জ্বলদর্চি

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা--১৩/প্রীতম সেনগুপ্ত

পর্ব ১৩

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা

প্রীতম সেনগুপ্ত

স্বামী বিবেকানন্দ যেদিন মহাসমাধিতে লীন হলেন (৪ জু্লাই,১৯০২) ব্রহ্মানন্দজী ভক্তপ্রবর বলরাম বসুর বাড়িতে (অধুনা বলরাম মন্দির) অবস্থান করছিলেন। সংবাদ পেয়ে মঠে ছুটে এলেন এবং প্রিয় ভ্রাতার বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। এমতাবস্থা থেকে আর এক গুরুভ্রাতা স্বামী সারদানন্দজী তাঁকে অতি সাবধানে তুলে আনলে বাষ্পরুদ্ধ গলায় বললেন,“সামনে থেকে যেন হিমালয় পাহাড় অদৃশ্য হয়ে গেল।” স্বামীজী জীবিত থাকাকালীনই শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন ভারত ও বহির্দেশে অত্যন্ত পরিচিত হয়ে ওঠে। তাঁর অবর্তমানে সঙ্ঘনায়কের দায়িত্ব পালন করা কত দুরূহ তা মহারাজ ভালোভাবেই জানতেন। স্বামীজী বেলুড়, মাদ্রাজ( অধুনা চেন্নাই), মায়াবতীতে মঠ স্থাপন করে যান। এছাড়া কাশীর অদ্বৈতাশ্রমের প্রতিষ্ঠাও তিনি করেছিলেন। ১৮৯৭ সালে গড়ে ওঠে সারগাছি আশ্রম(এটিই রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের প্রথম সেবাকেন্দ্র, শ্রীরামকৃষ্ণের অপর এক সন্ন্যাসী সন্তান গঙ্গাধর, উত্তরকালে স্বামী অখণ্ডানন্দজী এর প্রতিষ্ঠাতা, পিছনে ছিল স্বামীজীর অমোঘ প্রেরণা), ১৮৯৯-তে ঢাকা মঠ, ১৯০০ সালে কাশী সেবাশ্রম, ১৯০১ সালে কনখল সেবাশ্রম ও ১৯০২-তে নিবেদিতা বিদ্যালয়ের সূচনা হয়। ব্রহ্মানন্দজী এইসব কেন্দ্রগু‌লির শ্রীবৃদ্ধি ও স্থায়িত্ব সাধনে মনোনিবেশ করেন। পাশাপাশি নতুন কেন্দ্র স্থাপনে উদ্যোগী  হন।
   মঠ ও মিশনের গুরুভার তাঁর হস্তে ন্যস্ত থাকায় এর অভাব অনটন বিষয়ে তাঁর অভিজ্ঞতা যথেষ্ট ছিল। কিন্তু ব্যক্তিজীবনে তিনি যেমন ত্যাগের ধ্বজাকে সর্বোচ্চে উত্তোলন করতেন, সঙ্ঘের ক্ষেত্রেও সেই আদর্শকেই মহত্তম ঘোষণা করতে দ্বিধা করতেন না। একবার পুত্রশোকে অভিভূত এক ধনী ব্যবসায়ী কিছুদিন বেলুড় মঠের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে বসবাস করে এখানকার ভাবধারায় অতিশয় মুগ্ধ হন। তিনি লোকহিতের জন্য তাঁর সমস্ত সঞ্চিত অর্থ মঠের হাতে তুলে দিতে চান। স্বামী প্রেমানন্দজীর কাছে এই সংবাদ পেয়ে মহারাজ বলেছিলেন,“বাবুরাম-দা, সাধুসঙ্গ করে লোকটির মনে বৈরাগ্যের উদয় হল, আর তার সঙ্গ করে আমাদের বিষয়বুদ্ধি হবে?” স্বভাবতই ধনী ব্যক্তির প্রস্তাবে সম্মতি জানান নি তিনি। সঙ্ঘনায়ক হিসেবে শুধুমাত্র উপদেশ দান করেই চুপ থাকতেন না, প্রদত্ত উপদেশ সঠিকভাবে পালিত হচ্ছে কিনা সেদিকেও তীক্ষ্ণ নজর রাখতেন। বাঙ্গালোর আশ্রমে রাত্রে শয্যাত্যাগ করে সাধু-ব্রহ্মচারীরা ঠিকমতো সাধনভজন করছে কিনা খোঁজখবর নিতেন।

         শ্রীরামকৃষ্ণ সুরসিক ছিলেন। তাঁর মানসপুত্র পিতার অনুসারী হবেন সেটাই স্বাভাবিক। রঙ্গরসে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। স্বামী প্রশান্তানন্দের বর্ণনা অনুযায়ী--“কোন ঘটনায় রাগ করিয়া অদ্বৈতাশ্রমের মোহন্ত চন্দ্র মহারাজ আমার সঙ্গে কথা কহিতেন না। কাজকর্ম সবই চলিতেছে, কেবল কথাটি নাই। একদিন বিকালবেলায় মহারাজ সেবাশ্রমের মাঠে বসিয়া আছেন, আর আমি তাঁহার গায়ে মাথায় হাত বুলাইতেছি, জিজ্ঞাসা করিলেন, শালিক পাখির বুলি জানিস? আমি বলিলাম, না। তিনি কহিলেন, বল--রিরিরী, কটকটকট, পাপীচ,পাপীচ, খেন্দিকিরকিচ, কিদারকিচ, ইশনমিশন, ঢ্যাপ ঢ্যাপ, কিষ্টকিশোর, কিষ্টকিশোর, ডুগডুগাডুগ, প্লীং পাই। কিভাবে বুলি আওড়াইতে হবে, ‘প্লীং পাই’ বলার সঙ্গে সঙ্গে কিরূপ ভঙ্গি করিয়া সরিয়া পড়িতে হইবে, কয়েকদিন ধরিয়া এইসব শিখাইলেন। তারপরে যখন তখন আবৃত্তি করিতে বলিয়া আশ্রমবাসীদের সমক্ষে অভিনয়ে অভ্যস্ত করিয়া তুলিলেন।

অদ্বৈতাশ্রমে উৎসব, হলটি লোকে পরিপূর্ণ। হঠাৎ শুনিতে পাইলাম চন্দ্র মহারাজ উচ্চৈঃস্বরে আমার নাম ধরিয়া ডাকিতেছেন, কাছে যাইতেই বলিলেন, মহারাজ ডেকেচেন! মহারাজ তখন হলেই বসিয়াছিলেন, কহিলেন, শালিক পাখির বুলিটি বল। আমি কেবলই ইতস্তত করিতেছি দেখিয়া দ্বিতীয়বার তৃতীয়বার আদেশ করিলেন। আদেশ পালন করিলাম। সকলে হাসিয়া খুন, এমনকি মোহন্ত চন্দ্র মহারাজও। সেই দিন হইতে তিনি আমার উপর প্রসন্ন হইলেন ও আমার সঙ্গে কথা কহিতে শুরু করিলেন।”(ব্রহ্মানন্দ লীলাকথা)
 নানাবিধ দিব্য দর্শনের ঘটনা ব্রহ্মানন্দজীর জীবনকালে ঘটতে দেখা গিয়েছিল। প্রত্যক্ষভাবে দেব-দেবী দর্শন তাঁর প্রায়ই হত। অধ্যাত্ম রাজ্যের সম্রাট ছিলেন কিনা! স্বামী বরদানন্দের বর্ণনা অনুযায়ী--“১৯১২/১৩ সালের কথা। মহারাজের ইচ্ছানুসারে কাশীর উভয় আশ্রমে রামনাম সংকীর্তনের ব্যবস্থা হয়--একাদশীতে সেবাশ্রমে এবং অমাবস্যা-পূর্ণিমায় অদ্বৈতাশ্রমে। ওই সময়ে মহাবীরের উদ্দেশে একখানা আসন ও তদুপরি একখানা সঙ্কীর্তনের বই রাখা হইত। একদিন দুই আশ্রমের সকলে মিলিয়া, বহু এক্কায় করিয়া, সঙ্কটমোচন যাই। মন্দিরের বারান্দায় মুখ করিয়া বসিয়াছি নীরদ মহারাজ, বিশ্বরঞ্জন মহারাজ ও আমি; আর দুই পাশে পূর্বপশ্চিমে মুখ করিয়া বসিয়াছে সব দোহাররা। কীর্তন খুবই জমিয়া গেল। একজন গৌরবর্ণ পুরুষ-- সাদা ধবধবে চেহারা, লম্বা চুল-গোঁফ-দাড়ি, মোটা চাদরে সর্বাঙ্গ ঢাকা--মহাবীরের মন্দিরের দোরগোড়ায়, বাহিরের দিকে, পশ্চিমপাশে স্থির হইয়া বসিলেন পূর্বমুখে, মহারাজের কতকটা মুখোমুখি হইয়া; আর কীর্তন শেষ হইবামাত্র উঠিয়া চলিয়া গেলেন। অনেকবার আমি তাঁহাকে লক্ষ্য করিয়াছি। মহারাজ কহিলেন, মহাবীরের সাক্ষাৎ আবির্ভাব; ওই যে গৌরবর্ণ বৃদ্ধ বসে শুনছিলেন, তিনি হচ্চেন মহাবীর। মহাবীরকে খুঁজিতে কেহ কেহ তখন ছুটিল, কিন্তু বটগাছে কতিপয় হনুমান ব্যতীত আর কাহাকেও দেখিতে পাওয়া গেল না।”(ব্রহ্মানন্দ লীলাকথা-ব্রহ্মচারী অক্ষয়চৈতন্য)
সিস্টার নিবেদিতা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম আন্দোলনে প্রথমে গোপনে এবং স্বামী বিবেকানন্দের মহাপ্রয়াণের পর প্রকাশ্যে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন। রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের সঙ্গে নিবেদিতার প্রত্যক্ষ সংস্পর্শ এর ফলে বিশেষ প্রতিবন্ধকতা তৈরি করল। স্বামীজীর মানসকন্যা একাধারে শ্রীশ্রীমাতাঠাকুরানী ও স্বামী ব্রহ্মানন্দজীর বিশেষ প্রিয়পাত্র, স্নেহাস্পদ ছিলেন। নিবেদিতাকে মঠে ডেকে ব্রহ্মানন্দজী রাজনৈতিক কার্যকলাপে তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণে অসম্মতি জানিয়ে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করলেন। স্বাধীনচেতা সিস্টার মহারাজের সঙ্গে একমত হতে পারলেন না। এই পরিপ্রেক্ষিতে স্বামীজী লিখিত একটি পত্রের উল্লেখ করা যেতে পারে। তারিখ ১৯০২, ১২ ফেব্রুয়ারি। নিবেদিতাকে লেখা। এইরকম লিখেছিলেন--“I recommend you none--not one--except Brahmananda. That old man's judgement never failed-- mine always do. If you have to ask any advice or to get anybody to do your business Brahmananda is the only one I recommend, none else. With this my conscience is clear.” যাই হোক, নিবেদিতাকে নিবৃত্ত করা গেল না। মঠ কর্তৃপক্ষ ও সিস্টার নিবেদিতা যৌথ বিবৃতিতে ঘোষণা করলেন যে অতঃপর সিস্টারের কার্যকলাপের জন্য মঠ-কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবেন না। কিন্তু এই দূরত্ব তৈরি হলেও সিস্টার চিরকালই ছিলেন মঠবাসিদের আপনজন। নিজেকে ‘রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের নিবেদিতা’ বলে পরিচয় দিয়েছেন নিবেদিতা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। 

১৯০৪ সালের ৬ নভেম্বর নিবেদিতা লিখছেন--“প্রিয় স্বামী ব্রহ্মানন্দ কখনই তাঁহার হৃদয়কে আমার নিকট হইতে সরাইয়া লন নাই।” পরের সপ্তাহে ১৩ নভেম্বর লিখেছিলেন,“আমরা গতকাল মঠে গিয়াছিলাম। ফিরিলাম নবীনচাঁদকে মাথায় লইয়া! স্বামী ব্রহ্মানন্দ গুরুতর পীড়িত হইয়াছিলেন, এখন ভাল হইয়াছেন, যদিও তিনি তাহা ভাবেন না। আসল ব্রহ্মানন্দের সহসা আবির্ভাব দেখিলাম--যখন গতকা‌ল বারান্দায় বসিয়া কথা বলিতেছিলাম। তাঁহাকে মনে হইল স্বামীজী! ওঁরা(সেবকেরা) বলিলেন, এখন পাঁচ বছরের মতন স্বরূপ তাঁহার! অপরূপ! (নিবেদিতা লোকমাতা-শঙ্করীপ্রসাদ বসু)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments