জ্বলদর্চি

'গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু’ /ঈশিতা ভাদুড়ী

স্মৃতি ডট কম ৮

‘গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু’ 

ঈশিতা ভাদুড়ী

‘কিছুক্ষণ আরও নাহয় রহিতে কাছে  / আরও কিছু কথা নাহয় বলিতে ...’ – লেখক, সুরকার সবাইকে ছাপিয়ে এ গান যে-কণ্ঠ শ্রোতার মর্মে পৌঁছে দিয়েছে সেই কোকিল-কণ্ঠী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে একটি অধ্যায়ের সমাপন হলো। আমাদের শৈশব, আমাদের কৈশোর, আমাদের যৌবন ধরা আছে তাঁর গানে গানে। গান তো আসলে একটা মাধ্যম, যে মাধ্যমের সাহায্যে শ্রোতার হৃদয়ের অন্তস্তলে পৌঁছাতে চান গীতিকার, সুরকার এবং গায়ক সম্মিলিত ভাবে। কিন্তু সে গায়ক যদি সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় হন, তিনি তো শুধু গায়ক থাকেন না, তিনি তো শুধুমাত্র তাঁর শ্রোতার ড্রইং রুমে প্রবেশ করেন না, তাঁর গান দিয়ে শ্রোতার অনুভূতি সম্পূর্ণভাবে দখল করে নেন তিনি। দশকের পর দশক সন্ধ্যার নিখুঁত আওয়াজ, মধুর কণ্ঠ, সূক্ষ্ম কাজ এক মায়ার জাদু বিস্তার করেছিল। সেই সম্মোহন থেকে বাঙালি শ্রোতা আজও বার হতে পারেনি।
যদি লিখি সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ পরিচয় ছিল না, তাহলে ভুল বলা হবে, কেননা তিনি তো আমার পুরো অস্তিত্ব জুড়ে। তাঁর গানের সঙ্গে অনেক স্মৃতি আমার। সন্ধ্যা মানে দুপুরবেলা ছাদে বসে কৎবেল খেতে খেতে পাশের বাড়ি থেকে ভেসে আসা ‘এ গানে প্রজাপতি পাখায় পাখায় রঙ ছড়ায় / এ গানে রামধনু তার সাতটি রঙের দোল ঝরায় ...’ 
বাবা ছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গুণমুগ্ধ শ্রোতা। বাবাকে কোনোদিন গাইতে শুনিনি। কিন্তু একের পর এক রেকর্ড কিনতেন, রেডিও চালিয়ে সন্ধ্যার গানে ডুবে যেতেন – ‘পাখি জানে ফুল কেন ফোটে গো / ফুল জানে পাখি কেন গান গায় / রাত জানে চাঁদ কেন ওঠে গো...’ অথবা ‘ঘুম ঘুম চাঁদ ঝিকিমিকি তারা / ...ওগো মায়াভরা চাঁদ / ওগো মায়াবিনী চাঁদ...’
বাবার কেনা রেকর্ড শুনতে শুনতে কবে সন্ধ্যার মায়াবী কন্ঠের যাদু আমাকে টেনে নিয়ে গেছে কোন মিষ্টি সকালে আমি জানি না।  সেই রেকর্ডে যখন বাজতো – ‘আকাশের অস্তরাগে - / আমারই স্বপ্ন জাগে, / তাই কি হৃদয়ে দোলা লাগে। / আজ কান পেতে শুনেছি আমি - / মাধবীর কানে কানে কহিছে ভ্রমর / ‘আমি তোমারই’ / সেই সুরে স্বপ্নের মায়াজাল বুনেছি আমি / মনে হয় এ লগন আসেনি আগে…’ – তখন এই গান তো সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের থাকতো না, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথা বা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুর নিয়ে ভাবনাও থাকতো না, তখন তো এই গান আমার হয়ে যেতো সম্পূর্ণভাবে, আমাকেই তো কানে কানে কহিত ভ্রমর ‘আমি তোমারই’। আমিই তখন বুনে চলেছি স্বপ্ন। ভেবে চলেছি ‘এই পথ যদি না শেষ হয় / তবে কেমন হতো তুমি বলোতো / যদি পৃথিবীটা স্বপ্নের দেশ হয় / তবে কেমন হতো তুমি বলোতো...’
বাড়িতে রেকর্ডে, অথবা রেডিওতে অনুরোধের আসরে যখন একে একে বেজে চলত  – ‘ও বক্‌ বক্‌ বকম বকম …’ অথবা ‘এ শুধু গানের দিন এ লগন গান শোনাবার / এ লগনে দুটি পাখি মুখোমুখি নীড়ে জেগে রয় / কানে কানে রূপকথা কয় / এ তিথি শুধু গো যেন হৃদয় চাওয়ার…’ অথবা, ‘গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু / আজ স্বপ্ন ছড়াতে চায়’… তখন রেকর্ডের ওপরের মোড়কে দেখতাম না কোন গান লিখেছেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, কোন গান পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, দেখতাম না সুর দিয়েছেন অনুপম ঘটক অথবা হেমন্ত মুখোপাধ্যায় অথবা মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় অথবা রবীন চট্টোপাধ্যায়। এসব দেখতাম না। তখন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে সুরের মূর্ছনা ফুটে উঠতো নিদারুণ আবেগে, সেই আবেগ থেকে তাঁর সঙ্গীত আমাদের হৃদয়ে কল্পনা এবং কল্পনার মধ্যে মায়া বিস্তার করতো। দরদী গলায় একের পর এক গান গেয়ে আমাদের হৃদয়ে ঢেউ তুলেছিলেন, আপামর শ্রোতাদের মাতিয়ে দিয়ে গেছেন তিনি, ভাসিয়ে দিয়ে গেছেন। তাঁর কণ্ঠের স্বকীয়তা, তাঁর গান প্রজন্মের পর প্রজন্মকে আলোড়িত করে চলেছে। যদিও তিনি তথাকথিত পুরস্কার অনেক পেয়েছেন, কিন্তু সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গীত যাবতীয় পুরস্কারের ঊর্ধ্বে ছিল।
গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গান মানে আমাদের কলেজ-জীবন, উত্তম-সুচিত্রার একের পর এক সিনেমা, অগ্নিপরীক্ষা, সাগরিকা ইত্যাদি। সন্ধ্যার গান ছিল বাংলা রোমান্টিক গানের অ আ ক খ, সেইসব গানে ছিল আমাদের যাপন। বাংলা আধুনিক গানে তাঁর সবচেয়ে জনপ্রিয় জুটি ছিল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে, মান্না দে-র সঙ্গেও প্রচুর ভালো গান গেয়েছেন তিনি। সন্ধ্যা তখনকার অধিকাংশ নায়িকার নেপথ্য-সঙ্গীতে বিখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন, বিশেষত সুচিত্রা সেনের সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেলেন তাঁর কিংবদন্তি হয়ে ওঠা গানগুলোর মধ্যে দিয়ে। আমাদের কৈশোর থেকে যৌবনের পথে সুচিত্রার ঠোঁটে সন্ধ্যার কণ্ঠ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল। 

শুধু তো নেপথ্য সঙ্গীত নয়, বা অন্য আধুনিক গান নয়, ক্ল্যাসিকাল গানেও তাঁর দক্ষতাকে অতিক্রম সহজ ছিল না। ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খানের কাছে, ওস্তাদ মুনাওয়ার আলী খানের কাছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিখেছিলেন তিনি। অধ্যাপক চিন্ময় লাহিড়ীরও ছাত্রী ছিলেন। শুধুমাত্র অনুরোধের আসরে আধুনিক গান নয়, আকাশবাণীতে রাত ন’টায় তাঁর উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের অপেক্ষাও ছিল আমাদের, তাঁর কণ্ঠের বিভিন্ন কারুকার্য, কলাকৌশলের অপেক্ষা। যদিও তিনি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে শিক্ষালাভ করেছিলেন, তবুও আধুনিক গানেই তিনি তাঁর অধিকাংশ কাজ করেছেন। ১৯৫০ সালে একটি সিনেমায় গান দিয়ে তদানীন্তন বোম্বেতে হিন্দি গান গাইতে আরম্ভ করেছিলেন। তিনি একাধিক হিন্দি চলচিত্রে নেপথ্যে গান গেয়েছিলেন। লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে দ্বৈতভাবে গেয়েছিলেন ‘বোল পাপিহে বোল’। কিন্তু তাঁকে মুম্বাই থেকে কলকাতায় ফিরে আসতে হলো বলে হিন্দি সিনেমার জগত সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সুর থেকে বঞ্চিতই রয়ে গেল একরকম। 

যতদিন সুর থাকবে ততদিন গানের মাধুর্যে কেঁপে উঠবে আপামর বাঙালী, ততদিন হৃদয়ে হৃদয়ে বেজে উঠবে – ‘কেন এ হৃদয় চঞ্চল হলো / কে যেন ডাকে বারে বারে, কেন,  বলো কেন / আমি ফুল দেখেছি, ফুল ফুটতে কখনো দেখিনি / আজ মনে হয়, এই শিহরণ, এই বুঝি ফুটছে আমার তরে / কেন এ কণ্ঠে এল গান, কেন, বলো কেন / এ এক মধুর নেশা যেন, কেন, বলো কেন / শুধু সুর শুনেছি, সুর তুলতে এখনো পারিনি / আজ মনে হয় গান হয়ে মোর, তাই বুঝি ফুটেছে কথার কলি’।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments