জ্বলদর্চি

কবিতা অ্যাভিনিউ/পর্ব-৫/বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়


 কবিতা অ্যাভিনিউ

বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়

পর্ব -৫


“কোথাও আরম্ভ নেই, শেষ নেই।

 তবু মানুষের দেশে ঢেউ মানুষেরা কুলোর বাতাস নাড়িয়ে নাড়িয়ে তোলে”

 আবহমান সময়ের প্রবাহে যে ঢেউ কুলোর বাতাস দিয়ে নাড়িয়ে নাড়িয়ে তুলে যান কেউ কেউ, কতদূর তা যেতে পারে এই ক্ষণজীবনের মহিমায়? না  কি তা উত্তরকালের দুষ্প্রবেশ্যতাকে ভেদ করে রেখে যায় মহাজীবনের অনুভবরঞ্জিত জাগরুকতা? অবশ্যই রেখে যায় এবং রেখে যায় বলেই মণীন্দ্র গুপ্ত অনায়াসে বলতে পারেন – “ উৎকৃষ্ট কবিতার দুর্মর জীবনীশক্তি অনেকটা যেন বিশুষ্ক পদ্মবীজের মতো,যা হাজার হাজার  বছর পরেও অনুকূল ক্ষেত্রে পুঁতলে আবার বেঁচে ওঠে,  ফুল ফোটায়”। এই ঋজুতা নিয়েই এক গভীর প্রত্যয়ে লিখে যান প্রতিবিম্বিত পৃথিবীর ভাষা। যে ভাষায় জড়বস্তুর মধ্যেও সঞ্চারিত হয় প্রাণের স্পন্দন।ফলে তা শুধু সমকাল নয় সমকালকে অতিক্রম করে হয়ে ওঠে চিরকালের। হয়ে ওঠে আবহমানের। একজন কবি ঠিক কখন কবি হয়ে ওঠেন এর কোন  সূচনাবিন্দু নেই।নিজের কবিতা লেখা সম্পর্কেও কবি মণীন্দ্র গুপ্ত শিলীন্ধ্র ৯৪ সংখ্যায় কমল মুখোপাধ্যায়কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে স্পষ্ট এবং অভ্রান্ত অক্ষরে বলে গেছেন –“  একজন দোয়েল কবে  গান গাইতে শুরু করেছিল? একজন উদবেড়াল কবে সাঁতার কাটতে শুরু করেছিল? একজন মৌমাছি  কবে কেমন করে  চাক বাঁধতে শিখল? এসব প্রশ্নের উত্তর কি তারা দিতে পারবে?  মনে পড়ে  চেতনা জাগার পর থেকেই  নিসর্গ আমাকে দারুণ মুগ্ধ করত।  নিসর্গের সৌন্দর্য আমি অনুভব করতে পারতাম । মন কেমন করত। মন আঁকুপাঁকু করত। সেই পলায়মান সৌন্দর্যকে  আমি মন দিয়ে ধরে রাখতে চাইতাম। অপরিচিত অর্ধপরিচিত যুবক যুবতী, বৃদ্ধ   বৃদ্ধার  মুখ ও আকৃতি আমি বিস্ময়ের সাথে নিরীক্ষণ করতাম। তাদের ঐ বাইরের খোলস, নড়াচড়ার ভঙ্গি দেখে দেখে ক্রমশ আভাস পেতাম তাদের জীবনের, রহস্যের। ক্রমশ বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে  জন্ম, মৃত্যু্‌ সময় , মহাকাশ নিয়ে নানা দার্শনিক চিন্তা মাথায় ঢুকল। এই সময় আমার মনে হত, আমি হয়ত চিত্রকর ও ভাবুক। এক সময় আর পাঁচটা  ছেলের মতো  লিবিডো আমার মধ্যে প্রবল হয়ে উঠল । হতে পারে, তারই তাড়নায়  আমার কবিতায় মনোনিবেশ। অন্তত আমার প্রথম বই’আমরা তিনজন’  সেই কথাই বলে। তারপর একদিন লিবিডো আমাকে দংশন করল। বিষ টেনে নেবার  জন্য কবিতাই বিষ পাথরের কাজ করেছিল। ক্রমে  কবিতাই আমার পরম আশ্রয় হল।” …বস্তুত পক্ষে জাগতিক ঘটনার ভেতর  রহস্য অনুসন্ধান  এবং বস্তজগতের সাথে মানববিশ্বের পারস্পরিক সম্পর্কের যে বুনন, তার কেন্দ্রীয় আকরণ খুঁজতে খুঁজতেই তিনি অনিবার্য ভাবে পৌঁছে গেছেন কেন্দ্রের নির্মিতিতে। বোধহীন,চেতনহীন দৃশ্য অথবা অদৃশ্য বস্তুপুঞ্জের ভেতর প্রাণের সমীকরণটিকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন শাব্দিক বৈভবে ।

কবি মণীন্দ্র গুপ্তকে জানতে গেলে তাঁর কবিতার ভেতর আনবিক সাঁতার কাটার নির্ভুল প্রণালী  জানবার আগে তাঁর ব্যক্তিজীবনের ছায়ায় এসে যদি আমরা দাঁড়াই তাহলে দেখতে পাব কবি মণীন্দ্র গুপ্তের জন্ম  ১৯২৬ সালে  অবিভক্ত বাংলাদেশের বরিশাল জেলায়। পড়াশোনা আসামের  শিলচর এবং কলকাতায়। পড়াশোনা শেষ করার পরই বেঁচে থাকার তাগিদে বিভিন্ন জীবিকার  অনুসন্ধান করতে হয়েছে তাঁকে ।প্রথমে তিনি  ভারতীয় সেনাবাহিনীতে  যোগদান করেন।  উত্তর পূর্বাঞ্চলে বেশ কিছুদিন কাজ করার পর তা ছেড়ে দিয়ে কলকাতায় ফিরে আসেন এবং মেশিন ডিজাইনের শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন।সাধকের মগ্নতা নিয়ে ছয় দশকের বেশি সময় ধরে তিনি কাব্যচর্চা করেছেন।চলমান মুহুর্তের ভেতর থেকে,বোধের অন্তহীন পরম্পরা থেকে কবিতাকে খনন করেছেন ।তাঁর ভাষাপথের বিভিন্ন বাঁকে জীবনের কায়িক ও মানসিক অনুষঙ্গগুলির পাশাপাশি অতীন্দ্রিয় চেতনার প্রচ্ছায়াও লিপিবদ্ধ হয়েছে। তাই আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘ অক্ষয় মালবেরী’ নিছক দিনযাপনের ধারাবাহিক বিচ্ছুরণ নয় এক নির্বিকার সত্তার অনুসন্ধান।  কবিতা বিষয়ক গদ্যগ্রন্থ ‘চাঁদের  ওপিঠে’। এই গ্রন্থে জীব ও জড়ের সমস্ত সীমারেখাকে ভাঙচুর করে দিয়ে তিনি কবিতার  অন্তর্বয়নে অনুভূতির নানা স্তর ও বিভঙ্গের যে রূপান্তর ঘটিয়েছেন তা এক স্বতন্ত্র পথের সন্ধান দেয়। টুং টাং নৈঃশব্দ্যের ভেতর তিনি অনুসন্ধান করেছেন  নীল পাথরের আকাশ। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে  আমরা তিনজন, আমার রাত্রি, নীল পাথরের আকাশ, লাল স্কুলবাড়ি, মৌপোকাদের গ্রাম, ছত্রপলাশ চৈত্যে দিনশেষ, শরৎমেঘ ও কাশফুলের বন্ধু,  নমেরু মানে রুদ্রাক্ষ, মৌচুষি  যায় ছাদনাতলায়, নিরক্ষর আকবর, এক শিশি গন্ধহীন ফ্রেইগ্রানস এবং সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থ বনে আজ কনচের্টো । এই গ্রন্থের জন্য ২০১১ সালে  তিনি সাহিত্য আকাডেমী পুরস্কারে সম্মানিত হন।

 তাঁর কবিতার টুংটাং নিঃশব্দের এক অবিশ্রাম স্থিতিবিন্যাসের পাশে এসে দাঁড়ালে মগ্ন পাঠক অবশ্যই লক্ষ্য করবেন সেখানে শব্দের পর শব্দ জুড়ে তৈরি হয়েছে এক লৌকিক পথ। যে পথের পাশে ফুটে আছে কাশফুলের বন্ধুতা।শ্বেতশুভ্র সেই অনুভবের পাদদেশে একটি ক্ষীণ রাস্তা চলে গেছে নৈঃশব্দ্যের সম্ভাবনাময় পরিসরে।শরতের মেঘ জমেছে সেখানে।আলো এবং অবচ্ছায়ার এক অসমীকরণ পেরিয়ে শাশ্বতের দিকে চলে যাচ্ছে শব্দের যাত্রাপথ। পাঁচটি ইন্দ্রিয় এবং ভাবনার এক অতীব সংবেদনশীল বিশ্লেষণী শক্তি ছাড়া এই রহস্যময় পথের অনুসন্ধান  খুব সহজ কথা নয়। নিজের কবিতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে কবি মণীন্দ্র গুপ্ত খুব সচেতনভাবেই বলেছেন- “ জন্ম  থেকে এই জগতকে পাঁচ ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করেছি, আর তাঁর বিচিত্র  অর্থ মনের মধ্যে  উঁকিঝুঁকি দিয়ে গেছে। নিজে একা একা এইসব নিয়ে কথা বলি। খুব সংক্ষেপে বলতে গেলে , এই কথা বলাটাই আমার কবিতা। জগতকে আমি দেখি কালস্রোতের মধ্যে- কখনও উদাসীনভাবে বহমান, কখনও অতীত , বর্তমান, ভবিষ্যতের আলাদা আলাদা ঘরে স্থানু। যতদিন বাঁচি তার সঙ্গে আমার সংযোগ, সঙ্গম, সম্পর্কের আশ্চর্য কথা বলে যাই। মনে হয়, আমার জীবনের সম্পূর্ণ অসার্থকতার মধ্যে, শেষ পর্যন্ত , এটুকুই সার্থকতা” এই চলাচলকেই তিনি বিস্তৃত করেছেন তাঁর কবিতায় –

 

"দিন যায়। পরতে পরতে জমে ধুলো । সে চলে যাবার

অর্গানের রীডে – যাকে আমি সুরের পাঁজর বলতাম-

আর কেউ আঙুল রাখে না। না রাখুক আমি বেশ আছি।

বাড়িময় আলস্যের ঘুম ঘুম ঘোর, আকাঙ্ক্ষারা  ফটকের

বাইরে থাকে-

বিরক্ত করে না ঝরা পাতার তলায় ঢাকা এই বাড়ি , এই ম্লান জীবনেরও

 

এক রকম সুখ আছে, এক রকম আস্বাদন আছে।

আমি  বেশ আছি।

সব মিথ্যে। আসলে এ বাড়িতে কখনো অর্গান ছিল না

যা ছিল তা আমারই পাঁজর ।"( ম্লান জীবন)

কবি মণীন্দ্র গুপ্তের কবিতা সমস্ত আরোপিত উপলব্ধির স্থিতিস্থাপকতা পেরিয়ে এক সজাগ এবং গভীরতর সম্ভাব্যতার সাংকেতিক গ্রন্থনায় পৌঁছে দেয় আমাদের। ফাঁপা ইমারতের কোন বালাই নেই সেখানে।কাব্যের অনুপম স্থাপত্যের পাশাপাশি কথাবীজগুলি আমাদের এক নান্দনিক বীক্ষনবিন্দুর দিকে পরিচালিত করে। প্রায়  নিরুচ্চার   স্বরের প্রেক্ষণ থেকে নির্মিত হয় ব্যক্তিগত অভিব্যক্তির শাব্দিক আশ্রয়। সুরের পাঁজর এই শব্দটিই সমস্ত কবিতাটিকে এক অনন্য অভিমুখে পৌঁছে দেয়। বুকের ভেতর দিয়ে মোচড় দিয়ে বেরিয়ে আসে আকাঙ্ক্ষার সুর।এর মধ্যে আছে  সুখের আস্বাদন।  এই প্রসঙ্গে বারবারা জনসনের একটি কথা উদ্ধৃতি হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে- The deconstruction of a text does not proceed by random doubt arbitrary subversion but the careful tearing out warring forces of signification within the text itself.

এই কবিতার দিকে তাকালে মনে হতে পারে যেন বিষাদের কবিতা লিখেছেন তিনি।  তিনি বেদনার  বলয়ে নিক্ষিপ্ত করেছেন নিজেকে। আসলে তিনি জীবনের সত্যকে বলেছেন। পৃথিবীতে যে সুর বেজে চলেছে সঙ্গীতে যে শব্দের সমাবেশ কবিতাকে গভীর গভীরতর করেছে তা অনুভব করতে হলে তার সাথে একাত্ম হতে হলে ঝরা পাতায় ঢাকা এই পৃথিবীর ভেতর যে ম্লানজীবন আছে, সেখান থেকে  সমস্ত শব্দ এবং ধ্বনি যেন সেই পাঁজর কাঁপিয়ে উঠে  আসছে। বস্তুর ভেতর প্রাণের এই বার্তা কবি মণীন্দ্র গুপ্তের কবিতার স্বতন্ত্রতা তাঁর মৌলিক প্রকরণ। আগামী পর্বেও তাঁকে নিয়ে আরও অনেক কথা বলার আছে, তাই যাঁরা এই ধারাবাহিক নিয়মিত পড়ছেন এবং আমার  পাঠকজীবনের যাত্রাপথে সহযাত্রী হয়েছেন তাঁদের কাছে বিনীত অনুরোধ আগামী সংখ্যায় অবশ্যই চোখ রাখুন।

 ( চলবে)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇



 

Post a Comment

0 Comments