জ্বলদর্চি

প্রভাত চৌধুরী // ঈশিতা ভাদুড়ী

স্মৃতি ডট কম ৪

প্রভাত চৌধুরী 

ঈশিতা ভাদুড়ী 

‘কদিন আগে যে আগরতলার মাটিতে, হাঁটাহাঁটি করেছি / আজ সকালের দিকে আগরতলার মানচিত্রে হাঁটতে গিয়ে দেখি / কোথায় গেল সেই জলাশয়, সেই ফিঙেটি / জলাশয় এবং ফিঙে না থাকলেও দূর থেকে দেখতে পাচ্ছি / একটা এয়ারোড্রাম, তার ডানায় কিছু একটা লেখা আছে / আরো দূর থেকে দেখতে পাচ্ছি একটা রবার বাগান / কিন্তু আদতে মানচিত্রে তো এতসব দ্যাখা যায়না / যাঁদের চোখের ভেতরে আরো একটা চোখ থাকে, তাঁরাই / দেখতে পান / আমার ডানচোখের রেটিনায় ছিদ্র আছে, যার ডাকনাম ফুটো, আমি / বাঁচোখ দিয়েই সব দেখি / বাঁদিকের রাস্তা, ডানদিকের জলাশয়, ঊর্দ্ধ-আকাশের ফিঙে / আর রাস্তার উপর পড়ে থাকা কোনো একটা ছিপি / সবই দেখি বাঁচোখ দিয়ে / আমার বাঁচোখের ভিতরে আর কতগুলো চোখ আছে কখনও গুনে দেখিনি’ - ৬০-এর দশকের কবি প্রভাত চৌধুরী ‘অনুপমকে যা বললাম’ কবিতার প্রথম কবিতায় লিখেছিলেন। তাঁর ভাবনা এবং ভাষা ছিল ভিন্ন। সেই প্রভাত চৌধুরীর  সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল আমাদের বন্ধু নাসের হোসেন।
তখন চন্দননগরে থাকতাম। ২৫শে বৈশাখ সকালে প্রথম ট্রেন ধরে রবীন্দ্রসদনে আসতাম। সেই সকাল (প্রায় ভোরবেলা) থেকে দুপুর অবধি কবিতা গান আড্ডা। কত কত লিটল ম্যাগাজিন! কত মানুষের সঙ্গে পরিচয় রবীন্দ্রসদন প্রাঙ্গণে, সেখানেই সাক্ষাৎ ‘কবিতা পাক্ষিক’ পত্রিকার প্রাণপুরুষ প্রভাত চৌধুরীর সঙ্গে। 
নব্বই-এর দশক। ইতিমধ্যে আমরা একঝাঁক তরুণ-তরুণী মাঠে যে যার স্টাইলে যে যার ভাষা রপ্ত করে ফেলেছি। ১৯৯৩ সালে তাঁর সম্পাদনায় নতুন পত্রিকা ‘কবিতা পাক্ষিক’ প্রকাশিত হয় হৈ-হৈ করে, পত্রিকাটি আমি আগেই পাতিরাম থেকে কিনেছিলাম, কিন্তু কবিতা পাঠানোর সাহস হয়নি কখনও। কেননা ‘কবিতাপাক্ষিক’ পত্রিকার সঙ্গে উত্তরাধুনিক শব্দ জড়িয়ে ছিল, যে শব্দ বহু আলোচিত হলেও আমি সেই শব্দের সঙ্গে ততো বেশি পরিচিত হতে পারিনি তখনও। কিন্তু আমার ভীরু-ভাব কাটিয়ে প্রভাতদা কবিতা পাঠাতে বললেন, পাঠিয়েছিলাম।  তারপর থেকে ‘কবিতাপাক্ষিক’ পত্রিকায় আমার  কবিতা ছাপা হয়েছে অনেক। এরপর হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের বাড়িতেও যাতায়াত হলো আমার, বৌদির সঙ্গে পরিচয়, রজতেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, মুরারি সিংহ এবং আরও অনেক তরুণ কবির সঙ্গেও। পটল ডাঙা স্ট্রিটের ছাদে কবিতার আড্ডায়ও গিয়েছি। 
প্রভাতদা আসলেই তরুণদের প্রশ্রয়ের জায়গা ছিলেন। সকলের সামনেই একটি নতুন দরজা খুলে দিয়েছিলেন ‘কবিতা পাক্ষিক’ পত্রিকার মাধ্যমে। ওই পত্রিকার মধ্যে দিয়েই বাংলা কবিতার যাত্রাপথকে তিনি তুলে ধরতে চেয়েছেন বরাবর। প্রভাতদা লিখেছিলেন – …দীর্ঘকাল ধরে রাতের নীরবতার কথা বলে চলেছেন পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষার কবিরা। … সবকিছু ভালোভাবে না জেনে আমিও লিখে ফেলি, লেখার অভ্যেসটিকে চালু রাখার জন্য। এতে ফাঁকিগুলো ধরা পড়ে না। এটাও লেখার একটা কৌশল! …
প্রভাত চৌধুরী পোস্টমডার্ন বাংলা কবিতায় ‘সাক্ষাৎকার ২৮’-এ লিখেছিলেন – “একটা ঝরনার সাক্ষাৎকার নেবার জন্য ঝরনার কাছে গিয়ে দেখি / সে আপনমনে সেলাই করে চলেছে তার প্রতিবেশীর বিয়ের পোশাক / সেলাইমেসিনের শব্দ দিয়ে রচিত হয়েছে ঝরনাতলা / ঝরনার কথা থেকে জানা গেল / যে কোনো সম্পর্কের মধ্যে সুতোর ভূমিকাটা বেশ মহান / সুতো দিয়ে একটা আলো এবং একটা অন্ধকারকে বাঁধা হয় / আর সেই বন্ধন থেকেই উঠে আসে / ‘দুপুর’ নামক একটি শীর্ণ নদী, ‘গোধূলি’ নামক সফল / গীতিনাট্যটি এবং ‘রাত্রি’ নামক এক বিলুপ্ত রাজধানী।” ৬০-এর দশকের কবি প্রভাত চৌধুরী স্বতন্ত্র ভাষা তৈরী করেছিলেন। 
২০০১ -এর পর কোনও এক সকালে প্রভাতদার ফোন, ততদিনে আমার বাসা বদল, চন্দননগরে থেকে কলকাতা। প্রভাতদা ‘কবিতা পাক্ষিক’ থেকে একটি কবিতার বই করার আহ্বান জানালেন। অনেক আলোচনা ইত্যাদির পর ‘কবিতা পাক্ষিক’ থেকে আমার প্রেমের কবিতার বই ‘অথবা ব্রহ্মকমল’ প্রকাশিত হয়েছিল ২০০৩ সালে, সেই বই পশ্চিমবঙ্গ বাংলা অকাদেমি থেকে অনিতা-সুনীলকুমার স্মৃতি পুরস্কার পেয়েছিল। সেই পুরস্কারের কৃতিত্ব কিন্তু প্রভাতদার, কেননা নেপথ্যে থেকে পুরো বিষয়টি তিনিই সামলেছিলেন, এমন কি কবিতাগুলোর নির্বাচনও।
দীর্ঘ অসুস্থতার পর প্রভাতদা চলে গেলেন। তাঁকে আমি আমার প্রণাম জানিয়ে তাঁরই একটি কবিতা নিচে দিলাম – 
আমি যে কান দিয়ে ‘আকাশভরা’ শুনি  / ওই কান দিয়েই ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ দেখি / ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ দেখার জন্য আলাদা কোনো কান নেই / আর ঠিক এই কারণেই আমার দ্যাখার মধ্যে / প্রবেশ করে ফুল ফোটার শব্দ / আমি সেই গন্ধ অনুভব করি কান দিয়ে / আর নাক-কে পাঠিয়ে দিই প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত সেমিনারে / কাজেই আমার দ্যাখার সঙ্গে অন্য ৫ জনের / দ্যাখার একটা মৌলিক পার্থক্য থেকেই যায় / আর দ্যাখার পার্থক্য থাকলে লেখারও

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments