জ্বলদর্চি

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ উপমামৃত/পর্ব-১৩ /সুদর্শন নন্দী

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ উপমামৃত     
পর্ব-১৩
সুদর্শন নন্দী 

উপমা শ্রীরামকৃষ্ণস্য। ঠাকুরের কথামৃতে দেখি ভক্তদের সাথে ঈশ্বরীয় কথা বোঝাতে তিনি ছত্রে ছত্রে উপমা দিয়েছেন। সেই সরস, সহজ, সরল উপমা শুনে ভক্তদের মধ্যে যেমন হাসির রোল উঠত তেমনি তারা বিস্মিত হতেন কিভাবে তাঁর মুক্তোভাণ্ডার থেকে এত উপমা উৎসারিত হয়। আসি   ১৮৮৩, ২৪শে ডিসেম্বরের কথায়। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ঝাউতলায় মণির সাথে কথা বলছেন।।   কথায় কথায় ভগবান যে স্বরূকে চিনিয়ে দেন তার উপমা দিলেন ঠাকুর। বললেন, ন্যাংটা বাঘ আর ছাগলের পালের গল্প বলেছিল! একটা বাঘিনী ছাগলের পাল আক্রমণ করেছিল। একটা ব্যাধ দূর থেকে দেখে ওকে মেরে ফেললে। ওর পেটে ছানা ছিল, সেটা প্রসব হয়ে গেল। সেই ছানাটা ছাগলের সঙ্গে বড় হতে লাগল। প্রথমে ছাগলদের মায়ের দুধ খায়, — তারপর একটু বড় হলে ঘাস খেতে আরম্ভ করলে। আবার ছাগলদের মতো ভ্যা ভ্যা করে। ক্রমে খুব বড় হল — কিন্তু ঘাস খায় আর ভ্যা ভ্যা করে। কোন জানোয়ার আক্রমণ করলে ছাগলদের মতো দৌড়ে পালায়!
একদিন একটা ভয়ংকর বাঘ ছাগলদের পাল আক্রমণ করলে। সে অবাক্‌ হয়ে দেখলে যে, ওদের ভিতর একটা বাঘ ঘাস খাচ্ছিল, — ছাগলদের সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে পালাল! তখন ছাগলদের কিছু না বলে ওই ঘাসখেকো বাঘটাকে ধরলে। সেটা ভ্যা ভ্যা করতে লাগল! আর পালাবার চেষ্টা করতে লাগল। তখন সে তাকে একটা জলের ধারে টেনে নিয়ে গেল। আর বললে, ‘এই জলের ভিতর তোর মুখ দেখ। দেখ, আমারও যেমন হাঁড়ির মতো মুখ, তোরও তেমনি।’ তারপর তার মুখে একটু মাংস গুঁজে দিলে। প্রথমে, সে কোনমতে খেতে চায় না — তারপর একটু আস্বাদ পেয়ে খেতে লাগল। তখন বাঘটা বললে, ‘তুই ছাগলদের সঙ্গে ছিলি আর তুই ওদের মতো ঘাস খাচ্ছিলি! ধিক্‌ তোকে!’ তখন সে লজ্জিত হল।
ঠাকুর এবার বিশ্লেষণ করে বোঝাচ্ছেন যে ঘাস খাওয়া কি না কামিনী-কাঞ্চন নিয়ে থাকা। ছাগলের মতো ভ্যা ভ্যা করে ডাকা, আর পালানো — সামান্য জীবের মতো আচরণ করা। বাঘের সঙ্গে চলে যাওয়া, — কি না, গুরু যিনি চৈতন্য করালেন; তাঁর শরণাগত হওয়া, তাঁকেই আত্মীয় বলে জানা; নিজের ঠিক মুখ দেখা কি না স্ব-স্বরূপকে চেনা।
ঐদিন ঠাকুর আহারান্তে একটু বিশ্রাম করিতেছেন। কলকাতা থেকে সুরেন্দ্র, রাম প্রভৃতি ভক্তেরা একে এক করে আসছেন। শুরু হল কথাবার্তা।
 ঠাকুর ভক্তদের বললেন- ঈশ্বর যখন মানুষ হন তখন মানুষের মতো ব্যবহার করেন। একটি উপমা দিলেন। বললেন-একজন বহুরূপী সেজেছে, ‘ত্যাগী সাধু’। সাজটি ঠিক হয়েছে দেখে বাবুরা একটি টাকা দিতে গেল। সে নিলে না, উঁহু করে চলে গেল। গা-হাত-পা ধুয়ে যখন সহজ বেশে এলো, বললে, ‘টাকা দাও’। বাবুরা বললে, ‘এই তুমি টাকা নেবো না বলে চলে গেলে, আবার টাকা চাইছ?’ সে বললে, ‘তখন সাধু সেজেছি, টাকা নিতে নাই।’
তেমনি ঈশ্বর, যখন মানুষ হন, ঠিক মানুষের মতো ব্যবহার করেন।
সেদিন (২৪শে দিসেম্বর,১৮৮৩) সন্ধ্যার পর ঠাকুর ভক্তসঙ্গে বসে আছেন। মণিও ভক্তদের সাথে রয়েছেন। যোগের বিষয় — ষট্‌চক্রের বিষয় — কথা হচ্ছে। একাধিক উপমা দিলেন তিনি। 
“কি জান, ডিমের ভিতর ছানা বড় না হলে পাখি ঠোকরায় না। সময় হলেই পাখি ডিম ফুটোয়।
“তবে একটু সাধনা করা দরকার। গুরুই সব করেন, — তবে শেষটা একটু সাধনা করিয়ে লন। বড় গাছ কাটবার সময় প্রায় সবটা কাটা হলে পর একটু সরে দাঁড়াতে হয়। তারপর গাছটা মড়মড় করে আপনিই ভেঙে পড়ে।
“যখন খাল কেটে জল আনে, আর-একটু কাটলেই নদীর সঙ্গে যোগ হয়ে যাবে, তখন যে কাটে সে সরে দাঁড়ায়, তখন মাটিটা ভিজে আপনিই পড়ে যায়, আর নদীর জল হুড়হুড় করে খালে আসে।
“সাধনা করতে করতে তাঁর কৃপায় সিদ্ধ হয়। একটু খাটা চাই। তারপরই দর্শন ও আনন্দলাভ।
“অমুক জায়গায় সোনার কলসী পোতা আছে শুনে লোক ছুটে যায়। আর খুঁড়তে আরম্ভ করে। খুঁড়তে খুঁড়তে মাথায় ঘাম পড়ে। অনেক খোঁড়ার পর এক জায়গায় কোদালে ঠন্‌ করে শব্দ হল; কোদাল ফেলে দেখে, কলসী বেরিয়েছে কি না। কলসী দেখে নাচতে থাকে।
কলসী বার করে মোহর ঢেলে, হাতে করে গণে — আর খুব আনন্দ! দর্শন, — স্পর্শন, — সম্ভোগ! — কেমন?”
১৮৮৩, ২৭শে ডিসেম্বর। ঠাকুর অভ্যাসযোগ নিয়ে কথা বলছেন। উপমা সহকারে বললেন-অভ্যাসযোগ? ও-দেশে ছুতোরদের মেয়েরা চিঁড়ে বেচে। তারা কত দিক সামলে কাজ করে, শোন। ঢেঁকির পাট পড়ছে, হাতে ধানগুলি ঠেলে দিচ্ছে আর-একহাতে ছেলেকে কোলে করে মাই দিচ্ছে। আবার খদ্দের এসেছে; ঢেঁকি এদিকে পড়ছে, আবার খদ্দেরের সঙ্গে কথাও চলছে। খদ্দেরকে বলছে, তাহলে তুমি যে ক’পয়সা ধার আছে, সে ক’পয়সা দিয়ে যেও, আর জিনিস লয়ে যেও।
দেখ, — ছেলেকে মাই দেওয়া, ঢেঁকি পড়ছে, ধান ঠেলে দেওয়া ও কাঁড়া ধান তোলা, আবার খদ্দেরের সঙ্গে কথা বলা, একসঙ্গে করছে। এরই নাম অভ্যাসযোগ। কিন্তু তার পনর আনা মন ঢেঁকির পাটের দিকে রয়েছে, পাছে হাতে পড়ে যায়। আর এক আনায় ছেলেকে মাই দেওয়া আর খদ্দেরের সঙ্গে কথা কওয়া। তেমনি যারা সংসারে আছে, তাদের পনর আনা মন ভগবানে দেওয়া উচিত। না দিলে সর্বনাশ — কালের হাতে পড়তে হবে। আর এক আনায় অন্যান্য কর্ম কর।
আবার উপমা দিয়ে বোঝালেন জ্ঞানের পর সংসারে কিভাবে থাকতে হয়। বললেন-
“জ্ঞানের পর সংসারে থাকা যায়। কিন্তু আগে তো জ্ঞানলাভ করতে হবে। সংসার-রূপ জলে মন-রূপ দুধ রাখলে মিশে যাবে, তাই মন-রূপ দুধকে দই পেতে নির্জনে মন্থন করে — মাখন তুলে — সংসার-রূপ জলে রাখতে হয়।
সাধনার বিষয়ে বললেন-সাধনের দরকার। প্রথমাবস্থায় নির্জনে থাকা বড় দরকার। গাছের উপমা দিয়ে বোঝালেন,  অশ্বত্থগাছ যখন চারা থাকে তখন বেড়া দিতে হয়, তা না হলে ছাগল গরুতে খেয়ে ফেলে, কিন্তু গুঁড়ি মোটা হলে বেড়া খুলে দেওয়া যায়। এমন কি হাতি বেঁধে দিলেও গাছের কিছু হয় না।
তাই প্রথমাবস্থায় মাঝে মাঝে নির্জনে যেতে হয়। সাধনের দরকার। ভাত খাবে; বসে বসে বলছ, কাঠে অগ্নি আছে, ওই আগুনে ভাত রাঁধা হয়; তা বললে কি ভাত তৈয়ার হয়? আর-একখানা কাঠ এনে কাঠে কাঠে ঘষতে হয়, তবে আগুন বেরোয়।
সিদ্ধির উপমা দিয়ে বিষয়টি পরিস্কার করলেন ঠাকুর।- সিদ্ধি খেলে নেশা হয়, আনন্দ হয়। খেলে না, কিছুই করলে না, বসে বসে বলছ, ‘সিদ্ধি সিদ্ধিঞ্চ! তাহলে কি নেশা হয়, আনন্দ হয়?”
কি মনোমুগ্ধকর উপমা ঠাকুরের!
১৮৮৩, ২৭শে ডিসেম্বর। সাকার নিরাকার রূপ নিয়ে কথা হচ্ছে। ঠাকুর বিষয়টি বরফ ও জলের উদাহরণ দিয়ে জলবৎতরলং বুঝিয়ে দিলেন।    
বললেন —  কি জান যিনিই নিরাকার, তিনিই সাকার। ভক্তের চক্ষে তিনি সাকাররূপে দর্শন দেন। যেমন অনন্ত জলরাশি। মহাসমুদ্র। কূল-কিনারা নাই, সেই জলের কোন কোন স্থানে বরফ হয়েছে; বেশি ঠাণ্ডাতে বরফ হয়। ঠিক সেইরূপ ভক্তি-হিমে সাকাররূপ দর্শন হয়। আবার যেমন সূর্য উঠলে বরফ গলে যায় — যেমন জল তেমনি জল, ঠিক সেইরূপ জ্ঞানপথ — বিচারপথ — দিয়ে গেলে সাকাররূপ আর দেখা যায় না; আবার সব নিরাকার। জ্ঞানসূর্য উদয় হওয়াতে সাকার বরফ গলে গেল।
যারই নিরাকার, তারই সাকার। একটি ছোট্ট উপমা দিয়ে ঠাকুর ইশ্বরের রূপটি কতো সোজা সাপটা হৃদয়ে গেঁথে দিলেন ভক্তদের। ঠাকুরের উপমা যে অতুলনীয় ! 
                                    (ক্রমশঃ)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments