জ্বলদর্চি

গোটা সেদ্ধ ( শীতলষষ্ঠী ) /ভাস্করব্রত পতি

পশ্চিমবঙ্গের লৌকিক উৎসব, পর্ব - ৬
গোটা সেদ্ধ ( শীতলষষ্ঠী )

ভাস্করব্রত পতি

শ্রীপঞ্চমী তথা সরস্বতী পুজোর পরের দিন হল 'শুক্লাষষ্ঠী'। আসলে এটি 'শীতলষষ্ঠী' বা 'শিলনোড়া ষষ্ঠী'। কেউ কেউ বলেন "গোটা ষষ্ঠী"। আসলে আগের দিন থেকে তৈরি করা গোটা গোটা সবজি সেদ্ধ খাওয়ার রীতি এইদিন। রসনাপ্রিয় বাঙালির কাছে তা 'গোটা সেদ্ধ' নামে পরিচিত। বাড়িতে রান্না হয়না এদিন। আর সবকিছু খাওয়া হয় ঠাণ্ডা। 

প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই প্রয়োজন শিল এবং নোড়া। এই শিলনোড়ার পুজো করা হয় শীতলষষ্ঠীতে। এটাই 'শিলনোড়াপূজা' বা 'শিলষষ্ঠী'। এদিন শিলনোড়ার বিশ্রাম। বাড়িতে রান্না বন্ধ। উনুনের চুলা জ্বলেনা। তবে আজকাল গুঁড়োমশলার দাপটে শিলনোড়ার প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়েছে অনেক দিনই। মানুষও ভুলে যাচ্ছে শিলষষ্ঠীর আরাধনা। অনেক পরিবার অবশ্য সূর্যোদয়ের সময় ও তিথি অনুসারে ব্রত-পার্বণ পালন করে। পাঁজীতেও সেরকমই বলা আছে। তাই বাড়ির "গোটা বা শীতল ষষ্ঠী" উদযাপন করা হয় তিথি মেনে। ফলে কখনো কখনো এই দিনটি সরস্বতী পূজার পরের দিন ছাড়িয়ে তার পরের দিনেও হয়। তবে ওড়িশায় 'শীতলষষ্ঠী' পালিত হয় জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লা ষষ্ঠীতে। সম্বলপুর এলাকায় এই দিনটি বিশেষভাবে পালিত হয় মূলত শিব ও শক্তির আরাধনার জন্য। সেখানে এই উৎসব "শিব বিবাহ" নামেও পরিচিত।

এই শীতলষষ্ঠীতে হয় 'অরন্ধন'। আগেই বলেছি যে, এদিন রান্না বন্ধ। আর যেসব খাওয়া হয় তা বঁটিতে কুচানো হয়না। সবকিছুই গোটা গোটা সেদ্ধ করে খাওয়া হয়। তবে এই অরন্ধনের সাথে শ্রাবণ সংক্রান্তি কিংবা ভাদ্র সংক্রান্তির অরন্ধনের মধ্যে উপচারের ফারাক লক্ষ্য করা যায়। এই 'অরন্ধন' নানা যায়গায় নানা সময়ে নানা নামে পালিত হয়। দক্ষিণ ২৪ পরগনায় মাঘ মাসে গোটাসেদ্ধ বা শ্রীপঞ্চমী ব্রতের সাথে বাঁকুড়ায় শ্রাবণসংক্রান্তিতে খইঢেরা বা খইধারা বা আরণপালা, দক্ষিণ ২৪ পরগনায় ভাদ্রসংক্রান্তিতে অরন্ধন বা রান্নাপূজো, হাওড়ায় শ্রাবণ সংক্রান্তিতে ঢেলাফেলা, নদীয়ায় শ্রাবণসংক্রান্তিতে পাতালফোঁড়, বর্ধমানে শ্রাবণ সংক্রান্তিতে খইদই, হুগলীতে ভাদ্রসংক্রান্তিতে বুড়িআনন্দ ইত্যাদি লোক উৎসব প্রায় একই রকম। 

আসলে বাড়িতে উনুন জ্বালানো হয়না। আর সিলনোড়া দিয়ে মশলা বাটাও হয়না। তাই এই তিথিতে আগের দিনের গোটা সেদ্ধ রান্না ঠাণ্ডা অবস্থায় খাওয়া হয় পান্তা ভাতের সাথে। এই লৌকিক উৎসব ঘটিদের মধ্যে চালু থাকলেও বাঙালরাও অনেকে মানেন। শীতলষষ্ঠী পালিত হয় হুগলী, হাওড়া, পশ্চিম মেদিনীপুর, দক্ষিন ২৪ পরগনাতে। হিন্দিভাষী এলাকায় মাঘমাসে এটি পালিত হয়।

কিভাবে পূজা করা হয় এদিন? বাটনা বাটা শিলকে প্রথমে ভালো করে ধুয়ে নিতে হয়। এরপর ঐ শিলকে তেল হলুদ মাখানো হয়। তেল সিঁদুরের টিপ দেওয়া হয় শিলের গায়ে। পিটুলি দিয়ে শিলে 'ষাইট মূর্তি' কল্পনা করে আঁকা হয়। এর সাথে দেওয়া হয় শ্বেত চন্দনের ফোঁটা। আর শিলনোড়াতে জোড়া কলা, বাঁশপাতা এবং ২১ টি সজনে ফুল দেওয়া হয়। ঐ শিলটিকে দেওয়ালের গায়ে ঠেকিয়ে রাখা হয়। এরপর সেটিকে নতুন গামছা বা নতুন কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। গাঁদা ফুলের মালা জড়িয়ে দেওয়া হয়। শীতলা দেবী জ্ঞানে তা পূজা করা হয় শুক্লা ষষ্ঠীতে। 

সরস্বতী পুজোর রাতেই 'শিল জাগানো' হয়। শিলের কোলে নোড়া রেখে সাদা হলুদে ছোপানো কাপড় দিয়ে শিলটিকে ঢেকে রাখা হয়। ঐ কাপড়ের ওপরে সিঁদুরের ছ'টি ফোঁটা দেওয়া হয়। অঞ্চলভেদে উপচার আলাদা আলাদা হয়। পরেরদিন সকালে জোড়া শিম, জোড়া কড়াই শুঁটি, জোড়া কুল ( মোট ছ'টি ) শিল নোড়ার কোলে দেওয়া হয়। সেইসাথে এক বাটি 'গোটা সেদ্ধ' শিলনোড়ার সামনে নিবেদন করা হয় এবং ফুল দিয়ে প্রনাম করা হয় ঐ শিলনোড়া তথা শীতলা ঠাকুরকে।

ড. শীলা বসাক এই 'শিলনোড়া পুজো' সম্পর্কে লিখেছেন, "শ্রীপঞ্চমী বা সরস্বতী পুজোর পরদিন অর্থাৎ শীতল ষষ্ঠীর দিন শিলনোড়া পুজো হয়। সন্তানবতী নারীরা বাটনা বাটা শিলে পিটুলি দিয়ে ষাইট্ মূর্তি এঁকে তা হলুদ রঙের কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখে এবং শীতল ষষ্ঠীর দিন জোড়াকুল আর সিম দিয়ে এই পুজো করা হয়। সরস্বতী পুজোর দিন রাতে গোটা সেদ্ধ হয় অর্থাৎ শীষসহ পালংশাক, বেগুন, গাজর, কড়াইশুঁটি, সিম ইত্যাদি নানাধরনের সবজি না-কেটে গোটা সেদ্ধ রান্না করা হয় নুন-হলুদ ছাড়াই। পরের দিন পান্তাভাত দিয়ে গোটা সেদ্ধ খাওয়া হয় নুন-তেল মেখে। সাংসারিক মঙ্গল ও শরীর-স্বাস্থ্য ভালো থাকার কামনায় এই ব্রত পালিত হয়।"

গোটা সেদ্ধর উপকরণে থাকে পাঁচ ধরনের কলাই। একদম গোটা গোটা দেওয়া হয় মটর, মাসকলাই, ছোলা, বিরি ও মুগ। তবে মাসকলাই ও গোটা মুগ সবচেয়ে বেশি পরিমাণে থাকে। বাকিগুলো নাম কে ওয়াস্তে। এছাড়া সবজি হিসেবে থাকে গোটা গোটা গোল আলু, বেগুন, সীম, মটর শুঁটি, পুনকা গোড়া, পালং গোড়া, রাঙা আলু সহ অল্প পরিমাণে সজনে ফুল, কয়েকটি নারকেলি কুল এবং খোসাযুক্ত অল্প পরিমাণে চেরাই করা আখ। শীতলষষ্ঠীর উপচারে এই সব সবজি গোটা সেদ্ধ করে দেওয়া হয়। আসলে এ সময় পক্সের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। আর সেই রোগের দেবী হলেন শীতলা। পক্সের প্রতিষেধক হিসেবে সজনে ফুল সর্বজনবিদিত। গোটা সেদ্ধ রান্নার ফলে এগুলির ছালের পুষ্টিগুণ পেটে রায়। যে পরিমাণ প্রোটিন তথা খাদ্যগুণ আমাদের দেহে আসে তা পক্স রোধে সহায়ক। তাই শীতলষষ্ঠীর ব্রতে গোটা সেদ্ধ খাওয়ার চল রয়েছে।

গোটা সেদ্ধ প্রসাদ হিসেবে আত্মীয় বাড়িতে দেওয়ার চল রয়েছে। খুব উপাদেয় এই খাবার অনেকেই অন্যান্য চমকপ্রদ রেসিপির মতো গলাধঃকরণ করে। তবে ইদানিং অবশ্য ঐদিন হেঁসেলে রান্না বন্ধ রাখার চল হারিয়ে গিয়েছে। যথারীতি রান্না হয়। বরং অন্যান্য রসালো রান্নার সঙ্গে এই গোটা সেদ্ধ 'তরকারি' হিসেবে খাওয়া হয় তারিয়ে তারিয়ে। অনেকেই নিরামিষ খাবারের বদলে আমিষ খেয়ে থাকেন। শীতলষষ্ঠীর মূল নিয়ম হলো পূজোর পরে বাসি পান্তার সাথে এই গোটা সেদ্ধ খাওয়া।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments