জ্বলদর্চি

বিশেষ দিদৃক্ষা শ্যামলকান্তির আভিজাত্য /সুধীর চক্রবর্তী


বিশেষ দিদৃক্ষা শ্যামলকান্তির আভিজাত্য

সুধীর চক্রবর্তী

শ্যামলকান্তি দাশের নামের সঙ্গে তার কৃষ্ণকান্ত চেহারাটা মনে ভেসে ওঠে, সেইসঙ্গে তার সহাস্য সত্তা। নিজেকে সে তার কবিতায় আত্মপরিহাসের ছলে মেদিনীপুরিয়া বলে চিহ্নিত করেছে এবং রচনার মধ্যে সাবলীল অনায়াসে বহু গ্রামীণ শব্দ ও অনুষঙ্গ ভরে দিতে পারে। কিন্তু কিছুতেই সে আড়াল করতে পারে না তার অন্তর্লীন কবিতার দক্ষতা ও অন্তঃশীল আধুনিকতা। তার কবিতার প্রধান লক্ষণ হল নিজস্ব কবি ভাষার স্বাবলম্বিতা। তার কবিতা তাই কারোর মতো নয়, তার কারণ কবিতার স্বায়ত্ত দৃষ্টিকোণ তার সযত্ন অর্জন। তার জানা আছে :

এখনও দিনের শেষে গান হয়। ভাতের অপূর্ব গান। ব্যঞ্জনের
আরও আরও গান। 
দুয়ারে ধানের ছায়া। ধান গম। উড়ে চলো ও শ্যামল। আরও আরও 
পঞ্চাশ বছর।

এতো পঞ্চাশ বছরের জন্যে বাঁধা গান নয়, একে বলে শতঞ্জীব কবিতা—জরা মৃত্যুত্তীর্ণ। 

বরাবর শ্যামল ধরে থাকে যেন পরদেশি ভেক। এ জীবনে এ সমাজে দ্রষ্টার আগন্তুক বিস্ময়ে কত যে আবিষ্কার তার এবং ক্ষণে ক্ষণে। ভূতপ্রেত রাক্ষসেরা সেখানে কিলবিল করে কিন্তু তাতে কত যে মজা আর কী অবগাঢ় প্রতীকায়ন। সে দূরদেশি গেঁয়ো রাখালের ঢঙে মাত্রাছন্দে হাততালি দিয়ে গায় :

তোমাদের দেশে এত ধাঁধা মজা, এত প্ৰহেলিকা
গাছে পাকা পেঁপে, ফল খায় পাখি বিকেলবেলায়
চাষের জমিতে জল জমে আছে, এত আনন্দ 

আনন্দকে এত নিরায়োজনের মধ্যে খুঁজে পাওয়া এ তো সহজ সাধন নয়। কোন এক কবি যেন লিখেছিলেন :

 গাছে গাছে ফুল / ফুলে ফুলে অলি / সুন্দর ধরাতল'—শ্যামলকান্তি তেমনই এক শোভন সুন্দরের নান্দীপাঠ দিয়ে শুরু করে হঠাৎ দেখতে পায় মানুষের নিরবধি যাত্রাপথ। তার

চোখে ঘষা কাচ, হাতে ছাতা নেই, শূন্য মানুষ
মাঠপ্রান্তর পেরিয়ে এখন কোথায় যাচ্ছে
এত মেয়েছেলে, এত যৌনতা, সব ফেলেফুলে 
শূন্য মানুষ কাদা মাখা পায়ে কোথায় যাচ্ছে...

 সপ্রশ্ন এই দ্রষ্টা কবিতায় এরপর একটা পংক্তি বিরতি দিয়ে শেষ পংক্তিতে লেখে :

তোমাদের দেশে অবতরণের কী যে আনন্দ... 

আমার মতো যাদের বাউল গানের কথা প্রান্তরে একটু আধটু প্রবেশ ঘটেছে তাদের কাছে এদেশ ওদেশের গতায়াতে খুব একটা প্রহেলিকা খোঁজবার দরকার পড়ে না। মায়ের গর্ভকালে সেখানে আমরা থাকি উল্‌টো দেশে, তারপরে এই সাজানো জগতে অবতরণের পরে সব কিছু তেমন সোজা সহজ লাগে না। এই ঘটমান পৃথিবীর প্রত্যক্ষতার মধ্যে একজন প্রকৃত কবি দ্রষ্টার পরাদর্শন অর্জন করে খুঁজে পায় কি এক সানন্দ অস্তিত্ব। তখনই 'গাছ পেরিয়ে ফুল পেরিয়ে রাস্তা গেছে দূরে' সেটা টের পাওয়া যায় এবং বোঝা সহজ হয় যে,

বুকে পুরো একটা আকাশ চেপে
সন্ধ্যাবেলার পাখি বাড়ি ফিরছে।

শ্যামলকান্তি দাশ এখনকার বাংলা কবিতায় এক দৃঢ়প্রোথিত নাম, লিখছে বহুদিন থেকে, এবং কবিতা তার কাছে কখনই বিনোদনের মুখশ্রীতে ধরা দেয়নি। তার কবিজন্ম তাকে দিয়ে অনন্য মেধা ও দর্শনে ভরে যে একান্ত বিশ্বটি আড়ে আড়ে দেখিয়ে দিয়েছে তাকে প্রকাশক্ষম দ্যোতনায় ভরে দিতে শব্দ ও ছন্দে একপ্রকার নিরঙ্কুশ আধিপত্য অর্জন করতে হয় এবং সেই তার নিজস্ব কবিতার প্রাণ আবিষ্কার করতে পাঠককে বেশ খানিকটা পথ অতিক্রম করবার প্রয়াস লাগে। সেইসঙ্গে শ্যামলের কবিতার অন্তর্গত উপমা উৎপ্রেক্ষা জাতীয় অলংকৃতির গভীরে আশ্চর্য ঝলমলে এক সৃজনী আমাকে দিশেহারা করে দেয়। কত অনায়াসে শ্যামল লিখে দেয়: 'প্রবন্ধের মতো ভারী শক্ত গাছ।' তারপরে অন্য একটা লেখায় পাই : 

আমি আয়নার সামনে দাঁড়াই। হাতজোড় করি।
মাথা ঠেকাই আয়নার পায়ে।
আমার কবিতার মতোই সত্য আর পরিপূর্ণ এই আয়না। 

প্রবন্ধের মতো শক্ত গাছ আর কবিতার মতো সত্যতা—কথা দুটো আগে আমরা কোনো কবির কাছে শুনিনি। এবারে বুঝতে পারছি তার কবিতায় সত্য আর তার প্রতিবিম্ব যেন এক মায়াবি আয়নামহলকে মেলে ধরতে চায় পাঠকের কাছে। তাই বলে পরিপার্শ্ব জীবনের সবকিছু তো সম্মোহনকারী হতে পারে না। কবিকে মনে রাখতে হয় যে,

দু-একটা সংঘর্ষ না হলে
জীবনকে ঠিক জীবন মনে হয় না।

এবং

সত্যিকারের দু-একটা ঢেউ চিনে রাখা দরকার

এর পিঠোপিঠি কবির খেয়াল থাকে যে যারা পাহারা দেয়, যারা আকাশে যায়, যারা সমুদ্রে যায় তাদের সবকিছুকে আমরা সামলে রাখব, তারিফ করব, কিন্তু এও মনে হয়,

আমরা যারা জঙ্গলে রয়ে গেলাম,
পায়ে পায়ে উলটে যাওয়া বেচারা,
কাঁটাগাছের মতো দুঃখী,
খেলার মাঠের মতো অভাগা,
আমাদের কী হবে? আমাদের কী হবে?
কাঙালের মতো দীনহীন,
 আমাদের কী হবে? আমাদের কী হবে?

এ প্রশ্নের সমাধান বড় অপরূপ। জঙ্গলের কাঠ চেরাইয়ের শব্দ, হাতির বৃংহণ, আমাদের ঘুমচোখ আর লণ্ঠনের আলো যেমন আমাদের লক্ষ্য রাখবে তেমনই আমরা পাহারা দেব ‘জীবনের পর জীবন' ধরে ঐ জঙ্গলের দুঃসাহসকে। এমন নিরুপাধি কবিই কেবল বলতে পারে: 'আমাদের বাড়িঘর একেবারে পাখির মতন / ঠোঁটে করে আকাশ উড়িয়ে এনে ভেঙে পড়ে মাঠে'।

  শ্যামলকান্তির কবিতার একটা বড় লক্ষণ ব্যাপ্তিবোধ। পরিচিত ভূভাগের প্রায় সবটাই তার অধিগত তাই লিখতে পারে,

মাটির ভিতরেও অদ্ভুত একটা কান্না আছে,
সারাদিন গুমরে গুমরে ওঠে।
সেই কান্না তুলে এনে একদিন
 ঘরে, রামায়ণ মহাভারতের পাশে সাজিয়ে রাখি। 

অন্তদর্শী বলেই কবির কানে এ-কান্না ধরা পড়ে এবং তার চেতনা সারদর্শী বলেই সেই কান্না মর্যাদাবান গোত্র পায়। কিন্তু দুঃখ এটাও যে ব্যাপ্তি বা প্রসারণের হাতছানি আমাদের গড়পড়তা জীবনকে টানতে পারে না। ভাবতে তাই এই সৎকবির ক্ষোভ যে,

এত রাস্তা এত সুড়ঙ্গ এত বাঁক – কেন আমরা
 বৃত্ত আর বলয়ের মধ্যে আটকে রইলাম।

যদি তা না হত, যদি যথার্থ পর্যটনের প্রণালী আমরা আয়ত্ত করতে পারতাম তবে পরাদৃষ্টিতে দেখতে পেতাম এমন এক চমকপ্রদ দেশ, যেখানে –

পুকুরের জলের মতো টলমল করছে নীল
কিন্তু শরৎকাল অনেক দূরে।
শীত এলেও পাতা ঝরছে না।
... করুণসুরে অন্ধকার বেজে উঠছে।

এই কবির পক্ষে সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হল নিজস্ব কবিভাষা অর্জন শুধু নয়, সেই ভাষায় পাঠককে অভ্যস্ত করে যেন হাতে ধরে নিয়ে যাওয়া অভিনব কবিতাদেশে যা অনাবিষ্কৃত, অথচ ঝলমলে ভাবময়। যেখানে এমনকি,

ভাতের গরম ভাপে টসটস করে ওঠে।
কাঙালের জিভ

আমরা জানতে পারব মনখারাপ করা চৈত্রমাসে সবদিক যখন খটখটে আর অন্ধকার।তখনও

কিন্তু গভীর রাত্রিতে যদি মশারি থেকে মুখ বার করে
একটু জানলার বাইরে তাকাও
দেখবে ছোটো শহর তোমার চোখে চোখ রেখেছে!
তোমার হাতের কাছে অপরূপ ফর্সা একটা আকাশ
নেমে এসেছে, মুখে পড়েছে অন্যরকম আলো !

এই অন্যরকম আলোর পিপাসাই তো প্রকৃত শুদ্ধ কবির অন্বিষ্ঠ। শ্যামলকান্তির কবিতার স্নিগ্ধ সম্পন্ন অঙ্গন এক অপার্থিব চাঁদের আলোয় মুখরিত। 'সঙ্গম সর্বস্ব বিছানা' ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে পারলে পাঠকরাও শ্যামলের চোখের মতো স্বচ্ছন্দে আবিষ্কার করতে পারবেন কত কত 'গোধূলি মনোহর ছেলেমেয়ে'দের। দেখতে পাবেন ‘ফুলের বাতাস' 'আকাশের তন্দ্রা' আর 'গাছপালার শ্যামল আলো' ভরা আশ্চর্য জগৎ! 

 পিপড়ের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে শ্যামল একবার লিখেছে : ‘পিপড়ের মৃত্যু নেই / পিঁপড়ের আরেক নাম অবিনাশ'। এর পরের কথাটি, বরং বলা যাক অবলােকনটুকু, রীতিমত অভাবনীয় ।

মদ মাংস এবং রমণীকে পিঁপড়ে
কোনােদিন স্পর্শও করে না। 

এবারে কবির বয়ানে জানা গেল অবিনাশিতার মূল তত্ত্ব। সভ্যতার আদিকাল থেকে মানুষের যে বৈনাশিক পরম্পরা তার মূলে এই তিন জাগতিক উপাদান – মদ মাংস নারী। এ কথা মনে রেখে শ্যামলকান্তির একটি মিতায়তন দ্যোতক কবিতা সামনে আনব। সেটি : -

টাকা মাটি। মাটি টাকা। অঢেল অজস্র টাকা। কাকে দেব এখনও ভাবিনি। 
অপূর্ব কাঠাল বনে কাকচক্ষু সরােবর। প্রাণাধিক ছেলেমেয়ে পাবে। 
সােনা ফলাবার জন্য দু’কাঠা পতিত জমি প্রিয়তমা তােমাকে দিলাম।
তুমি ক্ষুদ্র পিপীলিকা। চিরজীবিতেষু। সংসারের নাট্যরস চেটে পুটে খাবে। 

মৃত্তিকাসাৎ হবার ভবিতব্য ভরা যে-বৈভব আর পিপীলিকাভুক সুতমিত রমণী সমাজে যে জীবন কুনাট্য রঙ্গ শ্যামলকান্তি নিপুণ লেখনীর সারাৎসারে এখানে উপস্থাপন করেছে তা অনবদ্য।

তাই বলে এই কবি সমকালীনতাকে এড়িয়ে যে যায়নি তার কিছু পরিহাসদ্রব উদাহরণ সতর্ক পাঠকের চোখ এড়াবে না। যথা :

ছবিতে গল্প কবিতা      ছবিতে সত্যকাহিনি 
ছবিতে দুর্গা নয়ছয়      ছবিতে ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী। 
ছবিতে জনতা ঝলমল      মানবাধিকার আসছে। 
নারী মুক্তির বন্যায়      বড়খুকুরাও ভাসছে 
ছবিতে মৈত্রী মজবুত      মিলে জুলে আছে ভাইবােন। 
হাতে হাত ধরে হাঁটছে      ত্রিভুজ বৃত্ত সমকোণ। 
ছবিতে আকাশ আয়না      দূষণমুক্ত পরিবেশ
বহুতল ভাঙে দুদ্দাড়      লেখা সমাপ্ত, ছবি শেষ। 

হালের ভিস্যুয়াল কালচারের বাড়াবাড়ি আর দূরদর্শিতার বােকা বাক্স নিয়ে এখন ক্রিটিক তেমন আর কই বাঙালি কবিসমাজে?

তবে এ সব কূটকচাল নিরিখের বাইরে রেখেও শ্যামলকান্তির কবি সত্তার অবয়ব খুঁজে নেওয়া কঠিন নয়। তার কিছু বচন অবিস্মরণীয়তার মর্যাদা পাবে। যেমন :
মৃত্যুর বিরুদ্ধে তুমি আরও মৃত্যু,
মানুষ অমর। 

গভীর পুকুরদিনের কাকচোখ জল ডিঙিয়ে অসীম অতল জীবনকে খোঁজে এই কবি। জলােচ্ছল তার ভাবনা পরিধির স্বচ্ছতা এতটাই যে সে উচ্চারণ করে :
জলের অধিক জলে দেখলাম দু-চারটি মােহন ফাটল।

এই বিশেষ দিদৃক্ষা শ্যামলকান্তির আভিজাত্য।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

1 Comments

  1. খুব ভালো আলোচনা। সমৃদ্ধ হলাম।

    ReplyDelete