জ্বলদর্চি

ভারতীয় সংগীতের ক্রমবিকাশ-২ / দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

ভারতীয় সংগীতের ক্রমবিকাশ 

দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

পর্ব – ২

দ্বিতীয় শতকে রচিত তামিল গ্রন্থ 'পরিপাডল'-এ যে তন্ত্রবাদ্যের উল্লেখ আছে সেই বাদ্যযন্ত্রে এক হাজার তার ছিল বলে প্রবাদ। চতুর্থ শতকে সম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের আমলে মহাকবি কালিদাসের রচিত নাটকাদিতে সংগীতের বাহুল্য লক্ষ্য করা যায়। বৌদ্ধ যুগে লিখিত বৌদ্ধ মহাযান গ্রন্থের চর্যাপদ গুলিতেও সংগীতের পরিচয় পাওয়া যায়। দ্বাদশ শতাব্দীতে বাংলার কবি জয়দেব ও তার স্ত্রী পদ্মাবতী রচিত 'গীতগোবিন্দ' গ্রন্থে বহু প্রবন্ধ গীতের উল্লেখ দেখা যায়। সঙ্গীতবিদেরা কবি জয়দেবকে উত্তর ভারতের প্রথম গায়ক রূপে অভিহিত করেছেন।   

  কবি জয়দেবের পরে ভারতীয় সংগীতে ইসলাম ধর্মের প্রভাব ও পৃষ্ঠপোষকতা লক্ষ্য করা যায়। প্রকৃতপক্ষে ভারতবর্ষে প্রথম মুসলমান আক্রমণ হয় ৭১২ খ্রিস্টাব্দে। ইরাকের শাসক হাজ্জাজ-ই প্রথম সিন্ধুদেশ আক্রমণ করেন। ১১৭৪ খ্রিস্টাব্দে মহম্মদ ঘোরী ভারতবর্ষ আক্রমণ করে পাঞ্জাব, গুজরাট, দিল্লী, আজমীর, কান্যকুব্জ প্রভৃতি রাজ্যগুলি অধিকার করেন। এর পরে আলাউদ্দিন খিলজির সময়ে (১২৯৫-১৩১৭ খ্রিস্টাব্দ) তাঁর রাজ্য দক্ষিণে দেবগিরি ও সেতুবন্ধ রামেশ্বর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। আলাউদ্দিন নিরক্ষর হলেও সংগীতের প্রতি তিনি বিশেষ পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। তাঁর সময়ে বিখ্যাত কবি ও সঙ্গীতজ্ঞ আমির খসরু ভারতীয় সংগীতের সাথে পারস্যের সংগীতের মিশ্রণ ঘটান, যার ফলে ভারতীয় সংগীতে নতুন নতুন রাগিনীর আমদানি হয়। তাঁর সময়ে কাওয়ালী ও খেয়াল গানের উদ্ভব হয়। এছাড়াও আমির খসরু কয়েকটি নতুন বাদ্যযন্ত্র ও সংগীতের তাল তৈরি করেছিলেন বলে জানা যায়। পঞ্চদশ শতাব্দীতে সুলতান হুসেন শর্কী খেয়াল গানের নতুন রীতি ছাড়াও জৌনপুরী, জৌনপুরী তোড়ি, সিন্ধু ভৈরবী, রসুল তোড়ি, সিন্ধুরা এবং শ্যাম নামক বারোটি নতুন রাগের সৃষ্টি করেছিলেন।           

  মুসলমান আমলে ভারতীয় সঙ্গীতের শ্রেষ্ঠ যুগ ছিল সম্রাট আকবরের আমলে। আকবর নিজে যদিও নিরক্ষর ছিলেন কিন্তু তার জ্ঞানপিপাসা ছিল অসাধারণ। বিশ্বখ্যাত সংগীতজ্ঞ তানসেন ছিলেন আকবরের নবরত্ন সভার বিশিষ্ট রত্ন। এছাড়াও শিল্পকলা, সাহিত্যের বিভিন্ন দিকপালদের তাঁর নবরত্ন সভায় তিনি নিয়ে এসেছিলেন। তাঁর সমসাময়িক কালে গোয়ালিয়রের রাজা মানসিংহ তোমরের রাজদরবারেও বহু সংগীতশিল্পীর পৃষ্ঠপোষকতা করা হতো। তাঁর দরবারে ছিলেন তানসেনের সমকক্ষ বৈজু বাওরা। তাঁর স্ত্রী মৃগনয়নীও সঙ্গীতে বিশেষ পারদর্শিনী ছিলেন। মানসিংহ তোমর নিজে 'মান কুতূহল' নামক সংগীত গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। বহু সংগীত বোদ্ধার অভিমত রাজা মানসিংহ ধ্রুপদ গানের স্রষ্টা। এছাড়াও ওই সময়ে পন্ডিত হরিদাস স্বামী, যিনি তানসেন ও বৈজু বাওরার সঙ্গীত গুরু ছিলেন, তিনি ধামার গানের সৃষ্টি করেছিলেন।         

  সম্রাট শাহজাহানের আমলে পণ্ডিত প্রবর অহোবল 'সংগীত পারিজাত' নামক গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। বলা হয় অহোবল-ই প্রথমে বীণাতন্ত্রীর দৈর্ঘ্য থেকে শুদ্ধ ও বিকৃত বারোটি স্বর স্থান নির্ণয় করেছেন। ঔরঙ্গজেবের রাজত্বকালের পরে মহম্মদ শাহ ১৭১৯ থেকে ১৭৪৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দিল্লির সিংহাসনে আসীন ছিলেন। তাঁর সময়ে বিখ্যাত বীণকার ন্যায়ামত খাঁ যিনি 'সদারঙ্গ' নামে বিখ্যাত ছিলেন এবং তিনি তানসেনের দৌহিত্র ছিলেন। এঁর সময়েই টপ্পা গানের বিখ্যাত প্রচারক শোরি মিঞার জন্ম হয় যিনি প্রথম টপ্পা গানকে ভদ্রস্থ করে সভ্য সমাজে প্রচার করেন।        

  সাধারণত ধরে নেয়া হয় যে দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতাব্দীতে উত্তর ভারতে মুসলমান অনুপ্রবেশকারীদের আসার পূর্ব পর্যন্ত সমগ্র ভারতবর্ষে একটি সাধারণ সংগীতের ধারা বহমান ছিল। পরবর্তীকালে উত্তর ভারতের সংগীতের ধারা পারস্য ও ইরানের সংগীতের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। দক্ষিণ ভারতে অনুপ্রবেশকারীদের আগমন না ঘটায় সেখানে প্রাচীন ভারতীয় সংগীতের ধারা অটুট ছিল। উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের সংগীতের ধারা দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে জন্ম নিল হিন্দুস্তানি বা উত্তর ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত এবং কর্ণাটকী বা দক্ষিণ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত। কিন্তু যে মূল ভিত্তি এই দুই ধারার সংগীতের মেলবন্ধন ঘটিয়েছে তা হলো ভারতীয় সংগীতে রাগরাগিণীর ব্যবহার। ভারতীয় সংগীতে যে উন্নত ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সুরের স্বাতন্ত্র্যকে চিহ্নিত করা যায় তাকে আমরা 'রাগ' বলি এবং তার সাথে ছন্দ ও লয় স্থির করার জন্য উন্নত মানের প্রথাকে আমরা 'তাল' নামে অভিহিত করি।         

  এদেশে ইংরেজ শাসন ব্যবস্থায় তথাকথিত সভ্য সমাজ ভারতীয় সঙ্গীত শিল্পীদের কোনরূপ পৃষ্ঠপোষকতা করতেন না। ব্যতিক্রম হয়েছিল কলকাতার বিখ্যাত ঠাকুর বাড়ীর সন্তান স্যার শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুরের সময়ে (১৮৪০-১৯৪১ খ্রীষ্টাব্দ)। তিনি যেমন ভারতীয় কণ্ঠ ও যন্ত্রসঙ্গীতের অনুশীলন করতেন তদনুরূপ পাশ্চাত্যের ইংরেজী ভাষায়ও বহু গ্রন্থ ও প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন যেগুলি পাশ্চাত্যের বহু মনীষীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। ১৮৭৫ সালে আমেরিকার ফিলাডেলফিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এবং ১৮৯৬ সালে ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাকে 'ডঃ অফ মিউজিক' উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ভারতবর্ষে তিনিই প্রথম এই সম্মানে ভূষিত হন। তিনিই প্রথম সংগীত সাধনার স্কুল খুলেছিলেন।                                     

  দক্ষিণ ভারতের তাঞ্জোরে এই সময়ে কর্ণাটকী সংগীতের মুখ্য কেন্দ্র ছিল। মহাত্মা ত্যাগরাজ, শ্যাম শাস্ত্রী, সুবরাম দীক্ষিত প্রভৃতি কর্ণাটকী সংগীতজ্ঞেরা এই সময়ে বিশেষ খ্যাতিমান ছিলেন। উত্তর ভারতে এই সময়ে সংগীতের 'ঘরানা' পদ্ধতির প্রচলন হয়। বিখ্যাত কণ্ঠ ও যন্ত্র সঙ্গীত শিল্পীরা নিজ নিজ বৈশিষ্ট্য অনুসারে নিজস্ব ঘরানার সৃষ্টি করেন। যেমন গোয়ালিয়র ঘরানা, লখনৌ ঘরানা, বেনারস ঘরানা প্রভৃতি।                    
                                                                                               ক্রমশঃ

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments