জ্বলদর্চি

আগডুম রাজ্যে – ৬ /অলোক চট্টোপাধ্যায়

আগডুম রাজ্যে – ৬ 

অলোক চট্টোপাধ্যায়

রাস্তাটা আবার সটান সোজা নয়। মাঝেমাঝেই কেমন যেন এঁকে বেঁকে গোল গোল ঘুরে গেছে। মনে হোল একই জায়গায় ঘুরছি নাতো? এদিকে বেলা একটু একটু করে বাড়ছে। রাস্তার ধারে ধারে দোকানপাট খুলছে। আমার মনে একটাই চিন্তা, জগঝম্প ছাড়া পেয়ে আমাকে খুঁজতে বেরিয়ে পড়ল কিনা। যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি চটপটির বাড়ি খুঁজে বার করা ভীষণ জরুরি। এমন সময়ে একটা চৌরাস্তার মোড়ে একটা খাবারের দোকান দেখে ভাবলাম এখানেই জিগ্যেস করা যাক। যেই তার সামনে দাঁড়িয়েছি অমনই একজন লোক বেরিয়ে এসে আমার হাত ধরে টানাটানি। - এসো এসো। সব কিছু তৈরি আছে। এক নম্বর জিনিষ। একবার খেলে বার বার চেয়ে খাবে। 
আমার তখন খাবার তাড়া নেই। কিন্তু লোকটা সে কথা শুনতেই রাজি নয়। - পষ্টো দেখছি তোমার খিদে পেয়েছে। ভেতরে তো চলো। তারপর দেখছি কেমন না খেয়ে থাকো।
অগত্যা বসতে হল ভেতরে গিয়ে। ভাবলাম পকেটে তো জেলখানা থেকে পালানোর জন্যে পাওয়া আটটা টঙ্ক রয়েছে। দেখাই যাক তাতে কি পাওয়া যায়। তবে দরদাম জিগ্যেস করার আগেই লোকটা একটা পাতার ওপর লুচির মত চেহারার কি যেন সাজিয়ে আমায় খেতে দিয়ে গেল। এতক্ষণে চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম দোকানে বেশ ভিড়। মাটিতে কাপড়ের আসন পেতে বসার ব্যবস্থা। আমি বসে ছিলাম একটা কোনে, যাতে চারদিকটা ঠিকঠাক নজর রাখা যায়। আমার সামনেই জনা সাত আট লোক গোল হয়ে বসে খেতে খেতে গল্প করছিল। তাদের কথাবার্তা কানে আসতেই আমারতো খাওয়া প্রায় মাথায় উঠল।
একজন বলছিল – শুনেছো, কালকের সাতাশ নম্বর চোরটা রাজসভায় কি সব অদ্ভুত কথা বলেছে? সময় নাকি অঙ্ক কষে যন্তর দিয়ে মেপে ফেলা যায়। এইটা শুনেই আমি হাতটা পেছনে নিয়ে গিয়ে হাতঘড়িটা খুলে ফতুয়ার পকেটে ভরে ফেললাম।
দ্বিতীয় একজন বলল – রাজামশাই তো শুনলাম বাঞ্ছারাম পন্ডিতকে কড়া নোটিশ দিয়েছেন ঐ রকম যন্তর তার সাতদিনের মধ্যে চাইই চাই। এইবার মনে হয় বাঞ্ছারামের সব জারিজুরি ফাঁস হয়ে যাবে।
-ওদিকে আবার সে লোকটাকে চোর হিসেবে চালান করার পর নাকি ফোড়নদাস বলেছে ও আসলে চোর নয়, পাগল। বাঞ্ছারাম নাকি নিজেই সেটা প্রমাণ করে দিয়েছে। আর একজন বলল।
অন্য একটা লোক তাই শুনে তেড়েফুঁড়ে বলল – কিন্তু এটাও তো প্রমাণ হয়ে গেছে যে সেই লোকটা সময় চুরি করেছে। রাজামশাই নিজেই সন্দেহ জানিয়েছেন এই যে ঠান্ডার সময়ে সকালের থেকে বেশ কিছুটা সময় হারিয়ে যায় সে নিশ্চয়ই এই লোকটার কাজ।
এই সব শুনে আমার হাত-পা এলিয়ে আসছিল। এমন সময়ে দোকানের লোকটা আবার এসে ধমকে গেল – একি এখনো খাবার নিয়ে বসে আছো? এটা শেষ না করলে কিন্তু মিষ্টি পাবেনা বলে দিলাম। নিরুপায় হয়ে লুচির মত বস্তুটা মুখে দিলাম। ভারি চমৎকার খেতে। ভেতরে আবার পুরও দেওয়া। আমি বরাবর দেখেছি ভালো খাবার দাবার পেলে আমার মাথার থেকে সব দুঃশ্চিন্তা উধাও হয়ে যায়। তখনও তাই হোল। গপাগপ সবকটা খেয়ে ফেললাম। তাই দেখে দোকানের লোকটা ভারি খুশি মুখে আমাকে গোটা কতক খয়েরি রঙের ঢেলা ঢেলা মিষ্টি দিয়ে গেল।
সেটা খেতে খেতেই দেখি সামনের লোকগুলোর মধ্যে একটা বিরাট ঝগড়া বেধে গেছে। গতদিনের সাতাশ নম্বরের চোরটা আসলে চোর না পাগল সেই নিয়ে ভয়ানক তর্কাতর্কি চলেছে। একদল বলছে সেটা পাক্কা একশো ভাগ পাগল, অন্য পক্ষের বক্তব্য, বাঞ্ছারাম যে আসলে কিচ্ছুটি জানেনা সে কথা ফাঁস হয়ে যাবার ভয়ে একজন সৎ আদর্শবান চোরকে পাগল বলে চালাবার চেষ্টা করছে।
তর্ক হতে হতে প্রায় হাতাহাতির উপক্রম। এমন সময়ে কে একজন বলল – ও লোকটা হয়তো চোর আর পাগল দুইই। সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। কিন্তু সে আর কতক্ষণ? কয়েকজন লোক যেন কিছু না কিছু নিয়ে ঝগড়া করবে বলে স্থির করেই রেখেছে। একজন বলে উঠল – অসম্ভব, একটাই লোক চোর আর পাগল দু রকম হতেই পারেনা। 
-কেন পারবেনা? অমনি তেড়ে উঠল আর একজন।
-নিয়ম নেই তাই। বৈদ্যরাজ কি মহা অমাত্য হতে পারে? মহা অমাত্য কি রাজ পন্ডিত হতে পারে? কোতোয়ালের পক্ষে কি সভাকবি হওয়া সম্ভব? একজন লোক, একরকম কাজ, সেটাই নিয়ম। আর তাছাড়া পাগল হলে সে ঠিকমত চুরি করবেই বা কি করে, চোরই বা পাগলামি করার ফুরসৎ পাবে কখন?
এই নিয়ে আবার একটা নতুন সমস্যা পাকিয়ে উঠল। দুটো দল হয়ে গেল তক্ষুনি। একদলের বক্তব্য একজন লোক একসঙ্গে চোর আর পাগল দুটোই হতে পারেনা। অন্য পক্ষের যুক্তি যদি একই লোক সকাল বেলায় পাগল থাকে সে রাতের বেলায় চুরি করতেই পারে। সে নিয়ে আবার এক দাঙ্গা বাধার উপক্রম।
এমন সময়ে কোত্থেকে যেন দূজন সেপাই দোকানে ঢুকে পড়ল। আমি তো আধখানা মিষ্টির ঢেলা কামড়ে চুপচাপ ঝগড়া শুনছিলাম। তাদের দেখে মুখটা প্রায় মাটির কাছাকাছি নামিয়ে বাকিটাতে কামড় বসালাম। আর তর্কবাগীশ লোকগুলো মুহূর্তের মধ্যে প্রসঙ্গ পালটে ব্যাঙের ছাতা চিনির জলে ভিজিয়ে তিনদিন রোদ্দুরে শুকোলে তা আমসত্বের মত খেতে হয় কিনা সে নিয়ে খুব নিচু স্বরে আলোচোনা করতে লাগল। সেপাইরা অবশ্য একটু দাঁড়িয়েই আবার চলে গেল।
আমি কোনোমতে খাওয়া শেষ করে উঠে পড়লাম। দোকানির কাছে দাম জিগ্যেস করতে যেতেই অদ্ভুত ব্যাপার। দোকানি চট করে আমার হাতে দু খানা টঙ্ক ধরিয়ে দিয়ে বলল – কেমন, খুশি তো? 
আমি বেজায় অবাক হয়ে বললাম – কি আশ্চর্য, খেলাম আমি, তুমি টঙ্ক দিচ্ছো কেন?
দোকানি খুব দুঃখিত মুখে বলল – কি আর করা যায় বল? যা দিনকাল পড়েছে।
আমি বললাম – তার মানে?
সে বলল – মানে আর কি? টঙ্কর দাম ক্রমাগত কমতে কমতে এমন অবস্থা হোল যে লোকে আর দোকানে ঢুকে কিছু খেতে পারেনা। তাতে আমাদের কি করে চলে বল? তাই গোড়ায় বিনি টঙ্কতেই খাওয়াতাম। তাও কি লোকে সহজে খেতে চায়? কত বুঝিয়ে সুঝিয়ে, ধরাধরি করে, কিংবা দরকার হলে ঘা কতক লাগিয়েই জোর করে খাওয়াতাম তখন। কিন্তু লোকেরাও ক্রমশ সেয়ানা হয়ে যাচ্ছে, দোকানের ধারে কাছে আসতেই চায়না। তাই এখন কিছু কিছু টঙ্ক দিয়েই খাওয়াতে হচ্ছে, এই আর কি।
আমি বেজায় অবাক হয়ে তার কথা শুনছি এমন সময়ে কে যেন আমার কাঁধে টোকা দিয়ে বলল – মশাই কি এ রাজ্যে নতুন নাকি? কিছুই জানেন না দেখছি।
আমি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি প্রায় ঘটপটির মতই দেখতে একজন লোক। ডান গালে মস্ত আঁচিল। আরে, এই তাহলে সে যাকে আমি খুঁজছি। আকুল ভাবে বললাম – তুমি কি চটপটি? ঘটপটির সেজোভাই? সে খুব সতর্কভাবে চারদিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল – এখানে একটাও কথা নয়। আগে আমার পিছু পিছু বেরিয়ে এসো। আমার সঙ্গে কোনো কথা বলবে না। তিন হাত পেছনে হাঁটবে। কোনোদিকে তাকাবে না। বলেই সে সোজা দোকান থেকে বেরিয়ে গেল। তার পেছনে আমিও।
অনেকটা হাঁটার পর একটু ফাঁকা মতন জায়গায় এসে একটা গাছের তলায় গিয়ে চটপটি বসল। আমিও বসলাম গিয়ে তার পাশে।
-তাহলে তুমিই হলে গিয়ে কালকের সাতাশ নম্বরের চোর। বলল সে। - তোমাকে নিয়েই এত হুলুস্থুলু কান্ড হচ্ছে। আমি ঘাড় নাড়লাম, যদিও হুলুস্থুল কান্ডএর বিষয়ে আমার কিছু জানা ছিল না। শুধু তো বন্দিশালা থেকে পালিয়েছি, তাও কোতোয়ালের কথাতেই আর ঘটপটির পরামর্শে। সে কথা চটপটিকে বলতে সে খুব চিন্তিত মুখে জানালো – তুমি কিছুই জানোনা দেখছি। আসলে আমার দাদাকে যখন সেপাইরা আজ সকালে আবার ধরে নিয়ে যাচ্ছিল তখন আমার বন্ধু ঘন্টাইকে রাস্তায় দেখতে পেয়ে সেপাইদের আব্বুলিশ লাগিয়ে ওর সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলে তোমার কথা জানিয়ে খবর পাঠিয়েছিল।
-আব্বুলিশটা আবার কি? ওকে থামিয়ে আমি জিগ্যেস করলাম।
-সে এখন কি করে বোঝাই? চটপটি বিরক্ত হল। - এই ধরে নাও, একটু থামতে বলা। কাজের ভেতর একটু ফাঁক চাওয়া, এই রকম আর কি। আমার মনে হল আমাদের চোর-পুলিশ বা কুমির ডাঙা খেলার সময়ে আমরা যেরকম আব্বুলি বলে সময় নিই সেইরকম কিছু হবে।
 -ঘন্টাই আবার রাজসভার হুঁকোবরদার। চটপটি আবার বলতে শুরু করল। - সে তোমার খবর দিতে এসে বলল কাল তোমাকে নিয়ে বেজায় হৈ চৈ হয়েছে সভাতে। বাঞ্ছারাম তোমাকে খুঁজতে লোক লাগিয়েছে, তোমার ঐ সময় মাপার যন্তরটা তার চাই। নয়তো চাকরি নিয়ে টানাটানি হতে পারে। ওদিকে ফোড়নদাসও নাকি নিজের চ্যালাচামুন্ডোদের লাগিয়েছে যাতে সেটা বাঞ্ছারামের আগেই তোমার কাছ থেকে হাতাতে পারে। ওদিকে তুমি পৌঁছোচ্ছো না দেখে আমি তোমার খোঁজ করতে গিয়ে দেখি পান্ডুশিখর পাগলাগারদের সামনে বেজায় গোলমাল চলেছে। জগঝম্প ভয়ানক ক্ষেপে গিয়ে রাস্তায় যাকে পাচ্ছে ধরে নিয়ে গারদে পুরে দিচ্ছে, কে একজন নতুন পাগল নাকি ওকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে গেছে। লোকজন ওর ভয়ে এদিক ওদিক দিয়ে দৌড়ে পালাচ্ছে। বর্ণণা শুনে বুঝলাম সেটাও তুমিই। আর দোকানে তোমাকে নিয়ে কিরকম আলোচোনা হচ্ছিল সেটা তো নিজের কানেই শুনলে। এখন তোমার সামনে ভীষণ বিপদ।
আমি কাঁদোকাঁদো গলায় বললাম – তাহলে এখন কি হবে?
চটপটি গম্ভীর মুখে কিসব ভাবল খানিকক্ষণ। তারপর বলল – তোমাকে লুকিয়ে পড়তে হবে। তারপর দেখা যাবে কি করা যায়। তার আগে তোমার সব কথা আমাকে খুলে বল দিকি। ঘটপটি দাদার থেকে যা শুনলাম সেতো বড় আশ্চর্যের কথা।
আমি গোড়ার থেকে সবকিছু তাকে খুলে বললাম। শুনে সে ব্যাজার মুখে চুপ করে বসে রইল কিছুক্ষণ। তারপর শুধোলো – তুমি সত্যি করে বলতো, আগডুম রাজ্য সম্পর্কে তুমি কিচ্ছুটি জানোনা?
আমি অনেক ভেবেচিন্তে বললাম – একদম কিছু জানিনা তাতো নয়। আমাদের আগডুম বাগডুম বলে একটা খেলা আছে। একটা ছড়াও আছে সে খেলায় – আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজে –
এই অবধি শুনেই চটপটি বলল – এই তো, নামগুলো তো জানো দেখছি। বাগডুম আমাদের লাগোয়া দেশ। আমাদের সঙ্গে নিত্যি গোলমাল লেগেই থাকে। আর ঘোড়াডুমও রাজ্যও আছে শুনেছি, তবে সে কোথায় আমরা জানিনা। সে যাক, আপাতত তোমাকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে রাখব। দুপুরে নেয়ে খেয়ে তারপর একজায়গায় যাব বুদ্ধি জোগাড় করতে। 
সেই মত চটপটির সঙ্গে আবার হাঁটতে হাঁটতে আমরা গেলাম তার বাড়িতে। ঠিক আমাদের গ্রাম গাঁয়ের বাড়িঘরের মত একটা চমৎকার নিকোনো উঠোনের চারদিক ঘিরে ছোটো ছোটো ঘর। চটপটির মায়ের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল ওর দাদার বন্ধু বলে। আমি প্রণাম করতে আমার চিবুক নেড়ে আদর করলেন। ওর ছোটোবোন এক মাথা কোঁকড়া চুলওয়ালা ঝকঝকে চেহারার ফুটফুটে মেয়ে চকমকির সঙ্গেও পরিচয় হল। আগডুম রাজ্যে আসার পর থেকে এই প্রথম কেমন যেন নিশ্চিন্ত বোধ করলাম। মনে হল এরা সবাই আমার খুব আপনজন। কোনো বিপদ আপদ হলে এ্ররা ঠিক সেসব সামলে দেবে।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments