জ্বলদর্চি

অ্যাপের নাম বাবাজী-৩ /বাসুদেব গুপ্ত

অ্যাপের নাম বাবাজী

বাসুদেব গুপ্ত

৩য় পর্ব  

-টাকা যখন করতেই হবে তখন একটু বেশি বেশি টাকার কথাই ভাবব। 
আইপ্যাডে বসে গুগল করতে করতে গম্ভীরমুখে মন্তব্য করল রূপম।
-ঠিকই বলেছ। আমার বাবা বলতেন খেতে যদি হয় খাবো তিমি মাছের ফ্রাই।
বিজলি গ্রীলের ফিস ফ্রাই একটু মাস্টার্ড আর টার্টার সসে মাখিয়ে একটা গভীর কামড় দিতে দিতে লোকির জোক। 
-তোর বাবা এখন কোথায়? তোর সংগেই থাকে? রতুর নিরীহ প্রশ্ন। 
ঘরটা একটু চুপচাপ হয়ে যায়। 
-ওর বাবা তিন মাস আগে করোনার শিকার। অক্সিজেন পাননি। পেলে হয়ত বেঁচেই যেত। রূপম গুগল করতেকরতে জানিয়ে দেয়। 
-ঐ ওপরে। 
নিরাসক্ত মুখে ওপরের দিকে আন্গুল তুলে দেখায় লোকি। 
-নিশ্চয় তিমি মাছের ফ্রাই মারছে। বেঁচে থাকতে একবারই খেয়েছিল স্থানীয় নেতার পাতানো ভাইএর বিয়েতে। আটরকম মাছ দুরকম মাংস গলদা চিংড়ী যত খুশি। চার রকম পোলাও বিরিয়ানি। কে ভুলবে। আমার বাপ সে টেস্ট আর ভোলেনি।
-তো সেই নেতা কোনো হেল্প করেন নি?
-করতেন হয়ত। কিন্তু তখন তিনি দুবাইতে কি একটা জমির কাজে ব্যস্ত। বুরুজ হোটেল আছে না, তাতেই নাকি ঘর কিনতে গিয়েছিলেন
-ফালতু বকিস না তো,
 খিঁচিয়ে ওঠে অর্ণব। 
-বুরুজ হোটেল নয় বুর্জ খলিফা। ওটা শাহরুখ খানের প্রপার্টি। দিলওয়ালে দুলহনিয়া দেখে ওদের দেশের আমীর খুশি হয়ে পুরস্কার দেয় জানিস না বকবকবক করে যাস খালি।
-তোরা চুপ করবি। টাকার কথা শুনতে চাস তো শোন,
রূপম গুগল করে ওদের পড়ে পড়ে শোনায়।
বলতো দেখি কিসে সবচেয়ে বেশি টাকা?
-লটারীর ফার্স্ট প্রাইজ। 
-স্মাগলিং
-ড্রাগ।  ড্রাগে শালা পয়সা হি পয়সা। দেখলি না একটা জাহাজ আটকে গেল গুজরাটে পাওয়া গেল ৩০০০ কোটি টাকার ড্রাগ
-নানা আমি জানি শেয়ার খেলে।
নানা মুনির নানা মত। রূপম এক ধমক দিয়ে বলে শোন তোদের কয়েকটা ফিগার শোনাই। অজ্ঞান হয়ে যাস না। সবচেয়ে বেশি টাকা কার? জেফ বেজোস। কে জানিস?
-আম্মাজান আমাজন। আমাজনের মালিক। 
দেখা গেল আম্মাজানকে সবাই চেনে। 
-তার টাকা হচ্ছে ধর ২০০ বিলিয়ন ডলার মানে ২০০*৭০*১০০০০০০০০০। কত হলো? ১৫ লক্ষ কোটি টাকা।
-এবারে শোন ওয়ারেন বুফে। উনি কিছু করেন না শুধু শেয়ার খেলেন। ৯১ বছর বয়স এখনও খেলা চালিয়ে যাচ্ছেন। শচীন সৌরভরা কবেই বসে গেছে খেলা থেকে। ওনার সম্পদ হলো ১০৫ বিলিয়ন ডলার মানে প্রায় সাড়ে সাত লক্ষ কোটি টাকা।
আমাদের হর্ষদ মেহতা তো অনেক টাকা করেছিল?
-ভালো তবে তুলনায় আসে না খুব জোর ৫০ থেকে ৬০০০০ কোটি টাকার গল্প। কিন্তু হজম না করতে পেরে ৪৭ বছরবয়সেই দুঃখজনক মৃত্যু।
চুক চুক আওয়াজ করে ওঠে রতু। ইন্ডিয়ানরা কি পারে আমেরিকানদের সংগে। 
 -এবারে শোন ক্যাসিনোর গল্প। ক্যাসিনো জানিস তো? শেলডন এডেলসন। বিরাট সফল ক্যাসিনো ব্যবসায়। প্রায় ১৬ বিলিয়ন ডলার। তোরা হিসেব করে নে। এক বিলিয়ন ডলার মানে ৭০০০০ কোটি টাকা।
-ট্রাম্পেরও ক্যাসিনো ছিল না?
-ছিলো তো বটেই। প্রায় দু বিলিয়ন ডলার কামিয়ে ঝামেলায় পড়ে ভদ্রলোক আমেরিকার প্রেসিডন্ট হন। পাবলিককে ভুজুং ভাজুং দিতে পারেন দারুণ। আর পাবলিকও গ্যাস খায়। 
-আমাদের দেশের লোক অত বোকা নয়। লোকির মন্তব্য।
একবার তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে রূপম। কিছু না বলে আবার গুগলে চোখ দেয়।
-এর পরেই মনে হবে ড্রাগের ব্যবসার কথা। সবচেয়ে নাম করা লোক হল পাবলো এসকোবার। তার সম্পত্তি ৩০ বিলিয়ন ডলার। 
-আর এখন বাজারে উঠেছে নতুন খেলা বেটিং। বাজি ধরো। লোকে সব কিছুর ওপরেই বাজি ধরতে রাজি। 
-আমরা সবাই একটু বাজীগর তাই না, 
লোকির গুরুদেব ওর মন জুড়ে আছে বোঝাই যায়।
-ওরে বাবা বাজীগর মানে জাদুকর। পি সি সরকার। আমি বলছি বাজী মানে যাকে বলে বেটিং। আমাদের এখানে সাট্টাও বলা হত। এখন সবচেয়ে বড় বেটিং কম্পানী হলো international sports technologies তাদের আয় ৫ বিলিয়ন ডলার
-আর ড্রিম ইলেভেন? মাইটিম ইলেভেন? এখন তো সৌরভ ধোনি সেবাগ সকাল বিকেল এড দিয়ে যাচ্ছে। 
অর্ণব বলে ওঠে। ও ক্রিকেট পাগল। এই সব পরিসংখ্যান ওর নখের ডগায়।
-তাও বলছি। মাইটীম ইলেভেন হচ্ছে  প্রায় ২০ মিলিয়ন। না বিলিয়ন নয়। এখনও এতদূরে যায় নি। কিবু ঝলি তাহলে? কোন রাস্তায় গেলে টাকা হি টাকা?
সবাই ভাবতে বসে। কাঁচের ছোট গ্লাসে চা দিয়ে গেল বাড়ীর নীচেই বসা মোবাইল চাওলা রামু যাদব। মোবাইলে হাটসাপে অর্ডার নেয় বলে তার এই শুভনাম।
-ইজি। ব্যবসাতেই বেশি টাকা 
-মূলধন কে দেবে? যার গুজরাতি শ্বশুর নেই তাকে ব্যাংকও লোন দেবে না।
_শেয়ারেও খুব টাকা।
-শেয়ার কিনতে পয়সা লাগে। আর টাকা হতে হতে ১০ বছর। বেশি জলদি করতে গেলেই মেহতা সাহেবের হাল।
-ড্রাগ? সেটা তো হবে না 
-ক্যাসিনো?
-একটা ক্যাসিনো খুলতেই তোর ১০০ কোটি বেরিয়ে যাবে। 
-তাহলে! সবাই বিষণ্ন হয়ে যায়। টাকা কি তা হলে হবে না? সেই নেটের  তার টাঙ্গানো আর জিমের ট্রেনার হয়ে কদ্দিন চলবে?
-আমার মাথায় এসেছে একটা ফান্ডা। ফান্ডও লাগবে না। শুধু ওয়েব সাইট চাই একটা। আর টকাটকের মত একটা একাউন্ট।
-কি কি কি। কি সেটা?
যেন হঠাৎ স্লুইস গেট খুলে দিয়েছে ডিভি সি এমনি উচ্ছ্বাস শোনা গেল সমবেত কন্ঠে।
-নামও একটা ভেবেছি। অ্যাপের নাম বাবাজী এডভেন্চারস।
-আমি ওদিকে জ্যামে আটকে রয়েছি আধঘণ্টা আর অটোওলার গলায় শ্যামাসংগীত শুনছি আর তোমরা ফ্রাই খেতে খেতে অ্যডভেঞ্চারের প্ল্যান করছো? বাঃ
হঠাৎ তীক্ষ্ণ গলার আওয়াজে সবাই দরজার দিকে তাকায়। ডাকাত নয়, শিখা। 
-কি আমি চা খাবো না? তোমাদের রামু মোবাইলকে একটু বলে দাও দয়া করে। দুধ ছাড়া চিনি ছাড়া।

সভা ভঙ্গ হয়ে গেল বুঝে চোখাচোখি হয় বাঊন্টিহান্টারসদের মধ্যে। রূপম বিরস গলায় জানায়, 
-আবার বুধবার বসবো কিন্তু। তার মধ্যে আমি প্ল্যান করে নি অ্যাপটা কি কি কি হবে।
সবাই বেরিয়ে গেলে ঝপাং করে এক লাফ দিয়ে  শিখা এসে রূপমকে জড়িয়ে ধরে। বলে 
-দাও।
-দেবো বলেই তো বসে আছি প্রিয়ে। পেন ড্রাইভটা তো। হ্যাঁ সিরিয়ালটা পুরো কপি করে দিয়েছি।
-উজবুক একটা। আমি কি তাই বলেছি?
-তবে কি প্রিয়ে?
-আমি বলেছি, মানে আমি বলেছি,
-থাক আর বলতে হবে না।
দুজনেই বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। খাবার সময় কথা বলতে নেই গুরুজনদের শিক্ষা কি ভোলবার?
 
গোল হয়ে মোড়ার ওপর বসেছে চারজন। প্রাচীন বাড়ীর শরিকি অংশ। ফার্নিচারও প্রাচীন। মোড়াগুলো কেনা ১৯৭১ সালে পৌষমেলায়। বেশ সংস্কৃত সংস্কৃত চেহারা। ওপরে চামড়ার সীট পুরনো ঘষা দেওয়ালের মত। তিন সাগরেদ বসে। আর রূপম বসে একটা সোফায়। সোফায় নেটের কভার একদিকে ঝুলে গেছে। বাকী ঘর ভর্তি নানাবয়সের ও সাইজের ল্যাপটপ একটা ঢাকা খোলা হাঁ করা  ডেস্কটপ, আলমারির ওপর রাউটারের সবুজ আলো অল্প অল্প পিটপিট করছে আর  শিখা মন দিয়ে একটা রেডমি ফোনে কি সব টাইপ করছে।
আজ আইডিয়া পেশ করবে রূপম। সবাই খুব উৎসুক। সামনে গোল গোল চীনা ছবি আঁকা কাপে জেসমিন টি। শিখার আমদানী। রূপমের পছন্দ দুধ চা কিন্তু নিরুপায়।  শিখা যদি চায় রূপম বাধ্য ছেলে হয়ে মেনে নেয়। আখেরে তাতে লাভ। 
 রূপম একটা চুমুক দিয়ে শুরু করে।
-টস জানিস তো? টস, হেড টেল। খেলা শুরুর আগে হয়। একটা পয়সা এক টোকা মেরে আকাশে ছুঁড়ে দাও আর ওটা ঘুরতে ঘুরতে পড়বে মাটিতে। পয়সার একটা দিক থাকবে আকাশের দিকে মুখ করে যেটা দেখা যাবে। হেড নাহয় টেল। আগে হেড মানে বোঝাতো বিদেশী রাজার মাথা। এখন থাকে অশোকস্তম্ভ বা গান্ধীর মাথা। পরে নতুন কারো মাথাও হতে পারে। যাই হোক যখন ছোঁড়া হল তখন একজনকে গেস করতে হবে হেড পড়বে না টেল পড়বে। মিলে গেল তো টসে জয়। বিরাট কোহলি বলব আমি ফিল্ডিং নেব। না মিললে অপোনেন্ট টিম জিতে যাবে।
-আমরা কি কোন গেম বানাচ্ছি? 
রতু জিজ্ঞেস করে ওঠে। খেলায় ওর প্রবল উৎসাহ।
-জীবনটাই তো একটা বিরাট খেলা রে রতু। সারাক্ষণ ভাগ্য টস করে যাচ্ছে। ইন্টারভিউ দিলি। চাকরি হলো বা হলো না। বাস ধরতে গেলি। বাসটা এলো বা আগেই চলে গেছে। মেঘ করেছে। বৃষ্টি হবে কি হবে না? তুই বেট ধরলি হবে না। ছাতা নিলি না। ভিজে চুপসে গেলি। আবার তুই বেট ধরলি বৃষ্টি হবে, ছাতা নিয়ে বেরোলি। খটখটে আকাশ। মাঝখানে ছাতাটা অফিসে ফেলে চলে গেলি। ফেরার সময় ঝমঝম বৃষ্টি। 
আবার ধর একটি সুন্দরী মহিলা। তোর পছন্দ। তুই জানিস না সে তোকে পছন্দ করে কি না। বেট ধরলি পছন্দ করে। তারপর তোর হার্ট ড্যামেজ করে দিয়ে সে চলে গেল আর কারো হাত ধরে। 
বলে আড়চোখে রূপম  শিখার দিকে তাকালো। একমন দিয়ে টাইপ করে যাচ্ছে। -কে বলেছে প্রতিটি কথা শুনছে আর রেকর্ড করে নিচ্ছে। মাল্টি কোর সিপিইউ। মুচকি হেসে রূপম আবার শুরু করে। 

-আমার নতুন প্রোডাক্ট অ্যাপের নাম দেখবাবাজী ডট কম। বেশ শুনতে না, একটা চ্যালেঞ্জ আছে। দেখবি নাকি, ভোজের বাজী।
-দেখটা বাদ দাও। টাকা পইসার ব্যাপার, লোকে পছন্দ করবে না। শুধু বাবাজী কর। 
শিখা মুখ তুলে জানিয়ে দেয় তার পছন্দ। 
-বাবা আছেন আমাদের ধর্ম ভীরু দেশ আর বাজী বা বেট আছে। নামটা আমার খুব মনে ধরেছে। এটাই হোক,  তারপর বলো।
-ব্যাপারটা আসলে খুব সহজ। আমরা রোজ নানা রকম ইভেন্টের ওপর পাবলিককে বেট করতে বলব। হেড না টেল? হবে কি হবে না? লোকে রেজিস্টার করবে একটা ফি দিয়ে। এবারে টস হবে কম্পিউটারে। যত কালেকশান হবে তার থেকে আমাদের কমিশন কেটে নেব। ধর ২০%। বাকীটা যারা পারবে তাদের ভাগ করে দেওয়া হবে। বুঝলি?
সবাই সমস্বরে বলল 
-হ্যাঁ। বুঝেছি। কিন্তু এ আর এমন কি? কত সাইট আছে। এ তো যে কেউ করতে পারে। আমাদের স্পেশাল কি হলো?  কি নিয়ে টস হবে? সাট্টার মত? আলুর দাম কত? লোকে আমাদের সাইটে এসে বেট করবেই বা কেন?
 -সেটা বলবে  শিখা। এসো।
 শিখার সংগে এদের সবারই খুব ভাব। কিন্তু কেউ আশা করে নি যে রূপম স্টেজ ছেড়ে দেবে  শিখাকে। সবাই কৌতূহলে কান খাড়া চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল।
-তোমরা কেউ এ আই জানো? ইংরেজী এ আই?
হাত তুলল লোকি। 
-রোবোট। আমি দেখেছি নেটে। যা বলবে উত্তর দেবে। রেস্টুরেন্টে চা দেবে। 
অর্ণব পছন্দ করে নি উত্তরটা। সে একটু মুখ বেঁকিয়ে সবজান্তার মত উত্তর দিল
-আরটিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্স। মানে কৃত্রিম বুদ্ধি। মেসিনকে এমন ট্রেনিং দেবে যে সে মানুষের মত বুদ্ধির কাজ করতে পারবে। সব পারবে না, কিছু কিছু কাজ। যেমন এলন মাস্কের অটোম্যাটিক কার। নিজেই চলবে রাস্তা দিয়ে ড্রাইভার ছাড়াই। শুধু বলে দাও কোথায় যেতে হবে। ঠিক চলে যাবে। 
-দুজনেই ঠিক বলেছ। কিন্তু অন্ধের হাতী দেখার মত এক এক জন এক একটা দিকের কথা বললে। এ আই মানে রোবট নয় বা গাড়ী নয়। ওগুলো বুদ্ধির এক একটা প্রকাশ। আসলে বুদ্ধি মানে বুদ্ধি। যার পেছনে রয়েছে শিক্ষা। মেসিন লারনিং। যন্ত্রকে শিক্ষা দিতে হবে আগে। সেইটাই সবচেয়ে কঠিন কাজ।
কেউই বুঝতে পারছিল না অ্যাপের নাম বাবাজী ডট কমের সংগে কি সম্পর্ক এআইএর। 
এর পরের পর্বে প্রকাশ হবে সেই গোপন প্ল্যান। একেবারে গোপন প্ল্যান। আশা করি কেউ এটা প্রকাশ করবেন না। কে জানে এই একটা আইডিয়ার দাম এক বিলিয়ন ডলার হয়ে গেল।
(ক্রমশঃ…)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments