জ্বলদর্চি

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা /পর্ব ৮ /প্রীতম সেনগুপ্ত


শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা

পর্ব ৮

প্রীতম সেনগুপ্ত


হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান-- সব ধর্মের মানুষকেই প্রেমের বাঁধনে বাঁধতে প্রয়াসী হয়েছিলেন স্বামী প্রেমানন্দ। কুমিল্লা থেকে এক মুসলমান ভক্ত এসে তাঁকে বলেন, ঠাকুর তাঁকে স্বপ্নে নির্দেশ দিয়েছেন বেলুড় মঠে গিয়ে তাঁর দর্শন ও প্রসাদ গ্রহণ করবার জন্য। এই ভক্তটি মঠে এসে ঠাকুরঘরে ঢুকে ভাববিহ্বল হয়ে পড়েন। সাষ্টাঙ্গ প্রণামপূর্বক ভক্তি নিবেদন করেন। এরপর প্রসাদ নিয়ে গঙ্গার ধারে বসে তা গ্রহণ করেন। আর এক খ্রিস্টান ভক্ত তাঁকে বলেছিলেন যে তার ধর্মে সামাজিকতাই সার। স্বামীজীর ধর্মে দয়া করে যেন তাকে গ্রহণ করা হয়। তিনি মঠে বেশ কয়েকদিন থেকে সকলের সঙ্গে বসে প্রসাদ পান। ১৯১৭ সালে প্রেমানন্দজী তখন ঢাকার নবনির্মিত মঠে কিছুদিনের জন্য অবস্থান করছেন। এই সময় সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের কয়েকজন মহিলা প্রায়ই ঢাকা মঠে এসে তাঁর পদতলে বসে কথামৃত পান করে পরম তৃপ্ত হয়ে বাড়ি ফিরে যেতেন। এরা ছিলেন নবাব পরিবারের। নবাব আসানুল্লার স্মৃতিরক্ষার্থে তাঁর কন্যা বেগম আখতারা বানু ঢাকা মঠে একটি গৃহ নির্মাণ করিয়েছিলেন। সেই ‘আসান-মঞ্জিল’ আজ অবধি সেখানে রন্ধনশালা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

  শ্রীশ্রীমাতাঠাকুরাণীর প্রতি প্রেমানন্দজীর অপার ভক্তি-শ্রদ্ধা ছিল। একটি পত্রে তিনি লিখেছিলেন--“শ্রীশ্রীঠাকরুনকে দেখছি ঠাকুরের চেয়েও বড়-- তিনি শক্তিস্বরূপিণী কিনা? তাঁর চাপবার ক্ষমতা কত! ঠাকুর চেষ্টা করেও পারতেন না, বাহিরে বেরিয়ে পড়ত। মা-ঠাকরুনের ভাবসমাধি হচ্ছে; কিন্তু কাহাকেও জানতে দেন?” আরেকটি পত্রে লিখেছিলেন--“শ্রীশ্রীমা মনুষ্যদেহধারিণী হলেও তাঁর অপ্রাকৃত ভগবতী তনু; জীবের কল্যাণের জন্য মনুষ্যবৎ লীলা করছেন।” মায়ের প্রতি তাঁর ভক্তির নিদর্শনস্বরূপ কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। উদ্বোধন থেকে স্বামী নির্লেপানন্দ (কার্তিক) মঠে এসেছেন। বাবুরাম মহারাজকে প্রণাম করতেই তিনি ওকে বললেন,“ওরে, যাবার সময় নৌকায় ওঠবার আগে আমাকে বলে যাস।” নির্লেপানন্দজী যখন ফিরবেন তার আগে মঠের সব্জি ও ফুলের বাগান থেকে সুন্দর ফুল, তরকারি এবং বিশেষ করে শ্রীশ্রীমা'র প্রিয় আমরুল শাক ঠিক করে রেখেছেন। ফিরবার সময় তাকে বলছেন,“বাবুরামের দণ্ডবৎ বলিস, আর এগুলো মাকে দিস।” কিছু সময় মঠ থেকে নিয়মিত শ্রীশ্রীমা'কে ফল ও দুধ পাঠাতেন। একবার মামাদের (শ্রীশ্রীমায়ের সহোদরদের) বিষয় সম্পত্তি, জমিজমা সুষ্ঠুভাবে ভাগ করে দেওয়ার জন্য স্বামী সারদানন্দজী (শরৎ মহারাজ) জয়রামবাটি যাবেন। সেখানে রওয়ানা হওয়ার আগে বাবুরাম মহারাজকে প্রণাম করে বললেন--“মা-ঠাকরুণের আদেশে যাচ্চি, ভাগ বাটোয়ারার কাজ জানিনা। তুমি আশীর্বাদ কর যাতে কাজটা সুষ্ঠুভাবে করে মা-ঠাকরুণকে উদ্বোধনে নিয়ে আসতে পারি।”

 বাবুরাম মহারাজ তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলেন--“তুমি যাঁর আদেশে যাচ্চ তাঁর আদেশ পেলে আমরা বর্তে যাই। আমি বলচি, তুমি যাও, ঠিক পারবে।” আবার স্বামী গৌরীশানন্দজী জানিয়েছেন--“জয়রামবাটী হইতে আমি ও জগদানন্দস্বামী তারকেশ্বর হইয়া মঠে ফিরিয়াছি(১৯১৬)। ঠাকুরের আরতি হইয়া গিয়াছে। উপরের বারান্দায় ঠাকুরের সাতজন সন্ন্যাসী সন্তান বসিয়াছিলেন ও মহারাজ আরাম আরাম কেদারায় বসিয়া শটকায় তামাক খাইতেছিলেন। জিজ্ঞাসা করিলেন, আমি তিনটি ছেলেকে চিঠি দিয়ে মার কাছে পাঠিয়ছিলুম, তিনি তাদের কৃপা করেছেন কি? আমি বলিলাম--আপনার চিঠি আমি মাকে পড়ে শোনাই। চিঠি শুনে, সদ্য জ্বরমুক্ত হয়েচেন, দুর্বল শরীর, স্বগতভাবে বল্লেন-- ছেলে আমায় বিদেশ থেকে শেষকালে এই জিনিস পাঠালে? মহারাজ স্তব্ধ হইয়া গেলেন, তাঁহার হাত হইতে শটকা খসিয়া পড়িল। সকলেই চুপচাপ।

   কয়েক মিনিট পরে নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করিয়া বাবুরাম মহারাজ বলিতে লাগিলেন--ধন্য মা! তিনি ঐ সব বিষ নিজে গ্রহণ করে আমাদের মতন সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখচেন। তিনি ঐ বিষ গ্রহণ না করলে আমরা কবে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যেতুম। বলিয়াই দুই হাত তুলিয়া ভাবাবেগে বারবার মাকে প্রণাম করিতে লাগিলেন।” (প্রেমানন্দ-প্রেমকথা--ব্রহ্মচারী অক্ষয়চৈতন্য) প্রসঙ্গত উল্লেখ্য এখানে মহারাজ বলতে শ্রীরামকৃষ্ণ মানসপুত্র স্বামী ব্রহ্মানন্দের কথা বলা হয়েছে।

     প্রেমানন্দজী শেষবার পূর্ববঙ্গে যান ১৯১৭ সালে। এখানে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে গমনকালে প্রচুর লোক সমাগম হত। তাঁর আকর্ষণীশক্তিবলেই যে এটা ঘটত তা নিঃসংশয়ে বলা যায়। এই বিষয়ে এক প্রত্যক্ষদর্শী মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে তুলনা টেনে বলেন যে, মহাত্মাজীকে দেখবার জন্যও নাকি এমন লোকসমাগম দেখা যায় না। মুসলমান সমাজেও তাঁর প্রেমের অমোঘ সঞ্চার ঘটেছে দেখে ময়মনসিংহের টাঙ্গাইল মহকুমার ঘারিন্দা গ্রামে তাঁর অবস্থানের সুযোগ নিয়ে জনৈক মুসলমান মৌলবি এক কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন। সম্মোহনী বিদ্যায় পারঙ্গম এক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে তিনি প্রেমানন্দ সকাশে হাজির হন। কিন্তু কার্যত অভীষ্ট কর্মটি সম্পাদন করতে ব্যর্থ হয়ে নিজ ত্রুটি স্বীকার করেন। এতে বিন্দুমাত্র বিরক্ত না হয়ে মৌলবিকে ফলমিষ্টান্নাদি আহার করতে দেন বাবুরাম মহারাজ। সেই মৌলবি তখন তাঁকে তার সঙ্গে এক পাতে আহার গ্রহণের আহ্বান জানান। যে উদার মতের প্রচার তিনি করে আসছেন তা কতটা অকপট তা যাচাই করাই ছিল মৌলবির উদ্দেশ্য। তৎক্ষণাৎ প্রেমানন্দজী সম্মতি জানান এবং কার্যত সেটাই করেন। ঘারিন্দার পর তিনি ঢাকায় যান এবং সেখান থেকে নারায়ণগঞ্জ হয়ে হাসাড়া ও সোনারগাঁ প্রভৃতি গ্রামে উৎসবে যোগ দেন। উৎসবকে উপলক্ষ করে সেখানকার মানুষের মনে নতুন ভাব, নতুন প্রেরণা সঞ্চার করতে তৎপর হন। পূর্ববঙ্গে সুদীর্ঘ ভ্রমণ ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে অতিরিক্ত পরিশ্রমের ফলে প্রেমানন্দজী কালাজ্বরে আক্রান্ত হলেন।

  কলকাতায় ফিরে এলে চিকিৎসা শুরু হয়। এর ফলে রোগের উপশম হয় কিছুটা। এরপর স্বাস্থ্যলাভের উদ্দেশ্যে বৈদ্যনাথ ধামে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে। এই সময় সারা বিশ্বে ইনফ্লুয়েঞ্জা রোগ মহামারিরূপে আত্মপ্রকাশ করেছে। বৈদ্যনাথধামে এটি তাঁর দেহে সংক্রমিত হয়ে জীবনসংশয়ের পরিস্থিতি সৃষ্টি করল। খবর পেয়ে গুরুভ্রাতা স্বামী শিবানন্দ (মহাপুরুষ মহারাজ) অতি সত্বর সেখানে গিয়ে তাঁকে সঙ্গে নিয়ে কলকাতা ফিরে এলেন। কিন্তু রোগ তখন অনেক গভীরে প্রোথিত হয়ে গিয়েছে। ২৭ জুন, শনিবার, কলকাতায় পৌঁছিয়েই ডাক্তার বিপিনবিহারী ঘোষকে দেখানো হল। ডাক্তার ঘোষ দেখে বললেন যে, এ তো সব শেষ করে আনা হয়েছে, তাঁর আর কিছু বলার নেই। ভক্তরা শুনলেন শ্রীরামকৃষ্ণ মানসপুত্র স্বামী ব্রহ্মানন্দ বিচলিত হয়ে বলছেন-- “এখন নারায়ণ বৈদ্য, গঙ্গাবারি ঔষধ।” বাবুরাম মহারাজকে বসু-ভবনের (অধুনা বলরাম মন্দির) উপরের হলঘরে এনে রাখা হয়েছিল।

     ১৪ই শ্রাবণ,১৩২৫ (৩০ জুলাই ১৯১৮) মঙ্গলবার। এদিন সকাল থেকেই বাবুরাম মহারাজের শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকেন। ব্রহ্মানন্দজী বিমর্ষভাবে পায়চারি করছেন, সেবককে স্তবপাঠে নিযুক্ত রেখে। সময় কাটতে থাকে। এরপর ঠাকুরের একটি ফটো নিয়ে এসে তিনি বাবুরাম মহারাজের কাছে বসে বললেন,“ বাবুরামদা, ঠাকুরকে দেখ।” কিন্তু তিনি দেখলেন কিনা বোঝা গেল না। তাঁর কানের কাছে উচ্চৈঃস্বরে বলে উঠলেন--“ বাবুরামদা, বাবুরামদা, ঠাকুরকে মনে আছে?” প্রেমানন্দজী চোখ খুলে দেওয়ালে ঠাকুরের তৈলচিত্রের দিকে তাকালেন। পরক্ষণেই নিমীলিত দুই চোখের কোণ দিয়ে প্রেমাশ্রু গড়িয়ে পড়ল। মহাসমাধিতে মগ্ন হলেন শ্রীরামকৃষ্ণ তনয় স্বামী প্রেমানন্দ। এবারের মতো অবতার লীলায় পার্ষদ ভূমিকা শেষ হল। শ্রীম অর্থাৎ মাস্টারমশাই এই দেহাবসানের সংবাদ পেয়ে বলেছিলেন--“ঠাকুরের প্রেমের দিকটা চলে গেল।” উদ্বোধনে শ্রীশ্রীমা সংবাদ পেয়ে কেঁদে আকুল হলেন। স্ত্রী ভক্তদের কাছে তাঁর পরম আদরের বাবুরামের কথা বারবার বলতে লাগলেন। বলেছিলেন--“ বাবুরাম আমার প্রাণের জিনিস ছিল। মঠের শক্তি ভক্তি যুক্তি-- সব আমার বাবুরামরূপে আলো করে বেড়াত।"


জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments