জ্বলদর্চি

তপোভূমি গঙ্গাসাগর - মহর্ষি কপিল ও ভগীরথ কথা /প্রসূন কাঞ্জিলাল

তপোভূমি গঙ্গাসাগর - মহর্ষি কপিল ও ভগীরথ কথা

প্রসূন কাঞ্জিলাল 

গঙ্গা ও বঙ্গোপসাগরের মিলনস্থান তীর্থভূমি গঙ্গাসাগর। গঙ্গাসাগরের খ্যাতি কেন? তীর্থভূমি বলে, না কি মেলাভূমি বলে। কিন্তু গঙ্গাসাগরের বেলাভূমিটি কম আকর্ষণীয় নয়।

ছোটবড় ৫১টি দ্বীপ নিয়ে ৫৮০ বর্গ কিমি জুড়ে সাগরদ্বীপ। গঙ্গার মর্ত্যে আসা ও সগর রাজার পুত্রদের জীবনদানের লোকগাথাকে ঘিরে গড়ে উঠেছে এই তীর্থভূমি। কপিল মুনির আশ্রমটি সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে গেলেও পরবর্তীকালে গড়ে ওঠা কপিল মুনির মন্দিরটিকে কেন্দ্র করে ভক্ত সমাগম হয়। মকর সংক্রান্তির পুণ্য তিথিতে লক্ষ লক্ষ মানুষের ভিড় জমে এই সঙ্গমে।

মেলার সময়টুকু বাদ দিলে গঙ্গাসাগর নিরালা, নির্জন। মন্দিরের সামনে থেকে নির্জন বালিয়াড়িটি সোজা গিয়ে মিশেছে সমুদ্রে। এখানে সমুদ্র ঢেউ ভাঙে না। তির তির করে এগিয়ে এসে পা ভিজিয়ে যায়। হাঁটতে হাঁটতে চলে যাও সমুদ্রের ভিতরে। পায়ের পাতা ভেজানো জল থেকে হাঁটু জলে। বড় কেউ সঙ্গে থাকলে স্নান করো। ফিরে এসো সমুদ্রতটে। অবাধে খেলে বেড়ায় লাল কাঁকড়া। তোমার আগমন টের পেলে সেঁধিয়ে যায় গর্তে। দূরে, দিগন্তরেখায়, একটা,দু’টো,তিনটে….অনেক অনেক নৌকা, নাকি ট্রলার। মাছ ধরতে গেছে গভীর সমুদ্রে।

ভ্যানরিকশায় চেপে বেরিয়ে পড়তে পারবেন দ্বীপ দর্শনে। মঠ–মন্দির-আশ্রমের এই সাগরসঙ্গমে। ঘুরে আসুন মনসাদ্বীপে রামকৃষ্ণ মিশনের আশ্রমে আর লাইটহাউসে। বিকেলে আর একবার চলে যান সাগর কিনারায়। তবে ভিন্ন পথে। যে পথ সেচবাংলো থেকে সমুদ্রে গেছে সেই পথে। এই পথে ঝাউয়ের জঙ্গল পাবেন । এখনও অক্ষত।

নিকটতম বড় শহর কলকাতা। রেলস্টেশন কাকদ্বীপ ও নামখানা। কলকাতা থেকে বাসে ঘণ্টা তিনেকের যাত্রায় পৌঁছনো যায় হারউড পয়েন্ট ৮ নম্বর লঞ্চ ঘাটে বা লট ৮ । ট্রেনে কাকদ্বীপ বা নামখানা পৌঁছেও বাসে বা রিকশায় হারউড পয়েন্ট ৮ নম্বর লঞ্চ ঘাটে পৌঁছনো যায়। সেখান থেকে ফেরি ভেসেলে গঙ্গা পেরিয়ে কচুবেড়িয়া। কচুবেড়িয়া থেকে বাসে বা ট্রেকারে ৩০ কিমি দূরে সাগর। মেলার সময় যাতায়াতের আরও বিশেষ ব্যবস্থা থাকে। গঙ্গাসাগরে থাকার জন্য নানান ধর্মশালা ও পান্থনিবাস আছে। এ ছাড়া পি ডব্লু ডি, সেচ দফতরের ও পাবলিক হেলথ ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বাংলো ও পঞ্চায়েতের যাত্রীনিবাস আছে।

সাগরদ্বীপ হল পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ প্রান্তে বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত একটি দ্বীপ। এই দ্বীপটি গঙ্গা ব-দ্বীপের অংশ। দ্বীপটির আয়োতন ৩০০ বর্গ কিলোমিটারের বেশি। দ্বীপটি মুড়িগঙ্গা নদী দ্বারা মূল ভূখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন। এর পশ্চিমে রয়েছে হুগলি নদী উত্তর ও পূর্বে রয়েছে মুড়িগঙ্গা নদী এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। দ্বীপটি বর্তমানে ভাঙ্গনের শিকার হয়েছে।

সাগরদ্বীপ একটি পর্যটন গন্তব্য। তীর্থযাত্রীদের এবং মজা প্রেমী মানুষ উভয়কে আকর্ষণ করে সুন্দরবনের এই দ্বীপ। সাগরদ্বীপ গঙ্গা নদীর মোহনার অপূর্ব সমুদ্রের আশেপাশের চাঁদ দেখা দেয়। সাগরদ্বীপ একটি রৌপ্য বালি এবং পরিষ্কার নীল আকাশের একর এবং পর্যটকেরা একটি শান্ত মনের সাথে তাদের সপ্তাহান্ত ব্যয় করতে চান শান্ত সমুদ্রের সঙ্গে। সাগরদ্বীপ জনপ্রিয় গঙ্গাসাগর হিসাবে পরিচিত। এই দ্বীপ এখনও অবাস্তব এবং মানুষের কাছে অপরিচিত। সাগরদ্বীপটি ভারতের সবচেয়ে বিখ্যাত হিন্দু তীর্থস্থান কেন্দ্রগুলির একটি। প্রতি বছর ভারতবর্ষের তীর্থযাত্রীরা মকর সংক্রান্তিতে (মধ্য জানুয়ারি) গঙ্গা এবং বঙ্গোপসাগরের মহনায় নদীতে একটি পবিত্র স্নানের জন্য সাগরদ্বীপে একত্রিত হয়। পবিত্র স্নানের পরে, তীর্থযাত্রীরা কপিল মুনি মন্দির বা আশ্রমে 'পূজা' প্রদান করে। 
মকর সংক্রন্তি উপলক্ষে, গঙ্গাসাগর মেলা এই দ্বীপে সংগঠিত হয়, যা পশ্চিমবঙ্গের বৃহত্তম মেলাগুলির মধ্যে একটি। ভারত সেবাশ্রম সংঘ মন্দিরটি সবচেয়ে বড়, এই মন্দিরে তিনটি বিশাল চূড়া রয়েছে। এটি প্রাচীন কাল থেকেই একটি বিখ্যাত তীর্থযাত্রী কেন্দ্র হয়েছে। মকর সংক্রন্তি উপলক্ষে অনুষ্ঠিত গঙ্গাসাগর মেলা পশ্চিমবঙ্গের বৃহত্তম মেলা। 

এক পৌরাণিক আখ্যান আছে কপিলমুনির আশ্রম ও গঙ্গাকে ঘিরে। একদা দেবর্ষি নারদের শখ হয় স্বর-সাধনার। কিন্তু তাঁর বিকৃত স্বর-সাধনায় সব রাগ-রাগিণী মুমূর্ষু হয়ে পড়েন। তখন তাঁরা ভগবান বিষ্ণুর কাছে এর প্রতিকার প্রার্থনা করেন। বিষ্ণু তখন তাঁদের নিয়ে কৈলাসে উপস্থিত হলেন দেবাদিদেব মহাদেবের কাছে। বিষ্ণুর অনুরোধে রাগ-রাগিণীদের উজ্জীবিত করতে মহাদেব সংগীত সাধনা আরম্ভ করলেন। সেই সুরলহরী ছড়িয়ে পড়ল বিশ্বের সমগ্র প্রান্তে। জগৎ উদ্বেলিত হয়ে উঠল আনন্দে। গানের সুরের প্রভাবে পক্ষীকুল আনন্দ-কলরবে দিকদিগন্ত মুখরিত করে তুলল। গাছে গাছে ফুল ফুটে উঠল। আর সেই সুরের আবেশে বিহ্বল বিষ্ণুর পদযুগল থেকে এক বিপুল জলরাশি রূপে জন্ম হল গঙ্গার। কিন্তু সেই বিপুল জলরাশির ভার যেহেতু পৃথিবী সহ্য করতে পারবে না, তাই তার থেকে বিশ্বকে রক্ষা করতে ভগবান ব্রহ্মা তাঁর মন্ত্রপূত কমণ্ডলুতে গঙ্গাকে আবদ্ধ করে রাখলেন।

এদিকে মর্ত্যে সগর নামে মহা পূণ্যবান এক রাজা শুরু করেছেন অশ্বমেধ যজ্ঞ। যজ্ঞের ঘোড়া নিয়ে রাজার ষাট হাজার পুত্র বিশ্ব ভ্রমণে বেরোলেন। এই যজ্ঞের নিয়ম হল, বহু দেশ ঘুরে ঘোড়া ফিরে এলে তাকে যজ্ঞস্থলে বলি দেওয়া হবে। পথে কেউ সেই ঘোড়া আটকালে তার সঙ্গে যুদ্ধ হবে যজ্ঞকারী রাজার। কিন্তু যজ্ঞ সুসম্পন্ন হলে সগর মহাপরাক্রমশালী হয়ে উঠবেন— এমন আশঙ্কায় প্রমাদ গুনলেন কূটবুদ্ধি দেবরাজ ইন্দ্র। নানা কারণে ইন্দ্রের প্রতি শিব ও বিষ্ণু খুবই অসন্তুষ্ট। তাঁকে সরিয়ে সগরকে স্বর্গের সিংহাসনে যদি বসিয়ে দেওয়া হয়— এমন আশঙ্কা করে ইন্দ্র যেমন ভাবে হোক সগরের যজ্ঞ পণ্ড করতে উদ্যোগী হলেন। খলবুদ্ধি ইন্দ্র সেই যজ্ঞের ঘোড়া চুরি করে সমুদ্রতটে মহাজ্ঞানী কপিল মুনির আশ্রমের কাছে বেঁধে রাখলেন।

হারানো ঘোড়া খুঁজতে খুঁজতে সগর-পুত্রেরা কপিলের আশ্রমে এসে পৌঁছলেন। এবং ধ্যানমগ্ন মুনির সামনে ঘোড়া বাঁধা দেখে তাঁরা সমস্বরে ‘মুনি ঘোড়া চোর’ বলে চিৎকার করে উঠলেন। সেই সমবেত চিৎকারে মুনির ধ্যান ভঙ্গ হল এবং বাকরুদ্ধ মুনির দু’চোখ থেকে নির্গত হল তীব্র রোষাগ্নি। সেই অগ্নিশিখায় তৎক্ষণাৎ ভস্মীভূত হলেন সগররাজার ষাট হাজার পুত্র।
রাজা সগরের বংশধরেরা অনেক চেষ্টা করেও ওই পুত্রদের জীবিত করতে পারলেন না। ফলে রাজবংশ এক সময়ে পুরুষশূন্য হয়ে পড়ল। তখন এক মুনির পরামর্শে বংশের দুই রানি সঙ্গমে মিলিত হলেন এবং জন্ম হল ভগীরথ নামে এক রাজপুত্রের। ভগ শব্দের অর্থ হল নারীর যোনি। পুরুষের সঙ্গম ছাড়া শুধু যোনি থেকে জন্ম বলে তাঁর নাম হল ভগীরথ। কিন্তু পুরুষের ঔরস থেকে জন্ম নয় বলে তাঁর দেহ হল অস্থিহীন। দুই নারীর মিলনে জন্ম হল ভগীরথের। 

সে যুগে অষ্টাবক্র মুনি নামে এক মহা পরাক্রমশালী কিন্তু বিকৃতদেহ মুনি ছিলেন। একদিন অস্থিহীন ভগীরথকে দেখে তিনি ভাবলেন যে ভগীরথ তাঁকে অনুকরণ করে ব্যঙ্গ করছেন। প্রথমে তিনি ভয়ঙ্কর ক্রুদ্ধ হলেও যখন বুঝতে পারলেন ভগীরথ সত্যিই বিকলাঙ্গ তখন তিনি ভগীরথকে আশীর্বাদ করলেন। সেই আশীর্বাদে ভগীরথ স্বাভাবিক দেহ পেলেন। অষ্টাবক্র মুনি ভগীরথের মুখে সগর রাজার যজ্ঞ বৃত্তান্ত ও সমস্ত ঘটনা শুনে জানালেন যে ভগীরথ যদি ভগবান ব্রহ্মার তপস্যা করে গঙ্গাকে মুক্ত করে পৃথিবীতে আনতে পারেন তবে গঙ্গার স্পর্শে তাঁর পূর্বপুরুষদের অভিশপ্ত আত্মারা মুক্তি পাবে।

ভগীরথ ব্রহ্মলোকে গিয়ে কঠোর তপস্যা করে ভগবান ব্রহ্মাকে রাজি করালেন গঙ্গাকে মুক্তি দিতে। কিন্তু ব্রহ্মা চিন্তিত হলেন এই ভেবে যে, গঙ্গার প্রবল ভারে স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল বিধ্বস্ত হবে। কে ধারণ করবে সেই মহাভার? সমস্যার সমাধানে এগিয়ে এলেন মহাদেব। কিন্তু অহঙ্কারী গঙ্গা মহাদেবকে বাঘছাল পরিহিত জটাধারী এক সামান্য তপস্বী মনে করে তাঁকে নিয়ে একটু মজা করতে গেলেন। গর্বে মদমত্ত গঙ্গা তীব্র বেগে ঝাঁপিয়ে পড়লেন মহাদেবের জটার উপর। কিন্তু সমগ্র জগতের যিনি পতি, সকল দেবতার যিনি দেবতা, সামান্য জলস্রোত তাঁর কী ক্ষতি করবে। মুহূর্তের মধ্যে গঙ্গা তাঁর জটাজালে আবদ্ধ হলেন। নিজের ভুল বুঝতে পেরে গঙ্গা শিবের কাছে ক্ষমা চাইলেন আর ভগীরথও শুরু করলেন শিব বন্দনা।

 অবশেষে মহাদেব তুষ্ট হলেন। গঙ্গা মুক্তি পেয়ে তিন ধারায় প্রবাহিত হতে আরম্ভ করলেন –স্বর্গে মন্দাকিনী, পাতালে ভোগবতী আর মর্তে অলকানন্দা। মকরবাহিনী গঙ্গার মর্তের ধারাকে শঙ্খনাদে পথ দেখিয়ে নিয়ে চললেন মহামতি ভগীরথ তাঁর পূর্বপুরুষদের মুক্তির জন্য।

গঙ্গার স্পর্শে মর্ত্যলোক আনন্দে মুখরিত হয়ে উঠল। মরুভূমি হয়ে উঠল শস্য শ্যামলা, বন-বনাঞ্চল পুষ্প-শোভিত হল, পাখির কলরবে চতুর্দিক মুখরিত হল, মানুষেরা পূজা ও আরতি-উলুধ্বনি-শঙ্খরব আর সঙ্গীতে আকাশ বাতাস মুখরিত করে তুলল।

পথ চলতে চলতে এক জায়গায় ভগীরথ খানিকটা বক্র পথ নেওয়ায় গঙ্গা তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন যে, তিনি কেন ঘুর পথে চলেছেন। ভগীরথ তখন জানালেন যে সামনে জহ্নু মুনির আশ্রম রয়েছে। সোজা পথে গেলে আশ্রমের ক্ষতি হবে বলে তিনি ঘুরপথে যাচ্ছেন। কিন্তু অহঙ্কারী গঙ্গা তাঁকে নির্দেশ দিলেন ওই আশ্রমের ওপর দিয়েই যাওয়ার জন্য। অগত্যা অনিচ্ছা সত্বেও ভগীরথ সোজা পথে চলতে বাধ্য হলেন, ফলে গঙ্গার তীব্র স্রোতে ভেসে গেল মুনির আশ্রম। মুনির ধ্যানভঙ্গ হল। ভয়ঙ্কর রোষে তিনি মুহূর্তের মধ্যে এক চুমুকে গঙ্গাকে শুষে নিলেন। মুনির জঠরে বন্দী হলেন গঙ্গা।

পূর্বপুরুষের মুক্তি ভেস্তে যাবার উপক্রম দেখে ভগীরথ মুনির প্রার্থনা শুরু করলেন। তাঁর প্রার্থনায় খুশি হয়ে অবশেষে মুনি তার জানু কেটে গঙ্গাকে মুক্তি দিলেন। সেই থেকে গঙ্গার আর এক নাম হল জাহ্নবী। আবার শুরু হল পথ চলা।
পথ চলতে চলতে এক সময়ে ভগীরথ পথের দিশা হারিয়ে ফেললেন। বিপন্ন হয়ে বিষ্ণুর প্রার্থনা আরম্ভ করলেন তিনি। ভগীরথের স্তবে খুশি হয়ে শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্ম ধারী বিষ্ণু আবির্ভূত হলেন। বিষ্ণু গঙ্গাকে বললেন, ‘এখন থেকে তোমার সত্ত্বা সাত্ত্বিক, রাজসিক আর তামসিক— এই তিন ধারায় প্রবাহিত হবে। রাজসিক আর তামসিক ধারা আরও পূর্ব দিকে এক নুতন পথে প্রবাহিত হবে। আর সাত্ত্বিক সত্ত্বা মূল ধারায় প্রবাহিত হয়ে কপিল মুনির আশ্রমে পৌঁছবে।’ পুবের রাজসিক-তামসিক ধারার নাম হল পদ্মা। ভারতের উত্তরাপথের সব নদীপ্রবাহ এসে মিশলো গঙ্গার দুই ধারায়। আর কৈলাস পর্বত থেকে মহাদেবের পদধৌত ব্রহ্মপুত্র এসে মিশলো পদ্মায়। আর ভগীরথকে বিষ্ণু বললেন, ‘তুমি এই নদীপথ অনুসরণ করে পিছন দিকে ফিরে গেলে পথের দিশা আবার খুঁজে পাবে। তখন সেই পথে গঙ্গার সাত্ত্বিক ধারাকে নিয়ে মুনির আশ্রমে পৌঁছবে।’

ভগবান বিষ্ণুর নির্দেশে ভগীরথ আবার পশ্চাদদিকে ফিরে গিয়ে গঙ্গার সাত্ত্বিক ধারাকে নিয়ে মুনির আশ্রমে পৌঁছলেন আর গঙ্গার স্পর্শে মুক্তি পেলেন তাঁর পুর্বপুরুষদের আত্মারা। ভগীরথের নাম থেকে গঙ্গার সাত্ত্বিক ধারার নাম হল ভাগীরথী।

কে এই মহর্ষি কপিল :--

মহর্ষি কপিল সম্ভবতঃ খ্রীঃপূঃ ৬৫০—৫৭৫ সালের মধ্যে বর্তমান ছিলেন। তিনি সাংখ্য দর্শনের প্রণেতা। তিনি ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করিতেন ন। ‘ঈশ্বরাসিদ্ধেঃ’ কেন না ঈশ্বরের অস্তিত্ব সপ্রমাণ হয় না। তাঁহার গ্রন্থ পাঠ করিলে বিস্ময়ে অভিভূত হইতে হয়। অতি প্রাচীন কালে হিন্দু সভ্যতার ও জ্ঞানের কতদূর উন্নতি হইয়াছিল, তাহা এই সাংখ্য-দর্শন পাঠ করিলেই সুস্পষ্ট অনুভূত হয়। যে বিবর্ত্তন-বাদ (Theory of Evolution) বর্ত্তমান ইউরোপীয় পণ্ডিতের আবিষ্কার বলিয়া আমরা পাঠ করিয়া থাকি, বহু পূর্ব্বে এদেশের কপিল মুনি তাহার উল্লেখ করিয়া গিয়াছেন। (সাংখ্য প্রবচন ১৷৬৪ সূত্র দ্রষ্টব্য)। তিনি ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করিতেন না। সুতরাং নাস্তিক। তাহা হইলেও তিনি বেদের প্রাধান্য স্বীকার করিতেন, ইহাই আশ্চর্য্যের বিষয়। 

কপিলের মতে সমস্ত জগৎ প্রকৃতি (জড় প্রকৃতি) হইতে উদ্ভূত। পরমাত্মা ও প্রকৃতি উভয়ই অনাদি। তিনি সৃষ্টি করেন না, দ্রষ্টা মাত্র। মানবের কর্ম্মফলানুসারে আত্মা দেহান্তর আশ্রয় করে। কর্ম্মক্ষয়ে দেহান্তরে প্রবেশ করে না, পৃথক অবস্থান করে। কপিলের মতে বস্তু মাত্রই সৎ, সৎ হইতে সতের উৎপত্তি। বীজ ভূমিতে উপ্ত হইলে বীজের ধ্বংস হয় বটে কিন্তু ইহার সম্পূর্ণ ধ্বংস হয় না। বীজের অবয়ব বর্ত্তমান থাকে এই ভাবভূত অবয়ব হইতে অঙ্কুর উৎপন্ন হয়।

 কপিলের মতে দুঃখ ত্রিবিধ—আধ্যাত্মিক, আধিভৌতিক ও অধিদৈবিক। বাতপিত্তাদির বৈষম্যনিবন্ধন শারীরিক এবং ক্রোধাদিজনিত মানসিক দুঃখকে আধ্যাত্মিক দুঃখ বলে। মনুষ্য-পশ্বাদি হইতে জাত দুঃখ আধিভৌতিক এবং যক্ষ, পিশাচাদি হইতে অথবা ভূমিকম্পাদি প্রভৃতি হইতে জাত দুঃখকে অধিদৈবিক দুঃখ বলে। এই ত্রিবিধ দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তিই মুক্তি। এই মুক্তিলাভের একমাত্র উপায় জ্ঞান লাভ। 

(১) সাংখ্য মতে জগৎ ব্যক্ত ও অব্যক্ত এই দুই ভাগে বিভক্ত। ব্যক্ত শব্দে প্রতীয়মান জগৎ এবং অব্যক্ত শব্দে প্রকৃতি বুঝায়। সাংখ্য মতে জগৎ সত্য কিন্তু ক্ষণিক। বেদান্ত মতে জগৎ মিথ্যা। বৈদান্তিক মতে রজ্জুতে সর্প জ্ঞানের ন্যায় ভ্রান্তি মাত্র। ইহার উত্তরে সাংখ্য বলেন,— সর্পের স্থানে যেমন রজ্জু, আছে, তদ্রূপ সংসার স্থানে একটা কিছু থাকা চাই এবং ইহাই প্রকৃতি। 

(২) অগ্নিপুরাণের ৩৯ অধ্যায়ে শিল্প শাস্ত্রকার এক কপিলের উল্লেখ আছে।।

(৩) কাশ্মীরপতি হর্ষদেব (১০৮৯—১১০২ খ্রীঃ) লোহর প্রদেশের সামন্ত নরপতি উদয়সিংহের মৃত্যুর পরে তাঁহার অন্যতম সেনাপতি ক্ষেমের পৌত্র কপিলকে লোহার রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন। উচ্চল কাশ্মীর সিংহাসন অধিকার করিবার উদ্যোগী হইলে, কপিল উচ্চলের সৈন্যদলকে বাধা দিতে যাইয়া পরাজিত হন। পরে বিদ্রোহী গর্গের সহিত যুদ্ধে তিনি নিহত হন।

 প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য --- স্বামী বিবেকানন্দ কপিলকে “বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মনস্তাত্ত্বিক” বলেছেন। তাঁর মতে, “জগতে এমন কোনো দর্শন নেই, যা কপিলের কাছে ঋণী নয়।”

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

4 Comments

  1. লেখাটা পড়ে সমৃদ্ধ হলাম।

    ReplyDelete
    Replies
    1. কত কিছুই এখনও জানিনা,আপনার লেখা পড়ার পর বারবার বুঝি।🙏🏼

      Delete
  2. ধন্যবাদ ধন্যবাদ

    ReplyDelete