জ্বলদর্চি

কবিতা অ্যাভিনিউ -৭/বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়

কবিতা অ্যাভিনিউ ৭

বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়


" ছত্রিশ হাজার লাইন কবিতা না লিখে
যদি আমি সমস্ত জীবন ধরে
একটি বীজ মাটিতে পুঁততাম
একটি গাছ জন্মাতে পারতাম
যেই গাছ ফুল হয় , ছায়া দেয়
যার ফলে প্রজাপতি আসে, যার ফলে 
পাখিদের ক্ষুধা মেটে

ছত্রিশ হাজার লাইন কবিতা না লিখে
যদি আমি মাটিকে জানতাম।"
 

ছত্রিশ হাজার লাইন  কবিতা লিখেও শিল্পের ক্ষুধা জীবনের ক্ষুধা প্রেমের ক্ষুধা যাকে তাড়না করেছে আজীবন তিনিই প্রবাহিত মনুষ্যত্বের কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। মাটিকে জেনেছিলেন নিবিড়ভাবে। স্পর্শ করেছিলেন মাটির ভেতরে জমে থাকা প্রতিটি অণু পরমাণুর আত্মমগ্ন উচ্চারণ। মাটি আর ভালোবাসার পিপাসা নিয়ে তিনি বলেছেন  “তুমি সোনার কলস কাঁখে চলে যাও
আমি মাটির কলস ছাড়া পিপাসা জানি না।”

তাই জন্মের একশো  বছর পরেও তাঁর কবিতার প্রতিটি লাইন চিরঞ্জয়ী সক্রিয়তা নিয়ে মানুষের মুখে মুখে ফেরে।ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যায় আমাদের নিত্যদিনের ডালভাত মাখা জীবনে। নাজিম হিকমত বলেছিলেন, 'আধুনিক বিশ্বের কবিতা দুধরনের। এক, প্রতিবাদী কবিতা। দুই, যে কবিতা নিজেই এক উজ্জ্বল  প্রতিবাদ।'  কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা  নিজেই হয়ে উঠেছে প্রতিবাদের শিল্পময় প্রকাশ। পেলব এবং দোদুল্যমান অনুভূতি দিয়ে বানিয়ে বানিয়ে কবিতা লেখায় তাঁর ছিল তীব্র অস্বস্তি।  নিজে সেই  অস্বস্তি গোপন করেননি তিনি  বরং স্পষ্টতই দ্বিধাহীন ভাষায়  বলেছেন ‘ওই লেখাদের দায়  বহন করার মতো শক্ত কাঁধ আমার নেই।' তাহলে কেমন কবিতা লিখতে চেয়েছেন তিনি। তাও তিনি পরিষ্কার করে দিয়েছেন তাঁর অমোঘ উচ্চারণে -

'লিখতে হয় লিখবি কবিতা
কিন্তু যদি সত্যিকারের ভালোবাসিস জন্মভূমির মানুষ,
তাহলে তার জন্য আগে কাপড় বোন, আগুনে সেঁক রুটি।'

জননী জন্মভূমি এবং প্রবাহিত জনমানসের প্রতি এই ভালোবাসার নামই কবিতা। কবিকে পড়তে গিয়ে বারবার প্রেমের কাছে ফিরে আসি আমরা। ভালোবাসা,  মানুষের প্রতি তীব্র ভালোবাসা থেকেই এক আত্যন্তিক যন্ত্রণায়  আত্মগত আলোড়ন তিনি লিপিবদ্ধ করেন এভাবেই-  

অন্ন বাক্য অন্ন প্রাণ অন্নই চেতনা
অন্ন ধ্বনি অন্ন মন্ত্র অন্ন আরাধনা।
অন্ন চিন্তা অন্ন গান অন্নই কবিতা
অন্ন অগ্নি বায়ু জল নক্ষত্র সবিতা
অন্ন আলো অন্ন জ্যোতি সর্বধর্মসার
অন্ন আদি অন্ন অন্ত অন্নই ওঙ্কার

সে অন্নে যে বিষ দেয় কিংবা তাকে কাড়ে
ধ্বংস করো ধ্বংস করো ধ্বংস করো তারে।

কবিতা কি নিছক শিল্প? নিছক প্রদর্শনের বিষয়? যদি আমাদের অন্ন, আমাদের ভাতের থালার গ্রাস , আমাদের বেঁচে থাকার অধিকারগুলি লুণ্ঠিত হয় প্রতিদিন।তাহলে কী করব আমরা ? নীরবতা মেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকব দেওয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে? নাকি আত্মধ্বংসী সময়ের বিষাক্ত ছোবলকে স্বীকার করে নেব বিনা প্রশ্নে? অন্ন , হ্যাঁ অন্ন , এর চেয়ে মহত্তম কবিতা আর কিছু হতে পারে না। এর চেয়ে প্রাগভীর কোন আরাধনার নাম পৃথিবীতে আবিষ্কৃত হয়নি । এর চেয়ে জ্যোতির্ময় কোন আলোর হদিশ আমরা পাইনি। তাই যারা অন্নের অধিকার কাড়তে চায় অথবা বিষ মিশিয়ে দিতে চায় মানুষের প্রেমময় রুটি রুজির  জীবনে সমষ্টির অস্তিত্বরক্ষার জন্য  শিল্পকে বিষমুক্ত করবার প্রশ্নে এবং ভালোবাসাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য ধ্বংস করতেই হবে এইসব ঘাতকের হাত।  
ভালোবাসার আত্মশুদ্ধি  আগুনে বারবার
পুড়েছেন তিনি। এই সংদাহ থেকেই বেরিয়ে এসেছে এক একটি অক্ষর। অক্ষরের যে নিজস্ব জীবন  আছে আছে রক্তমাংস হাড়পাঁজরা এবং চিন্তাবৃত্তির স্নায়ুমণ্ডলী অথবা প্রেমের জন্য প্রসারিত হৃদয় তা তিনি জীবন দিয়ে অনুভব করেছেন। তাই প্রেম নতুন এক পরিসর নিয়ে জেগে উঠেছে-  

‘সে চেয়েছিলো
একটি সত্যিকারের প্রেমের কবিতা লিখতে।
তার তো
একটাই জীবন। মানুষের জীবনে প্রেমের চেয়ে নির্মল
পিপাসার জল আর কী থাকতে পারে?’

এই পিপাসার জলই তাঁর কবিতাকে নিয়ে গেছে মাটির কাছে, জীবনের কাছে। মানুষের স্পন্দনময় অস্তিত্বের সাথে  বেঁধে নিয়েছে আনখশির। একটা পৃথিবী চাই মায়ের আঁচলের মতো ’মায়ের আঁচলের মতো পৃথিবীর স্বপ্ন তাকে উদ্বেল করেছে। আলোড়িত করেছে তাঁর সত্তার ধমনী।

 আগুন! তুমি আমাকে
সারা জীবন ধরে পুড়িয়েছ। কিন্তু আমি তো
শুদ্ধ হলাম না। শুধু পুড়ে গেলাম। 
আমি সারা জীবন শুধু হাজার হাজার মানুষের দীর্ঘশ্বাস, তাদের সর্বনাশ
আমার জটায় বেঁধে সরস্বতী-নদীর জলে ঝাঁপ দিতে গেলাম, কোথাও তাকে খুঁজে পেলাম না। 

তুমি আমাকে কী জীবন শেখাও, আগুন? –
এই কি মানুষের জীবন!’ ( হওয়া না হওয়ার গল্প )

বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায় কোন পালিশ বা প্রসাধন নেই, কোন কুয়াশা বা ধুলিধুসরতা নেই। খিদের আগুনে পোড়া জীবন থেকে, উপোসী জীবন থেকে যে দুঃসাহস অজস্র আলোকমালায় জ্বলে ওঠে  তার বিচ্ছুরণ তিনি অনুভব করেছেন নিরন্ন মুখের স্বতন্ত্র বর্ণচ্ছটায়।

‘উপোসেও তার মুখে হাসি থাকে ,
কে শিখিয়েছে তাকে ঐ সাহস ?

কে শেখায় এই সাহস আমরা জানি। আমরা যারা চারপাশের অভাব অনটন আর দারিদ্র্য থেকে সাঁতার দিতে দিতে সমুদ্র অতিক্রমণের স্বপ্ন দেখি, স্বপ্ন দেখি শিরদাঁড়া সোজা রেখে থালায় মাড়ভাত সাজিয়ে এক বেলা খেয়ে অথবা না খেয়ে  মুড়ির সাথে একটা কাঁচালংকা পেলে তাদের চোখে নেচে ওঠে ভুবন বিজয়ী হাসি। এই কবিতা তো তাদের অন্তর থেকে বেরিয়ে আসা কবিতা। এই কবিতা আকাশে উড়তে উড়তে লেখা যায় না। এই কবিতা ব্যালকানি থেকে সৌখিন দারিদ্র্য দেখার বিলাসিতা থেকে লেখা যায় না। এই আলো তো সেই অন্তরের আলো। যার সামনে একশো বছর পরও বসে থাকেন কবি, যতদিন ক্ষুধা থাকে আর থাকে ক্ষুধা বিজয়ের মন্ত্র। তিনি জানেন একদিন জেগে উঠবে মানুষের আলো। খুন অত্যাচার আর দানবীয় কিংস্রতার অবসান হবে। 
"এই তোমার রাজত্ব ,খুনি! তার উপর কে বাহবা চাও?
আমরাও দেখব তুমি  কতদিন এই ভাবে রাক্ষস নাচাও!"

কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সমাজ সচেতন রাজনৈতিক মতাদর্শঋদ্ধ কবি। বাস্তব জীবনের প্রতি আকর্ষণ তাকে কল্পনার জগতের দূরসঞ্চারী অলীক স্পর্শ থেকে  থেকে নামিয়ে এনেছে মাটির কাছাকাছি।তাই তিনি ছত্রিশ হাজার লাইন কবিতা না লিখে জানতে চেয়েছেন মাটিকে, মাটির অমোঘ সত্যকে।  এই সত্য লুকিয়ে আছে কৃষক-শ্রমিকের দারিদ্র লাঞ্ছিত কুটিরের উঠোনে। বিশ্বসংসারের নানা বাধা-বিপত্তি ও প্রতিকূলতা মানুষের জীবনকে ছিন্নভিন্ন করে দেয়--কবি ছুটে চলেন  সেই বেদনা-খিল্প জীবনের রূপ আবিষ্কারে।  তাঁর কবিতায় বেদনার ছবি-হতাশার দীর্ঘশ্বাস সত্ত্বেও তিনি কখনোই সমষ্টি মানুষের থেকে নিজের আন্তরিক সংযোগকে বিচ্ছিন্ন করেননি। মাত্র বাইশ বছর বয়সে কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের আবির্ভাব  'গ্রহচ্যুত' (১৯৪২) কাব্যগ্রন্থের মধ্য দিয়ে। এরপর ক্রমান্বয়ে প্রকাশিত হতে থাকে  'রাণুর জন্য' (১৯৫১), 'উলুখড়ের কবিতা' (১৯৫৪), 'মৃত্যুত্তীর্ণ' (১৯৫৫), 'লখিন্দর' (১৯৫৩), 'জাতক' (১৯৫৮), 'তিন পাহাড়ের স্বপ্ন' (১৯৬৩), 'সভা ভেঙে গেলে' (১৯৬৪), 'মুখে যদি রক্ত ওঠে' (১৯৬৪), 'ভিসা অফিসের সামনে', 'মহাদেবের দুয়ার' (১৯৬৭), 'ওরা যতই চক্ষু রাঙায়' (১৯৬৮), 'নভেম্বর-ডিসেম্বরের কবিতা' (১৯৬৮), 'মানুষের মুখ’ (১৯৬৯), 'শ্রেষ্ঠ কবিতা' (১৯৭০), 'মুণ্ডহীন ধড়গুলি আহ্লাদে চিৎকার করে' (১৯৭১), 'আমার রাজা হওয়ার স্পর্ধা' (১৯৭২), 'রাস্তায় যে হেঁটে যায়' (১৯৭২), 'মানুষ-খেকো বাঘেরা লাফায়' (১৯৭৩), 'এই জন্ম, জন্মভূমি', 'জ্বলুক সহস্র চিতা অহোরাত্র এপাড়া ও-পাড়ায়' (১৯৭৩), 'ভিয়েৎনাম ও ভারতবর্ষ' (১৯৭৪), 'বাহবা সময় তোর  সার্কাসের খেলা' (১৯৭৪), 'পৃথিবী ঘুরছে' (১৯৭৫), 'শীত বসন্তের গল্প' (১৯৭৬), 'বেঁচে থাকার কবিতা' (১৯৭৭), 'ন্যাংটো ছেলের সূর্য নেই' (১৯৭৭), 'সায়েরী' (১৯৮০) 'ন্যাংটো ছেলে আকাশ দেখছে’ (১৯৭৮), 'নীলকমল-লালকমল' (১৯৭৮), 'দিবস রজনীর কবিতা' (১৯৭৮), 'আমাদের ইতিহাসের স্যার এবং তাপ্পি আর ওভারকোটের গান' (১৯৭৮), 'আমার কবিতা' (১৯৮৫),  এভাবেই প্রকাশিত হয়েছে তাঁর 'অফুরন্ত জীবনের গান' কবির মৃত্যুর পর এই নামে একটি কাব্যগ্রন্থও প্রকাশিত হয়েছে। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায় আমরা  বাঁকবদল  দেখতে পাই লক্ষীন্দর কাব্যগ্রন্থে এসে। এখানেই তিনি হয়ে ওঠেন স্বতন্ত্র এবং নতুন এক পথের দিশারী। মৃত সভ্যতার ভেতর থেকে জাগরণের মন্ত্র নিয়ে আসেন তিনি।  মানুষের ব্যথা-বেদনার প্রকৃত রূপকার হয়ে ওঠেন। ছিন্নভিন্ন রক্তাক্ত সময়ের ভেতর থেকে খুঁজে আনেন বিশল্যকরণী। আত্মিক সংকট, আর্থিক সংকটের কাছে আত্মসমর্পনহীন সত্তা নিয়ে গড়ে তুলতে চেয়েছেন চেতনার  পৃথিবী। 'লখিন্দর' কাব্যের ‘বেহুলা' কবিতায় তারই সুস্পষ্ট প্রতিবিম্ব আমাদের হৃদপিণ্ডে বারবার অনুরণিত হয়

   ‘সে জাগবে। জাগবেই। 
     আমি তাকে কোলে নিয়ে 

  বসে আছি রক্ত-পুঁজে  মাখামাখি রাত্রি 
   ভেলায় ভাসিয়ে।'
 
কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিকৃতি এবং তাঁর মানবিক সত্তার বিচ্ছুরণ আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে আমাদের নতুন করে ভাবতে শেখায়। আজ যখন এক অনিবার্য ধারাবাহিকতায় পৌর সমাজ তলিয়ে যাচ্ছে ধর্মান্ধতার অতলে। দুর্নীতির সীমাহীন  ঔদ্ধত্যই যখন হয়ে উঠছে  সমাজের চালিকাশক্তি। যুক্তিবাদ মানবতাবাদের দীপায়ন যখন প্রাতিষ্ঠানিক আধিপত্যবাদের আক্রমণে খণ্ডবিখণ্ড হয়ে যাচ্ছে । তলিয়ে যাচ্ছে সংস্কৃতির বিবেক। তখন ‘শিখে নে সেই সাঁতার / প্রলয়ের নদী হবি পার/ বাঘের মতন ঢেউগুলি যত করুক হম্বিতম্বি/ তোকে রুখবার স্পর্ধা না যেন করে’ এই কবিতাগুলি আরও বেশি বেশি করে প্রাসঙ্গিক হয়ে যায়।
 কবির কবিতা নিয়ে এক পর্বে বলা কখনই সম্ভব নয়। তাই আগামী দিনে আগামী পর্বে কবি আমাদের সাথে থাকছেন।  (চলবে)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments