যেতে যেতে পথে
রোশেনারা খান
পর্ব ৫
আমাদের অখ্যাত গ্রাম মঙ্গলাপোতাকে একেবারেই অখ্যাত বলা যায় না। এই গ্রামের যথেষ্ট ঐতিহাসিক পরিচিতি রয়েছে।
কোনো এক সময় মল্লরাজারা তাঁদের রাজধানী গড়বেতা থেকে এই গ্রামে স্থানান্তরিত করেছিলেন। জনশ্রুতি গড়বেতায় যে সর্বমঙ্গলার মন্দির আছে, সেখান থেকে একটি মঙ্গলঘট নিয়ে এসে এই গ্রামে পোতা হয়েছিল। সেই থেকেই এই গ্রামের নাম হয় ‘মঙ্গলাপোতা।’ এই রাজপরিবারেরই সন্তান স্বাধীনতা সংগ্রামী অচল সিংহ। আমাদের এই গ্রামের উত্তর ও পশ্চিম প্রান্ত জঙ্গলে ঘেরা। পূর্বে খড়কুশমা গ্রাম। উত্তরে রুপোলী পাতের মত বয়ে চলেছে শিলাবতী নদী। ভরা বর্ষায় অবশ্য এই নদী অন্য রূপ ধারণ করে। তার সেই সর্বগ্রাসী রূপ নদীর ওপারের গ্রামের বাসিন্দাদের বুকে ভয় ধরিয়ে দেয়। গ্রামে হিন্দু মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের বাস। হাড়ি, মাঝি, ডোম, তাঁতি, কামার, কুমোরদের আলাদা আলাদা পাড়া থাকোলেও গ্রামের মানুষের শ্রেণি বিন্যাস হয়েছে রুজি-রোজগার বা অর্থনৈতিক অবস্থার নিরিখে। আবুলদা যেমন লটকা মাঝির দাওয়ায় বসে চুটাতে ( তামাকপাতা ভরা পাকানো শালপাতা ) টান দিতে দিতে সুখ দুখের গল্প করে। মধু লায়েকের মেয়ের নতুন শ্বশুরবাড়িতে আম কাঁঠাল পাঠানোর জন্য জহিরকাকা টাকা ধার দেয়। তবে কিছু মানুষের মনের ভেতরে থাকা সূক্ষ্ম সাম্প্রদায়িকতা মাঝে মাঝে সুযোগ পেলে প্রকাশ হয়ে পড়ত। নানা দিক দিয়ে পিছিয়ে থাকা মুসলিমরা নিজেদের পিছনের সারির মানুষ বলে মনে করত। এর জন্য তৎকালীন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং তৎকালীন সরকারের মানসিকতা অনেকাংশে দায়ি ছিল।
আমাদের পরিবারেরও এ তল্লাটে বিশেষ পরিচিতি রয়েছে। আমার ঠাকুরদা মতিউদ্দিন খান ছিলেন পুলিশ অফিসার। তাঁর এই পুলিশ অফিসার বা দারোগা হওয়ার পেছনে রয়েছে এক কৃষক বাবার স্বপ্ন, আর তার পেছনে রয়েছে একদিনের একটি ছোট্ট ঘটনা। আমাদের পূর্বপুরুষরা বিহারের সাসারাম থেকে বেশ কয়েকপুরুষ পূর্বে এই বাংলায় এসেছিলেন। তার একটি অংশ মেটিয়াবুরুজে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়, আর একটি অংশ দুইভাগে ভাগ হয়ে অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার গড়বেতা থানার ভেদুয়া ও মঙ্গলাপতায় বসবাস শুরু করে। ধিরে ধিরে কৃষিজমি কিনে চাষ-আবাদ করতে থাকে। সেইসময় এসব আঞ্চলে ধান ও তুঁতচাষ হত। বাবার ঠাকুরদা নন্দ খান একজন সম্পন্ন কৃষক ছিলেন। তিনি একদিন সকালে তাঁর জমির আলে দাঁড়িয়ে সোনালি ধানের ক্ষেতের দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে ছিলেন। হঠাৎ ব্রিটিশ পুলিশের একটি গাড়ির ড্রাইভার সামনে রাস্তা না থাকায় অফিসারের নির্দেশে পাকা ধানের ওপর দিয়েই গাড়ি চালিয়ে দেয়। এই দৃশ্য দেখে তিনি আকাশের দিকে দু’হাত তুলে খোদার কাছে দোয়া চান, হে খোদা, তুমি আমার একটি ছেলেকে অন্তত ‘মানুষের জুজু’ তৈরি কোরো। সেইসময়, মানে পরাধীন ভারতে মানুষ পুলিশকে জুজুর মত ভয় পেত। নন্দ খানের চার ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে আমার ঠাকুরদা মতিউদ্দিন খান ছিলেন সবার বড়। ওনার জন্ম সম্ভবত ১৮৯০ সালের এদিক বা ওদিক। ঠাকুরদা মানুষের জুজু হওয়ার স্বপ্ন নিয়েই বড় হতে থাকেন। পড়াশোনা শেষ করে প্রথম দিকে কিছুদিন নিলামে জঙ্গলের গাছ কিনে বিক্রি করতেন। সেইসময় গ্রামের লোক দাদুকে ‘বন দারোগা’ বলে সম্বোধন করত। তবে বেশিদিন নয়, কিছুদিনের মধ্যেই ঠাকুরদা নিজের যোগ্যতায় পুলিশের উচ্চপদে যোগ দিয়ে বাবার ও নিজের ইচ্ছা পূরণ করেন। তারপরেই ঠাকুরদার বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয়। মেয়ে দেখা শুরু হলে, ঠাকুরদা শর্ত রাখলেন, লেখাপড়া জানা মেয়ে ছাড়া বিয়ে করবেন না। এই কথা শুনে বাড়ির লোক সমস্যায় পড়লেন, আজ থেকে ১০০ বছরেরও আগে গ্রামাঞ্চলে বিশেষ করে মুসলিম পরিবারে লেখাপড়া জানা মেয়ে পাওয়া প্রায় অসম্ভব ছিল। অনেক খোঁজাখুজির পর খেজুরবান্দি গ্রামে পাঠশালায় পড়া একটি মেয়ের খোঁজ পাওয়া গেল। মেয়ের মামারবাড়ি পাশের গ্রাম খড়কুশমায়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে মেয়েটীর নাক খাঁদা। শুনে দাদু বলেন, খাঁদা তো কি হয়েছে? নিঃশ্বাস তো নিতে পারে? এই মেয়েটির সঙ্গেই দাদুর বিয়ে হয়। ঠাকুমার, নাম রমেসা বেগম।
ঠাকুরদা ঠাকুমা কাউকেই স্বচক্ষে দেখার সৌভাগ্য হয়নি, ছবিতে দেখেছি। ঠাকুমার গা-ভরতি গহনা, পায়ে রুপোর মোট মোটা মল। তবে আমাকে অবাক করেছে ঠাকুমার গায়ে থ্রি কোয়ার্টার হাতা ব্লাউজ দেখে। অবশ্য ওটা ব্লাউজ কিনা জানিনা, সেমিজও হতে পারে। সেজঠাকুমার কাছে শুনেছি ঠাকুমা শাড়ির সঙ্গে সেমিজ পরতেন। এখনকার নাইটির মত দেখতে ছিল সেমিজ। যা সায়া-ব্লাউজ দুয়েরই কাজ দিত। সেজঠাকুমাই আমাদের কাছে গল্প করেছেন, ঠাকুমা গ্রামের বাড়িতে এলে যাওয়ার দিন স্নান করে যে সেমিজটি ছাড়তেন, সেটি সেজঠাকুমার হত।
ঠাকুমার ছয় ছেলেমেয়ের মধ্যে সবার বড় হবিবুর রহমান খান(বাবা), মেজো মুকুলেসুর রহমান খান, সেজো আতিউর রহমান খান, ছোট মুজিবর রহমান খান। দুই পিসির নাম বেলা ও শিউলি। এই ছয় ছেলেমেয়ের পর সপ্তম সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে ঠাকুমার অকাল মৃত্যু ঘটে। কিছুদিন পর ঠাকুরদা মেদিনীপুরেই এক শিক্ষিকাকে দ্বিতীয় বার বিয়ে করেন। দাদুর এই দ্বিতীয় বিয়ের কারণে বাবা কাকারা নানারকম বঞ্চনা ও নির্যাতনের শিকার হতে থাকেন। এখান থেকেই বাবার জীবনে দুর্ভাগ্যের সূচনা হয়, যা বলতে গেলে আমৃত্যু বাবাকে তাড়া করে ফিরেছে। এই ঠাকুমা যথেষ্ট শিক্ষিতা ও আধুনিকা ছিলেন। প্রতিটি শাড়ির রঙের সঙ্গে মিলিয়ে সেই রঙের পাথর বসানো সোনার গহনা পরতেন। তাঁর বিলাসবহুল জীবনযাত্রার কারনে সংসার খরচের টাকায় টান পড়লে দাদুকে পরামর্শ দিতেন কাকাদের টিফিনের পয়সা কমিয়ে দিতে। একথা শুনে ছোটকাকা বলেছিলেন, মা সিনেমা দেখা কমিয়ে দিলেই তো অনেক খরচ বেঁচে যায়। একথা বলার জন্য ছোটকাকাকে শাস্তি পেতে হয়েছিল। এমনিতেই ঠাকুরদা থানা থেকে ফিরলে প্রায়দিনই ঠাকুমা কাকাদের নামে দাদুর কাছে নালিশ করতেন। উনিও মেজাজ ঠিক রাখতে না পেরে কোমরের বেল্ট খুলে কাকাদের পেটাতেন। এই ঠাকুমার এক ভাই ছিলেল, তার নাম জানা নেই, তবে তাঁকে শকুনিমামা বললে অত্যুক্তি হবে না। ঠাকুরদা বাবা কাকাদের জন্য কিছু করতে চাইলেই তিনি নানাভাবে বাধা দিতেন। কোয়ার্টার থাকা স্বত্বেও ঠাকুরদা পাশেই একটা বাড়ি ভাড়া নিয়েছিলেন কাকারা যাতে নিরিবিলিতে বসে পড়াশোনা করতে পারে। একদিন সেই বাড়ির বারান্দায় বসে কাকারা পড়ছিলেন। একদিন পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় উনি কাকাদের পড়তে দেখে কোয়ার্টারে গিয়ে দাদুকে বলেন, আপনি করেছেন কি? আপনি ওদের পড়ার ব্যবস্থ্যা করেছেন? আপনি জানেন না? দ্বিতীয় বিয়ে করলে প্রথম পক্ষের ছেলেরা শত্রু হয়ে যায়? মূর্খ শত্রুর থেকে শিক্ষিত শত্রুরা বেশি ভয়ঙ্কর! বাবা খুব একটা বেশিদূর পড়াশোনা করে উঠতে পারেন নি। তবে সেইসময় ওই শিক্ষাগত যোগ্যতায় একজন দারোগার ছেলে হিসেবে একটা চাকরি পেতেই পারতেন। কিন্তু বাবা ইংরেজদের অধীনে চাকরি করতে চাননি। শিল্পী মানুষ ছিলেন, ভাল ছবি আঁকতেন, নানারকম জিনিস বানাতে পারতেন, আর ছিল গানবাজনার নেশা। পরবর্তীকালে এই নেশা সেজোকাকা বাদে বাকি দুই চাচাকেও প্রভাবিত করেছিল। বাবা চিরকালই সহজ সরল স্বাধীনচেতা মানুষ ছিলেন। কিন্তু সাহসী ছিলেন না। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের খুবই শ্রদ্ধা করতেন। মেদিনীপুর জেলার যেখানে গান্ধীজি ,নেতাজীর সভা হত সেখানে হাজির থাকতেন। এসব কাহিনী বাবার মুখেই শোনা। কিছুটা গান্ধীজির আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েই চরকায় সুতো কাটতে শিখেছিলেন। আমি সেই চরকা দেখেছি।
বাবা স্বাধীনভাবে কিছু করতে চেয়েছিলেন । ব্যবসার জন্য ঠাকুরদা টাকা দিতে রাজিও হয়েছিলেন। কিন্তু ওই মামা ঠাকুরদাকে বোঝান, এই বয়সে হাতে টাকা পেলে বাবা সব উড়িয়ে দেবে। এই কথা শুনে ঠাকুরদা বাবার হাতে টাকা দিতে ভরসা পাননি। ইতিমধ্যে বাবার বিয়ে হয়েছে মেদিনীপুর শহরের এক ধনী পরিবারে। বাবার শ্বশুরমশাইয়ের দুই মেয়ের মধ্যে মা বড়। তিনি যে বাড়িতে বড় হয়েছেন, সে বাড়ি এত বিশাল যে লোকে ‘হাবেলি’ বলত। শ্বশুরমশাইয়ের ইচ্ছা ছিল, বাবা ওই বাড়িতে থাকুন। কিন্তু বাবা ‘ঘরজামাই’ এর তকমা নিতে রাজি ছিলেন না। বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাবা কলাইকুণ্ডার কাছ ক্ষেমাশুলি গ্রামে মাকে মাকে নিয়ে সংসার পাতেন এবং সেখানেই ‘জয় হিন্দ’ নাম দিয়ে একটি কাটা কাপড়ের দোকান দেন।
(ক্রমশ)
0 Comments