জ্বলদর্চি

কবিতা অ্যাভিনিউ /পর্ব-১/বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়

কবিতা অ্যাভিনিউ    

 পর্ব-১

বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়  

কবিতা পড়ার অভ্যাস সেই কোন ছোটবেলায় ঢুকে গিয়েছিল রক্তে। না জেনে  না বুঝে পড়তে পড়তেই লাইনগুলো মাথার ভেতর গেঁথে যেত অজান্তে।টেনে বার করে আনলেও নাছোড়বান্দার মতো জড়িয়ে ধরত স্মৃতিপথ।এখনও যখন মাঝে মাঝে একটির পর একটি কবিতা হঠাৎ হঠাৎ মনে পড়ে যায় এবং ভাবি অনেকদিন আগে কবিতাটি যে আকুলতা নিয়ে এসেছিল আজ তার রঙ বর্ণ ও অভিঘাত বদলে গেছে। বাইরের জামাকাপড় দিয়ে চেনা কবিতাটি অজান্তেই কখন ভেতরের ঘরে এসে বসে, গল্প করে। তখন মনে হয় এভাবে তো এর সাথে দেখা হয়নি কখনও। জানা হয়নি তার নিভৃত উচ্চারণ। এভাবেই দুয়ার থেকে এক একটি কবিতা ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ে। এখন মনে হয় সত্যিকারের কবিতার দশটি দিক থাকে।দশদিক থেকে উল্টেপাল্টে দেখতে দেখতে যখন আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারি যে দশটি রেখা একটি বিন্দু ফুড়ে উঠে আসছে।অনুভবের বিন্দু। যেন অনেকগুলো সূর্যরশ্মি সেই ছেদবিন্দুতে তৈরি করছে প্রবল আঁচ।এই ছেদবিন্দুটি স্পর্শ করা অনেকসময়  সম্ভব হয় না  আমাদের মতো সাধারণ পাঠকের পক্ষে। তাহলে কবিতার কোন মানে নেই আমাদের কাছে? আছে। ঐ যে মনের ভেতর অজান্তে তলিয়ে থাকা শিল্পবস্তু এক একদিন ঠিক জেগে উঠে। তখন মনে হয় এই তো এই তো স্পর্শ করতে পারছি ।  যে লাইনগুলো একদিন বলেছিল- ‘তুমি মোর পাও নাই পরিচয়।‘ তারা অজান্তেই একদিন  বলে ওঠে – ‘আমি তোমাদেরই লোক’। 

শিকড়ে শস্যের গন্ধ থাকে ? পাওয়া যায় কখনও? কিংবা  ধমনীতে স্বপ্নবর্ণ ফুল ? আমাদের সাধারণ চোখ কান নাক দিয়ে এই রূপ বা গন্ধের ঠিকানা সন্ধান করা খুব সহজ কাজ নয়। তাই এই ধ্বনিপুঞ্জ কোন ছবির জন্ম দেয় না চোখে। কবিতা পড়তে পড়তেই 
স্নায়ুবৃত্তে বারবার অনুবর্তিত হয় এই শব্দগুলি। নতুন বোধের দ্যোতনায় একদিন স্বপ্নবর্ণ ফুল ফোটে। এভাবেই কবিতার জন্ম হয় আমাদের মনে। আমাদের পাঠকসত্তায়। কবি কেন লিখেছেন তা আমাদের কাছে বিচার্য নয়। কবিতাটি কীভাবে আমার কাছে এল বা আমি তাকে কীভাবে পেলাম, এই প্রাপ্তির আনন্দটুকুই বয়ে আনে শিল্পের নির্যাস।

‘আমি তো ছিলাম ঘুমে
তুমি মোর শির চুমে
গুঞ্জরিলে কী উদাত্ত মোহমন্ত্র
মোর কানে কানে’ 

কবি অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের এই কথাগুলিই তখন হয়ে যায় আমাদের প্রাণের কথা। 

ওষ্ঠের স্পর্শে গুনগুন করে উঠে কবিতার লাইন।
আসলে সাবেকী খাচায় কল্পনা ও মননের সংমিশ্রণ নিয়ে নানা রঙে রসে বোধে পল্লবিত হয় কবিতা। প্রসারিত হয় তার অন্তর্বস্তু। রূপভেদ ঘটতে থাকে তার। কবিরা কি কেবল নকশাকাটা ছকের ভেতর নিজেদের  ভাবনাবাহী শব্দগুচ্ছ গুঁজে দিয়ে  বলবে- এই নাও কবিতা। তা তো হয় না। এভাবে কোন কবিই কবিতা লেখেন না।অন্তরের এক তাগিদ যা কাব্যিক রূপলাভের অনন্ত ইচ্ছে নিয়ে স্নায়ুতে মগজে ও অন্যান্য ইন্দ্রিয়ে ক্রমাগত সংক্রমণ চিহ্ন রেখে যায়। তারই বাহ্যিক এবং শাব্দিক প্রকাশ ঘটে কবিতায়।সেইসব নিজস্ব শব্দের ছবি ও সুর অনেকসময় পাঠকের কাছে তরঙ্গ তোলে না। পরে কখনও আমাদের অনুষঙ্গী মনে তা সংকেত পাঠায়।নাড়া দেয়, ভালো লাগে। তখন পাওয়া যায় স্পর্শের আনন্দ।

এভাবেই বিমূর্ত শূন্যতা ভরে যায় অসংজ্ঞেয় অনুভবে। যদি আপনি একে  ঈশ্বর বলেন বলতে পারেন। এই শূন্যতার ভেতর শুয়ে আছেন পূর্ণ। কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর একটি উদ্ধৃতি যদি এখানে অন্তর্ভুক্ত করি বোধ হয় অসঙ্গত হবে না- “ বাইরের জগত সংসারের নানা ঘটনা ও ভাব ভাবনার ধাক্কা মনে লাগা, পঞ্চেন্দ্রিয় দিয়ে সবকিছু ছুঁতে ভাল লাগা, নিজেদের অভিজ্ঞতার  বৃত্ত থেকে আনন্দ-  শোক- স্বান্ত্বনা ছুঁয়ে  ছেনে স্বাদে গন্ধে মনে যে তরঙ্গ হয় তাকে ভাষার ছবি ও গানে অন্যের কাছে নিয়ে যেতে এবং তাই দিয়ে নিজের বিচ্ছিন্নতা ঘোচাতে মন চায়” ( কেন লিখি, দেশ ২৭ জানুয়ারি,১৯৮৮)

  কবিতার অন্তর্নিহিত সত্য প্রসঙ্গে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় একসময় বলেছিলেন – “ শব্দ ভাষা মনের মতো করে দুনিয়া বদলাতে তাগিদ দেয়।

এই দুটি বক্তব্য থেকে যা নির্যাস উঠে আসে তা হল-
১  মানুষ ও প্রকৃতি থেকে মনে আসা এবং অন্য মনের অনুকূল করে ভাষায় রূপান্তরিত করার আত্মতৃপ্তিই শিল্পের মূলকথা।
২ পছন্দসই বিষয় যা ভালো লাগে,তাকে মনোজগতে আন্দোলিত করার কাজই শিল্পের কাজ
৩ বিচ্ছিন্নতা দূরীকরণ , সেতুবন্ধন নিজের ভাবনার সাথে অন্যকে যুক্ত করা।

খুব স্বাভাবিক ভাবেই এইসব আত্মগত ঝোঁক থেকে ইচ্ছের আশ্রয় থেকে যে কাব্যপথ বেরিয়ে এসেছে , যে শ্রম ও সংগ্রাম  থেকে ইতিহাস ও সমাজ বিবর্তনের স্রোত থেকে শিল্পের জন্ম হয়েছে এর নিরিখে আমরা কবিতার দুটি পথ দেখতে পাই। একদিকে কবিতার জন্য কবিতা লিখবার তাগিদ  যা আত্মপ্রতিকৃতিকেই আরোও মহীয়ান করে তোলে এবং অন্যদিকে মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে  জীবনের জনকল্লোলে নিজেকে সম্পৃক্ত করার নিরলস প্রয়াস। এই দুইয়ের সমান্তরাল অভিযান নিয়ে কবিতা অনেকদূর পথ এগিয়েছে।
স্তরীভূত চেতনায়  উজ্জ্বল অমোঘ হয়ে গেছে  আমাদের কিছু কিছু এমনই লাইন--

১ … আমার বিলুপ্ত হৃদয়, আমার মৃত চোখ , আমার বিলীন স্বপ্ন আকাঙ্ক্ষা ,
আর তুমি নারী-
এই সব ছিলো সেই জগতে একদিন।
অনেক কমলা রঙের রোদ ছিলো,
অনেক কাকাতুয়া পায়রা ছিলো,
 মেহগনির ছায়াঘন পল্লব ছিলো অনেক,
 
অনেক কমলা রঙের রোদ ছিলো,
অনেক কমলা রঙের রোদ;
আমি তুমি ছিলে … ( নগ্ন নির্জন হাত)
           
অথবা যদি আমরা এই কবিতার সামনে চুপচাপ কিছুক্ষণ বসি
‘এক পৃথিবীর রক্ত নিপতিত হয়ে গেছে জেনে
এক পৃথিবীর আলো সব নিভে গেছে বলে
রঙিন সাপকে তার বুকের ভিতরে টেনে নেয়;
অপরাহ্ন আকাশের রঙ ফিকে হলে।
 
তোমার বুকের পরে আমাদের পৃথিবীর অমোঘ সকাল
তোমার বুকের পরে আমাদের বিকেলের রক্তিম বিন্যাস;
তোমার বুকের পরে আমাদের পৃথিবীর রাত,
নদীর সাপিনী লতা, বিলীন বিশ্বাস’  ( তোমাকে )
এই প্রতিবিম্ব শুধুমাত্র জীবনের প্রতিবিম্ব নয়।তার চেয়েও অনেক বেশি মাত্রা নিয়ে এসেছে জীবনান্দের কবিতায়। মহৎ শিল্পের একটি আদর্শগত দিক থাকে। যা আমাদের কাছে নিয়ে  আসে পৃথিবীর অমোঘ সকাল। সমস্ত জগত ও জীবনকে ধরতে চায় এক অখন্ড সত্তার ভেতর।যেমন করে সূর্যের আলো ধরা পড়ে একটি জলবিন্দুর আধারে,  ধানের শীষে জমে থাকা শিশিরবিন্দুর উপর সমগ্র বিশ্বের প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠে।অপরাহ্নে আকাশের রঙ ফিকে হলে বিকেলের রক্তিম বিন্যাস তবু জেগে থাকে আমাদের বুকে। আমাদের হাসিকান্নায় আমাদের শব্দের কাছে সভ্যতার স্বর চাপা পড়ে আছে। শব্দের প্রাবল্য বেড়ে চলেছে ক্রমেই। ফলে তা প্রেমের চেয়ে বেশি আলোকিত হয়ে উঠছে। মনে রাখতে হবে শিল্প শুধু সমস্তের বর্ণনা নয় তা জীবনের সারসত্য। প্লেটো এরিষ্টটল কথিত অনুকরণবাদের সাথে আর্টের সম্পর্কের সাবেকি উক্তি মনে করা যেতে পারে। কিন্তু এ শুধু জীবনের উপরিভাগের প্রতিফলন নয়। এ শুধু আয়না নয় ফটোগ্রাফির কারিগরী কৌশল নয়। পরাবাস্তবতা জীবনান্দের কবিতার মূল উপাদান হলেও আমরা কি তাকে এভাবে খুঁজিনি কখনও
অন্ধকারে সব চেয়ে সে শরণ ভালো
যে প্রেম জ্ঞানের থেকে পেয়েছে গভীরভাবে  আলো।(যতদিন পৃথিবীতে)
এই আলোর উজ্জ্বলতার অনুসন্ধানই  জীবনানন্দের কবিতায়। অপ্রকৃতিস্থ অসুস্থ পৃথিবীতে যখন ক্রমাগত মিথ্যের উল্লাস। সেই উল্লাসভূমির উপর দাঁড়িয়ে ‘যেখানে মূর্খ আর রূপসীর ভয়াবহ সঙ্গম’ হিংস্র সর্বগ্রাসী দুনিয়ায় যেখানে “ অনর্গল অপরিশ্রুত উল্লাস” 
‘কেবলই জাহাজ এসে আমাদের বন্দরের 
দেখেছি ফসল নিয়ে উপনীত হয়
সেই ফসল অগণন মানুষের শব
শব্দ থেকে উত্থিত স্বর্ণের বিস্ময়’ ( সুচেতনা) 

এই প্রেক্ষণবিন্দু থেকে আমরা ফিরে দেখব তাঁর কবিতা।

(ক্রমশ) 

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

4 Comments