলে বাঁধনা পরবের সময় চাষের হাল হাতিয়ার ঘরের মাচায় তথা 'আড়াচে'তে তুলে রাখা হয়। তাই কৃষিকাজের বিরতি। লাঙল করা বন্ধ। আর এই পয়লা মাঘ তথা আখান দিন হল ভাগবত দিক থেকে কৃষি বর্ষের শুরু। এই দিনেই কৃষিকর্তা একজনকে কৃষিকাজের জন্য সহযোগী তথা 'গলা'  নিয়োগ করেন। যাঁদের বাড়িতে নিযুক্ত হন, তাঁরা হলেন 'গলাঘর'। শুধু তাই নয়, যাবতীয় মাঙ্গলিক কাজ যেমন ঘরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন, কনে দেখতে যাওয়া ইত্যাদি শুভ কাজের সূচনা করেন গেরস্থের লোকজন। এই দিনে অনেক যায়গায় অনেকেই শিকার উৎসবে মেতে ওঠেন। আর গ্রামে গ্রামে গরাম পূজা ও বড়াম পূজাও আয়োজিত হয়।

এই উৎসব প্রান্তিক মানুষের হৃদয়ের উৎসব। যার প্রতিটি ছত্রে ছত্রে লুকিয়ে আছে সাধারণ কৃষিজীবী মানুষের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিচ্ছবি। কৃষিকেন্দ্রিক ভাব ভালোবাসা আর মন থেকে উৎসারিত সুখানুভূতি। গানের সুরে উচ্চারিত হয় -

"তুমি টুসু জলে যাছ
কবে দেখা পাব গো।
জলে গেলে কারে মা গো
মা বইলে ডাকিবে গো।।
সুখে চলি যাও গো টুসু
সুখে চলি যাও গো --
আইসছে বছর এমনি দিনে
আরঅ যেন আইস গো।।"

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments