জ্বলদর্চি

শামসুর রাহমান / ঈশিতা ভাদুড়ী

স্মৃতি ডট কম ৩

শামসুর রাহমান 

 ঈশিতা ভাদুড়ী 

মনে হয় ২০০৫ সাল, বাংলাদেশে জাতীয় কবিতা পরিষদের আমন্ত্রণে ঢাকাতে কবিতা পড়তে গিয়েছিলাম। আমাদের এখানে যত কবিতা-উৎসব, যত মেলা হোক না কেন, ঢাকাতে গিয়েই আমি বুঝেছি বাংলা কবিতা-উৎসব কাকে বলে। শুধুমাত্র কবিতার জন্যে এত উন্মাদনা আমি দেখিনি আর। শুধুমাত্র কবিতার জন্যে পদযাত্রা, তায় আবার আমার অন্যতম প্রিয় কবি শামসুর রাহমানের সঙ্গে!

সেই শামসুর রাহমান, যাঁর অনবদ্য কবিতা একের পর এক পড়ে চলেছি সেই কবে থেকে – ‘…কাজ করছি, খাচ্ছি দাচ্ছি, ঘুমোচ্ছি, কাজ করছি, / খাচ্ছি দাচ্ছি, চকচকে ব্লেডে দাড়ি কামাচ্ছি, দু’বেলা / পার্কে যাচ্ছি, মাইক্রোফোনী কথা শুনছি, ঝাঁকের কই ঝাঁকে মিশে যাচ্ছি’। অথবা ‘স্বাধীনতা তুমি / রবিঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান। / স্বাধীনতা তুমি / কাজী নজরুল, ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো / মহান পুরুষ, সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাঁপা - / স্বাধীনতা তুমি / শহীদ মিনারে অমর একুশে ফেব্রুয়ারির উজ্জ্বল সভা…’
আমি কখনোই ভাবিনি কোনোদিন আমার শামসুর রাহমানের সঙ্গে পরিচয় হতে পারে। কোনো বিখ্যাত মানুষের বাড়ি গিয়ে আলাপ করার অভ্যেস আমার কোনোদিনই নেই, আমার ইচ্ছে থাকে না তা’ নয়, আসলে আমার কুণ্ঠা বোধ হয়, আমার মতো সামান্য মানুষের তাঁদের মতন বিখ্যাত মানুষকে বিরক্ত করার অভিপ্রায় কোনোদিনই হয়নি তাই। কলকাতায় থেকেও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বা শঙ্খ ঘোষের বাড়িতে সকালবেলার আড্ডায় আমার কখনো যাওয়া হয়নি। তো এ হেন লাজুক আমি শামসুর রাহমানের বাড়িতে গিয়ে আলাপ করব, তাও তো ভাবিনি। 

যাইহোক জাতীয় কবিতা উৎসবের অনুষ্ঠানে গিয়ে আমার অন্যতম প্রিয় কবি শামসুর রাহমানের সঙ্গে পরিচয় ঘটে গেল। ঘটনাচক্রে আমরা মঞ্চে পাশাপাশি বসেছিলাম। তিনি ফ্লোরে বসতে পারেন না বলে চেয়ারে বসেছিলেন, আমি নিচে, একদম পাশেই। শুধু মঞ্চে নয়, আমরা একসঙ্গে পদযাত্রায় পাশাপাশি হেঁটেওছিলাম। উৎসব চলা-কালীন আমাদের কিছু কিছু কথাবার্তাও হয়েছিল। শামসুর রাহমান যে একজন নিরহংকারী মানুষ, তার পরিচয় ওই স্বল্প-কথাবার্তায় পেয়েছিলাম। 
আমাকে বাড়িতে যাওয়ার নিমন্ত্রণও করেছিলেন, যদিও সে-যাত্রায় যাওয়া হয়নি আমার তাঁর বাড়িতে। কিন্তু পরবর্তীকালে যখন আবার ঢাকা গিয়েছিলাম, তখন গিয়েছিলাম তাঁর বাড়ি। ২০০৬ সালে বাংলাদেশের একুশে গ্রন্থমেলায় আমার ‘প্রেম ও বিরহের কবিতা’ নামে একটি বই প্রকাশিত হয়েছিল। সেই উপলক্ষ্যে আমি ঢাকা গিয়েছিলাম। তখন শামসুর রাহমানের বাড়িতে হঠাৎ করেই যাওয়া ঘটে গিয়েছিল। তিনি আমাকে তাঁর বাড়িতে যাওয়ার নিমন্ত্রণ করা সত্ত্বেও আমি যেতে পারিনি শুনে গ্রন্থমেলার মাঠ থেকে ‘পাঠশালা’ প্রকাশনার কর্ণধার এবং আমাদের বন্ধু সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল আমাকে সঙ্গে করে শ্যামলীতে তাঁর বাড়িতে নিয়ে গেলেন।

বলা বাহুল্য এত বড় কবির বাড়িতে পৌঁছে আমি যেন চাঁদে পৌঁছে গেলাম! দুলাল ভাইয়ের অন্য কাজ থাকায় তিনি চলে গেলেন আমাদের আগেই। সেখানে জোহরাভাবীর সঙ্গেও পরিচয়। বড় মানুষদের স্ত্রীরা মনে হয় নীরব থাকতেই ভালোবাসেন, তিনি আমাদের খাইয়ে-দাইয়ে অনেক আপ্যায়ন করেছিলেন। বিভিন্ন লেখা পড়ে শামসুর রাহমানকে ইন্ট্রোভার্ট জেনে থাকলেও তিনি কিন্তু খুব কাছের মানুষের মতনই অনেক কথাবার্তা বললেন আমার সঙ্গে, এমন মনে হল অনেকদিন ধরেই আমার সঙ্গে তাঁর কথাবার্তা হয়। আমাদের কথোপকথনের দু-চার কথা …

--তোমাদের ওখানকার অনেক কবি-লেখক আমার বাড়িতে এসেছেন। 
--আপনি বাংলা ভাষার এত বড় কবি, আপনার সংস্পর্শে তো মানুষ আসতে চাইবেই। 
--না না, আমি বড় কবি নই। বড় কবি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত…আমি কবিতাকে ভালোবাসি, অন্যের কবিতা পড়ি, নিজেও লিখি…কবিতা ছাড়া আর তো কিছু বুঝিও না।


--আপনি জীবনানন্দর সঙ্গে কথা বলেছেন?
--তখন তো ততো ফোন ছিল না। আমি গিয়েছিলাম ল্যান্সডাউনে ওঁর বাড়িতে, অনেকদিন আগে একবার, তেইশ-চব্বিশ বছর বয়সে। নরেশ গুহ নিয়ে গিয়েছিলেন, আলাপ করতেই গিয়েছিলাম, কিন্তু তিনি খুব ইন্ট্রোভার্ট ছিলেন, কথা বলতেন না ততো…তাই আমাদের বাক্যালাপ হয়নি বেশি। আর যাওয়া হয়নি। তার একবছর পরে তো তাঁর মৃত্যুই হয়ে যায়…

আমার দু-একটি কবিতার বই দিয়েছিলাম তাঁকে, আমার সামনেই উলটে পালটে দেখলেন, ‘অথবা ব্রহ্মকমল’ বইটি প্রায় পড়েই ফেললেন, প্রশস্তিবাক্যও বললেন। তাঁর মতন কবির কাছ থেকে সেসব শোনা আমার কাছে খুবই মহার্ঘ্য ছিল। তিনি বাংলাদেশের একজন প্রধান কবি, স্টার বলা যায়, যদিও তিনি এসব মানতে রাজি নন। তিনি বললেন, আমরা তৃতীয় বিশ্বের মানুষ, আমাদের হাজার সমস্যা। অনেক সময়ই ইচ্ছের বিরুদ্ধে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়তে হয়, প্রত্যক্ষ না হলেও পরোক্ষভাবে কিছু দায় এসেই যায়… আমরা বাংলাভাষায় লিখি, যদিও বাংলাভাষার কবিরা বিশ্বের দরবারে পৌঁছাতে পারে না ততো… আমরা আমাদের ভাষাকে ভালোবাসি…ভাষার জন্যে প্রাণ দেয় আমাদের তরুণ-কিশোরেরা…
এভাবেই ঘন্টাখানেক কেটে গেল। শেষে তাঁরই লেখা কয়েক পংক্তি –
 ‘… আমার কবি্তা করে বসবাস বস্তি ও শ্মশানে, 
চাঁড়ালের পাতে খায় সূর্যাস্তের রঙলাগা ভাত, 
কখনো পাপিষ্ঠ কোনো মুমূর্ষু রোগীকে কাঁধে বয়ে 
দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছে যায় আরোগ্যশালায়। 

আমার কবিতা পথপ্রান্তে দুঃখীর চোখের মতো 
চোখ মেলে চেয়ে থাকে কার পায়ের ছাপের দিকে, 
গা ধোয় ঝরনার জলে। স্বপ্ন দ্যাখে, বনদেবী তার 
ওষ্ঠে ঠোঁট রেখে হু হু জ্বলছেন সঙ্গম-লিপ্সায়!’


জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments