জ্বলদর্চি

কবিতা অ্যাভিনিউ ৮ /বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়

কবিতা অ্যাভিনিউ ৮ 
বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায় 


 
এর আগের পর্বে কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতাভাবনা এবং  আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে তাঁর কবিতা কেন প্রাসঙ্গিক  এ বিষয়ে দু’চার কথা বলেছি। চল্লিশের দশকের সূচনাবিন্দু থেকেই বাংলা কবিতায় সমাজসচেতন  রাজনৈতিক মনোভঙ্গিই হয়ে ওঠে কাব্যভাবনার নিউক্লিয়াস।  সুকান্ত ভট্টাচার্য, অরুণ মিত্র, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, মণীন্দ্র রায়, দিনেশ দাস, আবুল হোসেন, আহসান হাবীব, ফররুখ আহমদ, সৈয়দ আলী আহসান, বিমল ঘোষ, মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়  এরকম বেশকিছু কবির নাম বলা যেতে পারে। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁদেরই একজন। যদিও তিনি দ্বিধাহীন ভাষায় স্পষ্ট করে দিয়েছেন তাঁর অবস্থান- ‘আমার কবিতা কোনোদিনই চল্লিশের প্রগতিশীল কবিতা বা কবিদের কাছ থেকে অন্ন বা জল আহরণ করেনি। বরং আমি নিজের কবিতাকে যতটা বুঝি, আমার কবিতার শিকড় অন্যখানে। সেখানে আজও যাঁরা জলসিঞ্চন করছেন তাঁরা সবাই দলছুট একক কবি – যেমন জীবনানন্দ, তারপর নজরুল এবং রবীন্দ্রনাথ।’ (নান্দীমুখ : ১৯৮০)। তিনি আরোও বলেছেন  ‘চল্লিশের ‘প্রগতি সাহিত্য’ প্রথম থেকেই আমার কাছে খণ্ডিত এবং যান্ত্রিক বলে মনে হয়েছে। বাংলা কবিতায় শ্রেণীসচেতনতার কথা প্রবহমান চিরসত্য। আবহমান কাল ধরেই সমাজ ও রাজনীতি জড়িয়ে আছে কবিতার শরীরে। গোবিন্দচন্দ্র দাস, মুকুন্দ দাস, সত্যেন্দ্রনাথ, নজরুল, বিজয়লাল সেই কবে থেকে আমাদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছে বিপ্লবের বীজ।  চল্লিশের  কবিতার বিপ্লবী-বার্তার চেয়ে তাঁর কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে মুক্তির দশক হিসেবে চিহ্নিত সত্তরের দশককে। কারণ সত্তরের কবিতায় মানুষকে উদ্দীপিত করার অগ্নিবর্ষী আহ্বান মানুষকে প্রকৃত অর্থেই উদবুদ্ধ করেছিল। তাঁর কথা থেকেই তা আরও সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে  ‘আমার কেবলই মনে হয়েছে, ঐ দশকের [চল্লিশের দশক] প্রগতিশীল কবিদের কাছ থেকে আমাদের আর কিছুই চাওয়ার অথবা পাওয়ার নেই। বরং সত্তরে যেসব নতুন কবি এই দশকের রক্তস্নানকে সাক্ষী রেখে সামনে এগিয়ে আসছেন, সুযোগ পেলে একদিন আমার ভিক্ষাপাত্র নিয়ে তাঁদের সামনে উপস্থিত হবো।’ 

কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন  আনখশির ছোট কাগজের কবি।বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের তোয়াক্কা না করেই তিনি বিস্তৃত ভূখণ্ডের পাঠক আদৃতি লাভ করেছেন শুধুমাত্র ঋজু কন্ঠস্বরের জন্য। দ্বিতীয় বিশযুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে   একদিকে কর্মহীন বেকার ছিন্নমূল খাদ্যাভাবে জর্জরিত মানুষের আকাশবিদারী আর্তনাদ অন্যদিকে  সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। এর মাঝে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক থাবা থেকে স্বাধীনতা অর্জনের দুর্নিবার স্পৃহা এবং  বিশুদ্ধ স্বপ্নের অঙ্গীকার।তিনি দেখেছেন’ যুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষ আসে পরস্পরের মুখে চুমু খেতে খেতে’  স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর কবিতার ভেতর সময়ের এই সঞ্চরণ তাঁর নন্দনঋদ্ধির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তাঁর কবিতায় বিধৃত হয়েছে বৃহত্তর সমাজের দ্বন্দ্ব সংঘর্ষ ক্ষতবিক্ষত  অথচ  ঐক্য এবং সংগ্রামে উদ্দীপিত মানুষের প্রতি সদাজাগ্রত সহমর্মিতা। যা ইতিহাস সচেতন এক কবির দেশজ মৌল অনুভূতি জারিত। পাঁজরের হাড় থেকে নির্গত হয়েও তা আন্তর্জাতিকতায় উর্ত্তীর্ণ। কবি মণীন্দ্র রায় তাই যথার্থই বলেছেন-‘ বীরেন্দ্র প্রগতিশীল কবি, তাঁর সমস্ত কবিতাই মানুষের জন্য। যন্ত্রণার জ্বালা তীব্র  হয়ে বাজে তাঁর কবিতায়। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা কবিতার ভেতর দিয়ে ফোটে। শ্লোগানে পর্যবসিত হয় না। প্রকৃত অর্থেই তিনি প্রতিবাদী এবং প্রবাহিত মনুষত্বের কবি।তাঁর কবিতার প্রত্যেক স্তরে রয়েছে চেতনার পুনর্নির্মাণ এবং জীবনস্বপ্নের উজ্জ্বল ঘোষণা। যা দাসত্বকে ঘৃণা করে, মিথ্যাচারকে ছুঁড়ে ফেলে দেয় এবং যাবতীয় প্রতাপের বিরুদ্ধে রয়েছে উদ্ধত অস্বীকৃতি। 
মুখে যদি রক্ত ওঠে 
সে কথা এখন বলা পাপ…
যারা এই শতাব্দীর রক্ত আর ক্লেদ নিয়ে খেলা করে
সেই সব কালের জল্লাদ
তোমাকে পশুর মতো বধ করে আহ্লাদি ?
যা ইচ্ছে লেখো  কিন্তু খবরদার, দিও না সাপের লেজে পা
মানুষ রে তুই সমস্ত রাত জেগে পড় 
জন্মভূমির বর্ণপরিচয়
কে মুখোশ  আর কে মুখ এখন স্পষ্ট কিছু দেখা যায় না
কঠিন অসুখ সেরে গেলে যেরকম হয়
কেউ কাউকে রাস্তা ছেড়ে দেয় না
যতদিন এই পৃথিবীতে গান থাকে গানের মানুষ থাকে।
কবিতা তুমি কেমন আছো?
যেমন থাকে ভালোবাসার মানুষ অপমানে 
ভালোবাসার কান্নাগুলি নির্বাসনের একাকীত্বে ভিক্ষা চাইবে?
দেবার মানুষ নেই
যদি মরতেই হয়
 শুয়োয়ের মত নয়, যাদের পিছনে শিকারিরা 
খ্যাপা কুকুরদের লেলিয়ে দিয়ে
তাড়া করে নিয়ে যায় অসম্মান গহ্বরের দিকে, তারপর
যাদের অভিশপ্ত ভাগ্যকে নিয়ে 
হাসতে হাসতে  খুঁচিয়ে হত্যা করে।
১০
যে রাস্তায় তুমি হাঁটো একটার পর একটা বন্ধ দরজা
সারবন্দি ক্ষুধার্ত মানুষ। 
 চিরকালের প্রতিষ্ঠানবিরোধী আপসহীন কবি  বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়  লিখেছিলেন : 'মাথা উঁচু রাখতে হয়, নরকেও।' তাই যারা মাথা উঁচু রাখতে পারে না, যাদের শিরদাঁড়া বিক্রি হয়ে যায় তাদের তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন। আপোস যাদের রক্তে তাদের সঙ্গে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের আজীবনের শত্রুতা। দাসত্বকে তীব্র ঘৃণা করেছেন তিনি।প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার এই আজন্মলালিত অভ্যাসের  কারণে অনেকসময় বৌদ্ধিক পরিসরে অবস্থান করা অনেক সমসাময়িক কবিদের  বিরাগভাজন হয়েছেন তিনি।একবার কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর তীব্র সমালোচনা করে বীরেন্দ্র লেখেন নীরেন তোমার ন্যাংটো রাজা ,' নীরেন তোমার ন্যাংটো রাজা/ পোশাক ছেড়ে পোশাক পরেছে/ নাকি, তোমার রাজাই বদলেছে?সেই শিশুটি কোথায় গেল/যেই শিশুটি সেদিন ছিল?/ নাকি তুমি বলবে না আর/ তোমার যে আজ মাইনে বেড়েছে!/ পোশাক ছাড়া নীরেন, আমরা/সবাই যে ন্যাংটো.../কিন্তু তুমি বুঝবে কি আর/তোমার যে ভাই, মাইনে বেড়েছে।' অথবা তিনি বিশ্বাস করেছেন “ ফুল ফুটুক, তবেই বসন্ত/ তাই সুসংযত ভাষায় বলেছেন-‘প্রেমের ফুল ফুটুক, আগুনের /মতন রং ভালোবাসা রক্তজবা/আগুন ছাড়া মিথ্যে ভালোবাসা /এসো আমরা আগুনে হাত রেখে /প্রেমের গান গাই।একবুক ভালোবাসা না থাকলে এরকম কবিতা লেখা যায় না।তিনি বারুদের উপর দাঁড়িয়ে গারদের অন্ধকারেও লিখেছেন আলো ও উদ্দীপনার কবিতা। মাটি তো আগুনের মতো হবেই সেখানে তিনি বৃষ্টির মন্ত্রে লিখেছেন সবুজের সমারোহ। মানুষের হাত ধরেছেন নিবিড় ভাবে তাই তাদের না বলা অব্যক্ত অনুভব সঞ্চারিত হয়েছে তাঁর অন্তরে। ভালোবাসার অক্ষর যেমন চিনেছেন। মুখের উপর মুখোশের আবরণ চিনতে অসুবিধা হয়নি তাঁর। বর্ণময় চাকচিক্যের ভেতর থেকে বার করে এনেছেন নিরাভরণ কুৎসিত মুখ। এখানেও তিনি একশো ভাগ আপসহীন।নিজের ভেতরে শুদ্ধতার আগুন না থাকলে কখনই  লেখা যায় না ভণ্ডামীর বিরুদ্ধে এই মরমী উচ্চারণ-
একদিন মাকে দিয়েছিলাম দোষ
মা আমার আধা ভিখারী
না হয় আমরা ঘরে করব উপোষ
তাই বলে কি যাবে রাজার বাড়ি?

ছেলে আমার ছেলে
ঘুঁটে কুড়িয়ে পেট তো ভরে না
দোষ যদি হয় রাজার বাড়ি গেলে
ছেলের উপোষ দেখবে কি তার মা ? 



একদিন মাকে দিয়েছিলাম দোষ
মা ছিলেন আধা ভিখারী 
এখন আমার রাজার সঙ্গে ভাব
মায়ের সঙ্গে আমার  আড়ি।  

 বিড়ম্বিত, নিরুপায় ও প্রান্তিকায়িত মানুষের অন্তরের প্রতিটি গভীর সুপ্তবিন্দু স্পর্শ করেছেন তাই বারংবার এসেছে অনাহার, উপোষ এবং বস্ত্র ও আশ্রয়হীনের যন্ত্রণা, এসেছে ব্রাত্যজনের বেঁচে থাকার যুদ্ধকৌশল,প্রতিরোধের সোচ্চার ঘোষণা এবং রণক্ষেত্রের কথা। সর্বোপরি মনুষ্যত্বের বিকিরণ ছড়িয়ে দিয়েছেন প্রতি স্তরে প্রতি স্তবকে-  
১ 
মাঝে মাঝে মালটানা গাড়ির শব্দ,
কুকুরের কান্না!
তোমার রাতের ঘুমের পাশে আমার রাত্রি জাগরণ। 
অদ্ভুত এই পৃথিবীতে জীবনধারণ।

কানাকানি, দীর্ঘশ্বাস আর সতর্কতাকে এড়িয়ে
পাখির গান এগিয়েই চলেছে; 
অদ্ভুত মিষ্টি ওর সেই ডাক
যেন আহ্বান প্রিয়াকে”

'অনাহারে মৃত্যু নয়। অনাহারে মৃত্যু নয়।
কাল সারারাত তুমি
পৃথিবীকে ইচ্ছেমতো কামড়ে ছিড়ে খেয়েছ।
সমস্ত রাত।
তার শান্তি...শান্তি!..শান্তি।'


'কত রাজ্য আসে যায় ইতিহাসে, ঈর্ষা আর দ্বেষ
আকাশ বিষাক্ত করে
জল কালো করে, বাতাস ধোঁয়ায় কুয়াশায়
ক্রমে অন্ধকার হয়.....।'

অহংকার থাকা ভালো;
কিন্তু নিজেকে নিয়ে নয়।
স্পর্ধা থাকা ভালো :
কিন্তু দল, এমনকী দেশকে নিয়েও নয়।
সেই অহংকার আমাদের মানায়;
আমি একজন মানুষ, সমস্ত পৃথিবীর নাগরিক আমি।
সেই স্পর্ধা আমাদের ভালো রাখে;
মানুষের চেয়ে নির্মল এই পৃথিবীতে কিছুই নেই, আমারও
                                               অধিকার আছে
মনুষ্যত্বে।’ (‘বেঁচে থাকার কবিতা’, ১৯৭৭)
 
মিথ্যা যখন সত্যকে কান ধরে
বেঞ্চের ওপর দাঁড়াতে বলে,
আমরা সবাই গাধার টুপি মাথায়
দৃশ্যটা উপভোগ করি।
নিজেদের লাঞ্ছনা ও অপমানকে
তখন খুবই স্বাভাবিক মনে হয়।
‘গাঙুরের জলে ভাসে বেহুলার ভেলা 
দেখি তাই, শূন্যবুকে সারারাত জেগে থাকি— 
আমার স্বদেশ করে কাগজের নৌকা নিয়ে খেলা।’ (বেহুলার ভেলা) 
 ‘ন্যাংটো ছেলে আকাশে হাত বাড়ায় 
 যদিও তার খিদেয় পুড়ছে গা 
ফুটপাতে আজ জেগেছে জ্যোছনা; 
 চাঁদ হেসে তার কপালে চুমু খায়। 
লুকিয়ে মোছেন চোখের জল, মা।’ (ফুটপাতের কবিতা) 

লেনিন বলেছিলেন- বিপ্লবী মতবাদ কোন প্রাণহীন শাস্ত্রবাক্য নয়’ চারপাশের দুনিয়া এবং মৃত্তিকাসংলগ্ন মানুষের বিবর্তনশীল অস্তিত্বকে গভীরভাবে অনুধাবন করলে এই প্রাণ স্পর্শ করা যায়। রাতের আকাশে আশ্চর্য ভাতের গন্ধ সবাই পেতে পারে না। যারা পায় তাদের শরীরে আছে একবুক খিদে। ‘আশ্চর্য ভাতের গন্ধ রাত্রির আকাশে কারা যেন আজো ভাত রাঁধে ভাত বাড়ে, ভাত খায়। আর আমরা সারারাত জেগে থাকি আশ্চর্য ভাতের গন্ধে, প্রার্থনায়, সারা রাত।’ (আশ্চর্য ভাতের গন্ধ)। এই বেঁচে থাকা, এই জেগে থাকা মৃত্যুহীন নচিকেতার মতো। 

‘তাই নিয়ে নচিকেতা, তবু তুমি গড়বে প্রতিমা?
অন্ধ হবে, বোবা ও অধীর
তবু ক্লান্তিহীন, মৃত্তিকায় পুনর্জন্মের অস্থির
জিজ্ঞাসায় মৃত্যুর তুষার 
বারবার হেঁটে হবে পার?
অগ্নিদগ্ধ দুই হাতে কতবার খুলবে তুমি যমের দুয়ার ?’   
                                                    ( চলবে)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments