জ্বলদর্চি

রোদ্দুরের নাম অপরাজিতা /শ্রীজিৎ জানা

রোদ্দুরের নাম অপরাজিতা

শ্রীজিৎ জানা


সেই যে কথাগুলো  গুছিয়ে রাখলুম বুকের ভাঁজে। বোলবো বলে আড়াল খুঁজছি একচিলতে। দু'দন্ড ফুরসত। অম্নি বারান্দা পেরিয়ে রোদ্দুর বিকেলের হাত ধরে হাঁটা দিল পশ্চিমে। তার চলন ভঙ্গিমায়  আহত অনুরাগ, আবরিত পিছুটান। বয়নের অনুচ্চার দৃশ্যাভাষে অভিমানী স্বর -"আমার পিছু ডেকো না। ডেকো না আর কোনদিন"। তাহলে এবার কার হাতে আমি নিশ্চিন্তে সঁপে দেবো আবার বুকের অনুরণন? এবার আমার মনের শীর্ণ নদীটি একা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদবে। উঠোনে এবার ডালপালা মেলে দেবে একটা মনখারাপের গাছ! সেই বৃক্ষতলে বসে অপরাজিতা নাম্নী মায়াভরা রোদ্দুরের গান  কাকে শোনাবো? কাহাকে শোনাইব!

অনেকের মতো আমারও ছিল টেস্ট পেপারের ভিতর লুকানো স্কুলবেলা!  যেন সযত্নে রাখা ময়ূর পালক। ইতিউতি কালির উল্কিতে আঁকা নামের আদ্য অক্ষর।  দুব্বো ঘাসের মতো নরম মুখ, গোলাপী বাবলগামের মতো ঠোঁট, শ্রাবণের বিষ্টির মতো হাসি। পাশ দিয়ে হেঁটে গ্যালে বেজে উঠতো  ভায়োলিন । মিহি সুরের মূর্ছনায় ঘোর লেগে থাকতো দিনমান। দূরবীনের মতো চোখ খুঁজে ফিরতো ক্লাসময়। বারবার চোখ চলে যেত তার পাড়ায়। সন্ধে নামলেই যত রাজ্যের ভাবনা ফুসলে নিয়ে যেত মনকে। বইয়ের পাতার কালো অক্ষরগুলোর কোলাজে আঁকা হোতো তার মুখ। রাত মনে হোতো কালসাপাটি মাঠের চেয়েও দীর্ঘ; অনিঃশেষ।  তারপর যেই পুবের রোদ্দুর জানালায় রেখে যেত দিনের সংবাদ,অম্নি সোজা বিদ্যাসাগর কোচিং সেন্টারে হাজির। খানিকদূরে ফলসা গাছের তলায় অপেক্ষমান সাইকেল। অস্থির চোখ খুঁজে ফেরে সবুজ ওড়নার হলুদ চুড়িদার।

সবেমাত্র পরীক্ষা শেষ। ইয়ারদোস্তরা কবেই জাসুসি করে জেনে নিয়েছে 'মম চিত্তে নিতি নৃত্যে' যে,  আসলে তিনি কে!  কোন ঘাটে নোঙর করিয়াছে আমার মনের সপ্তডিঙা মধুকর! অগত্যা  'গোপন কথাটি রবে না গোপনে' জেনে সবিস্তারে করিনু বর্ণন্! বন্ধুদলের দৌত্য কর্মে কণ্টকাকীর্ণ প্রেমালাপের পথে ঝরতে লাগলো ফুল্লকুসুমদল। বকুলতলার 'মল্লিকা' সিনেমা হলে ম্যাটিনি শো'তে যাবার বন্দোবস্ত হোলো। সবই 'শোলে'  মার্কা জয়-বীরু দোস্তির দৌলতে। তবে গোপন একটা মৌ স্বাক্ষর হয়েছিল এর ফাঁকে। পেট ওদের, পকেট আমার। বিনিময়ে দুটো সিটের মাঝে কেউ ঢুকবে না। তখন 'আশিকী' সগৌরবে তৃতীয় সপ্তাহে চলমান। রূপোলী পর্দায় রাহুল রয় আর অনু আগরওয়াল তখন প্রেমের প্লাবনে ভাসমান। প্রাণে দোলা দিয়ে যায় গানের আকুলতা। শুধু একা আমার আলোআঁধারি নৈঃশব্দ্যে অনুভূত হচ্ছে বুকের ধুকপুকুনি। আর চতুঃপার্শ্ব জুড়ে বাতাসে ভাসমান কেয়োকারপিনের মৃদু সৌরভ।অজানা আড়ষ্টতায় নাহ্,রাহুল রয় হোয়ে ওঠা হয়নি সেদিন। বিক্ষিপ্ত দুটো চারটে শীর্ণকায় সরল বাক্য, টুকরোটুকরো হাসি নিয়ে ভগ্ন হৃদয়ে ফিরলাম ঘরে। বন্ধুদের কাছে ঝাড় খেলাম বিস্তর। আসলে টলিউড স্টাইলে গাঁয়ের ছেলে পোসেনজিৎ হতে মন চাইনি সেদিন। হাত ছুঁয়ে দেবার ইচ্ছেরা, কথা বলার ইচ্ছেরা সেদিন সাহসে কুলোতে পারেনি। ওর পাশে বসাটুকুই যেন সেদিনের জীবনে অনন্ত পাওয়া!
কিভাবে পেতে চেয়েছিলাম অপরাজিতা নামের রোদ্দুরকে! শরীরে! স্পর্শে! মনে! অনুভবে! জানি না,জানি না। শুধু বুঝতে পারতাম চোখের আড়াল হোলেই বুকের স্রোতে ঢেউ ভাঙতো। হৃদি তরঙ্গের শব্দ কেবলমাত্র হৃদয়-জনের কানেই পৌঁছায়। কতবার মনকে ধমকেছি, ফেরাতে চেয়েছি মনপবনের অভিমুখ। কিন্তু পরক্ষণেই হেরে গ্যাছি নিজেই নিজের কাছে। তারপর সাহসী বাতাস খানিকটা  বুকে টেনে সরস্বতীপুজোর দিন হাতে গুঁজে দিলাম গোলাপী খাম। কত কি লিখেছিলাম জানি না,তবে ভালোবাসা ছিল প্রতিটি অক্ষরের গায়।
তারপর একদিন কথা হোলো। সেই যে রোদ্দুর স্কুলের পুব কোণের রাবার গাছটার মাথা ডিঙিয়ে রওনা দিয়েছে দুপুরের দিকে,বৃক্ষতলে ঢেলে দিয়ে যাচ্ছে ছায়াবৃষ্টি তাতে ভিজলাম দুজনে। সেই বৃষ্টিতে ছিল নোনাজলের বেদনাবোধ। গোলাপী খামের প্রত্যুত্তরে ধেয়ে এল ধূসর কথারা। ওই যা আদি অনন্তকাল ধরে প্রবহমান জাতি বৈষম্য। রামি- চন্ডীদাস, পরাশর- সত্যবতী হোয়েছে বলে সবক্ষেত্রে সমাজ মানবে কেন?  বর্গক্ষত্রিয়র সাথে উচ্চবর্গীয় জাতির প্রেম সমাজের চক্ষুশূল! জাত্যাভিমানের মধ্যে নিষ্ঠুর এক অহংকার দৃষ্ট হয়। চোখে যন্ত্রণাদায়ক ঠেকে অন্যকে হেয় করার পৈশাচিক গর্ব। একইসাথে অপরদিকে থাকা মন ভোগে চরম হীণমন্যতায়। যেমনটি ভাবনা,হলও তাই-- 'তোমাকে আমি ভালবাসি কিন্তু তোমার জাতকে পরিবার মেনে নেবে না'-- এই এক আশ্চর্য কথন! তারপর ' বাবা প্রেমটেম মেনে নেবে না। আমাদের বংশে কেউ প্রেম করে বিয়ে করেনি'। 

পরে এইসব নিয়ে মনের ল্যাবে বিস্তর পোস্টমর্টেম করেছি। 'লাভ ম্যারেজ', 'সোশ্যাল ম্যারেজ' শব্দদুটোই অদ্ভূত। সোশ্যাল ম্যারেজে কি লাভ থাকেনা? অথবা লাভ ম্যারেজ কি সমাজের চোখে অসামাজিক? সেই তো বাপু "তোমাকে বলিনি প্রেম পরের পৃষ্ঠার গোপন মৈথুন"! দেখাশুনার বিয়েতে মেয়েকে দেখতে যায় বাড়ির সব্বাই। আসলে বহু দৃষ্টির ফিতে দিয়ে সৌন্দর্য বিচারের নামে মেয়ের শরীরের আগাপাছতলা  জরিপ করে। এও তো এক ধরণের কদর্য মানসিকতা সমাজের। 
জোর করতে পারিনি সেদিন। শুধু জানতে চেয়েছিলাম তার ভালবাসার কথা। মুখে কিছু বলেনি অপরাজিতা, শুধু চোখের আলতো চাহুনিতে রেখে গিয়েছিল হীরণ্ময় আলো। সেই আলোটুকু সযত্নে রেখেছি স্মৃতিজুড়ে। জন্ম জন্মান্তরেও ভোলা যাবে না সেদিনের সলাজ চোখের মায়া। কতদিন জনাকীর্ণ আড্ডায় কেটেছে একাকীত্বের ক্ষণ। চোখের নোনা শ্রাবণে ভিজেছে রাত্রি প্রহর। কাগজেকলমে এঁকেছি নিরন্তর অক্ষরের আবেগে বিরহের দিনলিপি। 

তারপর গল্প মোড় নিয়েছে অন্য পথে। অপরাজিতা এখন দূরতর দ্বীপ। বিচ্ছেদের মলাটের ভিতর বোধকরি আঁকা হয় গাঢ়তর প্রেমের হিয়েরোগ্লিফিক। এই যে এখন আমার ঘরকন্না, মায়াভাষ,প্রেম,সঙ্গম কিম্বা বাদানুবাদ - তার মধ্যেই কি খুঁজে ফিরি সেদিনের পয়মন্ত রোদ্দুরকে। দূরতর দ্বীপের দারুচিনি বনজুড়ে এমনই কি বয়ে যায় উথালপাতাল ফাল্গুনী দখিনা পবন?বিরহ জীয়নকাঠি। বিরহের মৃত্তিকায় পল্লবিত হয় পর্ণমোচী প্রেম। অপরাজিতা বিরহ! অপরাজিতা প্রেম! অপরাজিতার স্মৃতিই বাঁচিয়ে রাখে মনের মাধুর্যকে। অপরাজিতাই প্রেমিক করে রাখে পুরুষকে অনন্তকাল.....

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments