জ্বলদর্চি

ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা -৬৬



সম্পাদকীয়,
ছোটোবন্ধু ঋতুজার হাতে ওটা কি, জিগ্যেস করতেই ও কি বলল জানো? -এ মা জানো না আজ টুসু উৎসব! - হ্যাঁ, জানি তো, টুসু উৎসব বা মকর পরব একটি লোকউৎসব, যা বাংলা অগ্রহায়ণ মাসের শেষ দিনে শুরু হয় আর শেষ হয় পৌষ সংক্রান্তি বা মকর-সংক্রান্তির পূণ্যলগ্নে। টুসুকে নিয়ে অনেক গান, গল্প, মূর্তি গড়া, মেলা, হয় অনেক জেলায়। রাকেশ আঙ্কেল এই উৎসবের ছবি তুলে পাঠিয়ে আমাদের বারো মাসের তেরো পার্বনের কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন। কি এবার তোমরা মানবে তো,  যে মকর কেবল পিঠে খাবার উৎসব নয়? মকর উৎসব নিয়ে পড়ে নাও তোমাদের বন্ধু রেনেসাঁর অপূর্ব ছড়া। ও হ্যাঁ  সবে সবে বিবেকানন্দের জন্মদিন গেল। তাঁকে স্মরণ করে তোমরা যারা ছবি পাঠিয়েছো তাদের অনেক আদর। শুধু বিবেকানন্দ নয় আশাপূর্ণা দেবীরও জন্মদিন গেল, সে কথা আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন পীযূষ আঙ্কেল। আর সুমেধা আন্টির ভূতের গল্পটা পড়ে কেমন লাগল জানিও কিন্তু। তোমরা আমাকে জানানোর আগে পড়ে নিও সুদীপ্ত আঙ্কেলের ছড়ায় মিঠির চিঠি। কাকে চিঠি দিল মিঠি? ছড়া পড়ে জেনে নিও। বাসবদত্তা আন্টির বেড়ানোর গল্প তোমাদের কেমন লাগছে? সবশেষে যেটা আজ বলবনা ভেবেছিলাম,  কিন্তু না বললেও হবে না তা হল এই সংখ্যায় শেষ হয়ে যাচ্ছে 'ফুলকুসুমপুর খুব কাছে'।  বিলম্বদাদু এসেছে। অনিচ্ছে ঠাকুমার পাখিটা কথা শিখেছে.। বলছে ' মাস্ক পরুন' আর কি চাই! মন খারাপ সত্ত্বেও অপেক্ষা কর নতুন উপন্যাসের জন্য। নতুন মানেই আনন্দ। আর তোমাদের হয়ে রতনতনু জ্যেঠুকে আমি প্রণাম জানিয়ে দিলাম। এবার চলো বাসী পিঠেগুলো খেয়ে শেষ করে ফেলি।   - মৌসুমী ঘোষ।


আজ মকরের দিন 

রেনেসাঁ গঙ্গোপাধ্যায় 
সপ্তম শ্রেণী, স্যাক্রেড হার্ট স্কুল, আদ্রা, পুরুলিয়া

ভোরে উঠে ওই দোয়েল পাখিটি
কাঁপছে সে খুব শীতে
কেউ তো বলেনি - আয় কাছে বোস
খেতে দিই তোকে পিঠে। 

পিঠে নাই থাক তবুও পরব  
মকরের দিন আজ 
স্নান করে এসে পাখিটি দেখছে
প্রকৃতির নব সাজ।


ফুলকুসুমপুর ৩১ ( শেষ পর্ব)

রতনতনু ঘাটী


আজ দু’দিন হল ফুলকুসুমপুর গ্রামীণ কৃষিমেলা শেষ হয়ে গেছে। ছুটির পর এখনও আশপাশের গ্রামের স্কুলের ছেলেমেয়েরা আর মানুষজন চলে আসছে ত্রিপাঠীবাড়ির হযবরল চিড়িয়াখানা দেখতে। তারা কেউ কুমির জন্যে আনছে নরম ঘাস, রাধাগোবিন্দর জন্যে কেউ পাকা পেয়ারা, বিংগোর জন্যে ভাল-ভাল বিস্কুট। কেউ আবার বাড়ি থেকে মাকে দিয়ে মিঁউয়ের জন্যে ছোট-ছোট মাছ ভাজা করে নিয়ে আসছে। পরিপালনকাকু দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে সেসব তদারক করছেন। সকলকে সেসব দিতে নিষেধ করছেন।

   সকালেই পরিপালনকাকু কোথা থেকে একটা সাদা বোর্ডের উপর লিখে এনেছেন ‘কেউ পশুপাখিকে বাড়ি থেকে আনা খাবার দেবেন না।’ সে বোর্ডটা তিনি টাঙিয়ে দিয়েছেন ঠিক বিংগোর খাঁচার সামনে। কেননা, বিংগোটা বড্ড খাই-খাই করে কিনা! 

   লোকজন এলে যদিও চিড়িয়াখানার সমস্ত মেম্বারকে ভরে দেওয়া হয় একটা ঘরের ভিতর। সে ঘরের ভিতরে বাইরে থেকে আসা দর্শকদের কারও ঢোকার পারমিশন নেই। এমন নিয়ম তৈরি করে দিয়েছেন ইচ্ছেদাদু। দর্শকদের কাউকে কাছে ঘেঁষতে দেওয়া হয় না।

   একটু দূরে পরিপালনকাকা একটা চেয়ার নিয়ে বসে থাকেন। সে ঘরের ভিতর তিনি বিলম্বদাদুকে নিয়ে দু’-তিনটে বাঁশ দড়ি দিয়ে বেঁধে  দোলনা বানিয়ে নিয়েছেন। লোকজনের আসা শুরু হয়ে গেলে রাধাগোবিন্দ মনের আনন্দে এ দোলনা থেকে ও দোলনায় ওড়াউড়ি করে, দোল খায়। আর সুযোগ পেলেই বুম্বার শিখিয়ে দেওয়া দু’-তিনটে কথা মাঝে-মাঝে দর্শকদের শুনিয়ে দিতে ছাড়ে না। সে কথা তিনটে হল---‘হ্যালো!’, ‘কেমন আছেন’, ‘মাস্ক পরুন!’ ‘মাস্ক’কথাটার মধ্যে যুক্তাক্ষর আছে এবং শব্দটা ইংরেজি বলে কিনা কে জানে! রাধাগোবিন্দ এখনও ভালভাবে ওই শব্দটা উচ্চারণ করতে পারে না। তবু দূর থেকে শুনলে মনে হয়, রাধাগোবিন্দ যেন ঠিকই বলছে।

   অনিচ্ছে ঠাকুরমা রাধাগোবিন্দর ‘মাস্ক পরুন’ কথাটা শুনলেই বাড়ির সকলকে ডেকে-ডেকে বলতে শুরু করেছেন, ‘দেখেছ, আমার রাধাগোবিন্দর উচ্চারণ কত সুন্দর! রাধাগোবিন্দ এখন ইংরেজিও বলতে শিখে গেছে!’

   ইচ্ছেদাদু হঠাৎ ঠাকুরমাকে রাগিয়ে দেওয়ার জন্যে বললেন, ‘দ্যাখো অনিচ্ছে, তোমাকে একটা কথা বলি--গাধাকে যেমন পিটিয়ে ঘোড়া বানানো যায় না, তেমনি তোমার টিয়াপাখিকে তুমি যতই বলো ও হীরামন পাখি, ও কিন্তু আসলে একটা বুনো টিয়াপাখি। কতদিন হল আমাদের বাড়িতে আছে তোমার আদর-যত্নে। এমনকী, তুমি সাধ করে ওকে ‘বিশালক্ষ্মী স্টোর্স’-এর সোনার দোকান থেকেএকটা সোনার শেকল কিনেও দিয়েছ! তবু এখনও কিন্তু ও একটা কথাও বলতে শেখেনি!’

   ঠাকুরমার গলা হঠাৎ অভিমানে বুজে এল, ‘তুমি আমার রাধাগোবিন্দর যতই নিন্দে করো না কেন, টিভির খবরে তো দেখিয়েছে যে সে একটা জিনিয়াস কথা-বলা পাখি! গোটা দেশের লোক সে খবর দেখেছে! এখনও কাতারে-কাতারে লোক আসছে আমাদের বাড়িতে চিড়িয়াখানা দেখতে, রাধাগোবিন্দকে দেখতে। সে কি এমনি-এমনি?’

   বিন্নি কাছেই দাঁড়িয়েছিল। ঠাকুরমার কথায় সায় জানিয়ে দাদুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘দাদু, রাধাগোবিন্দ কিন্তু কথা-বলা পাখি, হোক না সে টিয়াপাখি! কথা বলতে তো শিখছে!’

   গোটা বাড়ির মধ্যে ইচ্ছেদাদু বিন্নির মতামত চট করে ফেলে দেন না। এর একটাই কারণ, বিন্নি স্কুলের কুইজ কম্পিটিশনে সব সময় ফার্স্ট হয়। এ নিয়ে দাদুর গর্বও কম নয়। দাদু বিন্নির কতায় সায় দেওয়ার ভঙ্গি করলেন। 

   বুম্বা রাধাগোবিন্দর কথা-বলা শেখানোর ট্রেনার। দাদুর কথাটা তারও গায়ে লাগল এসে। সে বলল, ‘দাদু, আমি তো ওকে কথা-বলা শেখাই! আমি লক্ষ করে দেখেছি, ও কতটা কথা বলতে পারে সেটা নয়। তবে আমি কিছু শেখাতে গেলে ও কিন্তু মন দিয়ে শোনে। মনে রাখারও চেষ্টা করে!’

   ঠাকুরমা চোখ তুলে তাকালেন সকলের দিকে। তারপর দাদুর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তুমি যতই নিন্দে করো, আমার রাধাগোবিন্দর জন্যে  আমি এবারের শীতে একটা উলের সোয়েটার বানিয়ে দেব। আমি বিলম্বকে দিয়ে তেপান্তরের হাট থেকে উল কিনিয়ে আনব সামনের হাটবারের দিন।’

   এমন সময় কোত্থেকে হন্তদন্ত হয়ে বাড়ি ফিরল বিলম্বদাদু। অনিচ্ছে ঠাকুরমার কথা তার কানে গিয়েছিল। সে চেঁচিয়ে বলল, ‘আমার হাতে বড়মা তেপান্তরের হাটে যাওয়ার মতো সময় নেই! আমার হাতে এখন মেলা কাজ!’

   ইচ্ছেদাদু কড়া গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোর হাতে কী এমন মহাকাজ পড়েছে শুনি? মুখের উপর বলে দিলি তুই বড়মার আহ্লাদের কাজটা করে দিতে পারবি না?’

   বিলম্বাদাদু দাদুর কথায় তেমন করে জোর দিল না। গলায় ভারীক্কি ভাব এনে বলল, ‘আমি এখন বুম্বা, তিন্নি আর বিন্নিকে নিয়ে একটা জরুরি কাজে বসব। তিন্নিদিদিরা, তোমরা আমার সঙ্গে পড়ার ঘরে এসো তো, বলছি।’ বলে নিজেই হনহন করে পড়ার ঘরে গিয়ে ঢুকল।

   দাদু মুচকি-মুচকি হেসে বললেন, ‘আশ্চর্য এই পাগল মানুষটা!’ তারপর তিন্নির বাবা, গল্পকাকা আর শুধুকাকার দিকে তাকিয়ে চোখ ঘুরিয়ে নিয়ে বললেন, ‘তোদের সেই কবিতাটা মনে পড়ে রে? সেই যে---‘স্পর্ধা তাহার হেনমতে আর কত বা সহিব নিত্য/ যত তারে দুষি তবু হনু খুশি হেরি পুরাতন ভৃত্য!’

   অমন সময় সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠছিলেন বিপদভঞ্জনস্যার। দাদুর আবৃত্তি করা কবিতার খেই ধরে বললেন, ‘কী ব্যাপার ইচ্ছেপ্রসন্ন! সকালেই রবীন্দ্রনাথের কবিতা নিয়ে পড়লে যে বড়? ও তো রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত কবিতার লাইন---‘পুরাতন ভৃত্য’। ঠিক বললাম কি?’

   দাদু তারিফ করে বললেন, ‘একশো ভাগ ঠিক! এই আমাদের বিলম্বকুমারের কথা বলছিলাম!’ বলে দাদু খিলখিল করে হেসে উঠলেন, ‘ওর কথা কবেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবিতায় লিখে গেছেন।’

   ছোটরা চলে গেল পড়ার ঘরে বিলম্বদাদুর ডাকে। দোতলার বারান্দায় সকালবেলার আড্ডা জমে উঠেছে। গল্পকাকা দাদুকে বললেন, ‘বাবা, কাল কলকাতা থেকে অনন্ত দণ্ডপাট আমাকে ফোন করেছিলেন। তিনি বললেন, কলকাতায় পথকুকুরদের নিয়ে এক আলোচনা সভায় বক্তা হিসেবে তিনি আমাকে পেতে চান।’

   দাদু চশমার উপর দিয়ে তাকিয়ে জানতে চাইলেন, ‘তিনি কে?’

   গল্পকাকা নিজের কপালে চাঁটি মেরে বললেন, ‘উঃ বাবা! তুমি সব ভুলে গেলে? উনি কলকাতার ‘পশুক্লেশ নিবারণী সমিতির’ সেক্রেটারি। আমি তো ওই সমিতির মেম্বারশিপ নিয়েছি। আমাদের হযবরল চিড়িয়াখানার খবর উনি টিভিতে দেখেছেন। তাই তড়িঘড়ি এরকম একটা আলোচনাসভার আয়োজন করে ফেলেছেন।’

   ‘তা বেশ তো! কবে?’

   ’এ মাসের পনেরো তারিখে।’

   ‘তা, যেওখ’ন!’

   বিপদভঞ্জনস্যার বললেন, ‘তুমি তো মাঝে-মাঝেই এসব অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে যাও? খুব ভাল কথা!’

   ততক্ষণে পড়ার ঘরে হুলুস্থুল কাণ্ড শুরু হয়েছে। বিলম্বদাদু একটা বড় পিসবোর্ড জোগাড় করে এনেছে। বিন্নিকে বলল, ‘বিন্নিদি, তুমি গোট-গোট অক্ষরে এই বোর্ডের উপর লিখে দাও তো---‘হযবরল চিড়িয়াখানা দেখতে হলে বাস থেকে এখানে নামুন!’ তার নীচে সাইনবোর্ড লেখার মতো বড় বড় অক্ষরে করে লিখে দাও---‘ফুলকুসুমপুর খুব কাছে!’ তার নীচে একটা তীরচিহ্ন এঁকে আমাদের বাড়ির দিকে ঘুরিয়ে দাও তো দিদি!’

   তিন্নি লিখতে শুরু করে দিল বিলম্বদাদু নির্দেশ মতো। একটু পরে জিজ্ঞেস করল, ‘এটা লিখে কী হবে দাদু?’

   বুম্বাও কিছু বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করল, ‘এ দিয়ে কী হবে গো বিলম্বদাদু?’

   বিলম্বদাদু বলল, ‘তোমরা নৈবেদ্য স্কুলে পড়ো! এটা কী কাজে লাগবে বুঝতে পারছ না? বাস রাস্তা থেকে আমাদের ফুলকুসুমপুর গ্রামে ঢোকার মুখে পিচ রাস্তার উপর একটা লম্বা খিরিশ গাছ আছে না? সে গাছের  গায়ে দড়ি দিয়ে বেঁধে দেব বোর্ডটা, যাতে সকলের চোখে পড়ে।’

   বুম্বা বলল, ‘গাছের গায়ে পেরেক পুঁতে অনেকে তো নানারকম বোর্ড লাগিয়ে দেয়। আমরা সেরকম করতে পারি না?’

   বিন্নি মুখ বাঁকিয়ে বলল, ‘না, পারি না! মানুষের গায়ে কাঁটা ফোটালে যেমন কষ্ট হয় মানুষের, গাছের গায়েও অমন করে পেরেক পুঁতলে গাছেরও কষ্ট হয়। আমাদের ক্লাসের তনিমামিস সেদিন ক্লাসে বলেছিলেন।’

   বিলম্বদাদু কী বুঝল কে জানে। বেশ বিজ্ঞ-মুখে মাথা নেড়ে বিন্নির কথায় সায় দিল। বিন্নি সেই সাইনবোর্ডে লেখাটা সুন্দর হস্তাক্ষরে লিখে ফেলল। এবার তিন্নি সে লেখার উপর ড্রয়িং ক্লাসের ওয়াটার কালারের প্যালেট থেকে রং নিয়ে তুলি দিয়ে বুলিয়ে-বুলিয়ে মোটা করতে লাগল। বুম্বা কোত্থেকে খানিকটা শক্ত দড়ি খুঁজে আনল।

   ততক্ষণে অনিচ্ছে ঠাকুরমার গলা শোনা গেল, ‘ছোটরা সকলে ব্রেকফাস্ট খেতে চলে এসো!’

   বিলম্বদাদু ছোটদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘চলো, আমরা ব্রেকফাস্ট খেয়েই বেরিয়ে পড়ব পিচ রাস্তার দিকে।’

   ইচ্ছেদাদু আর বিপদভঞ্জনস্যার এখন জমিয়ে নিজেদের ছেলেবেলার গল্পে মশগুল হয়ে উঠলেন। শুধুকাকা আর গল্পকাকা এবং তিন্নির বাবা ব্রেকফাস্টের পর কোথায় যেন বেরিয়ে গেলেন। বিলম্বদাদু দড়ি, ছুরি আর সাইনবোর্ডটা নিয়ে হনহন করে হেঁটে চলল পিচ রাস্তার দিকে। তার পিছন-পিছন তিন্নি, বিন্নি আর বুম্বা! যেন একটা চমৎকার শোভাযাত্রা চলেছে। যাওয়ার সময় বিলম্বদাদু অনিচ্ছে ঠাকুরমাকে শুধু বলে গেল, ‘আমি তিন্নিদের নিয়ে একটা কাজে বেরোচ্ছি বড়মা!’

   পিচ রাস্তার ধারের খিরিশ গাছটা ভাল করে দেখে নিল বিলম্বদাদু। তারপর বিন্নিকে বলল, ‘জানো তো বিন্নিদি, এটাই খিরিশ গাছ। আমি গাছ বেয়ে উপরে উঠছি। তিন্নিদি, আমি যখন যা চাইব, তুমি তুলে-তুলে দিও আমার হাতে। বিন্নিদি, তুমি খানিক দূরে গিয়ে দেখে বলবে তো, বোর্ডটা সোজা করে টাঙানো হয়েছে কিনা। আমি তো গাছ থেকে দেখে বলতে পারব না। আর বুম্বা, তুইও বিন্নিদির পাশে গিয়ে দাঁড়া! তোর আবার সোজা-জ্ঞানটা অনেকের চেয়ে বেশি ভাল।’

   চোখের পলকে বিলম্বদাদু খিরিশ গাছ বেয়ে কিছুটা উপরে উঠে গিয়ে তিন্নির হাত থেকে সাইনবোর্ড আর দড়ি চেয়ে নিল। তারপর দু’ হাতে গাছটাকে পেঁচিয়ে ধরে দড়ি জড়িয়ে সাইনবোর্ডটা বাঁধতে-বাঁধতে বিলম্বদাদু চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘বিন্নিদি, দ্যাখো তো, সোজা হল কিনা!’

   বুম্বা গম্ভীর গলায় বলল, ‘দাদু, বাঁ দিকে আর একটু উঁচু করো!’

   বিন্নি বুমবার কথার প্রতিবাদ করল, ‘না গো দাদু, একদম ঠিক হয়েছে। পারফেক্ট!’

   বুম্বা খানিকটা দমে গেল। অগত্যা সায় দেওয়ার ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। তিন্নি বলল, ‘দাদু, আর একটু রাস্তার দিকে ঘুরিয়ে দাও। তবে তো লোকের চোখে পড়বে।’

   বোর্ডটা বেঁধে বিলম্বদাদু নেমে এল গাছ থেকে। গাছের দিকে দেখে নিয়ে বলল, ‘বেশ হয়েছে! এবার দূর থেকে যারাই আসবে, তাদের আর কাউকে জিজ্ঞেস করতে হবে না—‘ওই যে গো, যে গ্রামের একটা বাড়িতে পাখি, বিড়াল, কুকুর আর খরগোশ একসঙ্গে ঘরের ভিতর ছাড়াই থাকে মানুষের মধ্যে, সেই ফুলকুসুমপুরটা কত দূর? এবার থেকে সাইনবোর্ডের লেখাটা পড়েই বুঝে যাবে তারা যে, ফুলকুসুমপুর খুব কাছে।’ তারপর বুম্বার দিকে মুখ তুলে বিলম্বদাদু জিজ্ঞেস করল, ‘বল বুম্বা, এটা ভাল হল না? চল এবার বাড়ি যাই!’

   গ্রামের লোকজন যারা বাসরাস্তায় এল তারা দাঁড়িয়ে মুখ তুলে দেখতে লাগল। দু’-একজন ভিন গ্রামের মানুষও তাদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে পড়ল। বিলম্বদাদু কিছুটা আসার পর পিছন ফিরে দেখে নিয়ে বলল, ‘জানিস বুম্বা, এটা দেখলে ইচ্ছেদাদু বড় খুশিই হবেন!’

   ও মা! দাদুর খুশি হওয়া তো দূরের কথা, ইচ্ছেদাদু রাগে কখন থেকে গরগর করছিলেন। বিলম্বদাদুকে বাড়িতে ঢুকতে দেখে গর্জন করে উঠলেন, ‘ছোটদের লেখাপড়া নেই? তুই এদের নিয়ে কোথায় গিয়েছিলি? পাজি কোথাকার! সারাক্ষণ কাজে ফাঁকি দিয়ে বেড়াস! তোকে দরকারের সময় কক্ষনো পাই না। যা, এ বাড়িতে তোকে আর থাকতে হবে। যেদিকে যাওয়ার চলে যা! আমি যেন তোকে এ বাড়িতে আর দেখতে না পাই!’ 

   ইচ্ছেদাদুর অমন উচ্চকিত গলা শুনে অনিচ্ছে ঠাকুরমা, মাধুরীজেম্মা, করবীকাকি আর বকুলকাকি রান্নাঘর থেকে ছুটে এলেন। পরিপালনকাকা ছুটে এলেন হযবরল চিড়িয়াখানার সামনে থেকে। দাদু রাগের চোটে থরথর করে কাঁপছেন। বুম্বা দাদুর কাছে গিয়ে তাঁর হাতটা চেপে ধরল। বিন্নিদিও দাদুকে জড়িয়ে ধরল। 

   অনিচ্ছে ঠাকুরমা আকুল গলায় বলে উঠলেন, ‘আহা, তুমি একটু শান্ত হয়ে বোসো তো! অত রেগে যাচ্ছ কেন?’

   বিলম্বদাদু ছলছল চোখে তাকাল ইচ্ছেদাদুর দিকে। তারপর ধীর পায়ে ঘরের ভিতর চলে গেল। একটু পরে বেরিয়ে এসে একটা কাগজে মোড়া প্যাকেট বুম্বার হাতে দিয়ে বলল, ‘বুম্বা, এটা তোর বইয়ের তাকে রেখে দে। সরস্বতী পুজো এলে তখন এটা বড়মার হাতে দিস!’

   বলেই সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে গেল বিলম্বদাদু। সকলেই ব্যস্ত ইচ্ছেদাদুকে নিয়ে। করবীকাকি মাথার উপরের ফ্যানটার স্পিড বাড়িয়ে দিলেন। বিপদভঞ্জনস্যার ব্যস্ত গলায় বললেন, ‘আমি ডাক্তারবাবুকে ডেকে আনছি এক্ষুনি!’

   পর পর শুধুকাকা, গল্পকাকা আর তিন্নির বাবাও ছুটে এসেছেন কারও মুখে ইচ্ছেদাদুর অসুস্থতার খবর শুনে। ততক্ষণে দাদু কিছুটা সুস্থ হয়ে সোজা হয়ে চেয়ারে বসেছেন। ঠাকুরমা দাদুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। তক্ষুনি ডাক্তাবাবুও এসে গেলেন। দাদুকে পরীক্ষা-টরিক্ষা করে বললেন, ‘না। চিন্তার কিছু নেই!’

   গোটা ত্রিপাঠীবাড়িটা ততক্ষণে যেন শান্ত হল। হযবরল চিড়িয়াখানার মেম্বাররা সকলেই আচমকা থম হয়ে গিয়েছিল। এবার সকলের আগে রাধাগোবিন্দ ‘ট্যাঁ-ট্যাঁ’ করে কী যেন বলে উঠল। দূর থেকে মিঁউ দাদুর দিকে তাকিয়ে ‘ম্যাঁও-ম্যাঁও’ করে বুম্বাদের পড়ার ঘরের দিকে হাঁটা দিল। বিংগো ‘ভৌ...’ করে ডেকে চুপ করে গেল। আর কুমি চোখ পিটপিট করে চারদিক দেখছিল। ধীর পায়ে সে নরম ঘাসের লোভে পরিপালনকাকার পায়ের কাছে ঘুরঘুর করতে লাগল।

   এসব হতচকিত কাণ্ডে দুপুরবেলার রান্নার বড্ড দেরি হয়ে গেল। ঠাকুরমা কিন্তু ইচ্ছেদাদুর কাছ থেকে নড়লেন না। চুপ করে বসে থাকলেন। শুধুকাকাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তোরা একবার খুঁজে দ্যাখ তো, বিলম্ব বকুনি শুনে রাগ করে মনে হয় কোথাও চলে গেল!’

   ইচ্ছেদাদু অভিমানী গলায় বললেন, ‘আমি এমন কী আর বকেছি যে মহাপুরুষকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হল? যাক, যেদিকে খুশি। সময় হলে ঠিক ফিরে আসবে!’

   সকলের টনক নড়ল যেন। কুয়াশামাসি বাড়িতে ঢুকে বিলম্বদাদুর খবর শুনে বলল, ‘ও বড়মা, আমি তো বিলম্বদাদুকে দেখলাম ফতুয়া গায়ে, কাঁধে লাল গামছাটা ফেলা, হনহন করে বাস রাস্তা ধরে তেমোহানি নদীর খেয়াঘাটের দিকে যাচ্ছে। আমি জিঞ্জেস করলাম, ‘দাদু, কোথায় চললে গো?’ কোনও উত্তরই দিল না।’

   শুধুকাকা, গল্পকাকা আর তিন্নির বাবা, সকলে একসঙ্গে বলে উঠলেন, ‘তাই নাকি? চলো তো দেখি!’ বলে সকলে বিলম্বদাদুকে খুঁজতে বেরিয়ে পড়লেন। তাঁদের দেখে দাদু বললেন, ‘দাঁড়া, তোদের সঙ্গে আমিও বিলম্বকে খুঁজতে যাব!’ ইচ্ছেদাদু চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন।

   অনিচ্ছে ঠাকুরমা বললেন, ‘না না। তোমাকে আমি যেতে দেব না!’

   দাদু বললেন, ‘না গো, অনিচ্ছে! আমার বকুনি শুনে রাগ করেছে বোধ হয়। কতদিন বেচারা আমাদের বাড়িতে আছে। বকলে কি চলে? যাই, বিলম্বকে খুঁজে আনি!’

   ’তুমি সত্যিই যদি যাও, তবে এই শরীর নিযে তোমাকে আমি একা যেতে দেব না। আমিও সঙ্গে যাব।’

   ঠাকুরমার কথা শুনে বুম্বা, তিন্নি আর বিন্নিও বেরিয়ে পড়ল বিলম্বদাদুকে খুঁজে আনতে। সকলে যখন তেমোহানি নদীর খেয়াঘাটে পোঁছল, তখন শেষ খেয়াও ছেড়ে ভেসে গেছে মাঝনদী পেরিয়ে। চারদিকে তাকিয়ে ইচ্ছেদাদু উদাস গলায় বললেন, ‘জানো অনিচ্ছে, বিলম্ব মনে হয় শেষ খেয়ায় চড়ে চলে গেল!’

   দূরে একটা ঝাঁকড়া বটগাছের ছায়া দুপুরের রোদ মাথায় নিয়ে খুব ছোট হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ বুম্বা চেঁচিয়ে উঠল, ‘দাদু, ওই তো মনে হয় বিলম্বদাদু বটগাছের শিকড়ের উপর বসে আছে!’

   সকলেই দেখলেন, দূরে মাথা ঝুঁকিয়ে দু’ হাঁটুর উপর মাথা রেখে বসে আছে একজন। দাদু গলায় আনন্দ ছড়িয়ে বললেন, ‘চল তো দেখি!’

   সকলে কাছে গিয়ে দেখলেন, হ্যাঁ, বিলম্বদাদুই অমন করে বসে আছে। বুম্বা ভাবল, মানুষ দুঃখ পেলে বুঝি অমন করে বসে থাকে! বিলম্বদাদুর কোনও দিকে হুশ নেই। 

   ইচ্ছেদাদু কাছে গিয়ে বিলম্বদাদু গলার গামছা ধরে টান দিয়ে বললেন, ‘এই যে মহাপুরুষ! চলুন, এবার বাড়ি চলুন! ঢের রাগ দেখানো হয়েছে!’

   যেন হুঁশ ফিরল বিলম্বদাদুর। উঠে দাঁড়াল। তারপর চারদিকে ত্রিপাঠীবাড়ির অত লোককে দেখে বলল, ‘বড়বাবু আর বড়মা, আপনারা আবার ছুটে এলে কেন?’ তারপর বুম্বার হাতে সেই কাগজের মোড়কটা দেখে কেড়ে নিয়ে বকুনির ভঙ্গিতে বলল, ‘বুম্বাদা, তুমি এটা নিয়ে এখানে এলে কেন?’ তারপর প্যাকেটটা অনিচ্ছে ঠাকুরমার হাতে দিয়ে বিলম্বদাদু বলল, ‘বড়মা, পুরনো বইখাতা আর খবরের কাগজ বিক্রি করে এ বছরের সরস্বতী পুজোর খরচ তুলে রাখা আছে এতে। পুজোর সময় খরচ করা হবে। আমি তো সেদিন হারাধন পটুয়ার বাড়িতে গিয়ে সরস্বতী ঠাকুর বায়না করে এসেছি!’

   ঠাকুরমা বললেন, ‘তোর এখন অত কথায় কাজ কী রে বিলম্ব? চল বাড়ি চল!’

   বিলম্বদাদুর কথা শুনে ইচ্ছেদাদু ফিক করে হেসে বললেন, ‘অ্যাই বুম্বা, বিন্নি, তিন্নি! তোরা শুনে রাখ, এবার তা হলে ত্রিপাঠীবাড়িতে জাঁক করে সরস্বতী পুজোটা হচ্ছে?’

   বাড়ি ফিরতে ফিরতে সকলে যখন সাইনবোর্ড বাঁধা সেই খিরিশ গাছটার কাছে এলেন, তখন হঠাৎ গল্পকাকা সাইনবোর্ডটা পড়তে-পড়তে  খুশি-খুশি গলায় বলে উঠলেন, ‘বাবা, এটা নিশ্চয়ই বুম্বা, বিন্নি, তিন্নি আর তোমার বিলম্বকুমারের কাজ!’

   ইচ্ছেদাদু আর অনিচ্ছে ঠাকুরমা সেদিকে তাকিয়ে একসঙ্গে বলে উঠলেন, ‘বিলম্বকুমার কিন্তু কাজটা ভালোই করেছে রে।’ তারপর হাসতে হাসতে বললেন, ‘ফুলকুসুমপুর খুব কাছে!’ (সমাপ্ত)



       

মিঠির চিঠি 

সুদীপ্ত বিশ্বাস


ছোট্ট মেয়ে মিঠি

এই তো সেদিন মেঘের ডানায় লিখল সে এক চিঠি-

'বড্ড একা আমি!

তোমরা কি কেউ বন্ধু হবে, আমায় দেবে হামি?'

একলা ছিল গাছ

মিঠির চিঠি পেয়েই সে তো করল শুরু নাচ।

ছোট্ট নদীর ধারে

মাছেরা সব মিঠির চিঠি পড়ল চুপিসারে

উঠলো নেচে খুব

বন্ধু হয়ে স্রোতের টানে আবার দিল ডুব।

চলল চিঠি ভেসে

গাছ-পাখিরা বন্ধু পাতায় মিঠির কাছে এসে।

পাহাড় ছিল একা

মিঠির চিঠি পেয়েই পাহাড় করতে চাইল দেখা।

চলল চিঠি চাঁদে

চাঁদের সবাই চিঠি পেয়ে আটখানা আহ্লাদে!

বলল সবাই, 'মিঠি!

আমরা তোমার বন্ধু হব,আজ পেয়েছি চিঠি।


ভালবাসার ওম

সুমেধা চট্টোপাধ্যায়


ধৃতি শীতের ছুটি পড়ার পর থেকেই উত্তেজনায় ফুটছে। মায়ের কাছে সেই কোন 'গল্প শুনে খাওয়ার' বয়স থেকে সে শুনে আসছে, মা'দের একটা বাড়ি আছে প্রায় ৩০০ বছরের পুরনো। কিন্তু কোনওদিন তা চোখে দেখা বা সবাই মিলে যাওয়াও হয় নি। ক্লাসের ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হল। অনেকদিন আগে থেকে ঠিক করে বড়দিনের ছুটিতে মা'দের দেশের বাড়ি সামশেরপুর যাওয়া ঠিক হয়েছে৷ সেই উত্তেজনায় শেষ অনলাইন পরীক্ষাটিও খুব তাড়াহুড়ো করে দিয়েছে ধৃতি। যদিও খারাপ হয় নি, এখন ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়ার অপেক্ষা। 

নির্ধারিত সময়ে একটি বেশ বড় গাড়িতে রওনা দিল মা-বাবা, দুই মাসি ও সাথে ধৃতি। কলকাতা থেকে প্রায় পুরোটাই গাড়িতে যাওয়া হবে। প্রায় ৭-৮ ঘন্টার পথ। ধৃতি সেদিন ঘরের বাইরে থেকে শুনেছে মা কাকে যেন বলছিল " কি যে বল, তুমি! দিদি'রা যাচ্ছে, আমরা তিনজ লন আছি..গা ছমছম করবে কেন?" ধৃতির মনে হয়েছিল ওখানে কি তবে কোনও অশরীরী থাকে! কি জানি বাবা, বেশ একটা রোমাঞ্চ হচ্ছে কিন্তু। বেশ একটা হন্টেড হাউসে মনে হচ্ছে থাকব আমরা। 

দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেলের দিকে ধৃতিদের গাড়ি সামশেরপুরের বিশাল জমিদারবাড়ি 'সেন বাড়ি'তে এসে পৌঁছাল। শেষ বিকেলের নরম আলোয় যেন কনে দেখা রঙে সেজে উঠেছে চারিদিক....কোলাহলহীন বাড়িটির গায়ের উপর মনখারাপের আলো। বাঁদিকে গেট দিয়ে ঢুকেই প্রাসাদোপম বাড়ির সামনে একটা মরা গাছ। ধৃতির শিরদাঁড়া দিয়ে যেন একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল সেইদিকে তাকিয়ে। সবাই মিলে হৈ হৈ করতে করতে বাড়ি ঢুকল। মা-মাসিরা তো ছোটবেলার গল্প করতেই ব্যস্ত। ধৃতি শুধু কেমন যেন আনমনা রইল। 

বাড়ির কেয়ারটেকার পুষ্করের সাথে ধৃতির বেশ ভাব হয়ে গেল। সে বাড়ির একটা দিক ঘুরিয়ে দেখালো ধৃতিকে। তাও ধৃতি মাঝে মাঝেই কেমন যেন আনমনা হয়ে পড়ছিল। সবাই শুনলে হাসবে তাই সে বলতে পারল না। তার বার বার মনে হচ্ছে একজন দীর্ঘাঙ্গী মাথায় কাপড় দেওয়া বউ যেন তাকে অনুসরণ করছে৷ 

পুষ্করকাকুর সাথে যে জায়গাটুকু ঘুরে দেখল ধৃতি স্তব্ধবাক হয়ে গেল। এত বিশাল বাড়ি....ঠিক যেন রূপকথা। জায়গায় জায়গায় সব গাছের শিকড় গজিয়েছে। মস্ত মস্ত সব থাম, জাফরি কাটা বারান্দা, ঝুল বারান্দাতেও রেলিং এ নক্সা করা। শেষ বিকেলের রোদে এক অদ্ভূত আলো-আঁধারি সৃষ্টি হয়েছে ঠাকুরদালান জুড়ে। ধৃতি দেখেছে, মা এবং মাসিরা চন্ডীমন্ডপে দুগগাঠাকুরের কাঠামোতে প্রণাম করেই বাড়িতে ঢুকেছে৷ 

ধৃতিকে বার বার পিছনে তাকাতে দেখে পুষ্কর একবার জিজ্ঞাসাই করে ফেলল "ও দিদিমণি, পিছনে ফিরছ কেন বার বার? ভয় লাগছে কি? আমি আছি তো তোমার সাথে।" ধৃতির অস্বস্তি আর যাচ্ছে না! ঠিক ভয় নয়.....একটা ভয়মিশ্রিত অনুভূতি।

আনমনে ভাবতে ভাবতে হঠাৎ একটা উঁচু চৌকাঠে হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়তে যাচ্ছিল ধৃতি। কিন্তু ও স্পষ্ট বুঝতে পারল ওকে পড়ার আগেই পিছন থেকে কে যেন টেনে দাঁড় করিয়ে দিল। কোনও আঘাত লাগল না ধৃতির। মাথা তুলেই সে দেখে পুষ্কর কাকা তো খানিক সামনে, তার টেনে তোলার কোনও উপায় নেই। তবে কে তাকে আগলে রাখছে সারাক্ষণ! এবার ধৃতির ভয় লাগছে বেশ। সারা বাড়িতে টাঙানো মা এর পূর্বপুরুষদের সব ছবিগুলো কেমন যেন তার দিকেই তাকিয়ে আছে মনে হচ্ছে। ধৃতি বেশ খানিকটা অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ যেন কানের কাছে এক মোলায়েম স্বরের আওয়াজ পেল 'ভয় পেও না, দিদিভাই। আমি তোমার কোনও ক্ষতি হতে দেব না। তুমি তো আমার নাতনি।' ধৃতি চমকে চারিদিকে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেল না।কিন্তু মনে হল কেউ যেন সরে গেল পিছন থেকে। সে বলে উঠল 'পুষ্কর কাকা, লাইব্রেরি, বড় ঘর সব তো দেখা হল, এবার চলো মা'দের কাছে ফিরে যাই।' "ঠিক আছে দিদিমণি, তাই চলো। হাতমুখ ধুয়ে, স্নান সেরে ভালো করে খেয়ে নেবে।" স্থানীয় এক ঠাকুর ধৃতিদের জন্য মাছের ঝোল-ভাত করে রেখেছে।স্নান খাওয়া সেরে থাকবার ঘরে ঢুকতে গিয়েই ধৃতি মাথা তুলে দেখে এক বিশাল আয়না রাখা। মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। অনেকক্ষণ ধরে আয়নার কাঁচের চারপাশের কারুকার্যটা দেখছিল ধৃতি। মা বলল, "আমার ঠাকুরদা এটি কিনে এনেছিলেন, একটি অকশান থেকে। এটি বিলেত-ফেরত জানিস!" আবছা একটি ছোট মেয়ের অবয়ব যেন ভেসে উঠেই মিলিয়ে গেল৷ ধৃতি যে তা দেখতে পেয়েছে তা আর জানাল না কাউকে। 

দুপুরটা বেশ হৈ হৈ করে কেটে গেল। সন্ধ্যে হতেই আবার সেই দম-আটকানো ভাবটা ফিরে এল। কি যে করবে ধৃতি ভেবে পায় না। বেশ শীত করছে।জ্যাকেট কম্বল চাপিয়েও কমছে না। মা আর ধৃতি একটা ডবল লেপের ভিতর শুয়েছে, মোজা-টুপি সব পরা। তাও কেমন যেন হাড় কেঁপে যাচ্ছে ধৃতির। কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ল। কিন্তু সে খেয়াল করল না তার মাথার কাছে বসে খাটে হেলান দিয়ে এক নারীমূর্তি উল বুনছেন। 

সকালবেলা ঝকঝকে রোদ উঠল। ধৃতি চোখ খুলে দেখল তার পায়ের কাছে শোওয়ার সময়ে রাখা কম্বলটা গায়ে খুব সুন্দর করে মোড়া। ঠান্ডা লাগার দরুণ মাঝরাতে সে আলাদা বিছানায় আলাদা কম্বল নিয়ে শুয়েছিল। মা'কে জিজ্ঞাসা করাতে মা বললো, "আমি তো রাতে উঠিই নি, তুই আলাদা শোয়াতে ভালই হয়েছে, আমার ঘুমটা ভালো হয়েছে, যা নড়িস তুই। দেখ গে যা, নিজেই গায়ে টেনে নিয়েছিলি।"কিন্তু ধৃতির মনে খটকা লেগেই রইল। এত পরিপাটি করে গায়ে কম্বল সে নিজে কোনও ভাবেই দেয় নি। 

যাই হোক, আজ ওরা একটি রেশম খামার দেখতে গেল কাছেই। গুটিপোকা থেকে কিভাবে নানা রঙের রেশম সুতো বেরোয় তা ঘুরে ঘুরে দেখালেন একজন। এরপর কাছের এক বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী এলাকায় গেল ওরা। সবুজের গালিচায় মোড়া বনানীর মধ্যে দিয়ে বয়ে চলেছে মাথাভাঙা। খুব সুন্দর চারিদিক। 

দুপুরে ফিরে খিচুড়ি-ডিমভাজা খাওয়া হল। ঘরে ঢুকে ধৃতি দেখে তার জামাকাপড়ের ব্যাগটা সুন্দর করে গোছানো এবং সব গরম জামাগুলো উপরের দিকে রাখা। মা কখনও তো এভাবে গুছিয়ে দেয় না। এক অন্যরকম ভালো  লাগা মনে এলেও বেশ ভয় ভয় করে উঠল। আজ দুপুরের খাওয়ার পর পুষ্করকাকা বাড়ির অন্য একটি দিক ঘোরাতে নিয়ে গেল। বড় বড় ঘর...উঁচু সব সিঁড়ি।  একটা ঘরে আবার দুটি পালঙ্ক রাখা। ছাদে ঝুলছে চামচিকে। বৈঠকখানার দেওয়ালে একটা বিশাল ছবি। তেল রং করা৷ সেদিকে চোখ পড়তেই চমকে ওঠে ধৃতি। অবিকল ঐ নারীমূর্তির মতো দেখতে লাগছে। হাতে দুটো ক্রুশ ধরা।পুষ্কর কাকাকে এনার পরিচয় জিজ্ঞাসা করাতে সে জানাল " দিদিমণি, ইনি তোমার মা'দের এক জেঠিমা হন। খুব বুনতে ভালবাসতেন। চোখের পলকে শীতে ছোট ছোট নাতি-নাতনিদের জন্য সোয়েটার বুনে দিতেন। কিন্তু খুব দুঃখের বিষয় ওনার ছোট মেয়ের প্রথম সন্তান জন্মের এক মাসের মাথায় এক অজানা জ্বরে মারা যায়। তখন তো এখনকার মতো এত ভাল ওষুধ-পত্র বা ডাক্তার -বদ্যি ছিল না। ওনার ধারণা শীতেই ও মারা যায়। এরপর থেকে উনি সব দুঃস্থ বাচ্চাদের জন্য রাত জেগে শীতে সোয়েটার বুনতেন। কেউ শীতে বা ঠান্ডায় কষ্ট পাচ্ছেন দেখলেই তার কষ্ট দূর করার চেষ্টা করতেন। তাঁর মন কেঁদে উঠত।"এইসব শুনতে শুনতে ধৃতি কেমন যেন আনমনা হয়ে গেল। 

প্রথম রাতে কিছুতেই ঘুম আসছিল না ধৃতির। এপাশ -ওপাশ করছিল। গরম লাগছিল বেশ। তাই থার্মালটা মাথার কাছে খুলে শুল ধৃতি। কিন্তু মাঝরাতে কিসের যেন খুটখাট আওয়াজে ঘুম ভেঙে দেখে বেশ ঠান্ডা লাগছে, কিন্তু সুন্দর কর থার্মালটা গায়ে পরানো। সোজা তাকিয়েই দেখে পায়ের কাছে বসে সেই ছায়ামূর্তি উল-কাঁটা বুনছে৷ কানের কাছে আবার সেই কণ্ঠস্বর 'কোনও ভয় নেই দিদিভাই, একটুও শীত করবে না তোমার। তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমাও।" ভয়ে মাথা পর্যন্ত কম্বল টেনে শুয়ে রইল ধৃতি। ক্রমে ঘুম নেমে এলো তার চোখে৷ 

সকালে সোনা রোদ উঠেছে। ধৃতির মুখে রোদের আলো এসে পড়ে৷ আজ ওদের ফেরা৷ কেমন যেন একটা মন-কেমন করা জমাট কষ্ট ঘিরে ধরে ধৃতিকে। মুখ চোখ ধুয়ে ব্যাগ থেকে মাফলারটা বার করতে গিয়ে ধৃতি দেখে ব্যাগের ভিতর একদম উপরে একটা গোলাপী রঙের দারুণ সুন্দর সোয়েটার রাখা। খুব নরম উলের। পরপারে গিয়েও তবে উনি সোয়েটার বোনা ছাড়েন নি...গতকালের পুষ্করকাকার কথাগুলো মনে পড়ছিল ধৃতির। ছোট বাচ্চা মেয়ে শীতে কষ্ট পাচ্ছে দেখলেই আর ঠিক থাকতে পারেন না...রানি জেঠিমা। হ্যাঁ ঐ ছবির নীচে নামটা লেখা ছিল। ধৃতি সোয়েটারটা জড়িয়ে মনে মনে বলল ' সব ভূত ভয় দেখায় না, ভালোও বাসে। জড়িয়ে রাখে ভালবাসার ওমে। ভালো থেকো জেঠিদিদা। আবার দেখা হবে। ' মা'এর চোখের আড়ালে ধৃতি সোয়েটারটা ব্যাগের একদম নীচে রেখে দিল।





   

চলো যাই ( কেরালা) 

পর্ব ৩

বাসবদত্তা কদম


ডাবের জলের পরপরই পছন্দসই প্রাতরাশ। প্রাতরাশ কে যে তোমরা আজকাল ব্রেকফাস্ট বলো, সে আমি জানি। তারপরের গল্প শোনো। আমাদের জন্য বরাদ্দ যে বোটখনা ছিল; সেখানায় তিনখানা শোবার ঘর সঙ্গে তিনখানা বাথরুম। নৌকার পিছনদিকের অংশে রান্নাঘর। সিঁড়ি আছে। ছাদে যাওয়াই যায়। ছাদ থেকে বেশ সুন্দর দেখা যায় দুপারের ছবির মত দৃশ্য। ওপর থেকে দৃশ্য ভালো দেখা যায়। ভালো ফটো তোলা যায় এ সবাই জানে! 

আমার তো এই বোট খানাকেই একখানা সাম্রাজ্য বলে মনে হচ্ছিল, নৌকার যাঁরা মাল্লা তাঁরা বললেন, সর্বোচ্চ বারোখানা ঘরেরও হাউসবোট হয়। বা-রো-খা-না! তিনটে ঘরের বোট এত বড় আর বারোখানা হলে ভেবে আমার হাঁ-মুখ আর বন্ধ হচ্ছে না। তা দেখে সে কি হাসি তাদের। এইসব কথাবার্তা চলতে চলতেই দেখি বোটখানা চলতে শুরু করেছে। ব্রেকফাস্টের আপম চাটনি ফল এইসব প্রচুর খেয়ে পেট জয়ঢাক করে আমি বসলাম ওদের হেড মাঝির কাছে 

-গল্প বলো দাদা।

-কিসের গল্প শুনবেন আপনি!

-কেন? হাউসবোট আর তোমাদের দেশ, ঘরবাড়ি স-ব কিছুর গল্প।

-শোনেন তবে। 

গল্প শোনায় সে আমায়। আমিও মালয়ালাম জানি না, সেও বাংলা জানে না। হিন্দি জানে ভাঙা ভাঙা। তবে ইংরেজিখানা বেশ খাসা জানে দেখলাম; কি সুন্দর করে আমায় কত কিছু বোঝালে আর দেখালে।

বোট যে দাদা চালাচ্ছেন, তাঁকে মাঝে মধ্যেই এই বুড়ো দাদা একটু দাঁড়া, একটু সাইড কর। এসমস্ত বলে গেল তার নিজের ভাষায় আর আমাকে দেখালো ওদের ধানক্ষেত। আশ্চর্য কি জান? মাইলের পর মাইল লম্বা সে সব ধানক্ষেতের বেশিরভাগই সমুদ্রতলের থেকে ৪, ৫ এমনকি ৭,৮ ফুট নীচেও হয়। খুব অবাক লাগছে না? এমন আবার হয় নাকি? আমরা তো সমুদ্রতল দিয়েই যে কোনো ভূমির উচ্চতাকে মাপি তাই না? আমারও তাই মনে হয়েছিল।

তবে কুট্টিনাড় অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য এটাই। কুট্টিনাড় অবশ্য শুধু আলাপুZhআ নিয়ে নয়। আশেপাশের খান তিনেক জেলা নিয়ে বিস্তৃত। কুট্টীনাড় অঞ্চলের সমুদ্রতলের থেকেও নীচের মাটিতে এই ধান চাষ কিন্তু পৃথিবী বিখ্যাত। সারা পৃথিবীর দু একটি জায়গাতেই এমনভাবে চাষ হয়। যার একটি আমাদের দেশের কেরালায়।

মাঝিদাদা বলেই চলেছে

আর এই যে এইসব নৌকায় আপনারা চড়েন, এগুলো কিন্তু মোটেও নতুন নৌকা নয়। শয়ে শয়ে বছর ধরে এইসব নৌকা পাড়ি জমাইছে দেশ বিদেশ। কখনো ধান নিয়ে। কখনো মশলা।

গালে হাত দিয়ে আমি ভাবতে থাকি কত শত বছর ধরে এইরকম সব নৌকা নিয়ে কেরালার মাঝিরা পাড়ি জমাতেন কর দূর দূর দেশে। পৃথিবীর সব দেশেই প্রাচীনকালে ব্যবসাবানিজ্য যা কিছু হত প্রায় সবই হত জলপথে। সড়কপথে যাতায়াতের উপযুক্ত যানবাহন এবং নিরাপত্তা দুয়েরই অভাব ছিল। 

আর কেরালার মশলার জন্য যে কত বিদেশি পাড়ি জমাতেন কেরালার সমুদ্রকূলে। শোনা যায় পর্তুগীজ নাবিক ভাস্কো-ডা-গামা মশলা ভর্তি জাহাজ নিয়ে দেশে ফেরার পরে সে দেশের রাজা তাঁকে জাহাজ ভর্তি সোনা উপহার দিয়েছিলেন। ভাস্কো-ডা-গামাও কিন্তু এসেছিলেন কেরালাতেই। কালিকট বন্দরে। কালিকটের এখনকার নাম কোচি বা কোচিন। তবে কেরালায় মশলা কিনতে আসা বিদেশিরা ওখানকার সাধারণ মানুষদের ওপর অনেক অত্যাচার করতেন। সেসব এখন থাক পরে হবে। 

এত্তসব গল্প কিন্তু শুনছি নৌকার গলুইয়ের উপরে বসে। নৌকাখানা পুরোই এত সুন্দর সাজানো যে বসে গল্প চা আড্ডা সব ই চলছে অনায়াস আরামে। হটাৎ এক জায়গায় দেখি নৌকাখানা ধীরে হয়ে গেল। একখানা লম্বা তক্তা পেতে দেওয়া হোল নৌকা থেকে পাড় পর্যন্ত। এ কী কান্ড লাফিয়ে লাফিয়ে নৌকো থেকে নামতে হবে? আমার তো ভেবেই হাত পা পেটের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। সাঁতার জানি নাকি যে জল কে ভয় পাব না? অতি উৎসাহী যিনি ছিলেন আমাদের দলে (তোমাদের আঙ্কেল) তিনি ঐ তক্তা বেয়ে নামলেন। ভাবলাম কি না কি! শুনলাম কি না আছে একখানা মাছ আর ডাবের বাজার। সেখান থেকে বিশাল বিশাল গোঁফওয়ালা চিংড়ী খানকতক কেনা হোল। সাহসের অভাবে আমার আর সে মাছের বাজার দেখা হোল না। আবার দড়ি খুলে বোট রওনা হোল।

মাঝিদাদা বলে -লাঞ্চ করে নেন।

আমি বলি -সেকি এখনই লাঞ্চ? আর এই বোট? হাউসবোট হোল কিভাবে? এইসব গল্প কখন বলবে?

-বলব। বলব(ক্রমশঃ)



স্মরণীয়

( আশাপূর্ণা দেবী)

কলমে - পীযূষ প্রতিহার

আশাপূর্ণা দেবী ১৯০৯ সালের ৮জানুয়ারী উত্তর কলকাতার মামাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা হরেন্দ্রনাথ গুপ্ত ছিলেন কমার্শিয়াল আর্টিস্ট এবং মা সরলাসুন্দরী দেবী ছিলেন সাহিত্যের অনুরাগী এবং ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের  সমর্থক। আশাপূর্ণার ঠাকুরমা নিস্তারিনী দেবী ছিলেন খুবই রক্ষণশীল এবং মেয়েদের শিক্ষার বিরোধী। তাই আশাপূর্ণাদের তিন বোনের স্কুলের শিক্ষা নিষিদ্ধ ছিল। মাত্র আড়াই বছর বয়সেই আশাপূর্ণা দাদাদের পড়া শুনে শুনে মুখস্থ করে ফেলতেন।  মায়ের কাছে শিখেছিলেন বর্ণপরিচয়। মাত্র ছয় বছর বয়সেই নিজে নিজে পড়তে পারতেন নানা ধরনের বই। ভীষণ ডাকাবুকো ছিলেন তিনি। একদিন ছোট বোন সম্পূর্ণার সঙ্গে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে লিখে পাঠিয়েছিলেন একটি চিঠি, সঙ্গে আবদার ছিল -"নিজের হাতে নাম লিখে আমাদের একটি উত্তর দেবেন"। রবীন্দ্রনাথ সে চিঠির উত্তর পাঠাতেই আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠেছিলেন আশাপূর্ণা। বাড়িতে আসত বেশ কয়েকটি পত্রপত্রিকা ও ছিল একটি লাইব্রেরী। সেইসব পত্রপত্রিকা ও বই পড়ে তাঁর ছোটবেলা কেটেছে নিজের জগতে। তাঁর নিজের কথায়- "হিসেব মতো আমার ছেলেবেলাটা কেটেছে সংসার উর্ধ্বের একটি স্বর্গীয় জগতে। বই পড়াই ছিল দৈনিক জীবনের আসল কাজ" । মাত্র পনের বছর বয়সেই ১৯২৪ সালে কৃষ্ণনগরের বাসিন্দা কালিদাস গুপ্তের সাথে বিয়ে হয়ে যায় তাঁর। ১৯২২ এ মাত্র সাড়ে তেরো কি চোদ্দ বছর বয়সে গোপনে 'শিশুসাথী' পত্রিকায় 'বাইরের ডাক' নামে একটি কবিতা লেখেন। তাঁর প্রথম গল্প প্রকাশিত হয় 'পাশাপাশি'। সারাদিনের সংসারের কাজের মাঝে মাঝে সময় পেলেই লিখতেন তিনি আর রাতে ছেলেমেয়েদের ঘুম পাড়িয়ে হ্যারিকেনের আলোয় লিখতেন যতক্ষন পারতেন। এত প্রতিবন্ধকতাও তাঁকে থামাতে পারেনি। তাঁর রচিত উপন্যাসের সংখ্যা ১৭৬টি, ছোটগল্প সংকলন ৩০টি, ছোটদের জন্য বই প্রায় ৪৭ টি। এছাড়াও তিনি লিখেছেন কবিতা, স্মৃতিকথা, রম্যরচনা এবং সমাজ ও সংস্কৃতি বিষয়ক অসংখ্য প্রবন্ধ। ১৯৩৮ সালে তাঁর প্রথম একক গ্রন্থ 'ছোট ঠাকুরদার কাশীযাত্রা' প্রকাশ হলে তা বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এরপর একে একে তাঁর কলম থেকে বেরিয়ে এসেছে নানা কালজয়ী রচনা। তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য তাঁর ত্রয়ী উপন্যাস - 'প্রথম প্রতিশ্রুতি', 'সুবর্ণলতা' ও 'বকুলকথা'। এই উপন্যাস ত্রয়ী তাঁকে খ্যাতির শীর্ষে নিয়ে যায়। তাঁর রচনাগুলো বহু ভারতীয় ভাষায় অনূদিত হওয়ার পাশাপাশি ইংরেজি ভাষাতেও অনুবাদ হয়েছে। বেশ কয়েকটি উপন্যাস ও গল্প অবলম্বনে হয়েছে চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন সিরিয়াল।

   ১৯৬৬সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কার রবীন্দ্র পুরস্কার লাভ করেন তিনি। এছাড়াও বহু পুরস্কারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য  ১৯৭৬ এ পদ্মশ্রী, ১৯৭৮ এ জ্ঞানপীঠ, ১৯৯৪ তে সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার লাভ করেন। চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে সাম্মানিক ডক্টরেট উপাধি পান যথাক্রমে জব্বলপুর(১৯৮৩), রবীন্দ্রভারতী (১৯৮৭), বর্ধমান (১৯৮৮) ও যাদবপুর (১৯৯০)। 

    এই মহীয়সী সাহিত্যিকের ১৯৯৫ সালের ১৩ই জুলাই মৃত্যু হয়।



  

পাঠ প্রতিক্রিয়া

(জ্বলদর্চি ছোটোবেলা ৬৫ পড়ে অসীম হালদার যা লিখলেন)

হাউসবোটে করে কেরালার ঐরকম প্রকৃতির শোভা দেখতে বেরিয়েও যদি পড়াশুনোর কথা বলে, এসব কি আর ভাল লাগে গো! আরে বাবা, ময়ুরপঙ্খী নাওএর ছবি দেখে আর চারপাশে নারকেল বাগান দেখে এখনই মনে হচ্ছিল, বেরিয়ে পড়ি কেরালা। অবশ্য মৌসুমী আন্টির জন্যই এই ভাল লাগা, প্রকৃতির সুন্দর সুন্দর ভ্রমণের ঠিকানা খুঁজে পাওয়া। আবার প্রচ্ছদে পুরুলিয়ার নক্সা আঁকা দেওয়াল! পারা যায় বসে থাকতে আর! ওমিক্রনটাকে আসতেই হলো জ্বালাতে! ওফ্...পারি না আর! ছাড়ো, চলো বরং চুপচাপ বসে না থেকে বাকি পাতাগুলো দেখে নেওয়া যাক।

  জয়দীপ, শ্রেয়সী, রমনেন্দু, স্নেহা প্রত্যেকে উজাড় করে দিয়েছে রং মাখিয়ে জ্বলদর্চির পাতাকে। ছোট্ট ছোট্ট শিল্পীদের এই সৃষ্টিকে দেখে মা সরস্বতী আজ বেশ তৃপ্ত। সব্বার জন্য তাই অকুণ্ঠ ভালবাসা আর স্নেহ।

  আরিব্বাস! শুধু যে "জেনাস" থেকে জানুয়ারী নামের উৎপত্তি, সেখানেই ব্যাপারটা শেষ নয়। আমিও কি বাপু জানতাম না কি যে নতুন বছরের শুরু জানুয়ারী মাস থেকে সব দেশেই হয় না। ইরাণ রাশিয়া ভিয়েতনাম চীন এসব দেশে ভিন্ন সময়ে নতুন বছর শুরু। ভাবা যায়! আবার চীনে বছরে দু বার নতুন বছর পালিত হয়, সেটাও অজানা ছিল যে! মুক্তিবাবুর "দেশে দেশে" না পড়লে সত্যিই অনেক কিছু অজানা থেকে যেতো। এর জন্য তাঁকে অনেক শুভেচ্ছা এবং কৃতজ্ঞতা।

  এবার এলাম "কাটাকুটি"র খেলায়। এক কাটায় রুজি রোজগার অন্য কাটায় পুণ্যবতীর সতিত্ব রক্ষা। এক কাটায় ছন্দসুর পতন, তো আর এক কাটায় চা পানে বিরক্তি। আছে কাটাকুটির রকমফের ছড়া জুড়ে কবি শতদ্রু মজুমদারের লেখনীতে। আছে মাইনে কাটার অসহায়তা, আছে কবিতার বই বিক্রয়ে ঘাটতির কথা। কাটাকাটির খেলার কারিগর যারা, তাদের কেউ কখনো কি ভেবে দেখেছেন যে, এমন কিছু কাটাকাটিতে রক্ত ঝরে, ঝরে অশ্রু ঘরে ঘরে। তোমরা বড় হয়ে বুঝবে সবই আরো ভালোভাবে পারিপার্শ্বিক জগত থেকে। অনেক কথায় সমৃদ্ধ এই লেখার জন্য কবিকে প্রণাম।

  কি, বলো এবার সবাই...মুখ গোমড়া করে আর কেউ নেই তো! জানি, নেই। টুনটুনির বুদ্ধির তারিফ না করে কি আর পারা যায়! ব্যাটা কাকটা কম জ্বালিয়েছে দোয়েল শালিক ফিঙে ইষ্টিকুটুম টুনটুনিদের! জবর শিক্ষা হয়েছে কাকের, বলো! দিলীপবাবুর লেখার প্রশংসা না করে পারলাম না।

  এরপর ফুলকুসুমপুরে আসতেই মনে পড়লো হযবরল চিড়িয়াখানার কথা। তারা তো এবারে কৃষিমেলার প্রাঙ্গণে! তারা তো এবার সংবাদের শিরোনামে। চিকলুর মতো আমিও তো অবাক...ত্রিপাঠী বাড়ির এই ঘটনা তো এবার গিনেস রেকর্ডে ওঠার অপেক্ষায়। তবে বিলম্বদাদুকে যে শেষ অব্দি পাওয়া গেল, তাই রক্ষে বাবা!

  ঠাকুর পরিবারের সদস্য হিসাবে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর বা অবন ঠাকুরের কথা বলতেই মনে এসে যায় তাঁর আঁকা ভারতমাতার ছবিটি! শিল্পকলায় সমৃদ্ধি তাঁর হাতের জাদুতেই। তাঁর সম্বন্ধে সংক্ষিপ্ত লেখাও যখন পত্রিকার পাতায় চলে আসে, অবাক লাগে। কতো কিছু নিয়েই এই রঙীন পত্রিকাটি! সেখানে রয়েছে মেয়েদের ব্রতকথাসহ আরো কতোরকমের ব্রতের ইতিহাস, পড়লাম এবং ঋদ্ধ হলাম। শ্রেয়সীর জন্য অসংখ্য শুভেচ্ছা। এমনই থাকুক কথায় কলমে।

  লেখা যখন প্রায় শেষের দিকে, অনায়াসে পীযূষবাবুর কথা মনে চলে আসে। প্রতি সপ্তাহেই বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে সংক্ষিপ্ত লেখা নজর কাড়ছে পাঠকদের। সেই দলে আমিও আছি। এবারের আকর্ষণ খগেন্দ্রনাথ মিত্র। শিশু সাহিত্যিক হিসাবে তাঁর নাম অক্ষয় হয়ে থাকবে, নিঃসন্দেহে বলতে পারি।

  আমাদের মনের কথা বলছিলাম...যাকে বেড়ি দিয়ে রাখতে কেউ কখনো পারে নি। গল্প লেখা শেষ হয়, হয় কবিতা লেখার ইতি। কিন্তু দেখো তো একটু ভেবে...তারপরেও কি সব শেষ হয়, না। কবি কলম রাখেন, গল্পকার একটু একান্তে ভাবনায় ডুবে। কিন্তু সময় চলতেই থাকে। আর সেই সময়ের ছন্দে হতে থাকে আরও কত ঘটনা, যা আবার কোন সময়ে লেখার বিষয়বস্তু হয়ে ধরা দেয় শিল্পির কলমের ছোঁয়ায়। আর পাঠক! সবকিছু দেখে, পড়ে মগজে ঘুরতে থাকে সেইসব। যেন চট করে চলে যাই আলেপ্পির হাউসবোটে। সেখান থেকে আবার হঠাৎ ফুলকুসুমপুরের মেলায়, পুরুলিয়ার পথে কখনও বা। আর সকলের সম্মুখে তুলে ধরার জন্য সেই দরদী হাতখানি, মৌসুমীদির। সর্বশেষ চোখ বোলানো। যাঁর কথা না বললেই নয়।


আরও পড়ুন 

http://www.jaladarchi.com/2022/01/childhood-vol-65.html


জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments