জ্বলদর্চি

হলুদ /ভাস্করব্রত পতি

বাংলার ঘাস পাতা ফুল ফল, পর্ব -- ৭৭
হলুদ

ভাস্করব্রত পতি

'তোদের হলুদ মাখা গা, 
তোরা সোজা রথে যা। 
আমরা হলুদ কোথায় পাবো, 
আমরা উল্টোরথে যাবো'।
সামনেই রথযাত্রা উৎসব। কবির লোকছড়া অনুসারে, যাঁরা হলুদ মাখবে, তাঁরা সোজা রথে যাবে। আর যাঁদের কাছে মাখার জন্য হলুদ নেই, তাঁরা বাধ্য হয়ে উল্টোরথেই যাবে। এই মুহূর্তে বেশ কয়েকদিন ধরেই সোশ্যাল মিডিয়ায় হলুদ নিয়ে চলছে অদ্ভুত আলোড়ন। যা খুব বিরক্তিকর এবং ঘ্যানঘেনে। ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের 'লংকাকাণ্ড' ছড়া থেকে বলতে পারি --
'লংকা চেঁচায়, দূর হয়ে যা, মৌরি মেথি হলদি। 
বাঁচতে হলে পালা সবাই, এক্ষুণি ভাগ জলদি'।

যজুর্বেদে পাই – ‘হরিৎ হরিদ্রং প্রতনু বিশ্বমস্য শোনং রুক্ল মাস্যৎ দেবানাং'। যজুর্বেদের অন্যত্র পাই— 'হরিতা ত্বমিমা ওষধিঃ সোমঃ সাদন্যং বিদুয্য সভেয়ং / হিরণ্যগর্ভা, ত্রিদিবাসু শোনিতং ইচ্ছন্তি গ্রারাণঃ সমিধানে অগ্নৌ'। আবার অন্যত্র পাই ‘যাস্তে রুচো আতন্বত্তি রশ্মিভিঃ অভির্নো / সৰ্ব্বাভৌ রুচে জনায়ন কৃধি হরিদ্রে'। কবি মুকুন্দ চক্রবর্তী তাঁর 'চণ্ডীমঙ্গল' কাব্যে লিখেছেন -
'আর বাঙ্গাল কান্দে শোকে শিরে দিয়া হাথ।
হলদীগুঁড়া হারাইল শুকুতার পাত'।। 
কৃষ্ণদাস কবিরাজের 'চৈতন্যচরিতামৃত' কাব্যে রয়েছে -- 'হরিদ্রা কুমকুম চন্দন ......' কথাগুলি। আবার জগজ্জীবনের 'মনসামঙ্গল' কাব্যে পাই --'হরিদ্রা মাখিঞা ভাজে কদলীর মাজা'। পাণ্ডুরঙ্গ জাবজী প্রকাশিত 'নৈষদচরিত' এ আছে -- 'হরিদ্রয়া পীতবর্ণং বস্ত্রম'। 
দোকানে বিক্রির জন্য শুকনো হলুদের স্তূপ

আধুনিক কবিদের কবিতাতেও হলুদের রমরমা উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। প্রেমেন্দ্র মিত্র তাঁর 'নটরাজ' কবিতায় এনেছেন হলুদের কথা -- 'প্রজাপতি হলুদ ক্ষেতে বেড়ায় দুলে দুলে'। তেমনি পল্লীকবি জসীমউদ্দিনের 'হলুদ বাটিছে মেয়ে' কবিতায় আছে -- 'হলুদ বাটিছে হলুদ বরণা মেয়ে, হলুদের বাটা হাসিয়া গড়ায় রাঙা অনুরাগে নেয়ে'! কবি জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন --'যখন হলুদ পাতা মিশিতেছে উঠানের খয়েরী পাতায়'। কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় তাঁর 'বিষ পিঁপড়ে' কবিতায় লিখেছেন, 'হলুদ তোমার হলুদ, এই কি সারাজীবন সন্ধ্যাবেলার সঙ্গ দেওয়া'? সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা 'একটি শীতের দৃশ্য' কবিতাতেও রয়েছে হলুদ নিয়ে অক্ষরের জাল -- 'হলুদ শস্যের স্তূপে ডুবিয়ে ওরা মল্লযুদ্ধে মেতে যাবে...'। আমরা লোকগানেও ব্যবহার করি হলুদের কথা, 'হলুদ বনে বনে / আমার নাকছাবিটি হারিয়ে গেছে / স্মরণ নেইকো মনে'। কবি অন্নদাশংকর রায় তাঁর 'বাঘের নাচন' ছড়ায় লিখেছেন --
'মহরমের অঙ্গ ছিল, নাচলেওয়ালা বাঘ। / হলুদ মাখা গায়ে তার, কালো ডোরার দাগ'।

পুরাণমতে গণেশের জন্মবৃত্তান্তের সঙ্গে হলুদের ব্যবহারের সম্পৃক্ততা রয়েছে। কোনও একদিন দেবী পার্বতী কৈলাসে নিজের বাড়ির মধ্যেকার এক সরোবরে সহচরীদের সাথে স্নান করার সময় দ্বাররক্ষী হিসেবে শিবের একনিষ্ঠ ভক্ত শিব-গণশকে রাখেন। 'শিব-গণশ পাহারা দেওয়ার সময় হঠাৎ শিব পার্বতীকে কিছু বলার জন্য বাড়িতে যেতে চাইলেন। যেহেতু শিব দেবী পার্বতীর স্বামী এবং 'শিব-গণশ' সেই শিবেরই একনিষ্ঠ ভক্ত, তাই সে আর শিবকে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করতে বাধা দেয়নি। এমনকি পার্বতীর স্নান ও অন্য কাউকে সেখানে প্রবেশের নিষেধাজ্ঞার কথাও জানায়নি শিবকে। 
হলুদ গাছ

যথারীতি শিব ঘরে ঢুকতেই দেবী পার্বতী এবং তাঁর সহচরীরা লজ্জায় লাল হয়ে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দেয়। কিন্তু শিব এসব চেঁচামেচির কারণ সম্পর্কে মাথাই ঘামাননি। পার্বতী একখানা ছোটো কাপড় পরে শিবের সামনে এলেন। কিন্তু শিব ভুলেই গিয়েছিলেন যে তিনি দেবী পার্বতীকে কী বলতে এসেছিলেন। আবারও বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান তৎক্ষণাৎ।

এরপর সহচরীরা পার্বতীকে দ্বাররক্ষীর বিরুদ্ধে অভিযোগ জানান। কাজে অবহেলা করেছে সে। দেবী পার্বতীও লজ্জা পেলেন সহচরীদের অনুযোগে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি 'শিব-গণশ'কে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেন। এরপর তিনি হলুদ দিয়ে একটি ছোটো বাচ্চা ছেলের মূর্তি তৈরি করে তার মধ্যে প্রাণ সঞ্চারণ করেন। এটিই হল 'হলুদ নির্মিত বালক'। সেই বালককে দ্বাররক্ষীর দায়িত্ব দেওয়া হল শিব-গনশের পরিবর্তে। সেই একই নিয়ম জানিয়ে দেওয়া হল তাঁকেও যে দেবী পার্বতীর অনুমতি ছাড়া কেউই যেন প্রবেশ করতে না পারে।
দোকানে আর হলুদ গুঁড়ো নেই!!

তখন গদা হাতে দ্বারে পাহারা দিচ্ছিলেন দেবীর সৃষ্ট নতুন প্রাণপ্রাপ্ত হলুদ-নির্মিত বালক। ইতিমধ্যে শিবের মনে পড়েছে কেন তিনি পার্বতীর কাছে গিয়েছিলেন। ফলে তিনি ফিরে এলেন পার্বতীকে বলার জন্য। কিন্তু দ্বারে দাঁড়িয়ে থাকা নতুন দ্বাররক্ষী তথা হলুদ নির্মিত বালক শিবকে বাধা দিলেন প্রবেশ করার ক্ষেত্রে। জানিয়ে দিলেন, দেবী পার্বতীর অনুমতি ছাড়া কাউকে ঘরের মধ্যে যেতে দিতে পারবেন না। শিবের কোনও অনুরোধ শোনা হলনা। ফলে শিব ফিরে গেলেন। এবার তিনি তাঁর অনুচর নন্দী ও ভৃঙ্গীকে পাঠালেন দ্বাররক্ষীকে বোঝাতে। কিন্তু তাঁরাও বিফল হলেন। এবার তাঁরা বালকটির গদার তাড়া খেয়ে পালালো। এসব শুনে শিব খুব রেগে উঠলেন। আর সঙ্গে্গে সঙ্গে ত্রিশূল দিয়ে দ্বাররক্ষী বালকটির মাথা কেটে ফেললেন।

দেবী পার্বতী তা জানতে পেরে শিবকে বললেন, 'এ আপনি কী করলেন প্রভু? নিজের ছেলেকে হত্যা করলেন! মাথা কেটে দিলেন! ওকে তো আমিই জন্ম দিয়েছিলাম'। শিব নিজের ভুল বুঝতে পারলেন এবং নন্দী ভৃঙ্গীকে বললেন, ঐ কাটা মাথা খুঁজে আনতে। কিন্তু কোথাও পাওয়া গেলনা সেই মাথা। বরং একটি বাচ্চা হাতিকে দেখতে পেয়ে তার মাথা কেটে নিয়ে হাজির। তখন শিব সেই বাচ্চা হাতির মাথা নিজের ছেলে তথা হলুদ নির্মিত বালকের দেহের ধড়ের উপর স্থাপন করে দিয়ে ফের প্রাণ সঞ্চারণ করলেন। সেইথেকে তাঁর নাম হল 'গজানন' তথা গণেশ। সেদিন থেকে সমস্ত দেবদেবীর বন্দনার আগে প্রথমে বন্দনা করা হয় এই গণেশকেই। 

ভগবান বিষ্ণু হলুদ রঙের পোশাক পরেন। শ্রীকৃষ্ণ এবং গনেশও হলুদ রঙের পোশাক পরেন। উল্লেখ করা যায়, দক্ষ রাজা ছিলেন ভগবান ব্রহ্মার পুত্র। এই দক্ষ প্রজাপতি এবং তাঁর স্ত্রী প্রযুতীর কন্যার নাম ছিল সতী। শিবের স্ত্রী সতীর নামই গৌরী। কেননা তাঁর গায়ের রং ছিল পবিত্র হলুদ বর্ণ। হিন্দুরা ভগবানকে হলুদ সিঁদুর দিয়ে আরাধনা করেন। হলুদ রং মানুষের জ্ঞান বুদ্ধি ও শক্তির বিকাশের প্রতীক। আর লাল হল শক্তির প্রতীক। তাই মন্দিরে লাল সিঁদুর হলুদের টিপ দেওয়া হয় পাশাপাশি। সিঁদুর ও হলুদ হল সৌভাগ্যেরও প্রতীক। বসন্তের রঙ। শিক্ষার রঙ। 

যেকোনো মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে লাল রঙের বা হলুদের জলে ডোবানো সুতো হাতের কবজিতে ধারণ করা হয়। বিয়ের নিমন্ত্রণপত্রের ওপর হলুদ এবং সিঁদুরের টিপ দেওয়া খুবই পবিত্র বলে বিশ্বাস করা হয়। বিবাহতে হরিদ্রা তথা হলুদ দিয়ে বরকন্যার অঙ্গসংস্কাররূপ এক ধরনের স্ত্রী আচার হল 'হরিদ্রামঙ্গল'। হিন্দুদের বিয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ এই উপচারকে বলে 'গায়ে হলুদ' বা 'গাত্রহরিদ্রা'। সীমান্তবাংলার 'গায়ে হলুদ' অনুষ্ঠানের গানে পাই হলুদের সংস্পর্শ --
'মাঘ ফাগুন মাসে ঝলা বড় বহে হে।
কি মাখাবে হলুদতেল গাহ বড় জ্বলে হে'। 
এই আচার পালনের জন্য বিয়ের দিন সকালে পাত্রকে যে হলুদ মাখানো হয়, তারই কিছুটা অংশ কন্যার বাড়িতে পাঠানো হয়। সেই হলুদ এয়োস্ত্রীরা কলাগাছ ঘেরা মণ্ডপে নিয়ে গিয়ে পাত্রীর গায়ে মাখায়। সেই সময় সকলেই হলুদ কাপড় পরেন। সাদা রঙের নতুন কিছু গেঞ্জি, ধুতি, প্যান্ট, জামা পরার আগে এক চিমটি হলুদ গুঁড়ো ছুঁইয়ে দেওয়া হয় তাতে। 

হিন্দুদের অসংখ্য লৌকিক উপচারে হলুদ একটি অত্যাবশ্যকীয় সামগ্রী হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এরকমই একটি প্রাচীন লৌকিক উৎসব হল 'আদা হলুদ উৎসব'। 
'আদা হলুদ ব্রত ক'রে এই পেলাম বর। 
এ জীবনে থাকবে নাকো বৈধব্যের ডর'।। 
চৈত্র সংক্রান্তি থেকে শুরু করে সারা বৈশাখ মাস জুড়ে পালিত হয় এটি। এই উৎসব পালন করেন কেবলমাত্র সধবা নারীরা। প্রতিদিন সকালে ব্রতীনীকে একজন সধবা (এয়ো) ও একজন ব্রাহ্মণকে ৫ টি হলুদ, ৫ টুকরো আদা, এক মুঠো ধান, এক মুঠো ধনে, মিষ্টি বা সন্দেশ ও দক্ষিণা হিসেবে ৫ টি টাকা বা পয়সা দিয়ে উৎসব পালন করতে হয়। এইভাবে টানা চার বছর পালন করতে হয়। প্রথম বছরে একজন সধবা, দ্বিতীয় বছরে দুজন সধবা, তৃতীয় বছরে তিনজন সধবা এবং চতুর্থ বছরে চারজন সধবাকে দিয়ে ব্রত পালন করতে হয়। চতুর্থ বছরে বিষ্ণুপদী সংক্রান্তিতে মোট চারজন সধবাকে একসাথে বসিয়ে সিঁদুর চুবড়ি, আলতা, শাঁখা, আয়না, নোয়া, আংটি, মাথাঘসা, পাখা ইত্যাদি সামগ্রী দিয়ে এবং চারজন ব্রাহ্মণকে যথাসাধ্য দক্ষিণা (ষোলো আনা) দিয়ে ভোজন করাতে হয়। তবে যাঁকে দিয়ে প্রথম শুরু করা হয়েছিল, তাঁকে এগুলি ছাড়াও একটি লালপেড়ে শাড়ি পৃথকভাবে দেওয়া হয়। লোকবিশ্বাস যে, এটি পালন করলে বৈধব্যযন্ত্রণা ভোগ করতে হয়না। সুখ সৌভাগ্য ও স্বামী সোহাগ কামনাই হল এই লৌকিক উৎসবের উদ্দেশ্য।

হলুদ বহুবর্ষজীবী উদ্ভিদ। প্রায় ৬০ - ৯০ সেমি লম্বা হয়। এর পাতাগুলি লম্বা লম্বা এবং বেশ বড় আকারের হয়। হলুদ ফুলের রং ঈষৎ হলুদ ও সাদা বর্ণের হয়। ফুলের আকার মোটামুটি ৩০ - ৪০ সেমি লম্বা এবং ৮ - ১২ সেমি চওড়া। পুষ্পবিন্যাসের দৈর্ঘ্য ১০ -১৫ সেমি। আমরা হলুদকে 'হরিদ্রা' বলেই জানি। পাঁচ রকমের হরিদ্রা পাওয়া যায়। সেগুলি হল— (১) কর্পূর হরিদ্রা (২) বনহরিদ্রা (৩) কালা হলুদ (৪) আম্রগন্ধি হরিদ্রা এবং (৫) দারুহরিদ্রা। এই হলুদকে কোঙ্কনীতে হলদি, কন্নড়ে বলে অর্শিনা, তেলুগুতে পঙ্গুহ, ফার্সিতে জবদচোর, ওড়িয়াতে হলদ, গুজরাটীতে হলদর এবং সংস্কৃতে রজনী বলে। কয়েকটি উন্নত প্রজাতির হলুদ হল -- সুগমধূম, সুরমা, আর রৌমা, সি ও ১, কৃষ্ণা, রাজাপুরী, আল্লেপ্পে, সোনিয়া, সুগুনা, সালেম, ইরোড় ইত্যাদি। এটি একপ্রকার কন্দ জাতীয় গাছ। অত্যন্ত ভেষজ গুণসম্পন্ন। হলুদকে অন্যান্য যে সব নামে ডাকা হয় তা হল – শ্যামা, বিলাসিনী, জয়ন্তিকা, হরবিলাসিনী, যোষিৎপ্রিয়া, মঙ্গল্যা, সুভাগা, হরিদ্রা, হরিদ্রঞ্জনী, স্বর্ণবর্ণা, সুবর্ণা, কাঞ্চনী, শিবা, দীর্ঘরাগা, কৃমিয়া, বিষয়ী, বরবর্ণিনী, বর্ণদাত্রী, গৌরী, হরিতা, বরাঙ্গী, হরিদ্রী, পীতা, শোকা, শোভনা, বরা এবং জনিষ্ঠা। 
হলুদ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোষ্ট করা ছবি

হলুদের বিজ্ঞানসম্মত নাম Curcuma longa, Curcurma domestica Valeton। এটি ZINZIBERACEAE পরিবারভুক্ত। সারা ভারতেই হলুদের চাষ হয়। পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও ভারতের বিভিন্ন রাজ্য তথা অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাডু, মহারাষ্ট্র, ওড়িশা, কর্ণাটক, কেরলে হলুদ উৎপাদিত হয়। তবে ভারতের পূর্বঘাট ও পশ্চিমঘাট উপত্যকায় প্রচুর বুনো হলুদ জন্মায়। ভারত ছাড়াও চিন, শ্রীলংকা, বাংলাদেশ, হাইতি, জামাইকা, পেরু, ইন্দোনেশিয়া ইত্যাদি দেশেও হলুদ উৎপাদিত হয়। যেটুকু জানা যায়, সম্ভবত ২৬০০ - ২২০০ খ্রিস্টপূর্ব সময়ে ফারমানা তে হলুদ আবিষ্কৃত হয়। বানিজ্যিকভাবে হলুদের প্রচলন হয় ইজরায়েলের মেগিড্ডোতে। আসিরীয়দের কিউনিফর্ম লিপিতেও হলুদের সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে। মধ্য ইউরোপে হলুদকে বলা হত Indian saffron। 

কলাগাছের তলায় মাটির দলা এবং হলুদ গাছের গোড়ায় ছাই দিলে গাছ সতেজ থাকে। বউয়ের মন রাখলে ছেলেও বশে থাকে। তাই নিয়ে গ্রাম্য ছড়ায় রয়েছে -- 'কলায় দলা, হলুদে ছাই / বউরে সেবিলে পুতেরে পাই'। বাংলা প্রবাদে আমরা ব্যবহার করি -- 'হলুদ পোঁদে মেখে রাঁধুনী কবলানো'। অনেক সময় ব্যাঙ্গ করে বলা হয় 'যেই বিয়ের ঘটা, তার আবার হলদি কোটা'। একইভাবে গ্রামের মানুষের মুখে শোনা যায়, 'হলুদ জব্দ শিলে, বউ জব্দ কিলে'। সব কথায় নাক গলানোকে আমরা বলে থাকি 'হলদিবাজি করা'। সব ধরনের রান্নায় হলুদের উপস্থিতি চোখে পড়বে। তাই বলা হয়ে থাকে -- 'হলুদের গুঁড়ো আর নুনের গুঁড়ো'। এছাড়াও প্রবাদে পাই -- 'একটু হলুদ নিতে এসে, বলে বাড়ির গিন্নি সে যে', 'সকল নোড়াই শালগ্রাম হলে, হলুদ বাটি কিসে', 'হলুদ রঙ নয় যে ধুলে যাবে', 'হাতে হলুদ না লাগলে রাঁধুনি হয়না' ইত্যাদি। 

হলুদ মাখলে সৌন্দর্য ফুটে ওঠে। সেজন্য ব্যঙ্গ করে গ্রামবাংলার মানুষের মুখে ব্যঙ্গ করে বলতে শোনা যায় - 'কালে কত দেখবো আর, ছুঁচোর গলায় চন্দ্রহার / বেরালের কপালে টীকে, বাঁদর বেড়ায় হলুদ মেখে', 'বুড়াকালে ধরেছে রসে, কাঁচা হলুদ গায়ে ঘসে', 'ব্যাঙের মাথায় সোনার ছাতি শোভা নাহি পায় / হলুদ খেলে রাঙা ছেলে কখনো না হয়' এবং 'কিবা ছেলের মুখে হাঁই / তবু হলুদ মাখেন নাই'। হলুদ একটি অ্যান্টিসেপটিক বস্তু। মুখের ঔজ্জ্বল্যতা বৃদ্ধি করে। সর্দিকাশি প্রতিরোধ, মানসিক অবসাদ, শিশুদের লিউকোমিয়া, ক্যানসার, কাশি, পেটের যন্ত্রনা, স্বরভঙ্গ, জোঁকে ধরা, হাঁপানি, মুখের বলীরেখা, ফাইলেরিয়া, পায়ের গোড়ালি ফাটা, তোতলামি, নাকের ক্ষত, হাম, কোষ্ঠকাঠিন্য উপশমে খুবই উপকারী। গায়ের রঙ উজ্জ্বল হয় নিয়মিত হলুদ খেলে এবং মাখলে। হলুদের মধ্যে প্রোটিন, ভিটামিন, খনিজ লবণ, ফসফরাস, ক্যালসিয়াম, লোহা থাকায় হলুদ খেলে শরীরে রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। 

হরিদ্রা বা হলুদের মধ্যে লুকিয়ে আছে রস, বীর্য এবং বিপাকের প্রভাব। নানা মারণরোগের বিরুদ্ধে হলুদের কার্যকারিতা প্রমানিত হয়েছে। নিয়মিত হলুদ সেবনে গাত্রবর্ণের উজ্জ্বলতা এবং কান্তিরক্ষা বৃদ্ধি পায়। হলুদের মধ্যে থাকে Curcumin। এতে থাকা প্রায় চল্লিশ শতাংশ বিশেষ ধরনের তেল অনেক জীবাণু ধ্বংস করতে পারে। এই হলুদ তেলের মধ্যে Turenerone, Turmerone এবং Curlone জাতীয় রাসায়নিক পদার্থ বর্তমান। হলুদ গুঁড়োতে থাকে ৬০-৭০% কার্বোহাইড্রেট, ৬-১৩% জল, ৫-১০% ফ্যাট, ২-৭% ফাইবার, ৩-৭ % খনিজ পদার্থ, ৬-৮% প্রোটিন, ৩-৭% উপকারী তেল, ১-৬% কারকিউমোনয়ডিস ইত্যাদি। হলুদের মধ্যে থাকা Curcuminoids রিউমাটয়েড আরথ্রাইটিস রোগ প্রতিষেধক। এছাড়াও হলুদের মধ্যেকার Betapinene, Beta sesqui phellandrene, Borneol, Caffeic acid, Caprylic acid, Caryophyllene, Cinnamic acid, Curcumenol essntial oil, Curdione & Eugenol essential oil, limonene essential oil, Coumaric acid, Vanilic acid, P-cymene বেশ উল্লেখযোগ্য। এগুলির মধ্যে Caffeic acid, Curcumin, limonene অ্যান্টি ক্যানসার হিসেবে খুবই সক্রিয়।

🍂
ad

Post a Comment

0 Comments