জ্বলদর্চি

গ্রামের শহুরে রূপকথা /অষ্টম পর্ব / সুরশ্রী ঘোষ সাহা

গ্রামের শহুরে রূপকথা 

অষ্টম পর্ব : হাট - বাজার 

 সুরশ্রী ঘোষ সাহা 


"দূরে দূরে গ্রাম দশ বারোখানি, মাঝে একখানি হাট
সন্ধ্যায় সেথা জ্বলে না প্রদীপ, প্রভাতে পড়ে না ঝাঁট
বেচা-কেনা সেরে বিকেলবেলায়
যে যাহার সবে ঘরে ফিরে যায়; 
বকের পাখায় আলোক লুকায় ছাড়িয়া পূবের মাঠ;
দূরে দূরে গ্রামে জ্বলে ওঠে দীপ... আঁধারেতে থাকে হাট।" 

আমাদের গ্রামের মাঝখানে, যেখানে সব গ্রামের মানুষের যাতায়াতের সুবিধা আছে; ঠিক এমন জায়গায় একটা বিরাট হাট বসত। হাট আসলে সেখানেই বসে, যেখানে নদী, খাল কিংবা সড়কপথে যাতায়াতের সুবিধা থাকে। পরে বড় হয়ে যত জায়গায় গেছি, দেখেছি, পল্লির অধিকাংশ বড়াে বড়াে হাট-বাজারই নদীর তীরে হয়। নদীর তীরবর্তী কোনো বিরাট খোলা একটা জায়গা, যেখানে অনেক প্রাচীন গাছপালা আছে, আশপাশে সারিবদ্ধ কিছু দোকানপাট আর সামনে বড় বড় গাছ দিয়ে ঘেরা বিরাট মাঠ। যেদিন হাট বসে, সেদিনটাকে বলা হত হাটবার। হাটবারে দেখা যেত, সকাল থেকেই মাল বােঝাই নৌকা আসতে শুরু করেছে হাটে। লঞ্চ কিংবা কার্গোতেও পণ্যসামগ্রী আসছে। কত কত ক্রেতা আর বিক্রেতারা জমায়েত হচ্ছে। যেসব অঞ্চলে নদী থাকত না, যেমন আমার পিসির বাড়িতে গিয়ে দেখতাম, বড়াে রাস্তার পাশে কিংবা রেলস্টেশনের পাশেই হাট বসেছে। বাস, ট্রাক কিংবা রেলপথে জিনিস আসছে। এভাবে শহরের কলকারখানায় তৈরি জিনিসপত্র গ্রামীণ জনগােষ্ঠীর কাছে আর গ্রামে উৎপন্ন কৃষিপণ্য শহরের মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। হাটে সব দোকানই যে স্থায়ী হত, তা নয়। বরং অধিকাংশ দোকানই অস্থায়ী বসত। বড়াে দোকানগুলাের উপরে একটা সামিয়ানা বা ছাউনি টাঙিয়ে দেওয়া থাকত। আর অস্থায়ী দোকানগুলাে খােলা জায়গায় বসত। কতকিছু পাওয়া যেত সেই হাটে। গ্রামের হাটুরেরা তাদের জমির চাল, ডাল, মরিচ, পিঁয়াজ, রসুন, আদা, শাক-সবজি, পান, সুপারি, তামাক, গুড়, পোষা হাঁস-মুরগি নিয়ে হাটে আসত। দিনের শেষে সেসব বিক্রি করে নিজের প্রয়ােজনীয় পণ্য কিনে নিয়ে যেত। 


 আমরা ভাই বোন, মা-ঠাকুমা সবাই অপেক্ষা করে থাকতাম কখন বাপ-ঠাকুরর্দা হাট করে ফিরবে। তখন তো কোন যানবাহন ছিল না। মাইলের পর মাইল খালি পায়ে হেঁটে গ্রামের মানুষকে হাটে পৌঁছতে হত আর ফিরতে হত। বর্ষাকালে ছিল আরো দুর্ভোগ। যেহেতু তখনও ছাতা বলে আমাদের জীবনে কিছু আসেনি। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতেই সকলকে পথ চলতে হত। সারাদিনের শ্রান্তি ক্লান্তি শেষে হাট ফেরত বাবা দাওয়ায় বসে শরীর এলিয়ে দিত। কাঁধের ব্যাগটা নামিয়ে রাখত পাশে। গায়ের জামাটা খুলতেই আমি দৌড়ে গিয়ে সেটা আম গাছের দড়িতে টাঙিয়ে দিতাম। বাবার সারাদিনের শরীরের ঘাম লেগে থাকত তাতে। মা তালপাতার পাখায় বাতাস দিত বাবাকে। তারপর এক গেলাস জল আর বাতাসা কিংবা নাড়ু খেয়ে বাবা সারাদিনের লাভ-লোকসানের গল্প জুড়ত। আমাদের কার জন্য কী জিনিস কিনে এনেছে ঝোলা থেকে বার করত... 

  নিজে পছন্দ করে চুলের ফিতে, কপালের টিপ কী এনামেলের চুড়ি কিনব বলে বহুবার বায়না করে আমি হাটে গিয়েছি। দেখেছি, বাজার-সব্জি-মাছ-মাংসের পাশেই শাড়ি-লুঙ্গির দোকান বসেছে। আবার তার পাশেই রয়েছে চায়ের দোকান, খাবার খাওয়ার হোটেল। কামার-কুমোর, ছুতােররা তাদের তৈরি জিনিসপত্র, যেমন- দা, কুড়াল, খুন্তি, কাস্তে, বেলুন-পিঁড়ি, কলসি, হাঁড়ি-পাতিল, সিলভার ও প্লাস্টিকের তৈরি বালতি, ডেকচি, কলসি এই সবকিছু নিয়ে বসেছে। কোনাে কোনাে হাটে তো গােরু-ছাগল বেচাকেনাও চলত। কত বিচিত্র হত তাদের পােশাক। আবার তেমনি বিচিত্র হত পণ্য বিক্রয়ের জন্য সেসব ফেরিওয়ালাদের আওয়াজ। কেউ বসে বসে খদ্দের ডাকছে, তো কেউ ঘুরে ঘুরে ফেরি করে বেড়াচ্ছে। হাটের পাশেই বসত বিভিন্ন ক্যানভাসারের জলসা। কোথাও থেকে ভেসে আসত রসালাে কিংবা আদি রসাত্মক বক্তৃতা। কোথাও মাইকে রেকর্ড বাজিয়ে কবিরাজি ওষুধ বিক্রি হত, তো কোথাও আবার ইঁদুর, তেলাপােকা, পােকামাকড়, উকুন ও ছারপােকা মারার বিষ বিক্রি করা হত। 

 কোন জিনিসের যতই খুব প্রয়োজন হোক না কেন তখন সেসব জিনিস হাতের কাছে পাওয়া যেত না। সারা সপ্তাহ তাই অপেক্ষা করা চলত কবে হাটবার আসবে। কারণ হাটবার আসা মানেই আমাদের সবার মনে আনন্দ। আমাদের আব্দার করে জিনিস পাওয়ার আনন্দ। বাবার শস্য বেচে পয়সা পাওয়ার আনন্দ। মায়ের সংসারের এটা ওটা জিনিস আসার আনন্দ। তখন গ্রামের পাঠশালায় মাস্টারি করে অতি সামান্য আয় ছিল বাবার। অথচ একান্নবর্তী সংসারে
অনেকগুলো হাঁ-করা মুখ বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকত। জমির থেকে আসা আয়েই একটু স্বচ্ছলতা আসত। স্বচ্ছলতা আর কী! প্রয়োজনটুকু মেটা। আর সেই প্রয়োজনও অতিরিক্ত কিছু নয়। সাধ্যের মধ্যেই সাধের জন্ম হত। সাধের মধ্যে সাধ্যের নয়। তখন পয়সার মূল্য ছিল অনেক বেশি। গ্রামের মানুষ সব নিম্নবিত্ত, অতি নিম্নবিত্ত এবং গরিব মানুষ। খদ্দেরদের সাথে কীভাবে দরদাম করতে হবে সেসব শেখানোর জন্য বাবা ভাইদেরকে প্রায়দিনই সাথে করে হাটে নিয়ে যেত। গ্রামের চাষা ঘরের ছেলে যতই লেখাপড়া শিখুক, ফসল কেনাবেচা তো শিখতেই হবে। 

 গ্রামের হাট যদিও এখন তার চরিত্র বদলে ফেলেছে। এখন হাট, হাট নয়, বাজার হয়ে উঠেছে বেশি। আগেকার দিনের সেই সপ্তাহে শুধুমাত্র একদিনের হাট বারের জন্য অপেক্ষাটা আর নেই। এখন সেই প্রতীক্ষার সম্পূর্ণ অবসান ঘটেছে। এখন বাজার প্রতিদিন বসে। এমনকি মানুষকে হাট-বাজারেও সবসময় যেতে হয় না।  সকাল সকাল দুয়ারে আসে মাছ বিক্রেতা। পথের ধারে ধারেই বহু দোকান গজিয়ে উঠেছে। গাড়ি সারানো, সাইকেল পাম দেওয়ার দোকান, মুদিখানা, জামাকাপড়, বাসনকোসন কি নেই আজ গ্রামের পথের দুই পাশে। গ্রামের ক্ষেতের মাঝে এখন দাঁড়িয়ে রয়েছে মোবাইল টাওয়ার কিংবা রাবার, প্লাস্টিক, ত্রিপল বা এমন বহু বড় বড় কারখানা। বর্তমানে শস্য বেচে সারাবছরে চাষির যা আয় হয়, সেই শস্য ফলানোর পিছনে খরচ বেড়েছে অনেক বেশি। সার কেনার খরচ, জমিতে জল দেওয়ার পাম্প চালানোর খরচ, জমি থেকে শস্য তুলে আনার গাড়ি ভাড়ার খরচ, ট্রাক্টর দিয়ে জমি চষার খরচ, লেবার খরচ ও এমন বহু বহু খরচের মুখ বেরিয়ে এসেছে এখন। অথচ সেই তুলনায় লাভের ঘর শূন্য। তাই কৃষক তার ক্ষেত-জমি বেচে দিচ্ছে। লাভবান হচ্ছে বড় বড় কারখানার মালিকরা। চাষির ছেলেরা সেই কারখানায় কাজ পাচ্ছে। চাকরি পাওয়ার বিরাট লোভও কাজ করছে, তাদের জমি বেচার পিছনে। 

 জেঠিমার মুখে গ্রামের হাটের গল্প শুনতে শুনতে মনে পড়ে গেল, বাবার মুখে শোনা সীমান্ত হাটের কথা। সীমান্ত হাট ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে জিরো লাইনের ঠিক এমন একটা জায়গায় বসে, যেখানে উভয় দেশের নিকটবর্তী এলাকার ভারতীয় ও বাংলাদেশী হাটরিয়ারা আসে। আজও আছে এই সীমান্ত হাট। শুনেছি, এখানে সব লেনদেন কর মুক্ত। বাংলাদেশী ও ভারতীয় উভয় দেশের মুদ্রাই প্রচলিত আছে এই হাটে। সপ্তাহে একদিনই মাত্র এই হাট বসে। আর কেবলইমাত্র পণ্য কেনাবেচার জন্য নয়, বরং উভয় দেশের মানুষের পুনর্মিলনের জন্য এই স্থান বিখ্যাত। 

 হাট শব্দটা বাঙালির জীবন থেকে পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি ঠিকই। তবে হাটের চরিত্র অনেকখানি বদলে গেছে ও আরো বদলে যাচ্ছে দিনে দিনে। 
                                                                    (ক্রমশ...) 

ছবি : চয়ন বসু

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments