জ্বলদর্চি

পদ্মপাতায় শিমুল-৮ /সীমা ব্যানার্জ্জী-রায়

পদ্মপাতায় শিমুল-৮

সীমা ব্যানার্জ্জী-রায়

-বড়দা-

বড়দা ক্লাসের সেরা ছেলে ছিল। শুধু সেরা ছেলে না, সব দিক থেকে সেরা ছেলে। ওই যে বলেছিলাম না “বুঢঢা” যাকে রাস্তায় অন্ধ অবস্থায় ভিক্ষে করতে দেখে বাড়ীতে নিয়ে এসেছিল। মা কে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে তাকে বাড়ির সামনের দিকের ঢাকা বারান্দায় এক কোণে ত্রিপল টাঙ্গিয়ে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। 

খেলাধূলা, ছবি আঁকা, পড়াশুনা, গান-নাটক সবেতেই স্কুলের সেরা ছিল বড়দা। 'আমাদের দল' নামে আবার একটা দল করেছিল। তখন মাত্র চোদ্দ বছরের ছেলে। সেই সময় তো স্বদেশী আন্দোলন চলছে। এইসব গল্প কিছুই জানতাম না, কারণ আমার জন্মের আগেই তো বড়দা মারা গেছে। মানে মার্ডার করেছিল তার প্রতিদ্বন্দ্বী এক সহপাঠী। আর তার সাক্ষীও ছিল।

--মার্ডার? সে কি? ইশ! শুনে কি খারাপ লাগছে। তোমাদের বাড়ি থেকে কেস করেন নি? ওনারা কি ভাবে জানতে পারলেন যে, মার্ডার করা হয়েছে? বলো না শুনি। ইন্টারেস্টিং তো!

--বলছি। বড়দা যা কাজ করত ওই টুকু বয়সে সব লিখে রাখত একটা কালো ডায়েরিতে। আর লুকিয়ে রাখত সেটা। বড়দা যে সমাজ সেবা করছে, স্বদেশী করছে বাড়ির কেউ তা টের পেত না। পাবে কি করে? কিছু তো বলত না বাড়িতে। আর পড়াশুনায় তো কোন ঘাটতি ছিল না।

মাঝে মাঝে স্কুলের মাইনে দিত না। বাবাকে পরে স্কুল থেকে জানানো হত যে, ধুনি স্কুলের মাইনে দেয় নি।

স্কুলের মাইনে রাস্তায় কোন গরীব কে দিয়ে দিত। আবার বড়দার পরিকল্পনায় 'আমাদের দল” গ্রুপ থেকে নিজেরা নিজেদের বাড়ি থেকে চাল, ডাল, আটা, শাক-সবজী এইসব নিয়ে আসত। তারপর সেগুলো গরীবদের বিলি করে দিত। বড়দার কথা যদি না বলি, আমার মনে হয়, আমার জীবনের অনেক কিছু ফাঁকি দিলাম। বলতে পারো, বড়দা আমার আইকন।

১৯৮৯ সালে আমেরিকায় আসার আগে কলকাতার গোলপার্কের রামকৃষ্ণ ইন্সটিটিউট অফ কালচার-এ স্প্যানিশ শিখতে যেতাম। তখন শ্রী রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় ওখানে ক্লাস নিতেন । ঠিক কি ক্লাস নিতেন মনে নেই আজ। যতদূর মনে পড়ছে বোধহয় আঁকা শেখাতেন। একদিন তাড়াতাড়ি মিশনে চলে যাওয়াতে লাইব্রেরীতে দাঁড়িয়ে একটা বই দেখছিলাম। উনি আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন। আমাকে অবাক করে হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, --“তোমার নাম কি?”

--শিমুল।

তখন আবার জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমার বাবার নাম কি?” বললাম বাবার নাম। শুনে উনি বললেন, “মুনিয়াদি-( আমার মেজদিদিয়ার ডাক নাম)” কোথায় এখন?”

বড়দা মারা যাবার সময় দিদিয়া ছাড়া আর তখন কেউই বড় ছিল না । তিন মেয়ের পরে ছেলে হয়েছিল বলে যা যা নিয়ম করতে হয় সব নাকি করা হয়েছিল।

-“কোথায় থাকো?” বললাম, 'ম্যান্ডেভিলি গার্ডেনস এ।' ফোন নাম্বার নিলেন এবং একদিন আসবেন বলে চলে গেলেন। সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে, কারণ উনি তো খুব নামকরা এখন অবশ্য জেনেছি।

পরের দিন সন্ধ্যাবেলা ম্যান্ডেভিলির 'জয়জয়ন্তী' ফ্ল্যাটে এলেন। ফ্ল্যাটে ঢুকেই বললেন, “তোমার ছোট বোন-কে আমি দেখিনি। তবে একেবারে ধুনির মুখ বসানো। তাই হঠাৎ সন্দেহবশতঃ হয়েই নাম জিজ্ঞেস করে ফেলেছি। ও কিছু বলে নি? লাজুক মনে হয়।”

তারপর ছোটবেলার বন্ধু বড়দাকে নিয়ে নানান গল্প করছিলেন। আরও বলছিলেন, “ ধুনি আজ বেঁচে থাকলে একজন কেউকেটা হত। ধুনি বড়দার ডাক নাম। আর ঢুসু হল রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়-এর ডাক নাম। খুব বন্ধু ছিলেন দুজনে। একেবারে মানিকজোড়। পাঁচু ঠাকুরের দোর ধরা বলে বড়দার ভালো নাম ছিল শ্যামসুন্দর বন্দ্যোপাধ্যায়। আর দেখতেও ছিল শ্যামসুন্দরের মত, একদম নাকি বাবার ডুপ্লিকেট। তারপর থেকে বাকি দাদাদের নাম এর শেষে গোপাল রাখা হয়।

টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। বড়দা সেদিন একটা ফুটবল ম্যাচ খেলতে যাবে কালি পাহাড়ের কোল ঘেঁষে একটা লেকের ধারে। সেখানেই ওরা ফুটবল খেলত। ম্যাচ হবে দু দলের। প্রতিদ্বন্দ্বী দলে ছিল বড়দাদার ক্লাসের সেকেন্ড বয়। বড়দাদা তো ফার্স্ট বয় ছিল।

পনেরো বছর বয়সে বাড়ির শুধু না বংশের সব চেয়ে বড় ছেলের পৈতে হবে। তার জন্য তোড়জোড়ের অন্ত নেই। চোদ্দ বছর পার হলেই ঠিক পনেরো বছর বয়সে পৈতে হবে। সবে গোঁফের রেখা উঠেছে তার সাদা ধপধপে রঙ আর গোলাপি ঠোঁটের ধার ঘেঁষে।

সূর্য আড়াআড়ি ভাবে ঢলে পড়ছে পশ্চিমে পাহাড়ের আড়ালে। খেলতে খেলতে বল লেকের জলের মধ্যে গিয়ে পড়েছে। সব ছেলেরা দৌড়াদৌড়ি করে বল আনতে গেলে বড়দাও যায় ওদের সাথে। সবাই যখন এদিক ওদিক করছে তখন হঠাৎ বড়দার আর্ত চিৎকার "বাঁচাও বাঁচাও” শুনে বন্ধুরা লেকের ধারে আসে। যারা সাঁতার জানে তারা ঝাঁপিয়ে জলে নেমে গিয়ে তাকে ডাঙ্গায় তুলে আনে। ঠোঁটের দু পাশ দিয়ে রক্ত পড়ছে তখন। তখনও প্রাণ ছিল তাই বন্ধুদের মধ্যে কয়েকজন ছুটে বাড়িতে এসে খবর দ্যায়। কয়েকজন ওকে নিয়ে হাসপাতাল-এ ছুটে যায়। কিন্তু রাস্তায় হার্টফেল করে শুধু একবার বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে আর ওই বন্ধুর দিকে আঙুল দিয়ে ইশারা করে। 

তারপর বাড়ির সবাই লেকের কাছে আসলে জানতে পারে হাসপাতালে নিয়ে গেছে...বাবাকে জানানো হয় এই কথা। বাবা তখনই অফিস থেকে ফিরেছেন। অফিস থেকে ফিরে বাবা রোজ বড়দার খোঁজ করেন। খেলতে গেছে শুনেই বাড়িতে তখনও মা কে বকছেন এই বলে, “ তোমার ধুনিকে নিয়ে আর পারা গেল না। আজ এত জ্বর নিয়ে কেন গেল খেলতে? আজ আসুক বাড়িতে...ওর পিঠের চামড়া তুলে দেব।” বড়দা কিন্তু তখন আর ইহজগতে নেই। ডাক্তার বললেন, “বুকে প্রচন্ড আঘাত লেগেছে।”

যখন বাড়িতে ডেড বডি আনা হয়েছিল, তখন বাড়ির গেটের কাছে সব ভিখারিদের ভিড়। “হম্বারা রাজাবাবুকো কিঁউ লে লিয়া ভগবান”, এই বলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছে তারা। সূর্য তখন কনে দেখা রঙ ছড়িয়ে অস্ত যাচ্ছে।

এদিকে ব্যানার্জ্জীদের বাড়িতে ঘন অমাবস্যা তখন। তরমুজের ফালির সূর্য তখন পশ্চিম দিকে হেলতে শুরু করেছে। তার আলো জানালো, চিরদিন বাঁচে না মানুষ। বাড়ীতে পুলিশ এ পুলিশ। লোকে লোকারণ্য। সবার প্রিয় ছিল যে।

এক সাধুবাবা ওখানে ধুনি জ্বালিয়ে পুজো করছিলেন। তিনি সব দেখেছিলেন। যখন দারোগা সাহেব এসে সোজাসুজি মা কে জেরা করেন যে, "আমরা খবর পেয়েছি যে, আপনাদের ধুনিকে খুন করা হয়েছে। বুকে লাথির আঘাতে হার্টফেল করেছে। আপনি শুধু একবার বলুন মা যে, খুন করা হয়েছে।” তখন আমার নিথর মা বললেন, “ আমার ধুনি চলে গেছে। সে তো আর ফিরবে না। যে করেছে সে তার মা-এর একমাত্র সন্তান। সেই মা-এর কোল শূন্য আমি করতে পারব না। আর আমি তো নিজের চোখে দেখিনি যে, কে খুন করেছে।”

মা জানতেন সেই ছেলে বড়দা কে যখন তখন ধাক্কা দিত। এইভাবে একবার তো পড়ে গিয়ে কপাল থেকে অনেক রক্ত পড়েছিল। একটুর জন্য একটা চোখ বেঁচে গিয়েছিল। মা কে নাকি বলত বড়দা, “ মা আমি ওর সাথে কত বন্ধু করতে চাই। ও কিছুতেই আমার বন্ধু হতে চায় না। কেন মা?” মা বুঝিয়েছিলেন যে, "ও এমনি করছে। পরে ঠিক হয়ে যাবে। দেখবি তোর প্রিয় বন্ধু হবে। মন খারাপ করিস না একেবারে। এখন তোরা দুজনেই ছোট তো।”

বড়দার ডায়েরি থেকে রোজকার দিনপঞ্জি কেমন ছিল,সব খবর পাওয়া যায়। স্কুলের মাইনে না দেওয়ার জন্য কত মার খেয়েছে বাবার কাছে। কিন্তু তাও মুখ ফুটে বলে নি যে, স্কুলের মাইনের টাকা ভিখারিদের দিয়েছে। পরে রাত্রে মা জিজ্ঞেস করলে বলত। 

ওহ হ্যাঁ! বড়দার ঐ বয়সে আবার একটা মেয়েবন্ধু ছিল। তিনি থাকতেন আমাদের রেলের কোয়ার্টারের পাশেই। নাম ছিল খুশি। মা কে বড়দা নাকি বলেছিল,“ বড় হয়ে আমি খুশিকেই বিয়ে করব, মা।” ঐটুকু ছেলে তখন। সেই খুশিদি নাকি আর বিয়ে করেন নি, দিদিয়ার কাছে শুনেছি। সত্যি আমার ভাগ্য খারাপ যে, আমি  বড়দাকে চোখে দেখি নি। তখন জন্মই হয় নি তো।

বড়দারা তিন বন্ধু মিলে একবার নাকি জামালপুরের কালী পাহাড়ে বেড়াতে গিয়েছিল। সন্ধ্যে হয়ে গেছিল বলে ওরা সেখান থেকে নিচে নামবার সময় রাস্তা ভুলে যায়। তখন দেখে কিছু দূরে পাহাড়ের গুহার মধ্যে একটা ধুনি জ্বলছে। এক সাধু সেখানে বসে ধ্যান করছেন। বড়দারা তিন বন্ধু সেখানে গিয়ে নিচে নামবার রাস্তা জানতে চায়। তখন সেই সাধু তাদের নিচে নামার রাস্তা বলে দেবার সাথে সাথেই হঠাৎ ওদের তিনজনকে তাদের আগামী ভবিষ্যতের কথা বলে ওঠেন। বড়দাকে বলেন, “ বেটা! তেরা সামনে এক খতরনাক ওয়াক্ত আ রহা হ্যায়। তু বেটা জরা সমভাল কে রহনা। আউর অগর ইস সময় বঁচ গয়া তো... তু বড়া কোই বননে ওয়ালা হ্যায়।” বড়দা মাকে এসে বলেছিল এই কথা। তার কিছুদিন পরেই সেই সাধুর ভবিষ্যৎ বাণী সত্যি ফলেছিল। ওই যে কথায় আছে না, “বিশ্বাসে মিলায় বস্তু...।” আমরা অনেক কিছু বিশ্বাস করি না। তুড়ি মেরে বা ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দি।

বড়দা মারা যাবার পর বড়দিকে দেখা দিয়েছিল সেইদিনই রাতে। শ্বশুরবাড়িতে বড়দি যখন বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসছিল -দেখেছিল বড়দা হাফ প্যান্ট পরে সামনে দাঁড়িয়ে আছে আর বলছে, “বড়দি তোর সাথে দেখা করতে এলাম।” তাই শুনে বড়দি চিৎকার করে ওঠে- “ধুনি! তুই কখন এলি?” বলেই অজ্ঞান হয়ে যায়। বড়দির শাশুড়ি তখন দৌড়ে এসে বড়দিকে কোনরকমে হাত ধরে ভেতরে নিয়ে যান। তার আগেই, টেলিগ্রাম এসে গেছিল বড়দির শ্বশুড়বাড়িতে যে, “জলে ডুবে ধুনি মারা গেছে।”

বড়দি বড়দার পৈতের জন্য টোপর থেকে শুরু করে সব কিনেছিল। বড়দি আগেই বলে রেখেছিল মা কে যে, “ আমি ধুনির পৈতের সব জোগাড় করব মা-তোমরা না কোরো না কিন্তু।” 

হল না বংশের বড় ছেলের পৈতে। হল না কোনো ধুমধাম। মাঠের বল মাঠেই রইল পড়ে।

(চলবে)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments