জ্বলদর্চি

অন্তরঙ্গ নবনীতা // ঈশিতা ভাদুড়ী

স্মৃতি ডট কম ৭
অন্তরঙ্গ নবনীতা // ঈশিতা ভাদুড়ী

সেই যে সেই কবে পনেরো / ষোল বছর বয়সের ছেলেমানুষীতে তাঁকে একটি চিঠি লিখেছিলাম, সেই থেকে , নাকি অটোগ্রাফ খাতা নিয়ে যেদিন দাঁড়িয়ে ছিলাম তাঁর সামনে, সেই থেকে কিভাবে যেন... 
প্রশ্ন করেছিলেন, 'তুমি সুনন্দার মেয়ে না? দেখো তোমার চিঠিতে তোমার এমন আদল ছিল যে, তুমি কথা বলার আগেই আমি তোমাকে চিনতে পেরেছি।' বন্ধুর মেয়ে বলে নাকি একনিষ্ঠ পাঠক বলে কিভাবে যেন সম্পর্ক তৈরী হয়ে গেল।
ক্রমশ বেশির ভাগ সময় ভালোবাসা-তে কাটতে লাগল আমার। বাড়ি ফেরার পথে দেখতাম গাড়িটা আছে কিনা, DLI 2147, গাড়ি আছে মানে নবনীতাদি আছেন। সেই গাড়ি চালিয়ে যখন লেকক্লাবে পিকো টুম্পাকে সাঁতার শেখাতে নিয়ে যেতেন, আমি তো চালকের পাশের আসনে বসে দিব্যি ফুরফুরে। কখনও গড়িয়াহাট থেকে জিনিস কিনে ফিরছি... আমার হাত থেকে প্যাকেটগুলো নিয়ে 'কবির হাতে এসব মানায় না' বলে রজনীগন্ধার একটি স্টিক আমার হাতে দিলেন (যদিও আমার চেয়ে ঢের বেশী কবি তিনিই) ... এইভাবে কিভাবে নবনীতাদি মায়ের নয় আমারই বন্ধু হয়ে গেলেন, এবং মাসি থেকে দিদি। নবনীতাদি ‘ইলাবাসের জ্যাঠামশাই’ নিবন্ধে ২০০৩ সালে লিখেওছিলেন “গত পঁচিশ বছর অবশ্য সুনন্দার বড় মেয়ে ঈশিতাই আমার ‘ইলাবাস’এর বন্ধু”।
নবনীতাদি এমন একজন মানুষ, যিনি একই সঙ্গে এত পান্ডিত্য এত সারল্য এত চঞ্চলতা নিয়ে বাস করেন।  একগুচ্ছ অ্যাওয়ার্ড নিয়েও নিরহঙ্কারী এক ব্যক্তিত্ব। শিশুর মতন চঞ্চল, শিশুর মতন অভিমানী, বন্ধুর মতন নিকট, মায়ের মতন নরম ও যত্নশীল এমন মানুষ খুব কমই দেখেছি আমি। 

নবনীতাদি ছবি আঁকতেন খুব সুন্দর। তাঁর ছবিও তাঁর লেখার মতনই সহজ সরল। আমার একটি অটোগ্রাফ খাতা ছিল, সেই খাতায় আমাকে অটোগ্রাফ দিয়েছিলেন ছড়া লিখে, সঙ্গে ছবি এঁকে। এরপরেও এক-আধটা ছবি আমি পেয়েছি তাঁর। তাঁর বই ‘ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দী’ ছাপা হয়েছিল অজস্র ভুলে ভরা। তাঁর কাছে দু’কপি বই ছিল, এক কপি আমাকে দিয়েছিলেন প্রুফ দেখার জন্যে, আমি সেই বইটি প্রুফ দেখে ফেরৎ দিয়েছিলাম। অন্য কপিটি সত্যজিৎ রায় ও বিজয়া রায়কে দেবেন বলে নাম লিখে রেখেছিলেন, কোনো কারণে বইটি দেওয়া হয়নি তখনও, সেই বইটি আমাকে দিয়েছিলেন তাঁদের নাম কেটে আঁকিবুকি করে। “বিকল্পে আদরের ঈশিতাকে নবনীতামাসী” লিখে, তখনও মাসী ছিলেন।
নবনীতাদি চিন্তা-ভাবনায় তাঁর সমবয়সীদের থেকে অনেক বেশি এগিয়ে ছিলেন। তাঁর চিন্তন উদার এবং আধুনিক ছিল। তরুণদের সঙ্গে সমমনস্ক ছিলেন। সেই কারণেই বোধহয় তিনি মাসি থেকে দিদি হয়ে গিয়েছিলেন। 
টেকনোলজিতেও অনেক অ্যাডভান্সড ছিলেন। যখন কলকাতায় সেইভাবে ই-মেইল তত জনপ্রিয় ছিল না, সেই তখনই নবনীতাদি ই-মেইলে পত্র-বিনিময় করতেন। তাঁর একটি ফ্যাক্স মেশিনও ছিল। আমার অনেক জরুরী ফ্যাক্স আসতো তাঁর কাছে ওই মেশিনে। সেই ফ্যাক্স তারপর সযত্নে কানাইকে দিয়ে আমার বাড়িতে পাঠিয়ে দিতেন।
আমি যখন এল আই সি তে চাকরির ইন্টারভিউ পেলাম, আমাকে গেজেটেড অফিসার অথবা কলকাতার প্রখ্যাত মানুষের সার্টিফিকেট জমা দিতে বলা হয়েছিল। নবনীতাদি তো আমার ইন্টারভিউ-এর কথা শুনে দারুণ খুশি হয়ে আমাকে তখনই একটি সার্টিফিকেট লিখে দিলেন। বলা বাহুল্য সেই সার্টিফিকেট আমি কেজো জায়গায় জমা দিয়ে নষ্ট করতে পারিনি, আমার কাছেই সুরক্ষিত আজও। 
আমার প্রথম বই পেয়ে আমাকে যদিও একটি আন্তরিক প্রশংসা-পত্র লিখেছিলেন, দেশ পত্রিকায় আলোচনাও করেছিলেন, কিন্তু প্রচ্ছদ এবং বই-এর নাম নিয়ে আমাকে পরে বলেছিলেন – “এমন বই আমাকে কিনতে হলে আমি কখনও কিনতাম না, কভার দেখে তো মনে হত জ্যোতিষশাস্ত্রের বই, আর নামটাই বা এমন কেন! কবিতার বই-এর এমন নাম হয়?” আমি সেই প্রথম বই থেকে আজ অবধি বই-এর নামকরণে খুবই অক্ষম। 
আমার বিভিন্ন বই-এর প্রচ্ছদ বিভিন্ন সময় পূর্ণেন্দু পত্রী, শুভাপ্রসন্ন, হিরণ মিত্র, কাজী অনির্বাণ করেছেন দেখে নবনীতাদি কপট অভিমানে বলতেন, তোর সবকটা বই-এর প্রচ্ছদ নামী শিল্পীরা করেন, আমার বই-এর কেউ করেন না। নবনীতা দেব সেন বললে কেউ করবেন না এমন তো হতেই পারে না। যাইহোক, তাঁর শ্রদ্ধাঞ্জলি অনুষ্ঠানে যে পুস্তিকা প্রকাশ হয়েছে দে’জ পাবলিশিং থেকে তাঁর প্রচ্ছদ শুভাপ্রসন্ন করেছেন, নবনীতাদি দেখলে কত খুশি হতেন!
 তিনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন, তার জন্যে আড়ম্বর ছিল না। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কথোপকথনে বিভিন্ন আচরণে সেটা স্পষ্ট ছিল। আমার বাবার মৃত্যুর পর আমাকে অনেক কথার সঙ্গে বলেছিলেন “এই বছর সাবধানে চলাফেরা কোরো, গুরুপতনের বছর তো”।
কোন ব্যক্তিগত সম্পর্কের জেরে নয়, রাজ্যশুদ্ধ মানুষই জানেন নবনীতা দেবসেন মানে প্রাণোচ্ছ্বল, আগাগোড়া রসিক, প্রবল আড্ডাপ্রিয়, স্নেহপ্রাণা, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি-সম্পন্ন, প্রতিবাদে সোচ্চার, যে কোন বয়সের মানুষের সমবয়স্ক একটি মানুষ। তবে একথাও ঠিক যে নবনীতাদি যতই কেন স্নেহের আধার হোন, অন্যায় করলে কিন্তু বকুনি দিতে মোটেও পিছপা নন। 
তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়ের শুরু থেকেই আমি দেখেছি তিনি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকম অসুখে ভুগতেন। মূলত তাঁর শ্বাসকষ্টের সমস্যা। এই রোগটি যেহেতু আমার মায়েরও রয়েছে, ফলে এই রোগটি সম্বন্ধে আমার সম্যক ধারণা বহুদিন ধরেই। আমার মায়ের যেমন একটি রোগ নয়, নবনীতাদিরও তো বহু রোগ, ফুলে অ্যালার্জি থেকে শতাধিক অসুখ। কিন্তু বরাবরই দেখেছি কিভাবে যেন তিনি তাঁর সমস্ত শারীরিক প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে উঠে দাঁড়ান। এবারেও ভাবছিলাম কিছু মিরাকল হবে...

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇




Post a Comment

0 Comments