জ্বলদর্চি

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা /পর্ব ১২/প্রীতম সেনগুপ্ত


শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা
পর্ব ১২

প্রীতম সেনগুপ্ত

 রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের প্রথম সঙ্ঘগুরু এবং দীর্ঘকাল (২১ বছর) সঙ্ঘগুরু পদে আসীন থাকার সুবাদে সঙ্ঘের আধ্যাত্মিক ভিত্তি নিজহস্তে নির্মাণ করেছিলেন ব্রহ্মানন্দজী। স্বামী বিবেকানন্দ স্বয়ং তাঁর সম্বন্ধে বলেছিলেন,“আধ্যাত্মিকতায় রাখাল আমাদের সকলের চেয়ে বড়।” সাধনপথে কীভাবে এগোতে হবে সেই বিষয়ে অধ্যাত্মপিপাসুদের পথনির্দেশ দিয়েছেন নানাভাবে, নানা সময়ে। এইসব অসামান্য নির্দেশিকা বা উপদেশসমূহের কিছু নমুনা পাঠকের জ্ঞাতার্থে পেশ করা যেতেই পারে।
(১) সাধনপথে পুরুষকার দরকার। কিছু কর-- চার বৎসর অন্ততঃ করে দেখ দেখি। যদি কিছু না হয় তবে আমার গালে একটি চড় মেরো।
(২) প্রত্যহ কিছু কিছু ধ্যান জপ করবে। কোনো দিন বাদ দেবে না। মন বালকের ন্যায় চঞ্চল, ক্রমাগত ছুটাছুটি করে। উহাকে পুনঃপুনঃ টেনে এনে ইষ্টের ধ্যানে মগ্ন করবে। এইরূপ দুই-তিন বৎসর করলেই দেখবে যে, প্রাণে অনির্বচনীয় আনন্দ আসছে, মনও স্থির হচ্ছে। প্রথম প্রথম জপ ধ্যান নীরসই লাগে, কিন্তু ঔষধসেবনের মতো জোর করে মনকে ইষ্টের চিন্তায় নিযুক্ত রাখতে হয়, তবে ক্রমে আনন্দ আসে। লোকে পরীক্ষা পাস করতে কত খাটে, কিন্তু ভগবানলাভ তা অপেক্ষা অনেক সহজ। প্রশান্ত অন্তঃকরণে সরলভাবে তাঁকে ডাকতে হয়। 
(৩) মন্ত্র না নিলে একাগ্রতা আসে না। আজ হয়তো তোমার কালীরূপ ভালো লাগল, আবার কাল হরিরূপও ভালো লাগল, পরশু নিরাকারে মন হল-- ফলে কোনোটাতেই একাগ্রতা হবে না। মন স্থির না হলে ভগবানলাভ তো দূরের কথা, সাধারণ সাংসারিক কাজের মধ্যেও অনেক গোলমাল হবে। ভগবানলাভ করতে গুরুর একান্ত দরকার। 
গুরু শিষ্যের ভাবানুযায়ী মন্ত্র ও ইষ্ট ঠিক করে দেন। সেই গুরুবাক্যে বিশ্বাস করে নিষ্ঠার সহিত সাধনভজন না করলে কিছুতেই কিছু হবে না। ধর্মপথ অতি দুর্গম। সিদ্ধগুরুর আশ্রয় না হলে যতই বুদ্ধিমান হোক না কেন, যতই চেষ্টা করুক না কেন, হোঁচট খেয়ে পড়তেই হবে। চুরি করতে পর্যন্ত একজন গুরুর দরকার। আর এত বড় ব্রহ্মবিদ্যা গুরুর দরকার নেই? 
(৪) খুব ধ্যান-জপ করবি। প্রথম প্রথম মন স্থূল বিষয়ে থাকে। ধ্যান-জপ করলে তখন সূক্ষ্ম বিষয় ধরতে শিখে।...‘ইহাসনে শুষ্যতু মে শরীরং’ বলে বসে যা। সত্যই ভগবান আছেন একবার দেখে নে না। একটু একটু তিতিক্ষা-- যেমন অমাবস্যা, একাদশীতে একাহার করা ভালো। বাজে গল্পটল্প না করে সারাদিন তাঁর স্মরণমনন করবি। খেতে, শুতে, বসতে-- সর্বক্ষণ। এইরূপ করলে দেখবি কুলকুণ্ডলিনী শক্তি ক্রমে ক্রমে জাগবে। স্মরণমননের চেয়ে আর কি জিনিস আছে? মায়ার পর্দা একটার পর একটা খুলে যাবে। নিজের ভিতরে যে কি অদ্ভুত জিনিস আছে দেখতে পাবি--স্বপ্রকাশ হবি।
(৫) ভয় ও দুর্বলতা মন থেকে দূর করে দাও। পাপ পাপ ভেবে মন কখনো খারাপ করবে না। যত বড় পাপই হউক না কেন লোকের চক্ষেই উহা বড়, ভগবানের দিক দিয়া উহা কিছুই না। তাঁর এক কটাক্ষে কোটি কোটি জন্মের পাপ এক মুহূর্তে ছিন্ন হতে পারে। লোককে পাপের পথ থেকে নিবৃত্ত করবার জন্য পাপের অত গুরুতর শাস্তির কথা লেখা আছে। তবে কর্মের ফল আছেই। অন্যায় কাজ করলে তজ্জন্য মনে অশান্তি আসে।

(৬) গুরুকরণ যারা করেছে, গুরু তাদের পারের রাস্তা  দেখিয়ে দেন এবং রাস্তার বাধাবিঘ্ন যা কিছু সব দূর করে দেন। গুরুবাক্যে বি‌শ্বাস করে তিনি যেমনটি বলেছেন করে যা। দেখবি মনের ময়লা সব কেটে গিয়ে ধীরে ধীরে জ্ঞানের আলো আসবে। গুরুর প্রতি ঠিক ঠিক বিশ্বাস হলেই সব কাজ হয়ে গেল। গুরুতে মানুষবুদ্ধি করতে নেই। শিষ্যের নিকট গুরু প্রত্যক্ষ ভগবান। গুরুপ্রণামে আছে --
গুরুর্ব্রহ্মা গুরুর্বিষ্ণু গুরর্দেব মহেশ্বরঃ।/ গুরুরেব পরং ব্রহ্ম তস্মৈ শ্রীগুরবে নমঃ।। (ধর্মপ্রসঙ্গে স্বামী ব্রহ্মানন্দ)
       এমন সাধন-ভজন পবিত্র জীবন অনুসরণে যিনি প্রতিনিয়ত উদ্বুদ্ধ করেন, তিনিই আবার পতিতের প্রতি অপার করুণা বর্ষণ করেছেন! তৎকালীন বঙ্গ রঙ্গালয়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী তারাসুন্দরী লিখেছেন--“মন বড় খারাপ, অশান্তি-অশান্তি, কিছু ভাল লাগে না, একস্থানে স্থির হইয়া থাকিতে পারি না। নানা তীর্থে দেবালয়ে যাই...একদিন ঘুরিতে ঘুরিতে বেলুড় মঠ গেলাম। সঙ্গে ছিলেন বিনোদিনী দাসী-- বাঙ্গলা নাট্যশালার শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী।... তখন প্রায় দুপুর উত্তীর্ণ হইয়াছে। মহারাজ সেবা অন্তে বিশ্রাম করিতে যাইবেন, আমরা উভয়ে প্রণাম করিলাম।...বলিলেন, এই যে বিনোদ, এই যে তারা, এস এস, এত বেলা করে এলে, মঠের খাওয়া দাওয়া যে হয়ে গেছে, আগে একটু খবর দিতে হয়, তাইতো--বস বস।...তাঁহার আদেশে তখনই প্রসাদ আসিল, লুচি ভাজাইবার ব্যবস্থা হইল।...মহারাজের তখন আর বিশ্রাম করা হইল না, একটি সাধুকে ডাকাইয়া বলিলেন, এদের সব মঠের কোথায় কী আছে দেখিয়ে দাও।
         “...অপবিত্র পতিতা-- কি জানি কোন অপরাধ হয়, তাই প্রথমে আমি সঙ্কোচে ভয়ে ভয়ে মহারাজের চরণধূলি লইয়াছিলাম।...সে ভয় সঙ্কোচ কোথায় উড়িয়া গেল! মহারাজ বলিলেন, ভয়? ঠাকুরের কাছে আসবে তার আর ভয় কী। আমরা সকলেই তো ঠাকুরের ছেলেমেয়ে...। যখন ইচ্ছা হবে এসো। মা, তিনি তো খোলটা দেখেন না, ভেতরটা দেখেন। তাঁর কাছে তো কোন সঙ্কোচ নাই।...বৈকালে চা খাইয়া মঠ হইতে ফিরিলাম। আসিবার সময় মহারাজ বলিলেন, মাঝে মাঝে এসো, আজ বড় কষ্ট হল, একদিন ভাল করে প্রসাদ পেও। এই আমার প্রথম দর্শন-- এই আমার প্রথম বন্ধন।”(ব্রহ্মানন্দ লীলাকথা)
        পুরী ও ভুবনেশ্বর উভয় স্থানের উপরই মহারাজের বিশেষ আকর্ষণ ছিল। এই দুই স্থান তাঁর কাছে আনন্দ উদ্রেককারী ছিল। পুরীতে তিনি একটি মঠ স্থাপনের ইচ্ছা পোষণ করলে ভক্তপ্রবর বলরাম বসুর পুত্র শ্রীযুক্ত রামকৃষ্ণ বসু ১৯১১ সালে চক্রতীর্থে একখণ্ড জমি দান করেন। ১৯৩২ সালে এই জমিতেই মঠ স্থাপন হয়। ১৯১৯ সালের ৩১ অক্টোবর ভুবনেশ্বর মঠের দ্বারোদ্ঘাটন হয়। মহারাজ বলতেন--“ভুবনেশ্বর শিবক্ষেত্র, গুপ্তকাশী বলে জানবে। এখানে একটু সাধন করলে অনেক ফল পাওয়া যায়।” এই জীবনে ভগবানলাভ এবং তার জন্য গুরুবাক্যে বিশ্বাস এই দুইয়ের সার্থক বোঝাপড়া ঘটুক সকলের সাধনজীবনে, এটি তিনি বিশেষভাবে চাইতেন। তিনি বলতেন, গুরুর উপর নির্ভর করলে তিনি সকল বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করেন। এই জগতে কারোর সাধ্য নেই গুরু-আশ্রিত শিষ্যের অনিষ্ট করার। জীবনে অনেক ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থেকে রক্ষা পাওয়া যায় যদি সঠিকভাবে গুরুকে আশ্রয় করে চলা যায়।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments