জ্বলদর্চি

শুধু আমার ভ্যালেন্টাইন/ বন্দনা সেনগুপ্ত

শুধু আমার ভ্যালেন্টাইন 
বন্দনা সেনগুপ্ত 


এখনও শীতের হালকা একটা আমেজ আছে। ঘুম থেকে উঠেও হালকা কম্বলটা গায়ে ফেলেই দেওয়ালে হেলান দিয়ে খাটে বসে ছিল অবিনাশ ওরফে বিনু। 

ভাড়ার এই বাড়িতে একটাই ঘর ওদের। রান্নাঘর নেই। অতসী, মানে ওর বৌ টুসি, ওই ঘরের একমাত্র জানালাটার তলায় রান্না করে। রান্না খাওয়ার জলও রাস্তার টাইম কল থেকে আনতে হয়। বারান্দা নেই। এজমালি উঠোনে অন্য সব ভাড়াটেদের কাপড়ের সাথেই কাপড় শুকানোর ব্যবস্থা। সবই অসুবিধা, সুবিধা শুধু একটাই যে নিজেদের ভাগে আলাদা বাথরুম আছে। 

পর্দাটা দুলে ওঠায় বুঝলো টুসি বাইরের কল থেকে জল নিয়ে ফিরলো। 

   "তুমি জেগে গেছো! দাঁড়াও চা করি।"

সামান্য কাজ এখন তাই উজালা যোজনাতে পাওয়া গ্যাসটা ধরালো টুসি, তাড়াতাড়ি হবে। সব সময় গ্যাস ব্যবহার করা চলে না, পয়সা কৈ অত দামি সিলিন্ডার কেনার! বিনু দেখছিলো ওকে। জানালাটা দিয়ে অস্তগামী সূর্যের একটু আলো  এসে পড়েছে টুসির উপরে, মুখে, গায়ে। চকচক করছে ও, কনে দেখা আলোয় মোহময়ী লাগছে ওকে।

অথচ কমাস আগেই  ...

প্রথমেই একটু গরম জল দিলো ওকে টুসি। তারপর চা। লাল চা অবশ্য। দুবেলা দুধ চা খাবার বিলাসিতা ওদের চলে না। সঙ্গে একটু মুড়ি, সাথে কয়েকটি বাদাম, গোলমরিচ ও কয়েক কুচি আদা।  

বসার সময় নেই টুসির। বিনুকে চা মুড়ি দিয়েই বেরিয়ে গেল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে চায়ে চুমুক দিলো বিনু।

এক বছরেই জীবনটা কতো পাল্টে গেলো! ভেবে অবাক হয় বিনু। গত বছরের এই সময় বিনু রীতিমতো চাকরি করছে একটা কারখানায়, ভালোই ইনকাম হতো তখন। নিজের চালিয়েও মা বাবাকে পাঠাত মাসে মাসে। তাদের জোরাজুরিতেই টুসির সাথে বিয়ে। তখন টুসিকে বেশ ভালোই লাগত তার।  অপূর্ব সুন্দরী না হলেও আলগা চটক ছিল ওর। উচ্চ মাধ্যমিক পাশও করেছিল। আর কি চাই? তবে বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই একে একে মা বাবা দুজনেই গত হলেন, আর টুসিও এখানে ওর কাছে চলে এল।

তখন তার বেশ কিছু বন্ধু বান্ধবও ছিল।তাদেরই একজন অনিন্দ্য। পাশের কারখানায় কাজ করত। বেশ হ্যান্ডসম দেখতে। তাছাড়া তার একটা বাইক ছিল। খুব রেলা ছিল তার। তারই জিএফ মানে গার্ল ফ্রেন্ড মানে বিশেষ বান্ধবী ছিল মিতালি বা মিলু। ওফ্ কি দেখতে! অন্তত পাঁচ সাত আট হাইট হবে। কি ফর্সা। লম্বা কালো খোলা চুল। জিনস আর টপ পরা, এখান সেখান থেকে শরীর উঁকি দিয়ে রক্ত গরম করে তুলত। কোন কলেজ না ইউনিভার্সিটিতে নাকি পড়তো। অনিন্দ্যর বাইকের পিছনে বসে ওকে জড়িয়ে চুল উড়িয়ে হুউউস করে বেরিয়ে যেত আর বিনু নিঃশ্বাস ফেলে নিজের কপালকে দোষ দিত। তখন এই শাড়ি পড়া খোঁপা করা ঘরের কাজ করে করে পুরোনো হয়ে যাওয়া টুসিকে দেখলে ঘেন্না করত ওর। অনিন্দ্য কেমন লাল গোলাপ আর আংটি দিয়েছিল ভ্যালেন্টাইন ডেতে! আর মিলু? ওদের সবার সামনে অনিন্দ্যকে জড়িয়ে ধরেছিল। সেও একটা গোলাপ এনেছিল টুসির জন্যে। খুব খুশি হয়েছিল টুসি, যতদিন না শুকিয়ে গেল ঠাকুরের সামনে সাজিয়ে রেখেছিল। ঠাটিয়ে চড় মারতে ইচ্ছা হয়েছিল সেদিন বিনুর। কষ্টে সামলেছিল। তার পরেই সে মদ ধরে। কারখানা থেকে ফিরেই ঠেকে চলে যেত আর এসে খেয়েই ঘুম। বুঝতে পারত টুসির মধ্যে প্রশ্ন জাগছে, বলছেও, অসহায় বোধ করছে। কিন্তু, বিনুর মধ্যে এই অল্পশিক্ষিত মেয়েটার জন্য কোন ফীলিংই ছিল না তখন। সব জমানো টাকা যে শেষ করছে নিজেই, সে বোধও তখন ছিল না। 

হুঁশ ফিরল হাসপাতালে। মদের নেশায় বৃষ্টির মধ্যে রাস্তায় পড়ে গেছিল। অনেক ক্ষণ ভিজেছিল। হয়ত আগেই শরীর খারাপ ছিল, কে জানে, কিন্তু ও রাস্তাতেই জ্ঞান হারিয়েছিল। হাসপাতালে নানান উপসর্গের চিকিৎসা হয়েছিল। অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা হল। থাকতে হল বেশ কদিন। ততদিনে চাকরিটি গেছে। কাজে গাফিলতির জন্য মালিক আগেই অসন্তুষ্ট ছিল, মদের নেশায় যা হয়। এখন সুযোগ পেয়ে কিছু টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়ে বিদায় করে দিল।

বাড়ি এসে দেখল অতসী আগের বড় বাড়িটা ছেড়ে এই সস্তা জায়গায় অল্প ভাড়ায় চলে এসেছে। প্রথমে কয়েকটা বাড়িতে রান্নার কাজ নিয়েছিল। কিন্তু, এখন একটা স্কুলে বাচ্চাদের ক্লাসে টিচারদের কাজে সাহায্য করে। ভদ্রস্থ কাজ হলেও ওই টাকায় সংসার চালানো মুশকিল। কিন্তু, এই সস্তা পল্লীতে বেশির ভাগই অবাঙ্গালী পরিবার, তাদের ঘরের মেয়েরা পড়াশুনা বিশেষ জানে না। তাদেরই কয়েকটা বাচ্চাকে বিকেলে আর সন্ধ্যায় পড়ায় টুসি। নিজের ঘরের কাজ তো আছেই। অতএব টুসি সারা দিন ব্যস্ত, এবং বেশির ভাগ সময় সে বাড়িতেও থাকে না। 

কিন্তু, এখন আর বিনুর কোনও নালিশ নেই। 

হাসপাতালেই সে শুনেছিল অনিন্দ্য আত্মহত্যা করেছে। মিলুর বায়না মেটাতে মেটাতে তার চার দিকে অনেক ধার হয়ে গেছিল। কিন্তু, সেই মিতালীও তো তার ছিল না। উপহারের স্রোত কমতেই তারও আসা কমতে লাগল, আর তার পরে তো তাকে এক গড়িধারীর সঙ্গে দেখা যেতেই, অনিন্দ্য আর নিতে পারে নি। মিলুর একটা কাজ করা খুব সুন্দর ওড়না ওর কাছ ছিল, ও রেখেছিল নিজের কাছে স্মৃতিরূপে। সেটা দিয়েই ঝুলে পড়েছিল। মিলু দেখতেও আসে নি।

আর টুসি? সে হাসিমুখে উদয়াস্ত পরিশ্রম করে চলেছে বিনুকে সুস্থ করে তোলার জন্য। গায়ে তার এক টুকরো সোনাও আর নেই, সব গেছে চিকিৎসার জন্য। হাসপাতাল থেকে ফেরার পর গয়না না দেখে জিগ্যেস করেছিল। খুব খারাপ লেগেছিল বিনুর। কিন্তু, অতসীর কোনো হেলদোল নেই।

    "তুমি আমার সবচেয়ে দামি সোনা"।

গলা জড়িয়ে ধরে অনেক আদরে সে বলেছিল সেদিন। আর সেদিন বিনুর মনে হয়েছিল টুসি ভ্যালেন্টাইন ডে, রোজ ডে, হাগ ডে ইত্যাদি আড়ম্বর কিছুই জানে না কিন্তু সে জানে সত্যি সত্যি কি করে ভালোবাসতে হয়।

আজ বিনুর মনে হয় "টুসি ইজ মাই ভ্যালেন্টাইন, ওনলি মাই ভ্যালেন্টাইন"। "টুসি আমার, শুধু আমায়"। 

এই সময় টুসি ফিরলে তার ক্লান্ত ঘামে ভেজা মুখ দেখেও বিনুর মনে হয়

     "ভালোবাসার রঙে রাঙ্গানো কি সুন্দৰ তুমি টুসি"। 

ফ্যানটা চালিয়ে দিয়ে টুসিকে বসতে বলে দুর্বল শরীরেও সে উঠে টুসির জন্যে জল বাতাসা নিয়ে আসে।


জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments